একদিনের যানজটের অভিজ্ঞতা | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

একদিনের যানজটের অভিজ্ঞতা | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা , জীবন হচ্ছে জাগ্ৰত মুহূর্তের কতকগুলো অনুভূতির সমষ্টি। প্রতিটি জীবনানুভূতিই এক-একটি অভিজ্ঞতায় তাৎপর্যবাহী। ছোট ছোট বালুকণা আর বিন্দু বিন্দু জলের মতোই অভিজ্ঞতাগুলো সঞ্চিত হয়ে অতল সাগরের মতো অফুরান সম্ভাবনাময় মানবজীবনকে গড়ে তোলে। বস্তুত সমগ্র জীবনটাই একটা অভিজ্ঞতার ফসল।

একদিনের যানজটের অভিজ্ঞতা | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা

নানা বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জনের মধ্য দিয়েই মানুষের জীবন অতিবাহিত হয়। জীবন শেষ হয়ে গেলেও অভিজ্ঞতার যেন শেষ নেই। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে, বিশেষত শহুরে জীবনে যে তিক্ত অভিজ্ঞতাটির সঙ্গে সবাই কম-বেশি পরিচিত, আজ সে-রকম একটি অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছি। অভিজ্ঞতাটি যে যানজটকে নিয়ে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। অনেকে হয়তো বলবে- এ আর নতুন কথা কি যানজটের শিকার হয়ে কত অসুস্থ রোগী হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই প্রাণ হারিয়েছে, কত শিক্ষার্থী যথাসময়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হতে না পেরে কেঁদেছে, বিলম্বে পৌঁছানোর কারণে কতজন চাকুরি হারিয়েছে, কত দিনমজুর না খেয়ে থেকেছে, কতজনে পথেঘাটে পড়ে মরেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

 

যানজটের অভিজ্ঞতার গল্প-কাহিনী যেন ‘আরব্য রজনী’র গল্পকেও হার মানায়। তবে, সেদিন যানজটের শিকার হয়ে আমার যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটি হয়েছে তার বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে একরকম দুঃসাধ্য। কেননা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যে অভিজ্ঞতা, তা কখনো বর্ণনা করা যায় না। ভাষার উপমা অলংকারে কিছুটা বোঝানো গেলেও পাঠক মাত্রকেই পুরো ঘটনাটা অনুভব করে নিতে হবে তার চেয়েও অনেক বেশি। দিনটি ছিল শনিবার। যানজট নিশ্চয়ই বার দেখে আসে না।

তার চেয়েও বড় কথা মায়ের অসুস্থতার কথা শুনেই আমি ঢাকা থেকে মায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছি। মা আছেন কুমিল্লা শহরের একটি হাসপাতালে। দু ঘণ্টার ব্যবধানেই পৌঁছে গেলাম কুমিল্লা। হাসপাতালে পৌঁছতেই ছোট ভাইবোন দুটি হাউমাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরল আমাকে। বুঝতে পারলাম নিশ্চয়ই বড় কোনো বিপদ। মনকে শক্ত করার চেষ্টা করলাম। দৃঢ়তা নিয়ে না কাঁদার চেষ্টা করছি। এমতাবস্থায় ডাক্তার আমাকে তাঁর ব্যক্তিগত রুমে নিয়ে আসলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছি, কটায় ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়েছি, কিছু খেয়েছি কিনা, কে সংবাদ দিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। ডাক্তার চেষ্টা করছেন আমাকে স্বাভাবিক করার জন্যে।

ততক্ষণে আমি অনুমান করতে পেরেছি যে- মাকে নিয়ে বড় রকমের একটা দুঃসংবাদ শুনতে হবে আমাকে। ডাক্তারের কথায় সায় দিয়ে আমি হাসির ভান করলাম। বললাম- কোনো অসুবিধে নেই ডাক্তার সাহেব, আপনি খুলে বলুন। ডাক্তার ইতস্তত জবাব দিলেন- আপনি কাঁদছেন কেন, আপনার আম্মু ভালোই আছেন। আসলে গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায় চোখের কোণে কখন যেন জল জমে ছিল, টেরই পাইনি। আমি আর ডাক্তার মুখ বাঁকিয়ে হাসলাম।

এ-হাসির অর্থ দুজনেরই অজানা। কিন্তু হাসতে হবে। হাসিমুখে দুঃসংবাদ শুনতে হবে এবং মেনে নিতে হবে। মানুষের জন্যে কী নিষ্ঠুর জীবন-অনুশীলন। মুহূর্তেই মনোবল দৃঢ় হয়ে গেল । জানতে পারলাম মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। তাকে দ্রুত দেশের বাহিরে নিয়ে যেতে হবে। চাইলে ভারতেও নেয়া যেতে পারে। আমরা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম কলকাতার ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হসপিটালে নিয়ে যাব। মাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যখন রওয়ানা হলাম, তখন ঘড়িতে সন্ধে সাতটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। মাকে নিয়ে প্রাইভেট কারটি ড্রাইভ করছি আমি নিজেই, সঙ্গে আর কেউ নেই। কিছুসময় পর গাড়ি এসে পৌঁছাল চান্দিনা।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

অনেকটা সময়, প্রায় বিশ মিনিটের মতো বসে থেকে যখন দেখলাম সামনের গাড়িটি স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে, তখন আমার বোধোদয় ঘটল; জানালার গ্লাস নামিয়ে পথচারীকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম, ঢাকা পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার রাস্তা পুরোটাই যানজটের শিকার। আমার কথা গেল থেমে। কী ভাববো, কী বলবো, কী করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভুলেই গিয়েছিলাম আজ বাদে দুদিন পর ঈদুল আযহা। ঈদের ছুটিতে ঘরমুখো মানুষ সবাই ফিরছে গ্রামের বাড়িতে। নিরুপায় হয়ে গিয়ে বসলাম গাড়িতে। কিন্তু কতক্ষণ বসা যায়! মা জানতে চাইলেন আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে? আমি কী উত্তর করবো বুঝতে পারছি না। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম— এই তো, আরও কিছু সময় হয়তো লাগতে পারে।

এখন আর কোনেদিকেই গাড়ি চলছে না। দুদিকেই যানজটে সম্পূর্ণ রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে গেছে। হকারদের হাকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে রাস্তার দুপাশ। অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে পায়চারি করে, কেউ কেউ এটা-ওটা খেয়ে নিয়ে আবার আরাম করে গিয়ে গাড়িতে বসেছে। হয়তো এখনই বা কিছু সময় পরেই গাড়ি চলতে শুরু করবে। কেউ কেউ আবার অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে খবর আনার চেষ্টা করছে; অধীর আগ্রহ নিয়ে সবাই সে খবর শোনে আর হতাশ হয়। ক্রমেই রাত বাড়তে থাকে। এখন রাত প্রায় বারটা। মা পানি খেতে চাইলেন।

আমি পানির সঙ্গে কেক আর আপেল দিয়েছিলাম, ই ছোট্ট একটা ি • মা শুধু পানিটুকুই খেলেন। পাশের বাসেই ছোট্ট একটা শিশু চিৎকার করে কাঁদছে, সে আর মায়ের কোলে থাকতে চাইছে না, গড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে, গরমে। মা নানাভাবে তাকে আদর-স্নেহ দিয়ে সান্তনা দিচ্ছে। কিছুতেই তাকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না। বাস ছেড়ে মা তাকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন। শঙ্কিত মার চোখে- মুখে ভয়ের ছাপ। কিছু সময় আগে মাত্র কয়েকটি বাস পরেই কয়েকজন যাত্রীর কাছ থেকে দুর্বৃত্তরা টাকাপয়সা নিয়ে গেছে। আরও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় যাত্রীরা বাসে গিয়ে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে।

কোথাও তেমন কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আমি গাড়ির পাশে নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার মনে কোনো শঙ্কা নেই, ভয় নেই, ক্ষোভ নেই, রাগ নেই। এক বুক কান্নার জলে সব ডুবে আছে। একটু কাঁদলেই ভয়-শঙ্কার কষ্টরা সব জেগে উঠবে। আমার কাঁদতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু কাঁদতে পারছি না। গাড়িতে হেলান দিয়ে ঘাড় তুলে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিতেই চাঁদের ক্ষীণ আলো মমতার পরশ বুলিয়ে দিল চোখে-মুখে। নিজেকে অসহায় আদিম মানুষের মতো মনে হলো। মানুষ কত সাধনায় বীভৎস ধরাকে সুশোভিত করল।

 

 

কত রাক্কোস-খোক্কস, ডাইনোসর, দৈত্য- দানব মানুষের কাছে নতি স্বীকার করল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, তথ্য-প্রযুক্তিতে মানুষ আজ নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করেছে। অথচ যানজট এমন কি বিষয়, যার কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমৰ্পণ । যানজট মুহূর্তেই জীবনের গতিকে থামিয়ে দিয়েছে। জীবনের কোনো অভিজ্ঞতাই এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারছে না, অসহায়ত্বের তীব্র যন্ত্রণায় মানুষ কীরকম বাক্রদ্ধ হয়ে আছে। ‘যানজট’ কী দৈত্য-দানবের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু; সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত থেকেও বড় কিছু! যাকে মানুষ জয় করতে পারে না, যাকে মানুষ অতিক্রম করতে পারে না, কী নিদারুণ পরাজয়।

অর্থের জন্যে মানুষ দিনান্ত পরিশ্রম করে; মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু টাকা অর্জন করে। অথচ চোখের সামনে কী বিশাল অর্থের অপচয় ঘটে চলেছে; হায় রে যানজট। যানজটের কাছে অসহায় মানুষের কি নির্মম-নিঃশব্দ আত্মাহুতি। হঠাৎ গাড়ির হর্ণ বেজে উঠতেই আঁৎকে ওঠলাম। জ্যাম ছেড়েছে, গাড়ি চলতে শুরু করেছে। চোখের জল আর মোছার সময় পেলাম না, দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসলাম। গাড়িগুলো ধীরে ধীরে চলছে।

আমি চলছি আরও ধীরে। আমার সঙ্গে আকাশের চাঁদটিও ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। দিগন্ত প্লাবিত জ্যোৎস্না ভুবনের সব দুঃখ-কষ্ট ধুয়ে-মুছে নিয়ে যাচ্ছে, সবার অলক্ষ্যে। অপার্থিব অনুভূতিতে হৃদয়-মন ভরে উঠলো। খণ্ড-সময়ের ঘটনা হয়েও জীবন খাতার অভিজ্ঞতার পাতায় ঘটনাটি চিরকালীন হয়ে রইল।

Leave a Comment