পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিভাগের “নির্মিতি” বিষয়ের একটি পাঠ। ‘ভাষা” শব্দের পূর্বে ‘পরি’ উপসর্গযোগে ‘পরিভাষা’ শব্দটি গঠিত হয়েছে। এর আক্ষরিক অর্থ-‘বিশেষ ভাষা’। অর্থাৎ, পারিভাষিক শব্দের অর্থ হল কোনো ভাষার মধ্যে বিশেষ অর্থে ব্যবহারযোগ্য শব্দ। বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দকে পারিভাষিক শব্দ বলে। ১ অন্যভাবে বলা যায়, মূলশব্দের মৌলিক অর্থ ও ভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে এক ভাষার শব্দকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত করে যে রূপ দান করা হয় তাকেই ‘পরিভাষা” বলে।
পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা
এই বিবেচনায় বাংলা ভাষায় প্রচলিত বিদেশি শব্দের ভাবানুবাদমূলক প্রতিশব্দগুলোকেই পরিভাষা নামে অভিহিত করা যায়। যেমন— Act শব্দের পরিভাষা হলো আইনের ধারা। পারিভাষিক শব্দ (Terminology) বা পরিভাষা কী তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত বাংলা অভিধান ‘চলন্তিকা’র সংকলয়িতা রাজশেখর বসু বলেছেন, “অভিধানে পরিভাষা অর্থ সংক্ষেপার্থ শব্দ। অর্থাৎ যে শব্দের দ্বারা সংক্ষেপে কোনও বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যায় তা পরিভাষা। যে শব্দের অনেক অর্থ, সে শব্দও যদি প্রসঙ্গ বিশেষে নির্দিষ্ট অর্থে প্রযুক্ত হয় তবে তা পরিভাষা স্থানীয়। সাধারণত ‘পরিভাষা’ বললে এমন শব্দ বা শব্দাবলি বোঝায় যার অর্থ পণ্ডিতগণের সম্মতিতে স্থিরীকৃত হয়েছে এবং যা দর্শন বিজ্ঞানাদির আলোচনায় প্রয়োগ করলে অর্থবোধে সংশয় ঘটে না।”
(বসু : ১৩৪০ ) পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষা কোনো না কোনোভাবে অন্য ভাষা থেকে উপাদান গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়। এই সংগৃহীত উপাদানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল পরিভাষা। বাংলা-ভাষা ব্যবহারকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই তাদের দৈনন্দিন কাজে কম-বেশি পরিভাষা ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্মতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি শাস্ত্রীয় বিষয়ের শব্দের প্রয়োজন হলে এ ধরনের পরিভাষা কোনো ভাষাতে সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।
মাতৃভাষায় গৃহীত এ জাতীয় মূল বিদেশি শব্দ, বিদেশি শব্দের অনুবাদ বা বিদেশি শব্দের কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপই হলো পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ; অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যেসব শব্দ সুনির্দিষ্ট বা বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয় সেগুলোই পরিভাষা বা পারিভাষিক শব্দ। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার ব্যাপক উৎকর্ষ সাধনের ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন নতুন ধারণা, বস্তুসামগ্রী, ঘটনা, কাজ ইত্যাদির জন্ম হচ্ছে যা কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পৃথিবীর সকল ভাষার লোকের মধ্যে তা বিস্তৃত।
সাধারণত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে যে দেশ যত অগ্রগামী সে দেশের মানুষ তাদের নিত্যনতুন উদ্ভাবিত জিনিসগুলোকে এবং অপরাপর সকল বিষয় মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকে। ফলে অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর লোকজন সেসব বিষয়ে
ধারণা নেয়ার জন্যে কিংবা জ্ঞানার্জনের জন্যে ওইসব বিষয়ে ব্যবহৃত শব্দসমূহ কখনো নিজের ভাষায় অনুবাদ বা শব্দার্থ করে, কখনো হুবুহু, কখনো-বা পরিভাষার মাধ্যমে অর্থ করে নিজেদের জীবনধারণের অগণিত প্রয়োজনীয় দাবি মেটায়। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ শব্দ এবং পারিভাষিক শব্দের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট পার্থক্য টেনে দেয়ার প্রয়োজন থাকলেও ভাষার কোন্ শব্দটি পরিভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং কোন্ শব্দটি হবে না সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই।
তাছাড়া সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে ফেলার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে হয় না; কেননা তার ফলে ভাষার ওপর জোর করে নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে ভাষাকে সহজ করার স্থলে জটিল অবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। লক্ষ করলে দেখা যায় যে বঙ্গানুবাদ, শব্দার্থ এবং পরিভাষার ক্ষেত্রে পার্থক্য যৎসামান্যই। আর যেটুকু পার্থক্য তা ধরা পড়ে কোনো শব্দকে পরিভাষা হিসেবে ব্যবহারের সময় অথবা কোনো শব্দের প্রতিশব্দ কিংবা বঙ্গানুবাদ না পাওয়া গেলে। আবার একই শব্দ সাধারণ শব্দভাণ্ডারে যেমন ব্যবহৃত হতে পারে তেমনি বিশেষ পারিভাষিক অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে।

যেমন ‘গুণ’ শব্দটি সাধারণ শব্দভাণ্ডারে নানা অর্থে ব্যবহৃত হলেও গণিতের ক্ষেত্রে ‘গুণ’ একটি পরিভাষা। আবার ‘নিওন’ (গ্যাস) শব্দটি পরিভাষা হলেও বাংলায় আমরা যখন ‘নিওন বাতি’ বলি তখন ‘নিওন’ শব্দটি সাধারণ শব্দের এলাকায় অবলীলায় ঢুকে পড়ে। ভাষাতাত্ত্বিক আইনার হগেন বলেছেন, ভাষা-সমস্যা হলো ভাসমান বিশাল বরফ-পাহাড়ের মতো, যার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র দৃষ্টিগোচর হয়, বিশালাংশ থাকে নিমজ্জিত। বাংলা ভাষা-সমস্যা সম্পর্কেও কথাটি প্রযোজ্য। বাংলা ভাষা-সমস্যার * ক্ষুদ্রাংশ বাঙালির চেতনায় বিধৃত হয়েছে, বিশালাংশ আছে জাগ্রত-চেতনার বাইরে।
বাংলার বিদ্বৎ-সমাজ পরিভাষাকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পরিভাষা সৃষ্টির সমস্যা সম্পর্কে অর্থাৎ নতুন শব্দ সৃষ্টির সঙ্কট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— “বাংলা ভাষায় গদ্য লিখতে নতুন শব্দের প্রয়োজন প্রতিদিনই ঘটে। অনেকদিন ধরে অনেকরকম লেখা লিখে এসেছি। সেই উপলক্ষে অনেক শব্দ আমাকে বানাতে হোলো। কিন্তু প্রায়ই মনের ভিতরে খটকা থেকে যায়। সুবিধা এই যে, বারবার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দ বিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে ওঠে, মূলে যেটা অসঙ্গত, অভ্যাসে সেটা সঙ্গতি লাভ করে।” (ঠাকুর : ১৩৩৬)
পারিভাষিক শব্দ নিয়ে বিস্তারিত ঃ
আরও দেখুন: