আজকের আলোচনার বিষয় বহুব্রীহি সমাস। এই আলোচনায় আমরা বহুব্রীহি সমাসের শ্রেণিবিভাগ, এর বিভিন্ন প্রকারভেদ, এবং সহজে বহুব্রীহি সমাস নির্ণয়ের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানব।
Table of Contents
বহুব্রীহি সমাস
‘ব্রীহি’ মানে ধান। ‘বহুব্রীহি’ মানে ‘বহু ধান’ নয়- ‘বহু ধান আছে যার এমন অবস্থাসম্পন্ন কোনও মানুষ’ যে সমাসে সমস্যমান পদ দুটির কোনোটির অর্থ না বুঝিয়ে অতিরিক্ত অন্য কোনো অর্থ বোঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে।
যে সমাসে পূর্বপদ বা পরপদ কোনোটির অর্থ না বুঝিয়ে এ দুয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো অর্থ প্রধানরূপে প্রতীয়মান হয় তাকে ‘বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন : দশ আনন যার দশানন। এখানে “দশ” বা “আনন’ (অর্থাৎ মুখ) কোনো পদের অর্থ বোঝানো হয় নি। লঙ্কার রাজা রাবণের দশটি মাথা থাকায় তার নাম দশানন। যেমন : বীণা পাণিতে যার – বীণাপাণি। এখানে ‘বীণা’ অথবা ‘পাণি’ (অর্থাৎ হাত) কোনোটাই না বুঝিয়ে দেবী সরস্বতীকে বোঝানো হয়েছে।
এরকম আরেকটি শব্দ “নীলকণ্ঠ’ অর্থাৎ নীল (বিষ) কণ্ঠ যার। এই শব্দে নীল বা কণ্ঠ কোনোটাই প্রধান বক্তব্য নয়, এখানে বুঝতে হবে শিবকে, কেননা বিষপানে শিবের কণ্ঠই নীল হয়ে গিয়েছিল। বহুব্রীহি সমাস সাধারণত বিশেষণ শব্দ গঠন করে এবং এ সমাসে ‘যে’, ‘যিনি’, ‘যার, ‘যাতে’ ইত্যাদি ব্যাসবাক্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আয়ত লোচন যার আয়তলোচনা (স্ত্রী), স্বচ্ছ সলিল যার স্বচ্ছসলিলা ইত্যাদি।
বহুব্রীহি সমাসে শব্দরূপের রূপান্তর ও বৈশিষ্ট্য
ক্র. | মূল শব্দ/উপাদান | বহুব্রীহি সমাসে রূপান্তর | উদাহরণ | ব্যাখ্যা |
১ | ‘সহ‘ / ‘সহিত‘ | ‘স’ রূপে পরিণত হয় | সবান্ধব = বান্ধবসহ সহোদর = উদরে সহ যার | ‘সহ’ ও ‘সহিত’ এর স্থলে ‘স’ ব্যবহৃত হয়। |
২ | অক্ষি / নাভি | যথাক্রমে ‘অক্ষ’ ও ‘নাভ’ হয় | কমলাক্ষ = কমলের মতো অক্ষি যার পদ্মনাভ = পদ্ম নাভিতে যার | ‘অক্ষি’ ও ‘নাভি’ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার হয়। |
৩ | জায়া | ‘জায়া’ → ‘জানি’ হয় এবং পূর্বপদে রূপান্তর | যুবজানি = যুবতী জায়া যার | ‘যুবতী’ → ‘যুব’ এবং ‘জায়া’ → ‘জানি’ হয়ে সমাস গঠিত হয়। |
৪ | চূড়া / কর্ম | যথাক্রমে ‘চূড়’ ও ‘কর্মা’ হয় | চন্দ্রচূড় = চন্দ্র চূড়ায় যার বিচিত্রকর্মা = বিচিত্র কর্ম যার | পরপদের সংক্ষিপ্ত রূপের মাধ্যমে সমাস গঠিত হয়। |
৫ | সমান | ‘সমান’ → ‘সহ’ বা ‘স’ হয় | সহকর্মী = সমান কর্মী সবর্ণ = সমান বর্ণ যার সহোদর = সমান উদর যার | ‘সমান’ অর্থ ‘সহ’ বা ‘স’ রূপে ব্যবহৃত হয় বহুব্রীহি সমাসে। |
বহুব্রীহি সমাসের শ্রেণিবিভাগ
বহুব্রীহি সমাস আট প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন-
১। সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস :
যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ বিশ্লেষণ এবং পরপদ বিশেষ্য হয় কিংবা পূর্বপদ বিশেষ্য এবং পরপদ বিশেষণ হয় তাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন কালো বরণ যার – কালোবরণ; পোড়া কপাল যার – পোড়াকপালে।
এ-রকম
বিশেষণ + বিশেষ্য : যেমন : অন্যমনস্ক, সুকণ্ঠ, অল্পবয়সী, খ্যাতনামা, সুহূদয় (সুহৃদ), গৌরাঙ্গ, ছিন্নমূল
মধ্যবয়সী, ষমায়ু, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, হতশ্রী, হতভাগ্য, হতবুদ্ধি, সুদর্শন, উচ্চশির, কদাকার, দ্রুতগতি করিতকর্মা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, শীর্ণকায়, নতজানু, শুদ্ধচিত্ত, সঙ্কীর্ণচিত্ত, কৃতকার্য ইত্যাদি। বিশেষ্য + বিশেষণ : যেমন কানকাটা, ঠোঁটকাটা, লেজকাটা, গেজঝোলা, ইচড়েপাকা, শান্তিপ্রিয়, কর্মনিষ্ঠ, শীতপ্রধান, সঙ্গীতপ্রিয়, ঘরপোড়া, রাশভারি, পেটমোটা ইত্যাদি
সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস: উদাহরণ টেবিল:
ক্র. | সমাসবদ্ধ শব্দ | গঠনের ধরন | সমাস বিচ্ছেদ | অর্থ/ব্যাখ্যা |
১ | নীলকমল | বিশেষণ + বিশেষ্য | নীল + কমল | যে কমল নীলবর্ণের |
২ | চন্দ্রমুখী | বিশেষ্য + বিশেষ্য | চন্দ্র + মুখ | যার মুখ চাঁদের মতো |
৩ | সুখদুঃখ | বিশেষ্য + বিশেষ্য | সুখ + দুঃখ | যেখানে সুখ ও দুঃখ দুই-ই আছে |
৪ | রাজর্ষি | বিশেষ্য + বিশেষ্য | রাজা + ঋষি | যিনি রাজা এবং ঋষি দুই-ই |
৫ | সত্যসন্ধ | বিশেষ্য + বিশেষ্য | সত্য + সন্ধান | যিনি সর্বদা সত্য সন্ধানে থাকেন |
৬ | কালধ্বংস | বিশেষ্য + বিশেষ্য | কাল + ধ্বংস | যে কাল (মৃত্যু/সময়)-কে ধ্বংস করতে সক্ষম |
৭ | দেবমানব | বিশেষ্য + বিশেষ্য | দেব + মানব | যিনি দেবতুল্য মানব |
৮ | অন্নজল | বিশেষ্য + বিশেষ্য | অন্ন + জল | খাদ্য ও পানি |
৯ | জীবনমৃত্যু | বিশেষ্য + বিশেষ্য | জীবন + মৃত্যু | জীবন ও মৃত্যু একসঙ্গে বিদ্যমান |
১০ | গরিবধনী | বিশেষ্য + বিশেষ্য | গরিব + ধনী | যে গরিব হয়েও ধনসম্পদে পরিপূর্ণ (অর্থাৎ গুণে ধনী) |
২। ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস :
পর পর অন্বিত দুটি বিশেষ্য পদে ব্যধিকরণ বহুব্রীহি’ সমাস হয়, অর্থাৎ বহুব্রীহি’ সমাসের পূর্বপদ ও পরপদ বিশেষ বিশেষ্য হলে এবং এর যে কোনো একটি পদ ব্যাসবাক্যে অধিকরণ সম্পর্ক বোঝালে তাকে ব্যধিকরণ বহুব্রীহি’ সমাস বলে।
এক কথায় বলা যায় যে, বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ এবং পরপদ কোনোটিই যদি বিশেষণ না হয় তবে তাকে ব্যধিকরণ বহুব্রীহি’ সমাস বলে।
যেমন : শূল পাণিতে যার শূলপাণি, বীণা পাণিতে যার বীণাপাণি। এ-রকম অনুমুখী, অন্যমনা ক্ষণজনা, খড়গহস্ত, বিয়োগান্ত, আশীবিষ, ঊর্ণনাভ, পদ্মনাভ, কর্ণফুলি, চশমা নাকে, চুড়ি-হাতে, ছাতা- হাতে, জুতা পায়ে ইত্যাদি।
পরপদ কৃদন্ত বিশেষণ হলেও ব্যধিকরণ বহুব্রীহি’ সমাস হয়। যেমন— দু কান কাটা যার – দুকানকাটা, বোঁটা এসেছে যার – বোঁটাসা।
ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ টেবিল:
ক্র. | সমাস পদ | সমাসের ধরন | বিশ্লেষণ | অর্থ / ব্যাখ্যা |
১ | নীলাচল | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | নীল আছল (চূড়া) যেটি | যে পাহাড়ের চূড়ায় নীলাভতা আছে (পাহাড় নয়, চূড়ার গুণ বোঝায়) |
২ | লৌহমানব | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | লৌহ (লোহার মতো) মানব | খুব কঠোর/দৃঢ় মানসিকতার মানুষ |
৩ | কৃষ্ণগিরি | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | কৃষ্ণ বর্ণের গিরি (পাহাড়) | কালো রঙের পাহাড় |
৪ | স্বর্ণকমল | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | স্বর্ণবর্ণের পদ্ম | সোনালি রঙের পদ্ম |
৫ | রৌদ্রমূর্তি | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | রৌদ্র (প্রচণ্ড রাগ) যাঁর মূর্তি | যিনি প্রচণ্ড রাগ প্রকাশ করেন, রাগী মূর্তি |
৬ | কর্ণফুল | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | কর্ণে (কানে) ফুল | কানে পরার জন্য ফুল (কানের নয়, অলঙ্কার বোঝায়) |
৭ | রক্তবর্ণ | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | রক্তের মতো বর্ণ | লাল বর্ণ |
৮ | ধবলপট | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | ধবল (সাদা) পট (পটচিত্র/পটভূমি) | সাদা পটভূমি |
৯ | নীলাম্বর | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | নীল আম্বর (বস্ত্র) | নীল রঙের পোশাক |
১০ | মেঘনাদ | ব্যধিকরণ বহুব্রীহি | মেঘের নাদ (গর্জন) | মেঘের মতো গর্জন |
৩। মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস :
ব্যাসবাক্যের মধ্যবর্তীপদ বা ব্যাখ্যানমূলক মধ্যপদ লোপ পেয়ে যে বহুব্রীহি, সমাস হয় তাকে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি ‘সমাস বলে। যেমন সোনার মত উজ্জ্বল মুখ যার – সোনামুখী, এক দিকে চোখ যার = একচোখা / একচোখো। এ-রকম : ক্ষুরধার গজানন, মৃগনয়না, মীনাক্ষী, স্বর্ণাভ, পদ্মমুখী, মেঘবরণ, শ্বাপদ, বিড়ালচোখা, হুতুমচোখি ইত্যাদি।
মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ টেবিল:
ক্র. | পূর্ণ শব্দসমূহ | মধ্যপদ লোপ (ছেঁটে) | সমাসের রূপ | অর্থ (বর্ণনা) |
১ | গগন + অভ্যন্তর | অভ্যন্তর → অন্তর | গগনন্তর | আকাশের মধ্যে (আকাশের অন্তর) |
২ | নদী + তারঙ্গ | তারঙ্গ → তরঙ্গ | নদীতরঙ্গ | নদীর ঢেউ |
৩ | দিগ + মঙ্গল | মঙ্গল → মঙ্গল (অক্ষুন্ন) | দিগমঙ্গল | চারদিকে মঙ্গল (সুবিধা, শুভ) |
৪ | চন্দ্র + কান্ত | কান্ত → কান্ত (অক্ষুন্ন) | চন্দ্রকান্ত | চাঁদের রশ্মি বা দীপ্তি |
৫ | পদ্ম + মুখ | মুখ → মুখ (অক্ষুন্ন) | পদ্মমুখ | পদ্মের মতো মুখ |
৬ | সুমন + অঙ্ক | অঙ্ক → অঙ্ক (অক্ষুন্ন) | সুমনাঙ্ক | সুন্দর ফুলের চিহ্ন |
৭ | বৃক্ষ + অক্ষ | অক্ষ → অক্ষ (অক্ষুন্ন) | বৃক্ষাক্ষ | বৃক্ষের মতো চেহারা |
৮ | জল + ধারা | ধারা → ধারা (অক্ষুন্ন) | জলধারা | জলের প্রবাহ |
মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাসে সমাসস্থ পদের মধ্যবর্তী অংশ (মধ্যপদ) থেকে কিছু অক্ষর বা পুরো শব্দটি ছেঁটে দেওয়া হয়, এবং অবশিষ্ট শব্দগুলো যুক্ত হয়ে একটি নতুন সমাস গঠন করে। টেবিলের কিছু ক্ষেত্রে মধ্যপদ পুরোপুরি থাকে (অক্ষুন্ন), তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিছু অংশ লোপ হয়ে যায়।
৪। প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি :
যে বহুব্রীহি’ সমাসের সমস্তপদে আ, এ, ও ইত্যাদি প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে বলা হয় প্রভায়ান্ত বহুব্রীহি’ সমাস। যেমন এক দিকে চোখ (দৃষ্টি) যার – একচোখা চোখ – আ), ঘরের দিকে মুখ যার ঘরমুখো (মুখ), নি খরচ যার নি- খরচে (খরচ + এ), এরূপ দোটানা, গোমনা, একগুঁয়ে, অকেজো, একঘরে, দোনলা, দোতলা, উনপাঁজুরে ইত্যাদি।
প্রত্যয়ান্ত বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ টেবিল:
ক্র. | সমাস উদাহরণ | প্রত্যয় | মূল শব্দ | অর্থ |
১ | নদীতট | -ট | নদী + ট | নদীর ধারের (যেখানে নদী অবস্থিত) |
২ | রাজপুত্র | -পুত্র | রাজা + পুত্র | রাজপুত্র, রাজাদের পুত্র |
৩ | অরণ্যপাল | -পাল | অরণ্য + পাল | বনের রক্ষক |
৪ | গৃহকর্ম | -কর্ম | গৃহ + কর্ম | গৃহের কাজ বা দায়িত্ব |
৫ | পথিক | -ক | পথ + ইক | পথচলা ব্যক্তি |
৬ | মুখর | -র | মুখ + র | উচ্চস্বরে কথা বলা বা শব্দযুক্ত |
৭ | বৃক্ষরাজ | -রাজ | বৃক্ষ + রাজ | গাছেদের রাজা (বনরাজা) |
৮ | অগ্নিপরীক্ষা | -পরীক্ষা | অগ্নি + পরীক্ষা | কঠোর পরীক্ষা বা পরীক্ষা যেটি অগ্নির মাধ্যমে হয় |
৯ | জনপথ | -পথ | জন + পথ | জনবহুল পথ বা প্রধান পথ |
১০ | জয়পাথ | -পাথ | জয় + পথ | বিজয়ের পথ |
৫। ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস :
যে বহুব্রীহি’ সমাসে দুটি একরূপ বিশেষ্য দিয়ে এক জাতীয় কাজ বোঝায় তাকে ব্যতিহার বহুব্রীহি’ সমাস বলে। অথবা, ক্রিয়ার পারস্পরিক অর্থে ব্যতিহার বহুব্রীহি হয়। এ সমাসে পূর্বপদে ‘আ’ এবং উত্তরপদে ‘ই’ যুক্ত হয়। যেমন : হাতে হাতে যে যুদ্ধ হাতাহাতি, হেসে হেসে যে আলাপ হাসাহাসি লাঠিতে লাঠিতে যে যুদ্ধ = লাঠালাঠি। এ-রকম কোলাকুলি, কাটাকাটি, কানাকানি, 1 কামড়াকামড়ি, দেখাদেখি, চুলাচুলি, রেষারেষি, ধস্তাধস্তি, চোখাচোখি, ফাটাফাটি, টানাটানি, বকাবকি, খুনাখুনি, ভাগাভাগি, হানাহানি, গুতাগুতি, দলাদলি ইত্যাদি।
ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ:
ক্র. | সমাসকৃত পদ | ব্যাখ্যা | অর্থ |
১ | চন্দ্রশিখা (চন্দ্র + শিখা) | চাঁদের মতো শিখা বা আলোর রেখা | চাঁদের আভা বা আলো |
২ | বৃক্ষগন্ধ (বৃক্ষ + গন্ধ) | গাছ থেকে আসা সুবাস | গাছের সুগন্ধ |
৩ | পদ্মনাভ (পদ্ম + নাভ) | পদ্মের নাভি বা মাঝখানে | পদ্মের মধ্যভাগ |
৪ | মহাশক্তি (মহা + শক্তি) | বিশাল শক্তি বা বল | মহান শক্তি |
৫ | ত্রিনয়ন (ত্রি + নয়ন) | তিনটি চোখ | তিনচোখী |
৬ | অগ্নিপুত্র (অগ্নি + পুত্র) | আগুনের সন্তান | আগ্নিপুত্র |
৭ | সরস্বতী (সরস +wati) | সরসের অধিকারিণী | জ্ঞান ও শিল্পের দেবী |
৮ | দেবদত্ত (দেব + দত্ত) | দেবতার দেওয়া | দেবদত্ত (ঈশ্বর প্রদত্ত) |
৯ | চন্দ্রমুখী (চন্দ্র + মুখী) | চাঁদের মতো মুখ | চাঁদের মতো মুখবিশিষ্ট |
১০ | প্রাণেশ্বর (প্রাণ + ইশ্বর) | জীবনের ঈশ্বর | প্রাণের অধিপতি |
৬। নঞর্থক বহুব্রীহি সমাস:
নর্থক অব্যয় পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের বহুব্রীহি’ সমাস হলে তাকে নঞর্থক বহুব্রীহি’ সমাস বলে। অথবা, বিশেষ্য পদের আগে নঞ (না অর্থবোধক অব্যয় যোগ করে বহুব্রীহি’ সমাস করা হলে তাকে নঞ বহুব্রীহি’ সমাস বলে। নঞ বহুব্রীহি’ সমাসে সাধিত পদটি বিশেষণ হয়। যেমন : ন (নাই) জ্ঞান যার অজ্ঞান, না (নাই) চারা (উপায়) যার নাচার, নি (নাই) ভুল যার নির্ভুল, না (নয়) জানা যা অজানা, অ (নেই) বুঝ যার অবুঝ, বে (নেই। হাসা যার – বেহায়া। এ-রকম অজ্ঞান, অসাড়, অতন্দ্র, অরাজক অথই, অসীম, অনাচার, অহিংস, অনাদি, অনীহ, অপুত্রক, আনাড়ি, নির্বিঘ্ন, নিষ্প্রাণ, নির্বোধ, বেআক্কেল, বেআদব, বেইমান, বেকার, নিখোজ, নির্লজ্জ, বেপরোয়া, নিখুঁত, নির্লোভ, নিরক্ষর, নিরন্তর, নিঃসন্তান নির্দোষ, নিষ্প্রভ ইত্যাদি।
ননর্থক (অর্থবর্জিত) বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ:
ক্র. | সমাসের শব্দ | অর্থ | মন্তব্য |
১ | সবলজীব | শক্তিশালী জীব | বাস্তব অর্থ নেই, সাধারণত উচ্চারণের জন্য ব্যবহৃত |
২ | সহোদর | একই উদর বা মাতৃগর্ভজাত ভাই-বোন | ‘সহোদর’ বহুব্রীহি হলেও মাঝে মাঝে অর্থবর্জিত হিসেবেও বিবেচিত হয় |
৩ | সর্পকূল | সর্পের মতো বা সর্পকূল (যেমন কোন স্থান) | প্রাকৃতিক বা ভৌগোলিক অর্থ নেই, নামমাত্র ব্যবহৃত |
৪ | সলঙ্গ | ফুলের নাম বা বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত | নির্দিষ্ট অর্থ না থাকার কারণে অর্থবর্জিত বলে ধরা হয় |
৫ | সজল | ভেজা বা জলময় | বহুব্রীহি সমাস হলেও দৈনন্দিন ব্যবহারে অর্থহীন হতে পারে |
৬ | সকল্যাণ | সকলের কল্যাণ | অর্থবহ হলেও বহুব্রীহির মূল অর্থ থেকে বিচ্যুত হয়ে থাকে |
৭। সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস :
পূর্বপদ সংখ্যাবাচক এবং পরপদ বিশেষা হলে এবং সমস্তপদটি বিশেষণ বোঝালে তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি’ সমাস বলে। এ সমাসে সমস্তপদে ‘আ’, ‘ই’ বা ‘ঈ’ যুক্ত হয়। যেমন : দশ গল্প পরিমাণ যার দশগজি, চৌ (চার) চাল যে ঘরের – চৌচালা, তিন পায়া যার তেপায়া, দুই নল যার – দোনলা। এ-রকম দশহাতি, একগুঁয়ে, চির, একতারা, দশানন, বিমাত্রিক, দ্বীপ, একরোখা, দুমুখো, পঞ্চানন, চতুর্ভুজ, পাঁচহাতি, চতুষ্কোণ, দোতলা, চতুষ্পদী, সেতার, দোপেয়ে, চারপেয়ে, চৌপায়া, তেতলা, ত্রিলোচন, ত্রিশুল, সাতনরি, শতমূলী ইত্যাদি।
লক্ষণীয় :
সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদ বা পরপদের অর্থ প্রধান না হয়ে তৃতীয় কোনো অর্থ প্রধান হয়, অপরপক্ষে দ্বিগু সমাসের পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক শব্দ হয় এবং পরপদের অর্থ প্রধান হয়। যেমন : দ্বিগু সমাস : চৌ রাস্তার সমাহার – চৌরাস্তা। বহুব্রীহি চোঁ চালা আছে যার – চৌচালা।
সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ:
ক্র. | সমাসবদ্ধ শব্দ | ভেঙে লেখা (মূল শব্দ) | অর্থ |
১ | ত্রিনয়ন | তিন + নয়ন | তিনটি চোখবিশিষ্ট |
২ | ষাটচল্লিশ | ষাট + চল্লিশ | ষাট ও চল্লিশ (সংখ্যার সমষ্টি) |
৩ | একপলস | এক + পলস (চাল) | এক পলস চাল বা এক গাছের চাল |
৪ | দ্বিবিভূতি | দুই + বিভূতি | দুইটি সম্পত্তি বা শক্তি |
৫ | পঞ্চদশী | পঞ্চ + দশী | পনেরটি (সংখ্যা নির্দেশক) |
৬ | সপ্তসুর | সপ্ত + সুর | সাতটি সুরবিশিষ্ট |
৭ | একশতক | এক + শতক | একশত কিলোমিটার (একশতেক) |
৮ | দ্বিশীর্ষ | দুই + শীর্ষ | দুইটি শীর্ষবিশিষ্ট |
৮। অলুক বহুব্রীহি সমাস :
পূর্বপদের বিভক্তি লোপ না পেয়ে যে বহুব্রীহি’ সমাস হয় তাকে অলুক বহুব্রীহি’ সমাস বলে। যেমন- মাথায় পাগড়ি যার মাথায় পাগড়ি, গায়ে হলুদ দেয়া হয় যে অনুষ্ঠানে গায়ে হলুদ। এ-রকম : কথায় পটু, মাথায় ছাতা, চশমা নাকে, মুখে-মধু, হাতেখড়ি, পায়ে বেড়ি ইত্যাদি।
অলুক বহুব্রীহি সমাসের উদাহরণ টেবিল:
ক্র. | বহুব্রীহি সমাস শব্দ | মূল শব্দ / ব্যাখ্যা | সমাসে রূপান্তর ও অর্থ |
১ | অলোকবাহক | আলো + বাহক | আলো বহনকারী (যেমন সূর্য, বাতি ইত্যাদি) |
২ | অলোকস্মিতা | আলো + স্মিতা | আলোর মতো হাসি |
৩ | অলোকচিত্র | আলো + চিত্র | আলো দ্বারা গঠিত ছবি বা আলোকছবি |
৪ | অলোকদূত | আলো + দূত | আলো নিয়ে যাওয়া বার্তাবাহক বা আলোকদূত |
৫ | অলোকপ্রবাহ | আলো + প্রবাহ | আলো এর প্রবাহ বা বিকিরণ |
৬ | অলোরাজ | আলো + রাজ | আলোর রাজা (সূর্য) |
৭ | অলোকময় | আলো + ময় (পূর্ণ) | আলো দ্বারা পূর্ণ, আলোকিত |
আরও কয়েক প্রকারের বহুব্রীহি’ সমাস:
অন্ত্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস ব্যাসবাক্যের শেষপদ লোপ পেয়ে যে বহুব্রীহি’ সমাস হয় তাকে অন্ত্যপদলোপী বহুব্রীহি’ সমাস বলে। যেমন দশবছরে (দশ বছর বয়স যার), বিশমণি (বিশ্ব পরিমাণ যার) ইত্যাদি। সহার্থক বহুব্রীহি’ সমাস সার্থক (অর্থ সহ অর্থজ্ঞাপক) পদের সঙ্গে বিশেষ্য পদের বহুব্রীহি’ সমাস হলে তাকে সহাৰ্থক বহুব্রীহি’ সমাস বলে। যেমন : স্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান সম্প্রীত, বিনয়ের সঙ্গে বর্তমান সবিনয়ু। এ-রকম সফল, সবান্ধব, সকরুণ, সহিত, সবল, সদয়, সরিয়, সবিরাম, সগোত্র, সচকিত সাড়ম্বর, সবেল, সচিত্র, সানল, সচেতন, সমান, সাপেক্ষ, স, সাবলীল, সজাগ, সার্থক, সলীল, সজোর, সঠিক, সশব্দ, সতর্ক, সশর, সদয়, সসৈনা, সধবা, সপ্রসঙ্গ, সত্বর ইত্যাদি।
* নিপাতনে সিদ্ধ (কোনো নিয়মের অধীনে নয়) বহুব্রীহি :
দু দিকে অপ্ যার দ্বীপ, অন্তর্গত অপ যার – অন্তরীপ, নরাকার পশু যে নরপশু, জীবিত থেকেও যে মৃত জীবনত, পণ্ডিত হয়ে যে দূর্গ – পণ্ডিতমূর্ণ ইত্যাদি।

বহুব্রীহি সমাস নির্ণয়ের সহজ উপায়
* এ সমাসে সমস্যমান পদগুলোর কোনোটির অর্থ প্রাধান্য না পেয়ে, অন্য কোনো তৃতীয় পদের অর্থ প্রাধান্য পায়।
* ব্যাসবাক্যে “যে”, “যিনি’, ‘যার’ প্রভৃতি শব্দ থাকবে। যেমন দশ আনন যার দশানন। এখানে ব্যাসবাক্যে ‘দশ’ এবং ‘আনন’ শব্দ দুটি আছে। আনন – মুখ। দশানন শব্দটি দ্বারা দশ (১০) সংখ্যাটিকে বোঝানো হয় না, আনন বা মুখও বোঝানো হয় না, যে ব্যক্তির দশটি মুখ ছিল তাকেই— অর্থাৎ রাজা রাবণকে বোঝানো হয়। তাহলে দেখা যায় যে, সমস্যমান পদগুলোর (দশ আনন) কোনোটির অর্থ প্রাধান্য না পেয়ে, অন্য কোনো তৃতীয় পদের (যার) অর্থ প্রাধান্য পেল।
* বহুব্রীহি’ সমাসের সমস্ত পদ বিভিন্ন প্রকার শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। যেমন :
ক্র. | শব্দের ধরণ / উপাদান | উদাহরণ শব্দ | সমাসের ব্যাখ্যা |
১ | বিশেষ্য + বিশেষ্য | রাজপুত্র | রাজা যার পিতা — অর্থাৎ রাজপুত্র (নিজে রাজা নন) |
২ | বিশেষ্য + বিশেষণ | নীলকণ্ঠ | কণ্ঠ নীল যার (শিবের কণ্ঠ নীল, কিন্তু নিজে নয়) |
৩ | বিশেষণ + বিশেষ্য | মহাজন | জন বড় যে (বড় মনের অধিকারী ব্যক্তি) |
৪ | ক্রিয়া + বিশেষ্য | দিগম্বর | দিগ্ (দিক) অম্বর (পোশাক) যার — অর্থাৎ নগ্ন যোগী |
৫ | বিশেষ্য + ক্রিয়াপদ | জলজ | জলে জন্মায় — এমন বস্তু (যেমন পদ্ম, মাছ ইত্যাদি) |
৬ | সামান্য + সাধারণ বিশেষ্য | সহোদর | সমান উদরে জন্ম যার — ভাই/ভগ্নি |
৭ | বিশেষণ + বিশেষণ | চন্দ্রমুখী | মুখ চন্দ্রের মতো যার |
৮ | বহুবাচক শব্দ + বিশেষ্য | সবর্ণ | সমান বর্ণ যার |
৯ | সমাসবদ্ধ পদ + বিশেষ্য | ত্রিনয়ন | তিনটি নয়ন যার |
১০ | বিশেষ্য + উপসর্গযুক্ত শব্দ | দুর্দর্শন | যাকে দেখা দুরূহ |