ভাষার গঠন ও অর্থ প্রকাশে “ক্রিয়া” এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি এমন একটি ব্যাকরণিক শব্দশ্রেণি যা কর্ম, অবস্থা, অবদানের ধারা বা অবস্থান্তর নির্দেশ করে। মানুষের চিন্তা, বাক্যগঠন ও অর্থপ্রকাশে ক্রিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যে বাক্যে ক্রিয়া নেই, তা অসম্পূর্ণ এবং ভাব প্রকাশে অপারগ। তাই ভাষা শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে ক্রিয়া এবং তার শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন অত্যন্ত প্রয়োজন।
এই প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করব—ক্রিয়া কী, এটি কীভাবে বাক্যে ব্যবহার হয়, এবং এর প্রধান শ্রেণিবিভাগসমূহ কী কী। একই সঙ্গে আমরা দেখব কীভাবে বিভিন্ন প্রকার ক্রিয়া বাক্যের গঠন ও অর্থ বহন করে এবং ভাষা শিক্ষায় এটি কীভাবে প্রভাব ফেলে।
Table of Contents
ক্রিয়া ও ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ | ব্যাকরণিক শব্দশ্রেণি | ভাষা ও শিক্ষা
বাক্য তৈরির জন্য ক্রিয়ার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। যে কোনো বাক্যে ক্রিয়া শব্দ থাকবেই। তবে কখনও হয়ত তার চেহারা চোখে পড়ে না, তার সাহচর্য মেলে আড়ালে। যেমন অণু ভালো ছেলে। এখানে ক্রিয়াপদটি উহ্য, অনু হয় ভাল ছেলে—এমন লেখা হলে ‘হ’ ধাতু থেকে তৈরি ক্রিয়াপদটি লক্ষযোগ্য হত। কিন্তু বাক্য গঠনে ‘হয়’ ক্রিয়াপদটির প্রয়োজন নেই। ‘হয়’ ক্রিয়া বর্তমানকালে প্রায়ই উহা থাকে। বাক্যে সাধারণত ‘হ’ এবং ‘আছ ধাতু দ্বারা গঠিত ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে।
ক্রিয়া মানে কাজ বা কার্যসম্পাদন। ক্রিয়া বাক্যের বিধেয় অংশ গঠন করে এবং বাক্যে উদ্দেশ্য বা কর্তা কী করে কিংবা কর্তার কী ঘটে বা হয় করা, থাকা, হওয়া, ঘটা) তা নির্দেশ করে। যে শব্দশ্রেণি বাক্যে কাল, প্রকার, পুরুষ ইত্যাদি বিভক্তি প্রয়োজন মতো গ্রহণ করে : ক) বাক্যের বিধেয় অংশ গঠন করে, এবং খ) কোনো কিছু করা, থাকা, ঘটা, হওয়া, অনুভব করা ইত্যাদি কাজের সংগঠন বোঝায় তাই ক্রিয়াশব্দ। যেমন—শফিক বই পড়ে। গতকাল বৃষ্টি ছিল। কাল একবার এসো।
ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ:
বিবিধ অর্থে ক্রিয়াপদকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন :
১। ভাব প্রকাশের সম্পূর্ণতা অনুসারে ক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ:
ভাব প্রকাশের দিক থেকে ক্রিয়াপদকে দু ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন-
ক. সমাপিকা ক্রিয়া :
যে ক্রিয়া বাকোর (মনোভাবের) পূর্ণতা বা পরিসমাপ্তি ঘটায় তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। যেমন— আমি ভাত খাচ্ছি। তুমি গান গাইবে। সে নিয়মিত পড়াশোনা করে। সমাপিকা ক্রিয়া বাক্যের কর্তার সঙ্গে পক্ষবাচক (পুরুষতেন) সম্পর্ক নির্দেশ করে এবং ক্রিয়ার কাল ও প্রকার নির্দেশ করে।
সমাপিকা ক্রিয়ার গঠন
সমাপিকা ক্রিয়া সকর্মক, অকর্মক ও দ্বিকর্মক হতে পারে। ধাতুর সঙ্গে বর্তমান, অতীত বা ভবিষ্যৎ কালের বিভক্তি যুক্ত হয়ে সমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়। যেমন—
শফিক বই পড়ে, সকর্মক ক্রিয়া, বর্তমান কাল)। নাসির সারা দিন খেলেছিল, (অকর্মক ক্রিয়া, অতীত কাল)। আমি তোমাকে একটি বই উপহার দেব, (দ্বিকর্মক ক্রিয়া, ভবিষ্যৎ কাল)।
খ. অসমাপিকা ক্রিয়া :
যে ক্রিয়া যারা বাক্যের পরিসমাপ্তি ঘটে না, বক্তার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। যেমন আমি ভাত খেয়ে সে নিয়মিত পড়াশুনা করতে করতে … …… সকালে সূর্য উঠলে
লক্ষণীয় : পূর্ণাতা বাক্য গঠন করতে হলে অবশ্যই সমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করতে হবে। সাধারণত ইয়া (পড়িয়া), ইলে (পড়িলে), ইতে (পড়িতে), -এ (পড়ে), লে (পড়লে) –তে (পড়তে) বিভক্তিযুক্ত ক্রিয়া অসমাপিকা ক্রিয়া।
অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা
অসমাপিকা ক্রিয়াঘটিত বাক্যে দুই ধরনের কর্তার (কর্তৃকারক) ব্যবহার দেখা যায়–
এক কর্তা : বাক্যস্থিত সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা এক বা অভিন্ন হতে পারে। যেমন— তুমি কাজ পেলে আর কি বাড়ি আসবে? ‘পেলে’ (অসমাপিকা ক্রিয়া) এবং “আসবে (সমাপিকা ক্রিয়া) উভয় ক্লিয়ার কর্তা এখানে ‘তুমি’।
অসমান কর্তা : বাক্যস্থিত সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা এক না হলে সেখানে কর্তাগুলোকে অসমান কর্তা বলে। যেমন— আমি তাকে যেতে বললে সে যাবে। অসমান কর্তা আবার দু প্রকার :
ক. শর্তাধীন কর্তা : এ জাতীয় কর্তাদের ব্যবহার শর্তাধীন হতে পারে। যেমন— তোমরা বাড়ি এলে আমি রওয়ানা হব। অর্থাৎ বাড়ি আসার উপর আমার রওনা হওয়া নির্ভর করছে, ফলে এখানে কর্তৃপদের ব্যবহার শর্তাধীন। উল্লিখিত বাকাটিতে এলে অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা ‘তোমরা’ এবং ‘রওয়ানা হব’ সমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা “আমি”।
খ. নিরপেক্ষ কর্তা : শর্তাধীন না হয়েও সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন কর্তৃপদ থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রথম কর্তৃপদটিকে বলা হয় নিরপেক্ষ কর্তা। যেমন— সূর্য অস্তমিত হলে যাত্রীদল পথ চলা শুরু করল। এখানে ‘যাত্রীদলের’ পথ চলার সঙ্গে ‘সূর্য’ অস্তমিত হওয়ার কোন শর্ত বা সম্পর্ক নেই বলে ‘সূর্য’। নিরপেক্ষ কর্তা।
২। কর্মপদের ভূমিকা অনুসারে ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ:
কর্মপদের ভূমিকা অনুসারে ক্রিয়াপদকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন–
ক. সকর্মক ক্রিয়া : যে ক্রিয়ার কর্ম আছে তাকে সকর্মক ক্রিয়া বলে। যেমন সে চিঠি লিখছে। তুমি ছবি আঁকছ। আমি চাঁদ দেখছি। এই তিনটি বাক্যে লিখছে, আঁকছ আর দেখছি ক্রিয়া সকর্মক। কারণ তাদের কর্ম আছে। কর্মগুলো যথাক্রমে চিঠি, ছবি ও চাঁদ। ক্রিয়ার সঙ্গে ‘কী’ বা ‘কাকে’ প্রশ্ন করে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা-ই ক্রিয়ার কর্মপদ। কর্মপদযুক্ত ক্রিয়াই সকর্মক ক্রিয়া।
খ. দ্বিকর্মক ক্রিয়া : যে ক্রিয়ার দুটো কর্ম থাকে তাকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে। যেমন: সে আমাকে চিঠি লিখছে। মা আমাকে গল্প বলছেন। আমি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলাম এখানে ‘লিখছে”, “বলছেন, এবং “জিজ্ঞেস করলাম’ ক্লিয়ার যথাক্রমে দুটি করে কর্ম : আমাকে ও চিঠি, আমাকে ও গল্প, তাকে ও কারণ। দেখা যাচ্ছে দুটি কর্মের মধ্যে একটি ব্যক্তিবাচক এবং অন্যটি বস্তুবাচক। বস্তুবাচক কর্মের নাম মুখ্যকর্ম (direct object) আর ব্যক্তিবাচক কর্মের নাম গৌণকর্ম (Indirect object)। দ্বিকর্মক ক্রিয়াকে অবলম্বন করে ‘কী’ জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পাওয়া যায় তা মুখ্যকর্ম আর। ‘কাকে’ জিজ্ঞেস করে যে উত্তর পাওয়া যায় তা গৌণ কর্ম।
গ. অকর্মক ক্রিয়া : যে ক্রিয়ার কর্ম নেই তাকে অকর্মক ক্রিয়া বলে। যেমন – সে রোজ এখানে আসে। সে মাটিতে শোয়, সে রোজ সেখানে যায়, সে ভালো দৌঁড়ায়, সে অল্পক্ষণ ঘুমোয়।
এখানে আসে, শোয়, যায়, দৌঁড়োয়, ঘুমোয়— এগুলো অকর্মক ক্রিয়া, এদের কোনও কর্ম নেই। এ-সব ক্রিয়াকে অবলম্বন করে ‘কী’ বা ‘কাকে’ প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।
ঘ. প্রযোজক ক্রিয়া : যে ক্রিয়া একজনের প্রযোজনা বা চালনায় অন্যের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়, সেই ক্রিয়াকে বলে প্রযোজক ক্রিয়া। সংস্কৃতে একে ণিজন্ত ক্রিয়া বলে। যেমন— আনিস শান্তুকে পড়াচ্ছে। এখানে প্রকৃতপক্ষে পড়ার কাজটি শান্তু করছে, কিন্তু কাজটি পরিচালনা করছে আনিস।
প্রযোজক কর্তা : যে ক্রিয়া প্রযোজনা করে, তাকে বলে প্রযোজক কর্তা। পূর্ববর্তী উদাহরণে আনিস প্রযোজক কর্তা আর পড়াচ্ছে প্রযোজক ক্রিয়া।
সমধাতুজ কর্ম
বাক্যের ক্রিয়া ও কর্ম একই ধাতু থেকে গঠিত হলে তাকে সমধাতুজ কর্ম বলে। যেমন— আর কত খেলা খেলবে। মূল ‘খেল’ ধাতু থেকে ক্রিয়াপদ ‘খেলবে এবং কর্মপদ ‘খেলা’ উভয়ই গঠিত হয়েছে। তাই ‘খেলা’ সমধাতুজ কর্ম। সমধাতুজ কর্মপদ অকর্মক ক্রিয়াকে সকর্মক করে। যেমন- এমন সুখের মরণ কে মরতে পারে? বেশ এক ঘুম ঘুমিয়েছি।
সকর্মক ক্রিয়ার অকর্মক রূপ : প্রয়োগ-বৈশিষ্ট্যে সকর্মক ক্রিয়াও অকর্মক হতে পারে। যেমন—
অকর্মক : আমি চোখে দেখি নে।
সকর্মক : আকাশে চাঁদ দেখি নে।
অকর্মক : আমি রাতে খাব না।
সকর্মক : আমি রাতে ভাত খাব না।
নামধাতুজ ক্রিয়া
বিশেষ্য, বিশেষণ এবং ধ্বন্যাত্মক শব্দের পরে ‘আ’ প্রত্যয়যোগে যে সাধিত ধাতু গঠিত হয়, সেগুলোকে নামধাতু বলা হয়। নামধাতুর সঙ্গে পক্ষ (পুরুষ) বা কালসূচক ক্রিয়া-বিভক্তি যোগে নামধাতুর ক্রিয়াপদ গঠিত হয়। যথা-
বেত (বিশেষ্য + আ (প্রত্যয়) বেতা (নামধাতু)। যথা- শিক্ষক ছাত্রটিকে বেতাচ্ছেন নোমধাতুর ক্রিয়াপদ) । বাঁক (বিশেষণ) + আ (প্রত্যয়) বাঁকা (নামধাতু)। যথা- কঞ্চিটি বাকিয়ে ধর (নামধাতুর ক্রিয়াপদ)। ধ্বন্যাত্মক শব্দ থেকে: টনটন- দাঁতটি বাথায় টনটনাচ্ছে। প্রযোজক ও নামধাতুর সঙ্গে আনো বিভক্তি যোগ করে ক্রিয়াবিশেষ্য আর কাল ও পক্ষবিভক্তি যোগ করে নামধাতুজ ক্রিয়া পাওয়া যায়। যেমন ডরানো, বাঁকানো, রাঙানো এবং ডরা+চ্ছ – ডরাচ্ছ, রাঙা+চ্ছ- রাঙাচ্ছ।
আ- প্রত্যয় যুক্ত না হয়েও কয়েকটি নামধাতু বাংলা ভাষায় মৌলিক ধাতুর মতো ব্যবহৃত হয়। যেমন— আমার বন্ধু বইটা ছেপেছে। বাগানে বেশ কিছু লিচু ফলেছে।
৩। গঠন-বৈশিষ্ট্য অনুসারে ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ:
এ ধরনের ক্রিয়া দুই প্রকার ক. যৌগিক ক্রিয়া, খ. সংযোগমূলক বা মিশ্ৰক্ৰিয়া।
ক. যৌগিক ক্রিয়া
একটি সমাপিকা ও একটি অসমাপিকা ক্রিয়া যদি একসঙ্গে একটি বিশেষ বা সম্প্রসারিত অর্থ প্রকাশ করে, তবে তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। যেমন— ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়ল (কার্য সমাপ্তি অর্থে)। এখন যেতে পার (অনুমোদন অর্থে)। তিনি বলতে লাগলেন (নিরন্তরতা অর্থে)।
যৌগিক ক্রিয়ার গঠন
অসমাপিকা ক্রিয়ার পরে যা, পড়ু, দেখ, লাগ, ফেল, আস, উঠ, দি, হ, থাক্ প্রভৃতি ধাতু থেকে সমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়ে উভয়ে মিলিতভাবে যৌগিক ক্রিয়া তৈরি করে, এসব যৌগিক ক্রিয়া বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে। যেমন— গায়ক গেয়ে যাচ্ছেন। এখন শুয়ে পড়। এদিকে চেয়ে দেখ। আজ বিকেলে বৃষ্টি আসতে পারে। আমাকে যেতে দাও। এবার কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও। পিঠাগুলো খেয়ে ফেল। ঋণের বোঝা ভারী হয়ে উঠেছে। খুকি কাঁদতে লাগল। এবার ভাবতে থাক।
খ. সংযোগমূলক বা মিশ্ৰ ক্ৰিয়া
বিশেষা, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক শব্দের সঙ্গে কর, হ, দি, যা, পা, কাটু, গা, ছাড়, ধর, মারু প্রভৃতি ধাতুযোগে গঠিত ক্রিয়াপদ বিশেষ বিশেষ অর্থে মিশ্র ক্রিয়া গঠন করে। যেমন- বিশেষ্যের উত্তর (পরে আমরা তাজমহল দর্শন করলাম। বিশেষণের উত্তর (পরে) তোমাকে দেখে বিশেষ প্রীত হলাম। ধ্বন্যাত্মক শব্দের উত্তর (পরে) মাথা ঝিমঝিম করছে।
৪। অস্তি-নেতি অনুসারে ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ:
এ ধরনের ক্রিয়া দুই প্রকার : ক. অস্তিবাচক খ. নঞর্থক ক্রিয়া
ক. অস্তিবাচক ক্রিয়া : এ ধরনের ক্রিয়া থাকা, অস্তিত্ব ইত্যাদির ইতিবাচকতা বোঝায়। যেমন : আমার অনেক বই আছে। সে ঘরটায় থাকে।
খ. নঞর্থক ক্রিয়া : এ ধরনের ক্রিয়ায় না, নেই, নিষেধ ইত্যাদি ভাবের প্রকাশ ঘটে। যেমন সে এখানে নেই।অঙ্কটা সহজ নয়।
