ভাষার সংজ্ঞার্থ ও ভাষার উৎপত্তি নিয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” সিরিজের ” বাংলা ভাষা” পাঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ভাষার সংজ্ঞার্থ ও ভাষার উৎপত্তি
ভাষার সংজ্ঞার্থ
বাগ্যন্ত্রের দ্বারা উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনির সাহায্যে মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যমকে ভাষা বলে। অর্থাৎ ‘ভাষা হল পরপর ধ্বনি ব্যবহার করে অর্থ প্রকাশের মানবিক উপায়। ভাষার এক প্রান্তে ধ্বনি; আর-এক প্রান্তে অর্থ- এই হল মূল কথা। ভাষাবিজ্ঞানিগণ বিভিন্নভাবে ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন :
প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত, শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।”
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষার সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘মনুষ্যজাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তাহার নাম ভাষা (Language) । ‘
ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, ‘মানুষ তাহার মনের ভাব প্রকাশ করিবার জন্য কণ্ঠ, জিহ্বা, তালু, ওষ্ঠ, দন্ত, নাসিকা, মুখবিবর প্রভৃতি বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে অপরের বোধগম্য যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির উচ্চারণ করিয়া থাকে, সেই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে ভাষা বলা হয়।
ড. সুকুমার সেনের মতে, মনের ভাব প্রকাশ করার নিমিত্ত বিভিন্ন জাতির বা সমাজের সকল সভ্যের বোধগম্য বাক্যসমূহের সমষ্টিকে সেই জাতির ভাষা বলে।
ভাষাবিদ মুহম্মদ আবদুল হাই-এর মতে, এক এক সমাজের সকল মানুষের অর্থবোধক ধ্বনির সমষ্টিই ভাষা।”
বহুভাষাবিদ পণ্ডিত জ্যোতিভূষণ চাকী বলেন, ভাষা মনের ভাবপ্রকাশের জন্যে বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন এমন শব্দসমষ্টি যা যতন্ত্রভাবে বিশেষ কোনও জনসমাজে ব্যবহৃত।
ভাষাবিদ অশোক মুখোপাধ্যায়-এর মতে, ‘কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবহ ধ্বনি সমষ্টির সাহায্যে মানুষের মনের ভাব প্রকাশ ও আদান প্রদানের স্বাভাবিক মাধ্যমের নাম ভাষা ।

ভাষার উৎপত্তি
ভাষার উৎপত্তি কেমন করে হল, কবে হল এই প্রশ্নের কোন উত্তর মানুষের জানা নেই। অবশ্য তার মানে এই নয় যে পণ্ডিত সমাজ এ- -বিষয়ে কোনো অনুমান করেন নি। অনুমান যথেষ্টই হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই ভাষার উৎপত্তির রহস্য সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করতে পারে নি। পৃথিবীর নানা ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে ভাষার সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর। ভাষার উদ্ভবের ঐশ্বরিক তত্ত্ব একদিকে সবচেয়ে নির্বিরোধী সন্দেহ নেই, কিন্তু বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসায় তার মূল্য সামান্য।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে একের পর এক যতগুলো তত্ত্ব তৈরি করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটিই নিরর্থক বলে বিবেচিত হয়েছে। প্রত্যেকটির একটি করে কৌতুক-নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন— একটি তত্ত্ব ছিল, ধ্বনির অনুকরণ থেকেই ভাষার উৎপত্তি। কুকুরের ডাক অনুকরণের মধ্য দিয়ে কুকুর বাচক শব্দের সৃষ্টি। বিরোধীরা এর নামকরণ করেছিলেন ‘বৌ-ঔ’ তত্ত্ব, বাংলায় বলা চলে ভৌ-ভৌ তত্ত্ব। আরেক দল মনে করতেন, ভাষার আদিম রূপ হল আবেগ বাচক ধ্বনি, ইংরেজিতে যাদের বলা হয় interjectional শব্দ।
উঃ আঃ ইত্যাদি হল মানুষের প্রথম উচ্চারিত ধ্বনি, তারই বিকশিত রূপ ভাষা। এর ব্যঙ্গ নাম দিলেন বিরোধী দল ‘পুঃ পুঃ’। ঠিক এ-রকম আরেকটি স্বভাব-তত্ত্ব দাবি করেছিল যে ধ্বনি আর অর্থের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, বিভিন্ন ধ্বনির দ্বারাই বস্তুর নামকরণ করা হয়েছিল আদিম যুগে। সেই ধ্বনিগুলো মানুষ শুনেছে, তার সঙ্গে যুক্ত করেছে বস্তুকে। এর নাম ‘ডিং ডং’। বলাই বাহুলা এও একটি কৌতুক নাম। এ-রকম আরেকটি তত্ত্বের নাম হল ‘ইয়ো হো-হো”। এর পেছনে আছে মানুষের কায়িক পরিশ্রম আর ধ্বনি নিঃসরণের সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টা।
আমরা লক্ষ করেছি সমষ্টিবদ্ধভাবে মানুষ যখন কোনো পরিশ্রম করে সে পাল্কি বওয়া হোক, কিংবা দাঁড় টানা, কাঠ কাটা কিংবা বড় লোহার রড টানা, তখন কাজের সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলো শব্দ উচ্চারণ করে। কোনো কোনো পণ্ডিত ভেবেছিলেন যে আদিম মানুষও তার বিভিন্ন সমষ্টিবদ্ধ কাজের সঙ্গে-সঙ্গে যে-সব ধ্বনি উচ্চারণ করত সম্ভবত সেগুলোই ভাষার প্রথম নমুনা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভাষার অনুকৃতিমূলক মতবাদের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে— “প্রাকৃতিক বস্তুসবল শব্দ করে। নদী কল কল করে, মেঘ গর গর করে, সিংহ হকার করে, সর্প ফোঁস ফোঁস করে। আমরাও যে সকল কাজ করি, তাহারও শব্দ আছে।
বাঙ্গালি সপ্ সপ্ করিয়া খায়, ‘গ গ’ করিয়া গেলে হন হন’ করিয়া চলিয়া যায়, ‘সুপ্ দাপ’ করিয়া লাফায়। এইরূপ নৈসর্গিক শব্দানুকৃতি ভাষার প্রথম সূত্র।” বস্তুত এসব তত্ত্ব চেষ্টা করেছে ভাষার উৎপত্তির অনুমান করতে। এসব তত্ত্ব কয়েকটি সম্ভাবনার কথা বলেছে কিন্তু প্রত্যেকটিই অত্যন্ত অসম্পূর্ণ এবং কোনটিই তথ্য নির্ভর নয়।
যে ঐতিহাসিক স্তরে ভাষার উদ্ভব হয়েছিল তার কোনো রেকর্ড না থাকায় এ সংক্রান্ত অনুমানের বেশির ভাগই জল্পনা-কল্পনা জাতীয়। যারা ভাষার দৈবী উদ্ভবে বিশ্বাস করেন তাদের অনুমানের বিশ্বাস্যতা বা সম্ভাব্যতাও নেই। কিন্তু যাদের ভাষার উদ্ভব সম্মন্ধে ধারণা মানব-নির্ভর, তাদের কথার সাক্ষ্য-প্রমাণ দাবি করাও আজ শক্ত।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ভাষার উদ্ভব সম্বন্ধে এই ধরনের জল্পনা-কল্পনার মূল্য সম্মন্ধে গবেষকদের মনে সংশয় তৈরি হয়েছিল, তাই ১৮৭৮ সালে প্যারিসের ভাষাতত্ত্ব সমিতি (লা সোসিয়েতে নাঁগিস্তিক দ পারি) ওই সমিতির কোনো অধিবেশনে ভাষার উদ্ভব বিষয়ক কোনো প্রবন্ধ পড়ার জন্য গৃহীত হবে না বলে নিষেধনামা জারি করে। কিন্তু ভাষার উদ্ভব সম্মন্ধে মানুষের প্রশ্নের উত্তরে কোনো সুনিশ্চিত তথ্য পাওয়া না যাক, একটা সংগত ও বিশ্বাস্য অনুমানের জায়গা নিশ্চয়ই আছে। এ-রকমই একটি অনুমান করেছিলেন হার্ডার, বলেছিলেন ভাষার সৃষ্টি করেছে মানুষ, ঈশ্বর নয়।
ভাষা ব্যক্তির হয়েও সমাজের সৃষ্টি, পরস্পরের সঙ্গে ভাবের বিনিময়ের জন্যেই ভাষার উদ্ভব। মার্কস বলেছেন, ব্যক্তিমানুষ একসঙ্গে বাস করছে না, পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে না অথচ ভাষার জন্ম ও বিকাশ হচ্ছে— এ হচ্ছে অসম্ভব দাবি। সমাজ তৈরি না হলে মানুষের মধ্যে আদান-প্রদানের বা ভাব বিনিময়ের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত না হলে ভাষার জন্ম সম্ভবপর ছিল না। এ যুগের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী চত্রি বলেছেন, ভাষা কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। ভাষা মানুষের সৃজনী চেতনার সঙ্গে যুক্ত।
চমস্কির অনুগামী এরিক লেনেবার্গ শারীরবিজ্ঞানের বিবর্তনের প্রসঙ্গ এনে এই কথাটি অন্যভাবে বলার চেষ্টা করেছেন। প্রাণিজগতের বিবর্তনের মধ্যে এমন একটা মৌলিক জীবকোষগত রূপান্তর (জেনেটিক মিউটেশন) ঘটে যায় যার ফলে মানুষ একদিন হোমো সাপিয়েন্স অর্থাৎ মননশীল প্রাণী হয়ে ওঠে। একজন মানুষ যখন তার মাতৃভাষায় স্বাভাবিকভাবে কথা বলে, তখন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উপলক্ষে তাকে বহুপ্রকারের বহুসংখ্যক বাক্য ব্যবহার করতে হয়।
সারাজীবনে অসংখ্য নতুন-নতুন পরিস্থিতিতে নতুন প্রয়োজনে অসংখ্য বাক্য তাকে বলতে হয়। এত বাকা কি সবই সে পৃথিবীতে জন্মাবার পরে পিতা-মাতা বা সমাজের কাছ থেকে আগে থেকে শিখে রাখে? মানুষের মন কি সমস্ত ভবিষ্যৎ পরিস্থিতিতে কল্পনা করে তার জন্যে প্রয়োজনীয় বাক্য আগেই সমাজের কাছ থেকে শিখে টেপ রেকর্ডারের মতো ধরে রাখে এবং পরে যথাসময়ে সেগুলো উদ্গীরণ। করে? বস্তুত মানুষের মন টেপ রেকর্ডারের মতো যন্ত্র নয় এবং ভাষাপ্রক্রিয়া সে-রকমের যান্ত্রিক ব্যাপার নয়।
মাতৃভাষাভাষী মানুষের মন ভাষার মূল নীতিটুকু নিজের সহজ বোধ ও বোধির সাহায্যে আয়ত্ত করে থাকে, তারপরে সেই মূলনীতিটুকু প্রয়োগ করে ভাষার সীমাবদ্ধ উপকরণকে নিজের সৃজনী ক্ষমতা দিয়ে নিত্য-নতুন করে সাজিয়ে। নতুন-নতুন পরিস্থিতির প্রয়োজনে নতুন-নতুন থাকা সৃজন করে চলে। কাজেই ভাষা সম্বন্ধে আমাদের সনাতন ধ্যান-ধারণা, তার উপযোগ সম্বন্ধে আমাদের লালিত বিশ্বাস, তার প্রয়োগ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তি সব বদলে যাচ্ছে দ্রুত। কেননা ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো সদা প্রবহমান ও বিকাশ বিবর্তনশীল। বিশেষ করে আজকের রাগতে নিসর্গের ও জীব-উদ্ভিদ-মানুষের সম্মন্ধে প্রতিদিন নতুন নতুন তত্ত্ব, তথ্য ও সত্য উদঘাটিত হচ্ছে।
মানুষের জীবন এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর, তাই এ যন্ত্রযুগে, যন্ত্রজগতে ও যন্ত্রনির্ভর জীবনে মানুষের মন-মনন- মনীষা প্রসূন যেমন বিচিত্ররূপে প্রকাশমান তেমনি চিকিৎসা ও পুষ্টিবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখারও নব নব আবিষ্কার উদ্ভাবন মানুষের মানসিক ও ব্যবহারিক জীবনের চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণ একাধারে ও যুগপৎ উৎকর্যের, সৌকর্যের, বৈচিত্র্যের ও স্বাচ্ছন্দ্যের গুণে মানে মাপে মাত্রায় ঘন ঘন রূপান্তর ঘটাচ্ছে। এবং সবটাই পরিণামে নতুন নতুন শব্দে আশ্রিত হয়েই পাচ্ছে অভিব্যক্তি— বিকশিত হচ্ছে ভাষা। ভাষার আদি স্রষ্টার সন্ধান না মিললেও প্রতিক্ষণে ভাষা নিঃশব্দ পৃথিবীর ঘুম ভাঙায়, প্রকৃতিকে জাগায়, মানুষকে ভাবায়। মানুষের ভাষায় মুখর হয়ে ওঠে সারা বিশ্ব।