‘প্রতিদান’ কবিতাটি রচয়িতা পল্লীকবি জসীম উদ্দীন—বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য নাম। গ্রামীণ জীবন, মানবিক সম্পর্ক এবং বাঙালির আবেগ-অনুভূতিকে গভীর মমতায় চিত্রিত করার ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। ‘প্রতিদান’ কবিতাটি তাঁর জনপ্রিয় এবং হৃদয়গ্রাহী কবিতাগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে গভীর মানবিক বোধ, আত্মত্যাগ এবং আবেগের মিশ্রণে নির্মিত হয়েছে এক অন্তর্দৃষ্টি-সম্পন্ন কাব্যজগৎ।
জসীম উদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে, তার নানাবাড়িতে। গ্রামীণ প্রকৃতি, বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও জীবনসংগ্রাম তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পিতার সঙ্গে গ্রামের মেঠোপথে হেঁটে হেঁটে বাজার কিংবা বিদ্যালয়ে যাতায়াত করার অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি পেয়েছিলেন জীবনের বাস্তব ছবি—যা পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যে পরিণত হয়েছে চিরায়ত সৌন্দর্যে।
‘প্রতিদান’ কবিতায় কবি তুলে ধরেছেন এক অনন্য মানবিক বার্তা—প্রেম, ত্যাগ, ও আত্মিক শ্রদ্ধাবোধের। কবিতার ভাষা সহজ, গ্রাম্য ও হৃদয়স্পর্শী; পাঠকের মনে গেঁথে যায় কৃতজ্ঞতার চিরন্তন আবেদন। এ কারণেই এই কবিতাটি কেবল একটি সাহিত্যকর্ম নয়, বরং বাঙালি পাঠকের হৃদয়ের এক প্রিয় সম্পদ।
পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘প্রতিদান’ তাই শুধু একটি কবিতা নয়, এটি বাংলার মাটি, মানুষের মন, এবং সংস্কৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।
প্রতিদান কবিতা – জসীম উদ্দীন
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তার ঘর।
আমার এ কূল ভাঙ্গিয়াছে যে বা আমি তার কূল বাঁধি;
যে গেছে বুকেতে আঘাত হানিয়া তার লাগি আমি কাঁদি;
যে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান;
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর,-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
মোর বুকে যে বা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল-মালঞ্চ ধরি
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী
আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি, সাজাই নিরন্তর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
প্রতিদান কবিতার মূলভাবঃ
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন রচিত ‘প্রতিদান’ কবিতার মূলভাব হলো— নির্বাক আত্মত্যাগ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতার মূল্যায়ন। কবিতায় একজন বিধবা নারীর নিঃস্বার্থ সেবা ও মমতার প্রতিদান হিসেবে তার দত্তক ছেলে পরিণত বয়সে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সেটিই কবির কল্পনায় উঠে এসেছে এক হৃদয়ছোঁয়া চিত্র হিসেবে।
কবিতার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে—প্রকৃত ভালোবাসা বা স্নেহ কখনও বৃথা যায় না। মানবিক মূল্যবোধ, কর্তব্যবোধ এবং আত্মিক সম্পর্কের এই গভীরতা পাঠকের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। কবি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষের মধ্যে যদি মমতা, ত্যাগ ও কৃতজ্ঞতা থাকে—তবে সমাজ হবে আরও মানবিক ও আলোয় ভরা।

প্রতিদান কবিতা বিশ্লেষণ ঃ