ঐকতান কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ঐকতান” কবিতাটি তাঁর মানবতাবাদী ও সর্বজনীন চিন্তাধারার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। কবিতাটিতে কবি মানুষের মাঝে বিভেদ, দ্বন্দ্ব ও অসহিষ্ণুতা দূর করে ঐক্যের সুর প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। “ঐকতান” শব্দের অর্থই হলো একসাথে বাজা—যেখানে ভিন্ন ভিন্ন সুর মিশে যায় একটি মধুর সঙ্গীতে।

কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মানুষকে ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সমন্বয় ও সাম্যের বন্ধনে আবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, বিশ্বমানবতার একত্র সুরেলা মিলনেই সৃষ্টি হবে প্রকৃত শান্তি ও সৌন্দর্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতাবাদী মনোভাব ও “বিশ্বকবি” উপাধির মূল সত্তাকে প্রতিফলিত করে।

“ঐকতান” কেবল একটি সাহিত্যকর্ম নয়, বরং এটি মানবসভ্যতার জন্য একটি চিরন্তন বার্তা—যেখানে বহুমাত্রিকতার মাঝে খুঁজে নিতে হবে ঐক্যের সুর, আর সেই সুরেই জাগবে মানবতার মহাকাব্য।

 

 

বসন্ত কবিতা রবি ঠাকুরের

 

ঐকতান কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-
মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু
রয়ে গেল অগোচরে। বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।
সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে যাহে
অক্ষয় উৎসাহে-
যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াই আনি।

জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
পূরণ করিয়া লই যত পানি ভিক্ষালব্ধ ধনে।
আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,
এই স্বরসাধণায় পৌঁছিল না বহুতর ডাক-
রয়ে গেছে ফাঁক।

প্রকৃতির ঐকতানস্রোতে
নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে;
তাদের সবার সাথে আছে মোর এইমাত্র যোগ-
সঙ্গ পাই সবাকার, লাভ করি আনন্দের ভোগ,
পাই নে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,
বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি জীবনযাত্রার।
চাষি খেতে চালাইছে হাল,
তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-
বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার
তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।

অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে
সমাজের উচ্চ মঞ্জে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।
মাঝে মাঝে গেছি আমি ও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।
জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।
তাই আমি মেনে নিই সে নিন্দার কথা
আমার সুরের অপূর্ণতা।

আমার কবিতা, জানি আমি,
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির-বাণী-লাগি কান পেতে আছি।
এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক মনের।

মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার-
প্রাণীহন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধান,
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরু ভূমি
রসে পূর্ণ করি দাও তুমি।
অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি
সাহিত্যের ঐকতানসংগীতসভায়
একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়-
মূক যারা দুঃখে সুখে,
নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে,
ওগো গুণী,
কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি

 

 

ঐকতান কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যাঃ

ঐকতান কবিতার মূলভাব ও ব্যাখ্যাঃ ঐকতান কবিতা টি কবির আত্ম-সমালোচনার বর্ণনা। কাব্য সাধনায় কবি নিজের অপূর্ণতা ও ব্যর্থতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন কবিতায়। এ কবিতায় তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। সাহিত্য সাধনার বিষয় ও তার বিস্তার এবং নিজের অপূর্ণতা; নিজের ব্যর্থতার কারণ এবং মাটির মানুষের কবির আগমনের প্রতীক্ষা।

দীর্ঘ জীবন-পরিক্রমণের শেষপ্রান্তে পৌঁছে স্থিতপ্রজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ পেছন ফিরে তাকিয়ে সমগ্র জীবনের সাহিত্যসাধনার সাফল্য ও ব্যথতার হিসাব খুঁজেছেন “ঐকতান” কবিতায়। তিনি অকপটে নিজের সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতার কথা ব্যক্ত করেছেন এখানে। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কবি অনুভব করেছেন নিজের অকিঞ্চিৎকরতা ও ব্যর্থতার স্বরূপ।

কবি বুঝতে পেরেছেন, এই পৃথিবীর অনেক কিছুই তাঁর অজানা ও অদেখা রয়ে গেছে। বিশ্বের বিশাল আয়োজনে তাঁর মন জুড়ে ছিল কেবল ছোট একটি কোণ। জ্ঞানের দীনতার কারণেই নানা দেশের বিত্রি অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন গ্রন্থের চিত্রময় বর্ণনার বাণী কবি ভিক্ষালব্ধ ধনের মতো সযত্নে আহরণ করে নিজের কাব্যভাণ্ডার পূর্ণ করেছেন। তবু বিপুল এ পৃথিবীর সর্বত্র তিনি প্রবেশের দ্বার খুঁজে পাননি।

চাষি ক্ষেতে হাল চষে, তাঁতি তাঁত বোনে, জেলে জাল ফেলে-এসব শ্রমজীবী মানুষের ওপর ভর করেই জীবনসংসার এগিয়ে চলে। কিন্তু কবি এসব হতদরিদ্র অপাঙ্ক্তেয় মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে সমাজের উচ্চমঞ্চে আসন গ্রহণ করেছিলেন। সেখানকার সংকীর্ণ জানালা দিয়ে যে জীবন ও জগৎকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তা ছিল খণ্ডিত তথা অপূর্ণ।

ক্ষুদ্র জীবনের সঙ্গে বৃহত্তম মানব-জীবনধারা ঐকতান সৃষ্টি না করতে পারলে শিল্পীর গানের পসরা তথা সৃষ্টি সম্ভার যে কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়, কবিতায় এই আত্মোপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে কবির। বলেছেন তিনি, তাঁর কবিতা বিচিত্র পথে অগ্রসর হলেও জীবনের সকল স্তরে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে, জীবন-সায়াহ্নে কবি অনাগত ভবিষ্যতের সেই মৃত্তিকা-সংলগ্ন মহৎ কবিরই আবির্ভার প্রত্যাশা করেছেন, যিনি শ্রমজীবী মানুষের অংশীদার হয়ে সত্য কর্মের মধ্যে সৃষ্টি করবেন আত্মীয়তার বন্ধন। “ঐকতান” কবিতায় যুগপৎ কবির নিজের এবং তাঁর সমকালীন বাংলা কবিতার বিষয়গত সীমাবদ্ধতার দিক উন্মোচিত হয়েছে।

ঐকতান কবিতা আবৃত্তিঃ

 

Leave a Comment