গৃহের আকর্ষণে রচনা – দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

গৃহের আকর্ষণে রচনা

Table of Contents

গৃহের আকর্ষণে রচনা- দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

গৃহের আকর্ষণে

 কল্যাণীয়া ক্যাথারিন,

এত আমোদ-প্রমোদের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই এই বুড়ীর বা এখানকার নিরানন্দ জীবনের কথা তোমার এখন মনে পড়ে না। কত বন্ধু হয়েছে তোমার। অবশ্য স্থল আনন্দে ডুবে থাকার মেয়ে যে তুমি নও, সে কথা আমি জানি। এখানকার খবর গতানুগতিক। এখানকার বেয়াড়া মেয়েদের নিয়ে বড়ই ঝামেলায় পড়তে হয় মাঝে মাঝে। অবাধ্য সব, বললেও গ্রাহ্য করে না। তোমার সঙ্গে যে এদের কত তফাৎ এখানে তাই ভাবি। এত করে বলি মেয়েদের হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্কার্ট আর বড় মোজা পরতে তা কেউ শোনে না আমার কথা। আমার বাতের ব্যথা খুব বেড়েছিল। ডক্টর হ্যারিসন আমাকে লণ্ডনে নিয়ে গিয়ে বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দেখিয়েছেন। ডাক্তার বলেছেন রোগটা ক্যান্সার। সাবধানে থেকো। অল্পবয়স আর প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী তুমি। অসৎ পুরুষ মানুষের বন্ধুত্ব করো না। কিন্তু মন্দ পুরুষ মানুষের ছলনায় কত মেয়ের জীবন যে নষ্ট হয়েছে তার একাধিক উদাহরণ আমি জানি। যদিও তুমি ভিন্ন প্রকৃতির মেয়ে তবুও তোমার মঙ্গলকামী বলেই একথা লিখলাম। সবসময় মনে রাখবে তোমার জন্যে এখানকার দরজা চিরদিনই ভোলা থাকবে। আশীর্বাদ জেনো।
—আমেনিয়া ডিনার।

পুনঃ খবরের কাগজে তোমার দিদিভাই টাম্পলিনের সঙ্গে তোমার নাম দেখলাম। প্রার্থনা করি অহেতুক দম্ভ বা অসার আত্মশ্লাঘা তোমার চারিত্রিক মাধুর্যকে যেন বিনষ্ট করে।

ক্যাথারিন বার কয়েক চিঠিটা পড়ল। সেন্ট মেরী মিড়-এর স্মৃতি তার চোখে ভেসে আসতে লাগল। তার কেমন যেন কান্না পেয়ে গেল। হঠাৎ লেনক্স এসে ঘরে ঢুকল।

–কি হয়েছে মাসী?

–কই, কিছু না তো।–চিঠিটা ব্যাগে রাখতে রাখতে ক্যাথারিন বলল।

–কিছু না? তবে মুখ ভার কেন?

–ডিনার-এর চিঠি পেলাম, ওর ক্যান্সার হয়েছে। তাই মনটা খারাপ লাগছে। বল, কি বলবে?

-রাগ করবে না তো। জান, আমি না, তোমার সেই ডিটেকটিভ বন্ধু পোয়ারোকে তোমার নাম করে ফোন করে নিস্-এ আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছি। আমি ভাবলাম, তোমার নাম করে না বললে হয়তো উনি রাজী হবেন না। রাগ করলে মাসী?

-রাগ করতে যাব কেন? তুমি তাহলে ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও?

–সে আর বলতে! আমি বোধহয় ওর প্রেমেই পড়ে গেছি।

–বুঝতে পেরেছি। তাই কয়েকদিন ধরেই দেখছি শুধু ড্রেক ক্যাথারিন-এর গ্রেপ্তার। আর ব্লু ট্রেনের কথা বলছ বিশেষ করে ড্রেক-এর গ্রেপ্তারের পর থেকে।

–আমি গাড়ি বের করতে বলছি ড্রাইভারকে। মাকে বলিনি কারণ মা তাহলে আমাদের সঙ্গে যাবে আর মা গেলে আমি কোনো চান্সই পেতাম না কথা বলার। শুধু শ্রোতা হয়েই থাকতে হতো।

–ঠিক আছে, তুমি নিচে নাম, আমি আসছি। লেনক্স ও ক্যাথারিন নেগ্রেসকোতে পৌঁছে দেখল পোয়ারো ওদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। পোয়ারোর অভিনন্দন জানানোর সুন্দর ভঙ্গি ওদের দুজনকেই মুগ্ধ করল। আহারের সময় পোয়ারোর কথার মাধুৰ্য্য আহার্যকে আরও উপভোগ্য করে তুলল। ক্যাথারিন চুপ করেছিল। আহার শেষে কফি খেতে খেতে লেনক্স বলল, কতদূর হলো মিঃ পোয়ারো? কি বললাম বুঝতে পেরেছেন?

হাতের আঙ্গুল মটকালেন পোয়ারো। তাদের সুবিধেমত তারা কাজ করছে।

–আর আপনি বসে বসে দেখছেন।

-মাদমোয়াজেল। আপনি তরুণী, আপনার গতিবেগ চঞ্চল। কিন্তু তিনটে জিনিসের গতি ধীর হয়। যা কখনও তাড়াতাড়ি হয় না। ভালোবাসা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। ফুল ধীরে ধীরে ফোটে আর ধীরে ধীরে কাজ করে বুড়োরা।

–ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আহা, আপনি মোটেই বুড়ো নন।

–সত্যি? শুনলেও ভালো লাগে।

–কিংটন আসছেন। সঙ্গে মিঃ আলডিনও আসছেন দেখছি।

-আমি চট করে একটা কথা মিঃ কিংটনকে জিজ্ঞেস করেই এখুনি আসছি।–লেনক্স উঠে গেল।

-আপনাকে আনমনা লাগছে কেন? কত দুরের চিন্তা করছেন? পোয়ারো বললেন।

-খুব বেশি দূরের নয়।–ব্যাগ থেকে ডিনারের চিঠিটা বের করে পোয়ারোর হাতে দিলেন।

চিঠিটা পড়ে পোয়ারো বললেন, আপনি তাহলে ফিরে যাচ্ছেন ইংলণ্ডে?

–না। আপাতত যাচ্ছি না। কেনই বা যাব।

–ও। আমারই ভুল হয়েছিল। এক মিনিট একটু আসছি। পোয়ারো উঠে দেখেন মিঃ কিংটন, মিঃ আলডিন ও লেডী টাম্পলিন যেখানে ছিল সেখানে গেলেন। মিঃ আলডিনের চেহারা খুব খারাপ লাগছে এবং পোয়ারোকে দেখে তিনি বেশি একটা খুশী হলেন না।

পোয়ারো কিংটনকে পাশে ডেকে বললেন, মিঃ আলডিন কি অসুস্থ?

–আর অসুস্থ হবেন না? মেয়ে খুন হল, আর খুনী কিনা জামাই। এখন আপনার হাতে তদন্ত দিয়েছেন বলে ওর আফসোস হচ্ছে।

–ওঁর ইংলণ্ডে ফিরে যাওয়া উচিত মিঃ কিংটন। ওকে সেখানে নিয়ে যান।

–আমরা তো পরশুদিনই ইংলণ্ডে যাচ্ছি।

–তাই নাকি। খুব ভালো কথা। মিস গ্রেকে বলবেন।

–কি বলব?

–এই আপনার, মানে মিঃ আলডিনকে নিয়ে ইংলণ্ডে ফিরে যাবার কথা।

কিছুক্ষণ পরে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে নানারকম আলোচনা করতে লাগলেন। ক্রমে বিদায় নেবার পালা এলো। প্রথমেই মিঃ আলডিন ও তার সেক্রেটারী বিদায় নিলেন।

-খুব ভালো লাগল আপনাদের এমন মধুর সঙ্গ। অন্যদিনের চেয়েও আজকের খাবার যেন বেশি সুস্বাদু মনে হলো। আপনাদের সঙ্গদানের ফলে। পোয়ারো বললেন, এখন প্রাণশক্তিতে ভরপুর আমি। হাসবেন না মিস গ্রে। আপনি দেখেছেন এক নির্জীব নিরীহ এরকুল পোয়ারোকে, কিন্তু তার আরও একটা বিপরীত রূপ আছে। সে চেহারা জানে অন্য এক জগতের লোকেরা। তাদের কাছে এরকুল পোয়ারোর উপস্থিতি মৃত্যুর উপস্থিতির সমতুল্য, ক্যাথারিন-এর মনে হলো। যে পোয়ারো কথা বলছিলেন এখন যেন তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন লোক। ক্যাথারিন যেন পোয়ারোর দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করল।

 

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

-এবারও বুদ্ধির লড়াইতে এরকুল পোয়ারোর জিত হবে। হা, জিত নিশ্চয়ই হবে। চললাম মাদমোয়াজেল। কয়েক পা এগোতেই পেছনে ক্যাথারিন বললেন,

-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কথাই ঠিক। আমি ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাচ্ছি।

–তাই নাকি!

–বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না?

-না, তা নয়। ভাবছি পোয়ারো কি করে আগেই জানলো। পোয়ারো গাড়িতে উঠে বললেন, কাউন্ট দ্য লা রোচির বাড়ি চল।

কাউন্টের বাড়িতে এসে দরজায় বেল টিপলেন পোয়ারো। দরজা খুলে গেল।

–আজ্ঞে, কাউন্ট তো বাড়ি নেই।

–আমি জানি তা। তুমি হিপোলাইট ফ্লাভেল না?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

–মেরী ফ্ল্যাভেল তোমার বউ না?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু…

–তোমাদের দুজনকেই আমার দরকার আছে।

বলতে বলতে হিপোলাইটকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন পোয়ারো। তোমার বউ নিশ্চয়ই রান্নাঘরে? হিপোলাইট কিছু বুঝে ওঠার আগেই পোয়ারো হলঘরের উল্টোদিকের দরজা দিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে অদৃশ্য হলেন রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে।

-আরে একি, কোথায় যাচ্ছেন? কি আপদ!–হিপোলাইটও ছুটল ভেতরে।

–আমি এরকুল পোয়ারো।-রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব মেরীকে বললেন।

ততক্ষণে হাঁপতে হাঁপাতে হিপোলাইটও এসে গেছে সেখানে, কি ব্যাপার দেখছ মেরী! কোথাকার,

–এরকুল পোয়ারোর নাম নিশ্চয়ই শুনেছ তোমরা?

–জীবনে কোনোদিন শুনিনি।–সবেগে মাথা নাড়ল হিপোলাইট।

–না, তোমাদের নিয়ে পারা গেল না।–অশান্ত ছোট ছেলের ভঙ্গি করলেন পোয়ারো, কোনো পাঠশালায় পড়েছিলে। এমন একজন নামকরা লোক। সাধারণ জ্ঞানের বই ছিল না তোমাদের ক্লাস-রুটিনে?

দুজনেই বিস্ময়ে ঢোক গিলে বলল, আজ্ঞে মশায়ের আসার কারণটা যদি

-হ্যাঁ বলছি। পুলিশের কাছে সাতটা মিথ্যে কথা কেন বলেছো সেটাই আমার জানা দরকার।

–মিথ্যে কথা। কখনও নয়।রেগে গেল হিপোলাইট।

–কিন্তু ও নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।–পাশেই রাখা একটা টুলে বসে পোয়ারো বললেন, আমি জানতে চাই, কাউন্ট দ্য লা রোচি চোদ্দই জানুয়ারি সকালে এখানে এসেছেন বলে পুলিশের কাছে তুমি জবানবন্দি দিয়েছ কিনা?

কিন্তু সেটা মিথ্যে নয় মঁসিয়ে। উনি চোদ্দই মানে মঙ্গলবার সকালে ফিরে আসেন। কি, তাই না মেরী?

–হ্যাঁ, আমার পরিষ্কার মনে আছে।

–আচ্ছা, সেদিন কি ডিনার দিয়েছিলে মনিবকে।

–ডিনার।….ঠিক মনে করতে পারছি না।

–একই দিনের ঘটনা পরিষ্কার মনে আছে আরেকটা পারছে না। সেদিন তোমার মনিব বাইরে ডিনার খেয়েছেন।-বাঁ হাতের চেটোয় সজোরে ডান হাতে আঘাত করলেন।

-হা হা।

–ওহো মিথ্যে বলছো, ভাবছো কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু দুজনকে ফাঁকি দিতে পারোনি। এক ওঁকে….একটা হাত ওপরে অনন্ত আকাশের দিকে তুলে ধরলেন, আর একজন এই এরকুল পোয়ারো।

-কিন্তু আপনি ভুল করছেন মঁসিয়ে। কাউন্ট সোমবার রাতে প্যারিস ছেড়েছেন।

-হ্যাঁ, তা জানি। কিন্তু তারপর তিনি বেঙ্গনায় আর একদিন কাটিয়েছেন সেটা তুমি, আমি কেউ জানি না। শুধু জানি বুধবার তিনি বাড়ি ফিরেছেন।

উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো; ঠিক আছে বিপদ যখন তোমরা চাইছ; বিপদে পড়।

তার মানে কি বলতে চাইছেন আপনি? –মেরী বলল।

-মাদাম ক্যাথারিন-এর খুনের ব্যাপারে জড়িত আছে সন্দেহে পুলিশ তোমাদের গ্রেপ্তার করবে।

-খুন! কি বলছেন মঁসিয়ে! আমরা খুনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।–ঠক ঠক করে দুজনের পা কাঁপতে লাগল।

–হ্যাঁ, প্রস্তুত থেকো তোমরা।–পোয়ারো যাবার জন্যে পা বাড়ালেন।

 

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

শুনুন, শুনুন সিয়ে, ব্যাপারটা যে এতদূর গুরুতর সে সম্বন্ধে….

–থামো–এক ধমক দিলেন পোয়ারো, নিজের ভালমন্দ বোঝে না এমন দুটো বোকার সঙ্গে বাজে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। শেষবারের মতো বলছি, কবে আর কখন কাউন্ট এই ভিলাতে ফিরে আসেন, মঙ্গলবার না বুধবার?

বুধবার–হিপোলাইট বলল।

–তবু ভালো, সুবুদ্ধি হলো শেষ পর্যন্ত। ভয়ানক বিপদে ফেলতে যাচ্ছিলে নিজেদের তোমরা।

কাউন্ট-এর মারিনা ভিলা থেকে বেরিয়ে পোয়ারো মিরেলির হোটেলের দিকে গেলেন।

কাঁটায় কাঁটায় ছটা। পোয়ারো হোটেলে মিরেলির কাজের ঘরে ঢুকলেন। পোয়ারোকে দেখে মিরেলি জ্বলে উঠল।

কি ভেবেছেন আপনারা? অনেক যন্ত্রণা তো দিয়েছেন এখনও সাধ মেটেনি! আমাকে দিয়ে যা নয় তাই বলিয়ে বেচারা ড্রেককে জেলে দিয়েছেন। আরও চান?

–শুধু ছোট একটা প্রশ্নের জবাব চাই মাদমোয়াজেল। পোয়ারো মিরেলির চোখে চোখ রাখলেন। সেদিন নয়েন স্টেশন ছাড়ার পর কখন আপনি মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিলেন?

-মানে?

–আমি বলছি কখন আপনি মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিলেন?

–কখনোই যাইনি।

-মিথ্যে কথা। গর্জে উঠলেন পোয়ারো। কি হয়েছিল সেদিন, আমি বলছি। আপনি মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকে তাঁকে মৃত দেখেছিলেন। কারণ আমিও কাছাকাছি ওখানেই কোথাও ছিলাম সেদিন। এখনও বলছি আপনাকে, এরকুল পোয়ারোকে মিথ্যে কথা বলার পরিণাম বড় সাংঘাতিক।

–আমি আমি কিছু করিনি…।হঠাৎ থেমে গেল মিরেলি।

–একটা কথাই ভাবি শুধু মাদমোয়াজেল। যার জন্যে আপনি গিয়েছিলেন তা কি পেয়েছিলেন, না আপনার আগেই কেউ সেখানে ঢুকেছিল?

-আর কিছুই বলতে পারব না। দোহাই আপনার। মিরেলি পাশের ঘরে চলে গেল। পোয়ারো বেরিয়ে এলেন হোটেল থেকে, মুখে তার তৃপ্তির হাসি।

.

২৭.

ডিনারএর রায়

মিস ডিনার-এর শোবার ঘরের জানালা দিয়ে ক্যাথারিন বাইরে তাকিয়েছিল। অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে। জানালা দিয়ে সামনের বাগানটা দেখা যায়। বাগানের একপাশ দিয়ে লাল ছোট ছোট নুড়ি পাথরের রাস্তা গেট পর্যন্ত চলে গেছে।

মিস ডিনার একটা পুরানো আমলের খাটে আধ শোয়া অবস্থায় আছেন। পাশেই একটা ট্রেতে প্রাতঃরাশের সামান্য ভুক্তাবশেষ কিছু পড়ে আছে। বৃদ্ধা একমনে সেদিনের চিঠিপত্র পড়ে চলেছেন আর তীক্ষ্ণ ভাষায় নিজের মতামত দিয়ে চলেছেন।

একটা খোলা চিঠি হাতে ক্যাথারিন বসেছিল। ইতিমধ্যে চিঠিখানা ক্যাথারিন দুবার পড়েছে। চিঠির ওপরে লেখা–রীজ হোটেল প্যারিস।

প্রিয় মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন,

নিশ্চয়ই ভাল আছেন। শীতের ইংল্যাণ্ড আশা করি আপনার খারাপ লাগছে না। আমার কাজ আমি যথাসাধ্য আন্তরিকভাবে করে চলেছি। ভাববেন না যেন ছুটি কাটাতে এখানে রয়েছি। খুব শীগগিরই আমাকে ইংল্যাণ্ডে যেতে হবে। তখন আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে। লণ্ডনে পৌঁছেই আপনার কাছে চিঠি লিখব। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।

প্রীতিমুগ্ধ
এরকুল পোয়ারো।

চিঠিখানা হাতে নিয়ে ক্যাথারিন কখন একসময় ভাবের রাজ্যে চলে গেছে, চমক ভাঙল বৃদ্ধা ডিনার-এর তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজে।

–আমি তখনই বলেছি ওদের, এ তোমরা নও, বুঝলে? ক্যাথারিন, লেডী টাম্পলিন-এর বোন। কি ভাবো তোমরা?

–তুমি কি আমার হয়ে সকলের সঙ্গে ঝগড়া করবে নাকি?

তোমার সম্বন্ধে বাজে কথা বললে আমি কি চুপ করে থাকতে পারি বল? আধুনিক সমাজের ঠুনকো আদবকায়দা শেখার জন্যে তুমি নাকি বড়লোকদের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছ

–এ কথা তো সত্যিও হতে পারে মিস ডিনার। আমি যে সে চেষ্টা করছি না, তা কেমন করে জানলে?–কই, আধুনিক সমাজের বেলেল্লাপনা তো দেখছি না। কই, তোমার স্কার্ট তো হাঁটুর ওপরে ওঠেনি আর অসভ্যের মতো জুতোও তো পরোনি।

–একটা কথা বলতে ভুলে গেছি তোমায়। ক্যাথারিন বলল, আমার এক রিভিয়ারার বন্ধু এখানে একদিন আসতে চায়।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বন্ধু মানে পুরুষ মানুষ?

-হ্যাঁ।

–কে সে?

–এক কোটিপতি মার্কিন ভদ্রলোকের প্রাইভেট সেক্রেটারী।

–কি নাম?

–কিংটন। মেজর রিচার্ড কিংটন।

-হুম! কোটিপতির সেক্রেটারী এখানে আসতে চায়। ক্যাথারিন, তোমার ভালোর জন্যে একটা কথা বলি। যদিও তুমি বিচক্ষণ মেয়ে তবুও জেনে রাখ, প্রতি মেয়েই জীবনে একবার না একবার ঠকে। তোমায় যেন একবারও ঠকতে না হয়।

-তাহলে বন্ধুকে আসতে বারণ করে দেব?

-না না, বারণ করবে কেন? তাকে নিশ্চয়ই আসতে বলবে। তোমার বন্ধুকে একদিন লাঞ্চ খেতে বল এখানে। অবশ্য এলেন-এর যা রান্না।

তারপর একদিন যথাসময়ে কিংটন নেমন্তন্ন রাখতে সেন্ট মেরী মিড-এ এলো। বৃদ্ধা ডিনার খুশি হলেন কিংটন-এর সঙ্গে আলাপ করে। অনেক গল্প করে তারপর বিকেলে চা খেয়ে কিংটন বিদায় নিল সেন্ট মেরী মিড থেকে।

ক্যাথারিনকে ডাকলেন ডিনার। না, তোমার লোক চিনতে ভুল হয়নি। পুরুষ মানুষ যতই মেজর কর্নেল হোক না কেন, গভীর ভালোবাসার জালে জড়িয়ে না পড়লে এমন অসহায়ের মতো চেহারা কখনও হয় না।

–তুমি বড় ভালো।–বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল ক্যাথারিন।

 

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

২৮.

ইম্পেসারি  মিঃ অ্যারন

মদের গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিলেন মিঃ জোসেফ অ্যারন্।

আঃ, খুব উৎকৃষ্ট জিনিসই অর্ডার দিয়েছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।-মুখে লেগে থাকা ফেনাটুকু বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিতে নিতে জড়ানো চোখে চাইলেন পোয়ারোর দিকে। হ্যাঁ, এমন জিনিস খেয়েও আরাম, খাইয়েও আরাম। দিন-দিন, ঢালুন–বেশি করেই ঢালুন।

–চিকেন মেয়নিজ?

-হা হা, নিশ্চয়ই দেবেন। কিডনি পুডিং অবশ্যই আমার অত্যন্ত প্রিয় খাবার। অবশ্য অ্যাপ টার্ট দিয়েই আমি খাওয়া শেষ করি।

কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে একের পর এক অর্ডার দিয়ে চললেন পোয়ারো। কিছুক্ষণের জন্যে খাবারের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন মিঃ অ্যার। তারপর একসময় খাওয়া শেষ হলে নেশাগ্রস্ত চোখ তুললেন। কি যেন একটা দরকারী কথা আছে বলছিলেন মিঃ পোয়ারো? যদি আপনার কোনো সাহায্যে আসতে পারি তো বলবেন, আমার যথাসাধ্য করব।

অনেক ধন্যবাদ। মঞ্চ জগৎ সম্বন্ধে কিছু জানতে হলে একমাত্র আপনি ছাড়া তো দ্বিতীয় কেউ নেই, তাই আপনার কথাই মনে হয়েছে সর্বপ্রথম।

নেহাত ভুল বলেননি। বেশ আত্মতৃপ্তির মুখভঙ্গি করলেন অ্যারন্। –মঞ্চ জগতের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সম্বন্ধে কিছু জানতে হলে এই ইম্পেসারি ও জোসেফ অ্যার-এর কাছে আসতে হবে।

–আচ্ছা মিঃ অ্যারন্, কি নামে কোনো যুবতাঁকে এ লাইনে চিনতেন কি?

–কি? কি টি কিড।

–সম্ভবতঃ কি টি কিড।

-খুব চালাক চতুর ছিল মেয়েটা। আর ছেলের ভূমিকায় ভালো করত। গান আর নাচ জানত ভাল। ছেলে সাজলে কেউ ধরতেই পারত না। এর কথাই বলছেন কি?

-হ্যাঁ এরই কথা জানতে চাইছিলাম।

-ওঃ। খুব ভালো রোজগার করত মেয়েটা। ওর বেশির ভাগ কনট্রাক্টই ছিল পরুষ ভূমিকায়। একটা দিন কামাই করত না। কিন্তু স্ত্রী ভূমিকায় অভিনয় করার সময় ও নিজেকে ছুঁতে দিত না কাউকে।

-আমিও তাই শুনেছি। কিন্তু তাকে অনেকদিন ধরে অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে না। জানেন কি?

হ্যাঁ। এক প্রচুর বড়লোক মক্কেল পাকড়ে মঞ্চকে চিরবিদায় জানিয়ে ফ্রান্সে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে।

-কতদিন আগে সেটা?

–দাঁড়ান, ভেবে দেখি। তা বছর তিনেক আগে তো নিশ্চয়ই।

–যার সঙ্গে কিটি গিয়েছিল সেই লোকটি সম্বন্ধে কিছু জানেন কি?

–তিনি তখন পুরোদমে টাকার সমুদ্রে ভাসছেন। কি যেন নাম। কাউন্ট অথবা মাকুইস। এ ধরনের কিছু একটা হবে। সম্ভবতঃ মার্কুইসই।

–আর কিছু জানেন?

-না, আর কিছুই জানি না। এমনি যে কিটির সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখাও হয়নি। আপনাকে আরও কিছু খবর দিতে পারলে খুশী হতাম। কোনো একসময় আপনিও যে আমার যথেষ্ট উপকার করেছিলেন সে কথা জোসেফ অ্যারন্ কোনোদিনই ভুলে যাবে না।

–সে ঋণ তো শোধ হয়ে গেল আপনার।

-উপকারীর উপকারের চেষ্টা সবসময়ই করা উচিত।

–তারপর আপনার কাজকর্ম কেমন চলছে?

-ভালো-মন্দয় চলে যাচ্ছে। দর্শকদের ভোয়ালে কখন কোনোটা ভালো লাগে কখন লাগে না- সবসময় দুচোখ খুলে কাজ করতে হয়।

-আচ্ছা এখন নাচের কদর বেড়েছে বোধহয়, তাই না?

–হ্যাঁ, দর্শকরা নাচটা পছন্দ করে দেখছি।

–মিরেলি নামে এক নাচিয়ের সঙ্গে আলাপ হল রিভিয়ারায়।

–মিরেলি? ওর এখন বাজার গরম। ও না চাইলেও অর্থ যেচে আসে ওর কাছে। তবে আমার এখনও প্রয়োজন হয়নি ওর কাছে যাবার। শুনেছি ভীষণ মেজাজী আর দেমাকী। ব্যবহারও খুব ভালো নয়।

-হ্যাঁ। আমিও একমত। আচ্ছা, মিরেলি কতদিন হলো মঞ্চে এসেছে বলুন তো? খুব বেশিদিন বোধহয় না?

-তা বছর আড়াই হবে। কে একজন ফরাসী ডিউক ওকে এ লাইনে নামিয়েছেন। তারপর মাঝে মিরেলির সঙ্গে গ্রীসের এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর দহরম-মহরম হয়।

–এ খবরটা অবশ্য জানতাম না আমি।

-এখন আবার শুনছি, মিরেলির জন্যেই নাকি ড্রেক ক্যাথারিন তার বউকে খুন করেছে। মিঃ ক্যাথারিন তো হাজতে। অবশ্য মিরেলি হোটেলেই আছে শুনেছি। মিরেলি নাকি কোথাকার একটা খুব দামী এবং ঐতিহাসিক পাথর সংগ্রহ করেছে। নীলা না রুবী কি যেন বলে। এবার বোধহয়…হেসে উঠলেন অ্যারন নাচ ছেড়ে পাথর সংগ্রহের দিকে ঝুঁকবে। ওই রুবী নীলা পরে অনেক জায়গায় মাঝে মাঝে যায় সে।

-রুবী!–পোয়ারোর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বেশ, বেশ।

 

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

–আমাকে আমার এক বন্ধু ইম্পোসারিও কথাটা বলেছে মিরেলিকে নিয়ে তাকে মাঝে মাঝে কাজ করতে হয়। কিন্তু আমি জানি ওসব নামী দামী বাজে কথা। স্রেফ রঙীন কাঁচের। এ ধরনের মেয়ে মানুষেরা ঝুরি ঝুরি মিথ্যে কথা বলে। আর কি প্রমাণ? দুনিয়া সুদ্ধ লোক তো আর পাথর বিশেষজ্ঞ হয়ে বসে নেই। হেসে উঠলেন তিনি আবার। ওর আবার একটা কি যেন একটা হার্ট অব ফায়ার বলে নাম দিয়েছে সে।

–আমার যতদূর মনে পড়ে–পোয়ারো যেন কিছু মনে করতে চাইলেন, ওই হার্ট অব ফায়ার নামে রুবীটা কেনে একটা গলার হারের মধ্যমণি রূপে আছে।

–আপনি কিন্তু এখনও বিশ্বাস করছেন ওটা আসল বলে। আরে মশাই, লাইনের লোক আমি। নানারকমের স্ত্রী চরিত্র দেখছি। নিজেদের গয়না নিয়ে অফুরন্ত মিথ্যে বলতে এদের জুড়ি নেই পৃথিবীতে। হ্যাঁ, একটা সরু প্ল্যাটিনামের চেনে ওটাকে কখনও কখনও গলায় পরে বলে শুনেছি।

-না, গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। ওটা একট মামুলী রঙীন কাঁচ বলে আমি মনে করি না।

.

২৯.

পোয়ারো ক্যাথারিন সংবাদ

স্যাভয় হোটেলের একটা টেবিলে মুখোমুখি বসে পোয়ারো আর ক্যাথারিন গল্প করছিলেন।

-আপনি অনেক বদলে গেছেন মাদমোয়াজেল।

–যথা? চোখ তুলল ক্যাথারিন।

–এই ধরনের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো ঠিক বলে বোঝানো যায় না।

–বয়স বেড়েছে তো, ম্লান হাসলো ক্যাথারিন।

–হ্যাঁ, তা বেড়েছে, কিন্তু বয়স বাড়ার পরিবর্তনের কথা আমি বলছি না। প্রথম যখন আপনাকে দেখি জীবন সম্বন্ধে আপনার আগ্রহ তখন অসীম।

কোটিপতির জীবন থেকে শুরু করে কাঠঠোকরার কাঠ খুঁটে খুঁটে বাসা তৈরি করাও লক্ষ্য করতে ভুলতেন না।

-আর এখন?

-এখন আর সেই কৌতূহল আপনার মাঝে দেখতে পাই না। হয়তো আমার অনুমান ঠিক নয়। তবু কেমন যেন মনে হয় আপনার ক্লান্তি এসেছে।

আমার বৃদ্ধা বন্ধুটির সঙ্গে থাকলে আপনিও ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। একদিন সেন্ট মেরি মিড-এ এসে ওর সঙ্গে আলাপ করে যান। আপনার ভালো লাগবে বৃদ্ধাকে।

ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল। পোয়ারো প্লেট থেকে একটা চিকেন ক্যাসরোলে উঠিয়ে, আচ্ছা আমার বন্ধু হেস্টিংস-এর কথা আপনাকে বলেছি, না? যে আমাকে শামুক আখ্যা দিয়েছে। ওর মতে পোয়ারো নাকি সব সময় একটা আড়ালের ভেতর থেকে তার কাজ করে যায়। এ কথাটাকে আপনি বোধহয় আমাকে ছাড়িয়ে যাবেন।

–কি যে বলেন?

–এরকুল পোয়ারো কখনও বাজে কথা বলে না। এখানে আসার পর আপনার রিভিয়ারার কারো সঙ্গে দেখা হয়েছে কি?

–মেজর কিংটনের সঙ্গে দেখা হয়েছে।

–আচ্ছা। তাই নাকি। তাহলে মিঃ আলডিন লণ্ডনেই আছেন?

–হ্যাঁ।

–কাল অথবা পরশু ওর সঙ্গে দেখা করতে হবে।

–কোনো খবর দেবার আছে ওর কাছে?

–একথা মনে হলো কেন আপনার মাদমোয়াজেল?

–এমনিই মনে হলো।

–মাদমোয়াজেল, আমি বেশ বুঝতে পারছি, আপনি আমাকে কিছু বলবেন। কিন্তু বলছেন না কেন? আমাকে কি বন্ধু ভাবতে পারছেন না? এই ব্ল ট্রেনের ব্যাপারে যেদিন থেকে আমরা দুজনে জড়িয়ে গেছি, সেদিন থেকেই কি আমরা পরস্পর সাহায্যকারী বন্ধু নই?

–হ্যাঁ, কিছু কথা বলার আছে আপনাকে। আচ্ছা প্যারীতে কি করছিলেন আপনি?

–রাশিয়ান এমব্যাসীতে একটু কাজ ছিল।

ও।

-নিরাশ হলেন তো? কিন্তু না, নিরাশ করব না আর। এবার সময় হয়েছে শামুক থেকে বেরিয়ে আসার। হাতের তাস এবার টেবিলে রাখব আমি। মিঃ ক্যাথারিন-এর গ্রেপ্তারের পর কিন্তু আমি সন্তুষ্ট নই।

আমি কিন্তু ভেবেছিলাম মিঃ ক্যাথারিনকে গ্রেপ্তার করালেন আর আপনার কর্তব্যও শেষ হলো।

–একথা মানছি আমি। আমারই একটা পরীক্ষামূলক কাজের ফল মিঃ ক্যাথারিন-এর গ্রেপ্তার হওয়া। কিন্তু এটা না হলে ম্যাজিস্ট্রেট ক্যারেডা এখনও কাউন্টকে অপরাধী করার বৃথা চেষ্ট করে যেতেন। সত্যকে খুঁজে বের করতেই হবে আমাকে। যদিও পুলিশ বলে এই ঘটনার এখানেই শেষ কিন্তু এরকুল পোয়ারো সন্তুষ্ট নন। পোয়ারো বললেন, মাদমোয়াজেল লেনক্স-এর খবর জানেন?

-হ্যাঁ, একটা ছোট চিঠি পেয়েছি। আমার চলে আসার জন্যে লেনক্স খুব রেগে আছে।

-মাদমোয়াজেল! আমি একটা খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। কেউ একজন আছে যে মিঃ ক্যাথারিনকে ভালোবাসে–যদি আমার ধারণা ভুল বলে মনে হয়, দয়া করে আমাকে বলবেন। আর তার মুখ চেয়েই বলছি। আমি ঠিকই করেছি। বরং পুলিশই ভুল করেছে। জানেন, কে সে?

-হ্যাঁ, জানি।

সামনে ক্যাথারিন-এর দিকে ঝুঁকে বললেন পোয়ারো, না মাদমোয়াজেল, না! আমি জানি সত্যকে খুঁজতে গেলেই পথ বারংবার মিঃ ক্যাথারিন-এর কাছেই নিয়ে যাবে, তবু একটা হিসেবে আমার গরমিল থেকে যাচ্ছে কেন?

–কি সেটা?

–সেটা হল নিহত রুথ ক্যাথারিন–এর বিকৃত করা মুখ। শতশত বার নিজেকে প্রশ্ন করেছি স্ত্রীকে খুন করার পরও মৃত স্ত্রীর মুখ নির্মমভাবে থেতলে দেবেন, সত্যিই কি ড্রেক ক্যাথারিন সেই চরিত্রের নোক? মুখটাকে বিকৃত করায় কি স্বার্থ সিদ্ধি হতে পারে? মনের আক্রোশ মেটানো সাধারণতঃ মনস্তত্ব বলে, কাউকে আক্রোশের বসে খুন করতে গেলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আক্রোশ মিটে যায়। মৃতের পরিচয় গোপন করার জন্যেই মাথা কেটে ফেলে। মুখ থেতলে দেয়। সেদিক থেকেও মন সায় দেয় না। একটা মাত্র জিনিসই এই সমস্যায় আমাকে সাহায্য করেছে।

 

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

পকেট থেকে নিজের নোট বইটা থেকে কয়েকটা লম্বা চুল বের করে দেখালেন, মনে পড়ে মাদমোয়াজেল?

ব্লু ট্রেনের সেই কামরায় কম্বলের সঙ্গে এগুলো জড়িয়ে ছিল? সামনে ঝুঁকে ক্যাথারিন সেই চুলগুলো দেখতে লাগল।

–কিছুই ধরতে পারছেন না? কিন্তু অনেক কিছু এর মধ্যে জানতে পারবেন মাদমোয়াজেল।

–একটা জিনিস আঁচ করছি। একটা অদ্ভুত কথা। আর সেইজন্যেই আপনাকে বলছিলাম প্যারীতে কেন গিয়েছিলেন?

–আপনাকে যখন চিঠি লিখি—

–রীজ হোটেল থেকে লেখা চিঠির কথা বলছেন তো?

–হ্যাঁ, রীজ হোটেলের কথাই বলছি। জানেন মাঝে মাঝে আমি খুব বড়লোক হয়ে যাই যখন কোনো কোটিপতি আমার হোটেলে থাকার খরচা দেন।

–কিন্তু সোভিয়েট এমব্যাসী এ ব্যাপারে জড়িত নয়।

-আমি কিছু খবর জানতে গিয়েছিলাম সেখানে। কোনো এক বিশেষ লোকের কাছেই গিয়েছিলাম এবং তাকে ভয় দেখিয়ে এসেছি।

-পুলিশের ভয়?

-না, খবরের কাগজে সেই লোকটির কীর্তির কথা ছাপিয়ে দেবার ভয় দেখিয়েছি। এসব ব্যাপারে ওরা প্রেসকে বেশি ভয় করে।

-তারপর?

-তারপর জানতে পেরেছি কোথায়, কখন, কবে এবং কাকে সেই রুবীটা বিক্রি করা হয়। লোকটাকে চাপ দিতেই সব বলেছে আমায়, এমনকি সেইদিন রুবীটা বিক্রি হবার পর রাস্তায় দেখা সেই লোকটি যে একমাথা সাদা চুল নিয়েও যুবকের মতো চলছিল। তার কথাও বলেছে। যাকে আমি নাম দিয়েছি –মঁসিয়ে লে মাকুইস।

আপনি লণ্ডনে এসেছিলেন কি মিঃ আলডিনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে।

–শুধু সেই জন্যেই নয় আরও কাজ ছিল। একজন মঞ্চজগতের ভদ্রলোক ও হার্লে স্ট্রীটের এক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেছি এবং দুজনের কাছেই কিছু খবর পেয়েছি। এইসব একবার দেখুন আমি যা পাচ্ছি আপনি তা পাচ্ছেন না।

–আমি?

–হ্যাঁ, আপনি। একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছিল। খুন এবং রুবী চুরি করা একই লোকর কাজ কিনা। অনেকদিন পর্যন্ত আমি কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারিনি।

-এখন?

–এখন আমি জানি।

–আমি কিন্তু আপনার মতো বুদ্ধিমান নই মঁসিয়ে। আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখছিলাম।

একই কথা। একই আয়নার সামনে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকে আয়না দেখলে কি হবে? কাউকে সামনে, কাউকে পাশ থেকে দেখা যাবে। মোট কথা দেখা যাবেই। আয়নায় প্রতিফলন হবেই।

–আমি যা ভেবেছি তা হয়তো আপনার অসম্ভব মনে হতে পারে কিন্তু

–হা হা, বলুন।

-দেখুন তো এটা আপনার কোনো সাহায্যে আসে কিনা? একটা খবরের কাগজের কাটিং দিলেন। মিস ডিনার-এর পুরনো সংগ্রহ থেকে পেয়েছি।

কাটিংটা পড়ে গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন পোয়ারো–যে কথা আপনাকে বলছিলাম মাদমোয়াজেল। একই আয়নায় একই জিনিস নানাভাবে রেখে দেখলেও প্রতিচ্ছবি একই দেখাবে।

–আমায় এবার ফিরতে হবে। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। উঠে দাঁড়ালেন ক্যাথারিন। মঁসিয়ে পোয়ারো–

-বলুন মাদমোয়জেল।

–এটা–এটা আর বেশিদূর বুঝতে পেরেছেন–আমি–আমি আর পারছি না। এভাবে।

গলাটা ধরে এলো ক্যাথারিন–এর।

ক্যাথারিন-এর হাত ধরে পোয়ারো আশ্বাস দিলেন, সাহস সঞ্চয় করুন মাদমোয়াজেল। এখন ভেঙে পড়লে কিছুতেই চলবে না। শেষ প্রায় হয়ে এসেছে।

 

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

৩০.

পোয়ারো নতুন কথা

-স্যার। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন।

-চুলোয় যাক। যত সব। রাগে ফেটে পড়লেন আলডিন। আলডিনের অবস্থা দেখে মায়া হলো কিংটন-এর।

–আজ সকালের পত্রিকাটা দেখেছ একবার?–অশান্তভাবে পায়চারি করতে লাগলেন আলডিন।

–একবার চোখ বুলিয়েছি স্যার।

–এখনও পর্যন্ত কাগজগুলো এটা নিয়ে কি নোংরামিই না করে চলেছে।–নিষ্ফল আক্রোশে দুহাতে মুখ ঢেকে চেয়ারে বসে পড়লেন আলডিন। ছিঃ ছিঃ, বাইরে মুখ দেখানা যাচ্ছে না কাউকে। এখন আফশোস হচ্ছে, এই অপদার্থ বেলজিয়ানটার ওপর রুথ-এর হত্যাকারীকে খুঁজে বার করার ভার দিয়েছি বলে।

–কিন্তু স্যার। আপনার সামনেই বেকসুর নিরপরাধ হয়ে থাকবে এও আপনি নিশ্চয়ই চাইতেন না?

–তার বোঝাপড়া আমিই করতাম।

–স্যার, তাতে আপনার কিছু সুবিধে হতো বলে মনে হয় না।

–এখনই বা কি সুবিধেটা হচ্ছে আমার?–দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন আলডিন। তা, ওকি সত্যিই দেখা করতে চায়?

–হ্যাঁ স্যার, বিশেষ দরকার আছে বলেছেন।

–তাহলে আজ বেলার দিকে আসতে বলো তাকে।

সকাল দশটায় পোয়ারো আলডিন-এর সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখলেন তাকে যেমন সুন্দর আর তেমনি প্রাণবন্ত লাগছে। তিনি প্রাণ খুলে খোশ গল্প করতে শুরু করলেন। বললেন এক ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে লণ্ডনে এসেছিলেন। ডাক্তারের নামও বললেন।

-আমার পুরনো স্মৃতি জড়ানো আছে এই ডাক্তারটির সঙ্গে। তখন পুলিশে কাজ করি। কয়েকটা বদমায়েসকে ধরতে গিয়ে বুলেট লাগে এই কাঁধটায়। তারপর হঠাৎ কিংটন-এর দিকে তাকিয়ে, আচ্ছা আপনার সঙ্গে মিস গ্রে-র দেখা হয়েছে, তাই না?

–আমার সঙ্গে-হ্যাঁ, দু একবার দেখা হয়েছে।

–তাই নাকি! কই আমাকে তো বলেননি কিছু?

–আজ এটা মামুলী কথা বলেই আপনাকে বলিনি।

-না না। মেয়েটিকে আমার ভারী ভালো লাগে। ওই মেয়ে কোথাকার সেন্টমেরি মিড়-এ পড়ে আছে। ভাবলে খুব খারাপ লাগে।

-সত্যিই ভালো মেয়ে। নয়তো অমন একজন খিটখিটে মেজাজের অনাত্মীয়া বৃদ্ধাকে দেখাশোনা করার জন্যে কে অত মাথা ঘামাতো? কিংটন বললেন।

-তা যাই বলুন, ক্যাথারিন-এর মতো মেয়ের এ এক অপমৃত্যুই বলা যায়। বললেন পোয়ারো। আচ্ছা, এবার কিছু কাজের কথা বলব আপনাদের। ধরুন ড্রেক ক্যাথারিন তার স্ত্রীকে খুন করেননি।

-মানে?

দুজনেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলেন পোয়ারোর দিকে।

–ধরুণ আমি বলছি, মিঃ ড্রেক ক্যাথারিন তার স্ত্রীকে খুন করেননি।

–আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি মঁসিয়ে?

-না মঁসিয়ে আলডিন, পাগল আমি নই। তবে লোকে বলে আমি না কি অদ্ভুত স্বভাবের লোক, খামখেয়ালী। যাকগে, যা বললাম তা যদি সত্যি হয়, আপনি তাহলে আনন্দিত না দুঃখিত হবেন?

–নিশ্চয়ই আনন্দিত হব। কিন্তু একি আপনার নেহাতই কল্পনা না এর পেছনে কোনো বাস্তবতা আছে?

-একটা ঝুঁকি নিয়ে দেখব ঠিক করেছি। কারণ আমার মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত কাউন্টই হবেন বোধহয়। অন্তত ওর পক্ষে যে অসম্ভব ছিল না সেটাই খুঁজে বের করেছি।

পোয়ারো কড়িকাঠের দিকে দেখতে লাগলেন।

-কি করে বের করলেন?

–আমার কতগুলো নিজস্ব পদ্ধতি আছে। আর আছে কৌশল ও বুদ্ধি। তাই দিয়েই বের করতে হয়েছে।

–কিন্তু রুবীর ব্যাপারটা; কাউন্ট-এর কাছ থেকে যে রুবী পাওয়া গেছে সেগুলো তো নকল?

–একমাত্র রুবীগুলোর জন্যেই কাউন্টের পক্ষে এই অপরাধ করা সম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু একটা জিনিষ আপনারা লক্ষ্য করছেন না; সেটা হলো, শুধু যদি রুবীর ব্যাপারটা ধরেন তাহলে এও সম্ভব যে কাউন্ট-এর আগে আর কেউ হয়তো সেখানে গিয়েছিল, যার পক্ষে রুবীগুলো নিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। আর যার ফলে কাউন্ট হত্যা করার পরও রুবীগুলো পায়নি।

এতো সম্পূর্ণ নতুন কথা বলছেন মঁসিয়ে উত্তেজিত হলো কিংটন। এভাবে কেউই তো চিন্তা করিনি।

আপনি কি এই অদ্ভুত সম্ভাবনার কথা বিশ্বাস করেন মঁসিয়ে পোয়ারো?–আলডিন জানতে চাইলেন।

-দেখুন মিঃ আলডিন, এটা আমার অনুমান মাত্র, এখনও কিছু প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু আমার এই অনুমানের প্রতিটি সূত্রই খুব মূল্যবান। সেইজন্যেই আপনাকে আমার সঙ্গে ফ্রান্সের দক্ষিণে একবার যেতে হবে এবং ঘটনাস্থানে থেকে আমাদের কাজ করে দেখতে হবে।

-আপনি কি বাস্তবিকই আমার যাওয়া প্রয়োজন মনে করেন মঁসিয়ে।

–সেই প্রয়োজনটা আপনি নিজে ভেবে দেখুন মিঃ আলডিন।

–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। তা কবে যাবেন ঠিক করেছেন? আপনার কিন্তু এখন পরপর অনেকগুলো বোর্ড মিটিং আছে স্যার। –কিংটন মনে করিয়ে দিলেন।

-কিন্তু এটাই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আমার কাছে। ঠিক আছে মঁসিয়ে পোয়ারো, কালই যাবো। বলুন কোনো ট্রেনে যাবেন?

–আমি ঠিক করেছি, ব্লু ট্রেনেই যাবো আমরা। হাসলেন পোয়ারো।

গৃহের আকর্ষণে - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
আগাথা ক্রিস্টি

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

Bangla Gurukul Logo গৃহের আকর্ষণে রচনা - দি মিস্ট্রি অফ ব্লু ট্রেন ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

হোটেলের পথে চলতে চলতে -মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস (১৯২৩) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

লন্ডন এক্সপ্রেস -মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস (১৯২৩) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

তেল ইয়ারিমাহ -মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

দ্য ইনক্রেডিবল থেফট -মার্ডার ইন দ্য মিউস (১৯৩৭) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

আত্মহত্যা নাকি খুন -মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment