বাংলা গদ্যসাহিত্য, বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ প্রতিবেদন রচনা [ Bengali prose literature ]

বাংলা সাহিত্য আমাদের জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য ও প্রাণবন্ত অঙ্গ। এর জন্ম, বিকাশ এবং রূপান্তরের প্রতিটি ধাপে বাংলাভাষী মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ, জীবনদর্শন ও সামগ্রিক সমাজচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্য শুধু কালের সাক্ষ্য নয়, এটি জাতির মনন ও আত্মপরিচয়ের ভাষ্যপাঠ। সেই বিবেচনায় বাংলা সাহিত্য শুধু শিল্প নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনার ধারক ও বাহক।

বাংলা সাহিত্যের মূলত দুইটি প্রধান শাখা—পদ্য ও গদ্য, যেগুলো পরস্পরকে পরিপূরক হিসেবে ধারণ করে এসেছে। পদ্য সাহিত্যে রয়েছে কবিতা, ছড়া, গান, কাব্যগ্রন্থ ইত্যাদি; যেগুলো আবেগ, সুর, ছন্দ ও কল্পনার মাধ্যমে মানুষের অন্তর্জগতে স্পর্শ করে। অপরদিকে গদ্য সাহিত্য, বাস্তবতার ভিত্তিতে চিন্তা, বিশ্লেষণ ও যুক্তির প্রকাশ ঘটায়। প্রবন্ধ, রম্যরচনা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি প্রভৃতি বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিচিত্র ধারাকে রচনা করেছে।

বিশেষত বাংলা গদ্যসাহিত্য তার উদ্ভবকাল থেকে ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে আজ এক বিস্তৃত ও গভীর সাহিত্যভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় রচনার গদ্য থেকে শুরু করে আধুনিক কথাসাহিত্য পর্যন্ত বাংলা গদ্যের বিকাশধারা আমাদের সাহিত্যজগতে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। গদ্যের মাধ্যমেই ভাষার গঠন, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ-মনস্তত্ত্বের জটিলতা সরাসরি পাঠকের সামনে প্রতিভাত হয়।

এই প্রতিবেদনে আমরা বাংলা গদ্যসাহিত্যের জন্ম, বিকাশ ও বিবর্তনের ধারাবাহিক পথরেখা অনুসন্ধান করব। পাশাপাশি গদ্য সাহিত্যের বিভিন্ন উপপ্রকার, এর ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, সাহিত্যিক অবদান এবং সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠকগণ বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ—গদ্যসাহিত্য সম্পর্কে একটি গভীর, সুসংহত ও প্রাজ্ঞ ধারণা লাভ করতে পারবেন, যা আগামী প্রজন্মের সাহিত্যসাধনাকেও আলোকিত করবে।

 

Table of Contents

বাংলা গদ্যসাহিত্য, বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ প্রতিবেদন রচনা

 

বাংলা গদ্যসাহিত্য রচনার ভূমিকা :

আমরা যে জগতে বসবাস করি, সেই দৃশ্যমান জগৎ একটি অনন্ত রূপ-রসের উৎস। প্রকৃতির বুকে নিত্য প্রবাহমান রঙ, রেখা, গন্ধ, শব্দ, আলো ও ছায়ার খেলায় ফুটে ওঠে জীবনের বহুবর্ণ সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য মানুষকে শুধুমাত্র দেখায় নয়, বরং অনুভব করতে শেখায়। সেই আদি মানব, যিনি প্রথমবার এই বিস্ময়কর সৃষ্টি-সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তিনিও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন বিস্মিত ও বিমোহিত হয়ে—তাঁর হৃদয় নিঃশব্দে বলে উঠেছিল: “এ আমি কেমন করে ধারণ করি?”

মানুষ জানার জন্য জন্মেছে, বুঝতে চায়, নিজের চারপাশের জগৎকে নিজের ভেতর গ্রহণ করতে চায়। সে চায় প্রকৃতির মর্মর ধ্বনি, আকাশের নীলিমা, পাখির কলতান, নদীর কলকল ধারা—এসব তার হৃদয়ের ভাষায় রূপ পাবে, তার অনুভবের আয়নায় প্রতিফলিত হবে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়াই হল শিল্প। শিল্প হলো সেই অনুশীলন, যার মাধ্যমে মানুষ তার দেখার জগৎকে অনুভবের রূপে রূপান্তরিত করে। আর সেই শিল্পের এক পরিণত রূপ হচ্ছে সাহিত্য, বিশেষ করে গদ্যসাহিত্য

রুশ মনীষী লিও তলস্তয় একবার বলেছিলেন—

“শিল্প হলো শিল্পীর অভিজ্ঞতাপ্রসূত অনুভূতির এমন এক রূপায়ণ, যা রঙ, শব্দ, ভাষা কিংবা রূপকের মাধ্যমে অন্যের মনে সঞ্চারিত হয়।”

এই সংক্রমণই সাহিত্যকে করে তোলে জীবন্ত। আর সাহিত্য যখন গদ্যের সরল ভাষায় এই অনুভবকে রূপ দেয়, তখন তা হয়ে ওঠে ভাবনার শরীর, যুক্তির গঠন এবং অনুভবের নির্যাস। কবিতায় যেখানে আবেগ প্রবল, সেখানে গদ্যে যুক্তি ও বিশ্লেষণ সমন্বিত হয়ে রচে এক বাস্তবতার পাঠ—যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে ও সমাজকে আত্মবিশ্লেষণের আলোকে দেখতে পায়।

বাংলা গদ্যসাহিত্যের রচনার প্রেরণা এই মানবিক অন্তর্জিজ্ঞাসা ও জগৎ-জয়ের তৃষ্ণায় উৎসারিত। গদ্যের মাধ্যমে মানুষ তার অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি, ভাবনা, প্রতিবাদ, প্রশ্ন, সমাজ ও সংস্কৃতির চিত্র এক ছন্দহীন কিন্তু প্রাণময় ভাষায় রচনা করে। এই গদ্য হয়ে ওঠে সময়ের দলিল, সমাজের প্রতিচ্ছবি এবং মানুষের মনের মানচিত্র।

তাই বলা যায়, বাংলা গদ্যসাহিত্যের রচনার পেছনে রয়েছে মানুষের প্রকৃতি-প্রণোদিত বিস্ময়, সত্যের সন্ধান, জীবনের ব্যাখ্যা এবং ভাব-ব্যঞ্জনার শিল্পরূপ। গদ্য সাহিত্যের ভাষা শুধু ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, তা হয়ে উঠেছে আত্মপ্রকাশ, মতপ্রকাশ ও বোধপ্রকাশের এক সৃজনশীল ভাষ্যপট।

 

বাংলা গদ্যসাহিত্য :

বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ভুবনে গদ্যসাহিত্য আজ সর্বাধিক প্রভাবশালী একটি শাখা। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ধারায় গদ্যের অবাধ বিচরণ লক্ষণীয়—গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি থেকে শুরু করে এমনকি আধুনিক কবিতাও আজ অনেকাংশে গদ্যভিত্তিক হয়ে উঠেছে। একসময় যেমন প্রবন্ধ লেখা হতো ছন্দ ও অলংকারমণ্ডিত কবিতায়, আজ সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে যুক্তিনির্ভর, পরিশীলিত গদ্য। বলা যায়, আধুনিক সাহিত্যিক প্রকাশের প্রধান মাধ্যম আজ গদ্য—এমনকি জীবন ও বাস্তবতাও যেন গদ্যের কাঠামোয় পরিচালিত।

গদ্য একসময় সাহিত্যের অন্তঃস্থ সীমায় অবস্থান করলেও বর্তমানে তার চরম বিকাশ ও প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বাংলা গদ্যের মাধ্যমে সমাজ, রাজনীতি, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস—সবকিছু প্রকাশের এক বলিষ্ঠ পথ তৈরি হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে গদ্য তার গঠন, ভাষা, ভঙ্গি ও অভিব্যক্তি পরিবর্তন করে সাহিত্যের মূলধারাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

আধুনিকতা ও গদ্যের সম্পর্ক

উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের যে নবজাগরণ সূচিত হয়, তা কেবল রূপে নয়, গভীরতাতেও সাহিত্যের গতিপথ বদলে দেয়। এই সময় মানুষ যুক্তিকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে, সমাজ-সংস্কার, ধর্মীয় উদারতা ও মানবিক মূল্যবোধে আকৃষ্ট হয়। আবেগ ও কল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয় যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ, যা সাহিত্যে এনে দেয় এক নতুন মাত্রা। এই পরিবর্তনের ধারক হিসেবে গদ্য নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলে।

আধুনিক সাহিত্যের এই নবআলো বাংলা গদ্যের চরিত্র কাঠামোকে করে তোলে সময়োপযোগী ও চিন্তাশীল। উনিশ শতকে বাংলা গদ্য কেবল ভাষার বাহন নয়, দর্শন সমাজচেতনার মুখপাত্র হয়ে ওঠে। তাই বলা যায়, আধুনিকতার সূচনা যেমন গদ্যের বিকাশে প্রভাব ফেলেছে, তেমনি গদ্যও আধুনিকতার বাহক হিসেবে সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়েছে।

 

গদ্যসাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ : ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছাপাখানা

বাংলা গদ্যসাহিত্যের আধুনিক বিকাশে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। এই কলেজের পণ্ডিত ও অনুবাদকগণ বাংলা গদ্যকে সহজবোধ্য, প্রমিত ও সরল রচনাশৈলীতে পরিণত করার প্রয়াসে এগিয়ে আসেন। এর ফলে এক নতুন ধারার গদ্যশৈলী গড়ে ওঠে, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পায়।

এর সঙ্গে মুদ্রণযন্ত্রের প্রবর্তন—ছাপাখানার প্রতিষ্ঠা—বাংলা গদ্যসাহিত্যের সম্প্রসারণে বিপ্লব আনয়নে সাহায্য করে। বই ছাপানোর সুবিধায় গদ্যভাষার প্রচার, প্রসার ও পাঠকসৃষ্টি দ্রুততর হয়। এই প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেন বাংলা গদ্যের আদি রূপকাররা।

 

পথিকৃৎ লেখকদের অবদান
  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০১৮৯১) বাংলা গদ্যকে সংস্কার, সংযম ও সরলতার মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলেন। শিশুদের জন্য ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে শুরু করে কাব্য ও প্রবন্ধের ভাষাতেও তিনি বাস্তবধর্মী এবং যুক্তিবোধসম্পন্ন গদ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন।
  • প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪১৮৮৩) পseudonym হিসেবে ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ নামে রচিত আলালের ঘরের দুলাল বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর রচনায় উঠে এসেছে সমকালীন সমাজজীবনের হাস্য-বিদ্রূপ ও ব্যঙ্গচিত্র।
  • কালীপ্রসন্ন সিংহ রম্যগদ্য ও বিদ্রুপ রচনায় দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর অনুবাদিত মহাভারত ও বিভিন্ন ব্যঙ্গাত্মক রচনা বাংলা গদ্যের সম্ভারকে সমৃদ্ধ করেছে।
  • মাইকেল মধুসূদন দত্ত আধুনিকতা ও পাশ্চাত্য সাহিত্যচেতনার সংমিশ্রণে বাংলা সাহিত্যে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন। যদিও তিনি মূলত কবি, তবুও ট্র্যাজেডি, প্রহসন, চতুর্দশপদী (সনেট) রচনা এবং নাট্যগদ্যের মাধ্যমে বাংলা গদ্যকে সাহসী ও শৈল্পিক রূপ দেন।
  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রকৃত রূপকার হিসেবে বিবেচিত। তাঁর উপন্যাস, সমালোচনা, প্রবন্ধ, বিদ্রুপাত্মক রচনা বাংলা সাহিত্যে গদ্যের রস ও কাঠামোকে অনন্য উচ্চতায় উন্নীত করেছে। তাঁর হাতে গদ্য হয়ে ওঠে শক্তিশালী, বর্ণনামূলক এবং চিন্তামূলক।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বাংলা গদ্যের বিকাশ :

বাংলা গদ্যের সুসংহত বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য যুগান্তকারী পর্ব। পূর্বে বাংলা সাহিত্যে গদ্যের উপস্থিতি ছিল ছায়ামাত্র—প্রধানত ধর্মীয় অনুবাদ, কাহিনিনির্ভর পদ্য কিংবা মুখের ভাষাভিত্তিক কিছু চিঠিপত্র বা স্মৃতিচারণামূলক রচনায় সীমাবদ্ধ। এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে যখন ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, যা বাংলা গদ্যসাহিত্যের জন্ম ও বিকাশে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।

এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ ছিলেন পাদ্রী উইলিয়াম কেরি, যিনি বাংলা ভাষাকে শাসনকার্য, ধর্মপ্রচার ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে একটি প্রমিত গদ্যশৈলী গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। কেরিকে সহযোগিতা করেন এ দেশের প্রখ্যাত পণ্ডিতগণ—রামরাম বসুমৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার অন্যতম। এঁদের হাত ধরে বাংলা গদ্য পায় প্রথম গঠনমূলক রূপ।

  • রামরাম বসু রচনা করেন প্রতাপাদিত্য চরিতলিপিমালা, যা তথ্যনির্ভর ও সাবলীল ভাষায় রচিত।
  • মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার লেখেন রাজাবলী, হিতোপদেশ, প্রবোধচন্দ্রিকা প্রভৃতি, যা নীতিকথা ও উপদেশমূলক সাহিত্যকে আধুনিক গদ্যে রূপান্তর করে।
  • উইলিয়াম কেরি নিজেই লেখেন শিক্ষামূলক বই কথোপকথন, যা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য গদ্যচর্চার একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করে।

এই গ্রন্থগুলি প্রথম বাংলা গদ্যচর্চার পাঠ্যভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃপক্ষ এগুলো মুদ্রণ করে বিস্তৃতভাবে প্রচার করে। গদ্য ভাষার ব্যাকরণিক গঠন, বাক্যবন্ধের সরলতা, এবং বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে।

 

নবজাগরণের প্রভাতসূর্য : রামমোহন থেকে বঙ্কিমচন্দ্র

এরপর বাংলা গদ্যের বিকাশে সামনে আসেন রামমোহন রায়, যিনি শুধু ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের পুরোধা নন, বরং যুক্তিভিত্তিক প্রবন্ধ ও সমালোচনার ভাষা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ। তার রচনায় উঠে আসে আধুনিক চিন্তার বুনিয়াদ—যা গদ্যকে দেয় যুক্তি, স্পষ্টতা ও সাহস।

তাঁর ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে এক গদ্যপ্রধান সাহিত্যধারা। এই ধারার প্রধান নির্মাতারা হলেন—

  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
  • অক্ষয়কুমার দত্ত
  • তারাশঙ্কর তর্করত্ন
  • ভূদেব মুখোপাধ্যায়
  • রাজনারায়ণ বসু

বিদ্যাসাগর-এর অবদান বাংলা গদ্যসাহিত্যের ক্ষেত্রে অপরিসীম। তিনি যে গদ্যরীতি নির্মাণ করেন, তা পরিচ্ছন্ন, প্রাঞ্জল, মার্জিত এবং যুক্তিবোধসম্পন্ন। তার রচিত বেতাল পঞ্চবিংশতি, সীতার বনবাস, শকুন্তলা, ভ্রান্তিবিলাস, প্রভাবতী সম্ভাষণজীবনচরিত গ্রন্থগুলি বাংলা গদ্যের শৈলী ও কাঠামোয় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

 

বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিস্তৃতি বহুমুখী রূপ

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলা গদ্যসাহিত্যে যুক্ত হয় উপন্যাস, নাটক, আত্মজীবনী, ভাষাবিজ্ঞান, সাহিত্য সমালোচনা, দর্শনচিন্তা, বিজ্ঞান, এবং রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা। এই সময়ই বাংলা ভাষায় রচিত হয় প্রথম উপন্যাস, প্রতিষ্ঠিত হয় দৈনিক সংবাদপত্র ও সাহিত্য সাময়িকী—যা গদ্যচর্চাকে প্রসারিত করে নতুন পাঠকগোষ্ঠী সৃষ্টি করে।

এরপর সাহিত্যাঙ্গনে আবির্ভূত হন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি বাংলা গদ্যকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যমাধ্যমে পরিণত করেন। তাঁর উপন্যাস যেমন দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘আনন্দমঠ, তেমনি তার সমালোচনামূলক ও প্রবন্ধমূলক রচনা বাংলা ভাষার চিন্তাশীল ও মননপ্রবণ গদ্যের উৎকর্ষ উদাহরণ। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ লেখকগণও গদ্যসাহিত্যের বহুবিধ দিক উন্মোচন করেন।

 

ঐতিহাসিক গুরুত্ব মূল্যায়ন

ঊনবিংশ শতক বাংলা গদ্যের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ, ভাষাগত পরিশীলন, এবং বিষয়বৈচিত্র্যের অভূতপূর্ব বিস্ফোরণের শতক। যেখানে মধ্যযুগে শতাব্দীর পর শতাব্দীজুড়ে পদ্যই সাহিত্যের মুখ্য রূপ ছিল, সেখানে উনিশ শতকে মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই গদ্য সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিপুল সাহিত্যভাণ্ডার গড়ে ওঠে। একেকজন লেখক এমন সাহিত্যভাণ্ডার রেখে যান, যা আগের যুগের দশজনের সম্মিলিত রচনার সমান।

অতএব, নির্দ্বিধায় বলা যায়—বাংলা ভাষার গদ্যসাহিত্য উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক উপহার, যা বাংলা সাহিত্যকে কেবল আধুনিক করে তোলে না, বরং একটি প্রাজ্ঞ, বিশ্লেষণী, যুক্তিনির্ভর ও সামাজিকভাবে সচেতন রূপ দেয়।

 

বাংলা গদ্যসাহিত্যে বিদেশীদের অবদান :

বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রারম্ভিক যুগে শুধু পর্তুগিজ ও উইলিয়াম কেরিই নয়, বরং আরও একাধিক বিদেশি লেখক, মিশনারি পণ্ডিত এই ভাষার গদ্যচর্চায় রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। এঁদের মধ্যে কেউ বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনে, কেউ ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে, আবার কেউ ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার অংশ হিসেবে বাংলা গদ্যে কাজ করেছেন।

 

১. জোশুয়া মার্শম্যান (Joshua Marshman, ১৭৬৮১৮৩৭)

উইলিয়াম কেরির ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। তিনিও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং বাংলা ভাষা শিক্ষার উদ্দেশ্যে নানা গ্রন্থ রচনা করেন।

  • তিনি কেরির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন:
    A Grammar of the Bengali Language (1801)
  • বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদের কাজেও তার অবদান ছিল।

তার ব্যাকরণচর্চা বাংলা গদ্যের বাক্যগঠন ভাষাগত পরিশীলনে সাহায্য করে।

 

২. উইলিয়াম হান্টার (William Hunter)

বাংলার ইতিহাস, সমাজ ও ভাষা নিয়ে গবেষণা করতেন। বাংলা ভাষার প্রাথমিক গদ্যরূপ বুঝতে তিনি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও লোকভাষার ভাণ্ডার সংগ্রহে মনোযোগ দেন। যদিও তিনি সাহিত্যিক হিসেবে সরাসরি প্রসিদ্ধ নন, তথাপি বাংলা গদ্যের গবেষণাভিত্তিক চর্চার পথপ্রদর্শক।

 

৩. নাথানিয়েল ব্রাসি হালহেড (Nathaniel Brassey Halhed, ১৭৫১১৮৩০)

বাংলা গদ্যচর্চার ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন ইংরেজ লেখক। তিনি রচনা করেন—

  • A Grammar of the Bengali Language (1778)
    এটি বাংলা ভাষার প্রথম ইংরেজি ভাষায় লিখিত ব্যাকরণগ্রন্থ।

এতে বাংলার ব্যাকরণ ও গদ্যভাষা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। বাংলা গদ্যের ভবিষ্যৎ গঠনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

 

৪. জন গ্ল্যাডউইন (John Gladwin)

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা অনুবাদক ও পণ্ডিত। তিনি বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ধর্মীয় ও নীতিগল্প অনুবাদ করেন এবং বাংলা গদ্যচর্চাকে ধর্মীয় ও নীতিশিক্ষার মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলেন।

 

৫. ড্যানিয়েল লেসলি রিচার্ডসন (D. L. Richardson)

একজন ইংরেজ কবি ও গদ্যকার, যিনি কলকাতায় অধ্যাপনারত ছিলেন এবং বাংলা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অনুবাদ ও পর্যালোচনায় অবদান রাখেন।

 

৬. জেমস লং (James Long, ১৮১৪১৮৮৭)

বাংলাদেশে একজন বিশিষ্ট মিশনারি ও শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ, শিক্ষার প্রসার এবং সমাজসংস্কারে ভূমিকা রাখেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে বহু বাংলা পুস্তক অনূদিত হয়।

 

বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে বিদেশিদের অবদান শুধু শুরুতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি ধারাবাহিক পথপ্রদর্শক ভূমিকা পালন করেছে। পর্তুগিজ, ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় মিশনারিদের এই অবদান ছিল একাধারে—

  • ভাষার প্রাথমিক রূপরেখা নির্মাণ
  • ব্যাকরণ ও অভিধান রচনা
  • ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক পাঠ্যগ্রন্থ প্রণয়ন
  • লোকভাষা ও কথ্যভাষার সংগ্রহ
  • মুদ্রণ ও পুস্তকপ্রকাশের মাধ্যমে বাংলা গদ্যের প্রসার

এঁদের কাজের ভিত্তিতেই পরবর্তী শতকে বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন প্রমুখ সাহিত্যিকরা বাংলা গদ্যকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যরূপে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন

 

গদ্যসাহিত্যে উপন্যাস:

উপন্যাস হল গদ্যসাহিত্যের প্রাণভোমরা—একটি বহুমাত্রিক, বাস্তবধর্মী এবং শিল্পসুষমামণ্ডিত সাহিত্যরূপ, যার কেন্দ্রে থাকে মানুষ এবং তার জীবন। এটি কেবল কল্পনার রচনা নয়; বরং মানবজীবনের প্রতিদিনের হাসি-কান্না, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, প্রেম-বিরহ, স্বপ্ন ও সংগ্রামের এক গাঢ় প্রতিফলন। তাই বলা হয়—উপন্যাস মানেই জীবনের প্রতিচ্ছবি

আধুনিক যুগে সাহিত্যের যে সব শাখা জনপ্রিয়তার শীর্ষে, উপন্যাস তার অন্যতম। কারণ, এই ধারায় একদিকে যেমন বিদগ্ধ পাঠক আত্মজিজ্ঞাসা ও সমাজ বিশ্লেষণের উপাদান খুঁজে পান, অন্যদিকে সাধারণ পাঠকও এতে মনের আনন্দ ও আত্মীয়তা অনুভব করেন। উপন্যাস লেখকের কল্পনা ও অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন—যেখানে ভাষা, প্লট, চরিত্র ও সমাজচিত্রের মধ্য দিয়ে জীবনের বহুরৈখিক রূপ উন্মোচিত হয়।

 

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের অগ্রযাত্রা

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের সূচনা হয় ঊনবিংশ শতকে, আর সেই সূচনার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর)। তাঁর রচিত আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৭) বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ছিল এক ব্যঙ্গাত্মক সামাজিক ছবি—যা পরবর্তীকালে বাংলা উপন্যাসকে জীবনের নানা স্তর অন্বেষণের সাহস দেয়।

এরপর উপন্যাসকে পরিপক্ব রূপদান করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, আনন্দমঠ প্রভৃতি উপন্যাসের মাধ্যমে ঐতিহাসিক, রোমান্টিক জাতীয়তাবাদী চেতনার সংমিশ্রণ ঘটান। বাংলা উপন্যাস এখানে পায় গভীরতা, নাটকীয়তা ও সাহিত্যিক বিশ্লেষণের নতুন দিগন্ত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাসে কেবল প্রেম বা সমাজ নয়—তিনি মানবমন, সম্পর্কের জটিলতা, আত্মসংঘাত, নারীর আত্মপরিচয় প্রভৃতি বিষয়ের অনুপম প্রকাশ ঘটান ঘরে বাইরে, চোখের বালি, যোগাযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে।

 

বাংলা উপন্যাসে বিস্তৃত ধারার নির্মাতা ঔপন্যাসিকগণ

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা বৈচিত্র্যময় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে একাধিক বিশিষ্ট ঔপন্যাসিকের হাতে। যাঁরা বাংলা গদ্যসাহিত্যকে বহুমাত্রিক করে তোলেন:

  • মীর মশাররফ হোসেনবিষাদসিন্ধু (ইসলামী ইতিহাসভিত্তিক কাহিনির সূচনা)
  • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়দেবদাস’, ‘পথের দাবী’, ‘শ্রীকান্ত; মানবিক অনুভূতির গভীর অনুরণন
  • সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়পলাশীর যুদ্ধ’, ‘রাজসিংহ; ইতিহাস ও কল্পনার সংমিশ্রণ
  • প্রমথ চৌধুরী – ভাষাশৈলী ও প্রবন্ধধর্মী গদ্যরীতি প্রচলনে অগ্রণী
  • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা; মনস্তত্ত্ব ও বাস্তববাদের প্রবক্তা
  • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়গণদেবতা’, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা; সমাজজীবনের বাস্তব প্রতিফলন
  • প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশঙ্কর বসু, বিমল মিত্র, সমরেশ বসু, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় – আধুনিক নগরজীবন, প্রেম, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে উপন্যাস নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে—

  • শওকত ওসমান (ক্রীতদাসের হাসি)
  • আবু ইসহাক (সূর্যদীঘল বাড়ি)
  • সরদার জয়েনউদ্দিন, শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজবাস্তবতা নির্ভর উপন্যাসে প্রখর সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করেছেন।

 

আধুনিক সমকালীন বাংলা উপন্যাস : বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ

বাংলাদেশে আধুনিক ও সমকালীন উপন্যাসে গদ্যসাহিত্য এক নতুন গতিপথ লাভ করেছে। বিশ শতকের শেষভাগ একবিংশ শতকের সূচনায় বাংলা উপন্যাসে নতুন ভাষাভঙ্গি, ব্যক্তি-মনস্তত্ত্ব, নগরজীবন, রাজনীতি ও প্রযুক্তি-আসক্ত সমাজ উঠে এসেছে।

উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিকরা হলেন—

  • হুমায়ুন আহমেদ – জনপ্রিয়তা, সহজ গদ্যভঙ্গি, মানবিক অনুভবের অসামান্য রূপকার। নন্দিত নরকে’, ‘জোছনা জননীর গল্প’, ‘কোথাও কেউ নেই প্রভৃতি তাঁর কালজয়ী উপন্যাস।
  • হুমায়ুন আজাদ – তীব্র বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রতিবাদী সাহিত্যচেতনার বাহক (ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল)
  • ইমদাদুল হক মিলন – প্রেম ও সামাজিক দ্বন্দ্ব নির্ভর জনপ্রীতিমূলক উপন্যাস
  • মইনুল আহসান সাবের, আবদুল্লাহ আল মামুন – সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে রচনায় স্বকীয়তা দেখিয়েছেন।

 

বাংলা গদ্যসাহিত্যে উপন্যাস কেবল একটি শাখা নয়এটি এক বিস্তৃত সভ্যতা, যা যুগে যুগে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রেম, সংগ্রাম, মানুষ ও মননের বহুবর্ণ প্রতিফলন ঘটিয়েছে। এই ধারার বিকাশে যেসব ঔপন্যাসিক অবদান রেখেছেন, তারা বাংলা ভাষাকে শুধু সমৃদ্ধই করেননি, বাংলা জাতিসত্তাকেও সাহিত্যের মাধ্যমে একটি আত্মপরিচয় দিয়েছেন।

 

গদ্যসাহিত্যে নাটক:

নাটক হল সাহিত্য ও অভিনয়ের সম্মিলিত রূপ—একটি দৃশ্যকাব্য, যেখানে মানবজীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি রূপায়িত হয় সংলাপ, মঞ্চায়ন ও চরিত্রচিত্রণের মাধ্যমে। নাট্যকার বাস্তবজীবনের ঘটনাকে নাটকীয়ভাবে বিন্যস্ত করে একটি কাহিনির অবয়ব গড়ে তোলেন, যাতে দর্শক ও পাঠক উভয়ই আবেগে উদ্বেলিত হন এবং চিন্তার খোরাক পান।

বাংলাদেশের নাট্যসংস্কৃতির গোড়াপত্তন যাত্রা, পালাগান, কীর্তন ও লোকনাট্যের মধ্য দিয়ে হলেও, বাংলা সাহিত্যে আধুনিক গদ্যনাটকের সূচনা ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। নাট্যরচনার প্রথম প্রয়াসগুলো ধর্মীয়, সামাজিক কিংবা নীতিশিক্ষামূলক হলেও ক্রমে তা রূপ নেয় রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও দার্শনিক অভিব্যক্তির সাহিত্যে।

 

বাংলা গদ্যনাটকের সূচনা প্রাথমিক বিকাশ

বাংলা ভাষায় প্রথম মৌলিক গদ্যনাটক ভদ্রার্জুন রচনা করেন তারাচরণ শিকদার ১৮৫২ সালে। এটি বাংলা নাটকের এক প্রাথমিক প্রয়াস, যেখানে কাব্যের চেয়ে গদ্যভাষার ব্যবহার নাট্যরূপকে বাস্তবতা ও পাঠযোগ্যতার দিক থেকে এগিয়ে দেয়।

এরপর একে একে নাট্যচর্চায় আত্মপ্রকাশ করেন—

  • রামনারায়ণ তর্করত্নকুলীন কুলসর্বস্ব প্রভৃতি নাটকে সমাজ-সংস্কারমুখী চেতনার প্রকাশ
  • কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র – ব্যঙ্গ, রম্য এবং সামাজিক বিষয়ের নাট্যরূপায়ণে ভূমিকা রাখেন

 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত : নাটকের আধুনিক পথিকৃৎ

বাংলা নাটকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত একটি মৌলিক ও যুগান্তকারী নাম।

  • তিনি বাংলা সাহিত্যে ট্র্যাজেডি নাটকপ্রহসন ধারার সূচনা করেন
  • তাঁর শর্মিষ্ঠা’, ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘একেই কি বলে সভ্যতা’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রভৃতি নাটক সমসাময়িক সমাজ, নীতিবোধ ইউরোপীয় নাট্যচেতনার মিশ্রণে গড়ে ওঠা একটি আধুনিক ধারা প্রতিষ্ঠা করে

 

দীনবন্ধু মিত্র গিরিশচন্দ্র ঘোষ : সামাজিক নাটকের জনক

দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাটকে সামাজিক প্রতিবাদউপনিবেশবিরোধী মনোভাবকে মঞ্চে নিয়ে আসেন।

  • নীল দর্পণ নাটকে তিনি ইংরেজ নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের প্রতিবাদী চিত্র তুলে ধরেন, যা বাংলা গদ্যনাটকে একটি বিপ্লবী পালাবদল আনে।

গিরিশচন্দ্র ঘোষ নাট্যকলার জনপ্রিয় রূপদাতা। তিনি ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, পৌরাণিক ও সামাজিক নাটক রচনার মাধ্যমে মঞ্চনাট্যের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : নাট্যে কাব্য দর্শনের সংমিশ্রণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নাটকে কাব্যিকতা, সংগীত, দর্শন ও মানবতাবাদকে একত্র করে নাট্যসাহিত্যে একটি আত্মবিশ্লেষণমূলক ধারার সূচনা করেন
তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক—

  • রক্তকরবী, চিত্রাঙ্গদা, ডাকঘর, অচলায়তন, রাজা
    এগুলো বাংলা গদ্যনাটকের ভাষা, রূপ, আঙ্গিক ও মনস্তত্ত্বকে করে তোলে নতুনভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য।

 

উনিশ বিংশ শতকের নাট্যকারগণ

বাংলা গদ্যনাট্যে পরবর্তী সময়ে অবদান রাখেন—

  • মীর মশাররফ হোসেনবিষাদসিন্ধু-র লেখক হলেও তার নাটকেও রয়েছে ধর্মীয় মানবতাবাদ
  • কাজী নজরুল ইসলামআলেয়া, মৃত্যুখেলা, ঝিলিমিলি প্রভৃতি নাটকে সাহসী ও সমাজমনস্ক ভাবধারা
  • ইব্রাহীম খাঁ, আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আলী মনসুর, আনিস চৌধুরী – যারা পাকিস্তান আমলের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গদ্যনাট্য নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন

 

সমকালীন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে গদ্যনাট্য

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর গদ্যনাটকে নতুন এক জাতীয় চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, আত্মপরিচয় প্রতিরোধের ভাষা যোগ হয়। এ সময় নাটক হয়ে ওঠে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং প্রতিরোধ, প্রতিবাদ সমাজদর্শনের আয়না

উল্লেখযোগ্য নাট্যকারগণ:

  • আবদুল্লাহ আল মামুনকবর, পাতাল বিজয়, জননী
  • সৈয়দ শামসুল হকনুরলদীনের সারাজীবন, ঈর্ষা, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়
  • মমতাজউদ্দিন আহমেদবকুলপুরের শতবর্ষ, ভাষাচেতনা ও রাজনৈতিক বিদ্রূপ নাটকে ফুটিয়ে তুলেছেন
  • মামুনুর রশীদ – আরণ্যক নাট্যদলের মাধ্যমে সমাজ, কৃষক ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে নাটক রচনা
  • সেলিম আল দীনজন্ডিস বিবিধ বেলুন, হাতহদাই, চাকা প্রভৃতি নাটকে লোকজভাষা, প্রথা জীবনচক্র ভিত্তিক নাট্যশৈলীর অনন্য নির্মাতা

 

বাংলা গদ্যসাহিত্যে নাট্যধারা একটি জীবন্ত শক্তিশালী সাহিত্যরূপ, যা মঞ্চ ও পাঠ—দুই ক্ষেত্রেই মানুষকে আবেগ, চিন্তা ও প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত করে। ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, প্রেম—সবকিছু নাটকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপিত হয়।

গদ্যনাটকের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য মানবচরিত্রের নাট্যীয় রূপান্তর বাস্তব জীবনের বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনার এক শক্তিশালী ভাষা পেয়েছে। এ ধারায় নাট্যকারদের অবদান বাংলা গদ্যসাহিত্যকে বৈচিত্র্যময়, তীক্ষ্ণ ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

 

গদ্যসাহিত্যে প্রবন্ধ :

প্রবন্ধ হল সেই গদ্যরূপ, যেখানে যুক্তি, বিশ্লেষণ, অনুভব ও বোধের সম্মিলনে রচিত হয় একটি প্রাঞ্জল বয়ান। এটি কেবল সাহিত্যরসের বাহন নয়—বরং এক প্রজ্ঞাবান চেতনার বিকাশ, যা পাঠককে ভাবায়, শেখায় এবং চিন্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

বাংলা গদ্যসাহিত্যে প্রবন্ধ রচনা ধারাটি শুরু থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত। এটি কখনও সমাজচিন্তা, কখনও ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম বা রাজনীতি, আবার কখনও নৈতিকতা, সাহিত্য ও মানবতা বিষয়ক বিশ্লেষণমূলক আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

প্রবন্ধ সাহিত্যের সূচনা ও প্রথম পথিকৃৎ

ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের যুগে প্রবন্ধ হয়ে ওঠে চিন্তার মুক্ত প্রকাশের মাধ্যম।

  • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রবন্ধকে ব্যবহার করেন সমাজসংস্কারের হাতিয়ার হিসেবে। বাল্যবিবাহ রদবিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বিধবা বিবাহ প্রসঙ্গ’ প্রভৃতি তার প্রবন্ধ সমাজ ও গদ্য দুই ক্ষেত্রেই ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
  • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রবন্ধে যুক্তি ও ভাবনার নিখুঁত সামঞ্জস্য ঘটান। তাঁর কৃষ্ণচরিত্র’, ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ গদ্যের স্বচ্ছতা, দার্শনিকতা এবং সাহিত্যের সৌন্দর্যকে একত্র করেছে।

 

প্রবন্ধ সাহিত্যে বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের অবদান

প্রমথ চৌধুরী

তিনি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ভাষা ও ভঙ্গিকে করে তোলেন সহজ, ব্যক্তিগত রম্যধর্মী। তাঁর বিরসা সংকলন’, চাবিকাঠি’, আহরণ’ প্রভৃতি প্রবন্ধে রয়েছে রুচিশীলতা, রসবোধ ও দার্শনিক চিন্তার মিশেল।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

তাঁর প্রবন্ধে ইতিহাস, সাহিত্য এবং সমাজমনস্তত্ত্বের চমৎকার বিশ্লেষণ দেখা যায়। গদ্যের সরলতা ও ভাবের গভীরতা তাঁকে গুণী প্রবন্ধকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তিনি শুধু কবি নন, বরং প্রবন্ধকার হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে অনন্য। সভ্যতার সংকট’, ‘আত্মশক্তি’, ‘ধর্ম মানবতা’, ‘সংস্কৃতি সাহিত্য’ প্রভৃতি রচনায় তিনি বাংলা গদ্যকে গভীরতম দার্শনিক উচ্চতায় নিয়ে যান।

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ

তাঁর প্রবন্ধে ধর্ম, সংস্কৃতি ও মুসলিম সমাজসংস্কারের প্রতি সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। তিনি গঠনমূলক সমাজচিন্তার রূপকার।

কাজী নজরুল ইসলাম

তাঁর গদ্য প্রবন্ধগুলো ছিল বিদ্রোহী চেতনায় উজ্জীবিত। যুগবাণী’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ প্রভৃতি রচনায় তার সমাজ, রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ এবং বিপ্লবাত্মক ভাষা বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে শক্তিশালী রূপ এনে দেয়।

মোতাহার হোসেন চৌধুরী

তাঁর প্রবন্ধে বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি ও সাহিত্যিক সুবিবেচনা ছিল অসামান্য। সাহিত্য প্রগতি’, সাহিত্যচিন্তা’ ইত্যাদি গ্রন্থে ভাষার গভীরতা ও সমাজ বিশ্লেষণ দেখা যায়।

. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

তিনি ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানী, সাহিত্যবোদ্ধা ও সমাজচিন্তক। তার প্রবন্ধে ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে ভাষার অন্তর্গত সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। বাংলা গদ্যে তাঁর রচনার ভাষা ছিল মিতকথনমূলক, অথচ গভীর ও সুবিন্যস্ত।

 

প্রবন্ধ বাংলা গদ্যসাহিত্যের এমন এক শাখা, যেখানে যুক্তি, দৃষ্টি ও শিল্প একত্রে কাজ করে। এটি পাঠকের কাছে নতুন ভাবনার দ্বার খুলে দেয় এবং সমকালীন সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে গভীর অনুধ্যানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

ঈশ্বরচন্দ্র থেকে শহীদুল্লাহ—বাংলা গদ্যের প্রবন্ধকারগণ গদ্যকে কেবল কাহিনির বাহন করে রাখেননি; বরং চিন্তাশীল, দার্শনিক, সমাজমনস্ক ও মননপ্রবণ ভাষার রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাংলা গদ্যসাহিত্যের এই ধারা আজও নতুন ভাবনায়, বিশ্লেষণে ও বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

 

পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকী :

বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে পত্র-পত্রিকা সাহিত্য সাময়িকী অসামান্য অবদান রেখেছে। গদ্যের ধারাকে শক্তিশালী ও সজীব করে তুলতে এগুলো ভূমিকা রেখেছে পথপ্রদর্শকের মতো। এই মাধ্যমগুলো বাংলা ভাষার রূপান্তর, ভাষাশৈলী, চিন্তাধারা এবং সাহিত্যবোধে বৈচিত্র্য এনেছে। বাংলা গদ্য যে সহজ, সাবলীল, পরিপক্ব ও আধুনিক রূপে রূপান্তরিত হয়েছে, তার পেছনে এই পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলা ভাষায় প্রথম পত্রিকা : দিগ্দর্শন

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা ছিল দিগ্‌দর্শন (প্রকাশকাল: ১৮১৮)। এটি প্রকাশ করেন শ্রীরামপুর মিশনারিরা। এই পত্রিকায় ব্যবহৃত গদ্য ছিল সহজ ও সরল, পাঠকের বোধগম্যতাকে প্রধান্য দিয়ে নির্মিত। এতে সাহিত্যের পাশাপাশি বিজ্ঞান, ইতিহাস, নৈতিকতা ও ধর্মীয় ভাবনার চর্চা হতো, যা বাংলা গদ্যের বহুমুখী বিকাশে সহায়ক হয়।

সংবাদপত্রের গদ্যচর্চা ও ভাষার বিকাশ

বাংলা গদ্যসাহিত্যকে বেগবান করতে সংবাদপত্র ছিল প্রধান চালিকাশক্তি।

  • সমাচার দর্পণ (প্রকাশকাল: ১৮১৮) – গদ্যভাষার একটি মাইলফলক। এটি বাংলার প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং বাংলা সাংবাদিকতার সূত্রপাত করে।
  • সংবাদ প্রভাকর (প্রকাশকাল: ১৮৩১) – বাংলা গদ্যের শক্তিমান এক মাধ্যম, যা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় ভাষাকে আরও রসমণ্ডিত করে তোলে। এতে রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক সমালোচনা এবং সাহিত্যিক আলোচনা উঠে আসতে থাকে।

এই পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে গদ্যের ভাষা হয়ে ওঠে পরিণত, বলিষ্ঠ ও যুগোপযোগী।

গদ্যের বিকাশে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের ভূমিকা

পত্রপত্রিকার মাধ্যমে বাংলা গদ্যের চর্চায় অবদান রেখেছেন বহু মনীষী—

  • রাজা রামমোহন রায় : সমাচার চন্দ্রিকা, ব্রাহ্মণিক ম্যাগাজিন প্রভৃতি পত্রিকায় যুক্ত থেকে তিনি যুক্তিবাদ, ধর্মসংস্কার ও সমাজচিন্তামূলক প্রবন্ধ লেখেন।
  • ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় : ব্যঙ্গাত্মক গদ্যরীতির সূচনা করেন, যার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকায়।
  • ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত : সংবাদ প্রভাকর-এ তাঁর কবিত্বপূর্ণ গদ্যরীতির প্রভাব সুদূরপ্রসারী, যা বাংলা গদ্যের একটি স্বতন্ত্র শৈলী নির্মাণে সহায়ক হয়।

সাহিত্য সাময়িকীর ভূমিকা

উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বাংলা সাহিত্য সাময়িকীর মাধ্যমে গদ্যসাহিত্যে যুক্ত হয় সাহিত্যের নানা শাখা—

  • গল্প উপন্যাস
  • সাহিত্য সমালোচনা
  • বিজ্ঞান দর্শনচিন্তা
  • ধর্ম নৈতিকতা বিষয়ক আলোচনা

এগুলি কেবল পাঠকের চিন্তাকে প্রসারিত করেনি, বরং গদ্যচর্চায় এক নতুন মাত্রা এনেছে। বিশেষ করে সাধনা, ভারতী, প্রবাসী, মাসিক মোহাম্মদী, সমালোচনাসার, কালান্তর ইত্যাদি সাহিত্য পত্রিকাগুলোতে নানা ভাবধারার প্রবন্ধ, অনুবাদ ও গল্পরচনার মাধ্যমে গদ্যসাহিত্যকে সংহত ও সমৃদ্ধ করা হয়।

 

গদ্যসাহিত্যে চলিত গদ্যরীতি :

বাংলা গদ্যের বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হল চলিত গদ্যরীতি—যা সাহিত্যে স্বাভাবিক কথ্যভাষার অনুরণন তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে বাংলা গদ্য ছিল সদালাপি এবং কখনও সনাতন গাম্ভীর্যপূর্ণ, যা পাঠকের কাছে ছিল কিছুটা দূরবর্তী। এই গাম্ভীর্য ভেঙে গদ্যকে জীবন্ত, সহজ ও আবেগঘন করে তোলেন প্রমথ চৌধুরী। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে চলিত রীতির সুনিপুণ প্রয়োগ শুরু হয় এবং সেটিই হয়ে ওঠে পরবর্তী কালের সাহিত্যের মূলস্রোত।

বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ : চলিত রীতির পূর্বাভাস

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাস ও প্রবন্ধে গদ্যকে প্রথম প্রাণবন্ত রূপ দেন। তাঁর গদ্য ছিল অলংকারবহুল, তবে আবেগ, যুক্তি ও কল্পনার মেলবন্ধনে সে যুগের সাহিত্যে তা বিপ্লব এনেছিল। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গদ্যকে উচ্ছ্বসিত করে তোলেন—

  • গল্পে : ‘ছুটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘সমাপ্তি’ প্রভৃতি কাহিনিতে সংলাপধর্মী সাবলীল গদ্যের প্রয়োগ লক্ষণীয়।
  • উপন্যাসে : ‘গোরা’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘যোগাযোগ’-এর মতো রচনায় ভাবগম্ভীর ও প্রাঞ্জল গদ্য মিলেমিশে এক আশ্চর্য ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে।
  • প্রবন্ধে চিঠিপত্রে : রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব গদ্যরীতিতে পাঠকের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ স্থাপন করেছেন।

তবে রবীন্দ্রনাথের গদ্য এখনো পুরোপুরি চলিত হয়নি। তাঁর গদ্যে কোথাও কোথাও উচ্চকোটির সাহিত্যের ভাষা ও ক্লাসিক কাঠামোর প্রভাব ছিল।

প্রমথ চৌধুরী : চলিত রীতির পুরোধা

চলিত গদ্যরীতির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলা গদ্যের মধ্যে যুক্ত করেন—

  • কথ্যভাষার স্বাভাবিক ভঙ্গি,
  • সংক্ষিপ্ত বাক্যগঠন,
  • সহজ শব্দচয়ন,
  • ও তীক্ষ্ণ যুক্তির প্রকাশ।

তাঁর সম্পাদিত সবুজ পত্র পত্রিকা ছিল চলিত গদ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্র। তাঁর রচনায় যে গদ্যরীতি গড়ে ওঠে, তা ছিল একদম নতুন ধরনের—মননশীল, তাজা, স্পষ্ট এবং গভীর। তাঁর ‘আলঙ্কার-রসকথা’, ‘বিরসা কাব্য’, ‘চারটি প্রবন্ধ’ প্রভৃতি রচনায় এ রীতি পূর্ণতা পায়।

রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের রীতি পরিবর্তন

প্রমথ চৌধুরীর প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর জীবনের শেষভাগে চলিত গদ্যরীতি অবলম্বন করেন। বিশেষ করে তাঁর পরবর্তী কালের চিঠিপত্র ও প্রবন্ধে এই গদ্যরীতির প্রভাব স্পষ্ট। এ গদ্যরীতির মাধ্যমে তিনি পাঠকের সঙ্গে একটি সহজ মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

চলিত গদ্যরীতির তাৎপর্য

চলিত গদ্যরীতি বাংলা গদ্যসাহিত্যের জন্য ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল। এর ফলেই—

  • সাহিত্যজনিত বৌদ্ধিক আলোচনাগুলো সাধারণ পাঠকের নাগালে আসে,
  • পাঠকের ভাষিক স্বচ্ছন্দতা ও বোধগম্যতা নিশ্চিত হয়,
  • বাংলা গদ্য হারায় তার অতিরিক্ত জাঁকজমক এবং হয়ে ওঠে আরও মানবিক, বাস্তব ও প্রাণবন্ত।

বাংলা গদ্যসাহিত্যে চলিত গদ্যরীতি এক যুগান্তকারী রূপান্তর। প্রমথ চৌধুরীর নিপুণ শৈলী, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যিক প্রয়াসের সমন্বয়ে এই রীতি বাংলা গদ্যের সৌন্দর্য ও গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। আজকের সাহিত্যের সহজ, প্রাঞ্জল ও জীবন্ত গদ্য যে চলমান ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে, তার ভিত্তিভূমি স্থাপিত হয়েছিল এই চলিত রীতির পথিকৃৎদের হাত ধরেই।

 

বিশ শতকের গদ্যসাহিত্য:

বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রকৃত শিকড় গাঁথা উনিশ শতকে হলেও, বিশ শতক ছিল এর পরিণত বিকাশ ফলনের শতাব্দী। এ সময় গদ্য কেবল ভাষার বাহন নয়, বরং became the prime medium of nuanced artistic expression—দার্শনিক অনুসন্ধান, সামাজিক সমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণের প্রধান ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এ শতাব্দীতে গদ্য সাহিত্যের সকল শাখা—গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ—নিরন্তর নবত্ব লাভ করে।

ছোটগল্পের শিল্পরূপ ও রবীন্দ্রনাথ

বিশ শতকে বাংলা গদ্যসাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও শিল্পসমৃদ্ধ যে শাখাটি বিকশিত হয় তা হল ছোটগল্প। আর এই শাখার অন্যতম পথিকৃৎ ও শ্রেষ্ঠ শিল্পী হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ‘ছুটি’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘সমাপ্তি’, ‘শেষ প্রশ্ন’ প্রভৃতি ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যায়—যেখানে কেবল কাহিনির বর্ণনা নয়, চরিত্র, অনুভব ও জীবনবোধের সূক্ষ্মতা ফুটে ওঠে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর : চিত্রকলার ভাষায় গদ্য

বিশ শতকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে গদ্যের এক নতুন রূপ সৃষ্টি করেন। চিত্রকলা ও সাহিত্যের সম্মিলনে তার রচনায় দেখা যায় স্বপ্ন, রূপকথা ও ইতিহাসের মিশ্রণ। ‘রাজকাহিনী’, ‘খাগের বাসা’, ‘ভুতের ডাক’, ‘ভারতলক্ষ্মী’ ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ। তাঁর গদ্যে কাব্যিকতা, রহস্য, ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিকতা এক অনন্য শৈলীতে মিশে যায়।

প্রমথ চৌধুরী : চলিত রীতির শৈল্পিক নির্মাতা

প্রমথ চৌধুরী এই শতকে বাংলা গদ্যকে আধুনিক ভাষাশৈলীর এক নতুন বাঁক এনে দেন। চলিত রীতিকে কেবল ব্যবহারিক স্তরে নয়, সাহিত্যিক স্তরেও পরিণত করেন তিনি। তাঁর লেখা ‘আলঙ্কার রসকথা’, ‘চারটি প্রবন্ধ’, ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’ বাংলা গদ্যের ভাষা, যুক্তি ও রুচির উৎকর্ষতার দৃষ্টান্ত। তাঁর সম্পাদকীয় সম্পাদিত ‘সবুজ পত্র’ চলিত গদ্যের পরীক্ষাগার হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।

নাটকে রবীন্দ্রনাথের আধিপত্য

বিশ শতকের নাট্যাঙ্গনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম। তাঁর নাটক যেমন—‘রক্তকরবী’, ‘ডাকঘর’, ‘অচলায়তন’, ‘বিসর্জন’ ইত্যাদি বাংলা নাট্যসাহিত্যের আধ্যাত্মিকতা, প্রতীকবাদ ও রাজনৈতিক চেতনার গভীর প্রকাশ ঘটায়। এই সময়ের অন্যান্য নাট্যকাররাও সক্রিয় ছিলেন, তবে বিশ শতকের প্রধান নাট্যপ্রবাহকে রবীন্দ্রনাথই নেতৃত্ব দিয়েছেন।

গদ্যে মনন ও বিশ্লেষণের উত্থান

এই শতকে গদ্যশিল্প কেবল সাহিত্য রসের বাহক নয়; বরং বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের বিশ্লেষণাত্মক রচনাতেও গদ্যের অসাধারণ সক্ষমতা প্রতিভাত হয়। প্রবন্ধ সাহিত্যে আবির্ভূত হন নজরুল ইসলাম, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ।

 

উপসংহার:

বর্তমান বাংলা সাহিত্যের মর্মমূলে যে শক্তিশালী ও বহুধা বিস্তৃত ধারা প্রবাহমান, তা নিঃসন্দেহে গদ্যসাহিত্য। এটি কেবল ভাষার কাঠামোগত রূপ নয়, বরং মানবজীবনের বিচিত্র অনুভব, অভিজ্ঞতা ও বোধের বহুমাত্রিক প্রকাশভঙ্গি। গদ্যশিল্পীরা হলেন জীবনের নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষক—তাঁরা আনন্দ ও উল্লাস, প্রেম ও বিরহ, আশা ও হতাশা, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির সূক্ষ্ম বিন্যাসকে শব্দে রূপদান করেন। জীবনের পরিপূর্ণতা যেমন এঁদের লেখনীতে উদ্ভাসিত হয়, তেমনি জীবনসংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ দিকটিও নির্ভীকভাবে উঠে আসে।

বাংলা গদ্যসাহিত্য এমন এক সৃজনশীল ক্ষেত্র, যেখানে সময়, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক জীবন্ত দলিল নির্মিত হয়েছে। আবেগ বা কল্পনার রঙিন আবরণ নয়, বরং জীবনের নিরাবরণ বাস্তবতা—তৎকালীন বা সমসাময়িক—এই সাহিত্যের মূল প্রেরণা। আর এভাবেই বাংলা গদ্যসাহিত্য হয়ে উঠেছে বাঙালির সমাজ-চেতনার দর্পণ, ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল এবং সাহিত্যের হৃদপিণ্ড।

এই গদ্যের জোয়ার ভবিষ্যতেও বহমান থাকবে, আর প্রতিটি যুগের পরিবর্তমান বাস্তবতা ও মানবিক অভিজ্ঞতা তার রূপ ও ভাষা পাল্টে নতুন শিল্পভাষায় আত্মপ্রকাশ করবে—এই বিশ্বাসই বাংলা সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারা ও গদ্যসাহিত্যের মহত্ত্বের প্রেরণা হয়ে থাকবে।

Leave a Comment