হার্ডির টেস : “A Pure Woman”? সাহিত্যে নারীজীবনের রূপায়ণ : ইংরেজী সাহিত্যে ভিক্টোরীয় যুগের অন্যতম প্রধান উপন্যাস Tess of the D’Urbervilles-এর লেখক টমাস হার্ডি উপন্যাসটির নামকরণের ব্যাপারে সহসা মনস্থির করতে পারেননি। উপন্যাসটি লেখার ব্যাপারে ১৮৮৭ সালের জুন মাসে প্রকাশনা সংস্থা Tillotson’s-এর সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হবার পরপরই তিনি ঘোষণা করেন, উপন্যাসের নাম হবে The Body and Soul of Sue।
নায়িকার নাম তখন ভেবেছিলেন Sue, এবং এই নামকরণে এটা স্পষ্ট যে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের দৈহিক ও আত্মিক বিষয় নিয়ে আবর্তিত হবে উপন্যাসের কাহিনী। কিন্তু মাত্র তিন সপ্তাহ পরে তিনি উপন্যাসটির নতুন নামকরণ করেন Too Late, Beloved এই নামকরণে “প্রিয়তম” শব্দের ব্যবহার উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে প্রেমের পটভূমির আভাষ পাওয়া যায়। নামকরণের প্রক্রিয়া চলতেই থাকে এবং এক পর্যায়ে তিনি A Daughter of the d’Urbervilles নামকরণের সিদ্ধান্ত নেন।
[ হার্ডির টেস : “A Pure Woman”? সাহিত্যে নারীজীবনের রূপায়ণ ]
ডারবারভিল পরিবারের মেয়েকে নিয়েই যে রচিত হবে এই উপন্যাস তাও স্পষ্ট হয়ে যায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে নায়িকার নাম পরিবর্তনের পর (Sue থেকে Tess) উপন্যাসটির নামকরণ হয় Tess of the D’Urbervilles উপন্যাসের প্রথম অংশের প্রুফ দেখার সময় প্রকাশনা সংস্থা আপত্তি জানায় যে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উপন্যাসের নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়বস্তু রচিত হয়নি এবং তা পরিবর্তনের জন্য লেখককে অনুরোধ জানানো হয়।
আগের উপন্যাসগুলি রচনার ক্ষেত্রে হার্ডির মনোভাব অনেক নমনীয় ছিল এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জনে প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে তিনি পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে হার্ডি কঠোর মনোভাব দেখান এবং যে কোন পরিবর্তনে অস্বীকৃতি জানান। এ কারণে প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়। পরবর্তীতে জনপ্রিয় পত্রিকা Graphic-এ উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন হার্ডি।
এই উপন্যাসের ব্যাপারে হার্ডির অনমনীয় মনোভাব তাৎপর্যপূর্ণ। সমালোচকদের মতে, উপন্যাসটি রচনার সময় লেখক কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র টেসের প্রতি অতিরিক্ত যত্নবান ও সংবেদনশীল হয়ে পড়েছিলেন। Irving Howe মন্তব্য করেছেন, “He is as tender to Tess as is to the world.” আর সম্ভবত সে কারণেই উপন্যাসের নামকরণে তিনি সাব-টাইটেল “A Pure Woman” ব্যবহার করেছেন, যা পক্ষপাতমূলক বিবেচনা করেছেন অনেক পাঠক ও সাহিত্য সমালোচক।
উপন্যাসে দেখি, ঘটনা পরম্পরায় গভীর রাতে এক গহীন অরণ্যে এ্যালেক কর্তৃক ধর্ষিতা হয়েছেন টেস, যদিও তিনি তখন ক্লান্তি ও শ্রান্তিতে গভীর ঘুমে অচেতন। ভিক্টোরীয় যুগের কঠোর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে টেসকে “a pure woman” অভিধায় চিহ্নিত করা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
১৮৯২ সালের ২৩শে জানুয়ারী The Spectator পত্রিকায় সমালোচক R. H. Hutton মন্তব্য করেন, ঐ সাব-টাইটেলে টেসকে সঠিকভাবে বর্ণনা করা যায় না। উপন্যাসটি রচনার সময় হার্ডিও সম্ভবত এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং স্বীয় মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নানাবিধ যুক্তির আশ্রয় নেন। বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনার আগে উপন্যাসে টেসের উপস্থাপন এবং কাহিনীর বিকাশে তাঁর প্রতিকৃতি নির্মাণে হার্ডির মনোভাব বিশ্লেষণ করা যায়।
উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ের (Phase the First) নামকরণ “The Maiden,” কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ের নামকরণ “Maiden No More.” প্রথম অধ্যায়ের কাহিনীতে দেখি, টেস কুমারী, কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ের কাহিনীতে তাঁর কুমারীত্ব হরণ করেছে উপন্যাসের ম্যাকিয়াভেলিয়ান চরিত্র এ্যালেক। সুতরাং এই নামকরণের পেছনে টেসের ব্যক্তিগত জীবনের পরিস্থিতি ছিল প্রধান বিবেচনা। টেসকে উপস্থাপন করা হয়েছে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের এক গ্রামীণ পরিবেশে, মে মাসের লোকনৃত্যের আসরে সঙ্গীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায়।
উজ্জ্বল রোদ প্রতিফলিত হচ্ছিল তাদের আকর্ষণীয় চুলে। ওদের কারো সুন্দর চোখ, কারো আবার নাক দেখতে সুন্দর। অন্যদের মুখাবয়ব ও ফিগার সুন্দর। দু’একজনের আবার সবকিছুই আকর্ষণীয়। খোলামেলা এই লোকনৃত্যের আসরে দর্শকদের সামনে ওরা কিছুটা বিব্রত বোধ করছে। The Pure Drop Inn-এর পাশ দিয়ে সবুজ মাঠের মধ্যে ঢোকার মুহূর্তে একজন তরুণীর চোখে পড়ে অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য। চিৎকার করে টেসকে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে: “হায় বিধাতা, টেস ডারবেফিল্ড, দেখতো তোমার বাবা ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে বাড়ী ফিরছে না?”
দলের মধ্য থেকে এক তরুণী ফিরে তাকান সেদিকে, চমৎকার এক সুন্দরী তিনি, যদিও কারো কারো চেয়ে বেশী আকর্ষণীয় নন। কিন্তু তাঁর কোমল মুখ ও নিষ্পাপ আয়ত দু’টি চোখ তাঁর দৈহিক গড়ন ও চেহারাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। চুলে লাল ফিতা বাঁধা তার, অন্যদের যা নেই। টেস চেয়ে দেখেন, তাঁর বাবা চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে এবং হাত নেড়ে মৃদুস্বরে গান গাইতে গাইতে ঘোড়ার গাড়ীতে বাড়ী ফিরছেন। টেস ছাড়া অন্য সবাই তখন মৃদু হাসছে। টেস কিছুটা ক্রুদ্ধ যে তাঁর বাবা অন্যদের সামনে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করছেন।
“বাবা ক্লান্ত, সেজন্যই” দ্রুত বলে ওঠেন টেস, “কারো গাড়ীতে লিফট নিয়ে বাড়ী যাচ্ছেন। আমাদের ঘোড়ার আজ আবার বিশ্রামের দিন।”
“তোমার সরলতার প্রশংসা করতে হয়, টেস” সঙ্গীদের প্রত্যুত্তর। “সঙ্গে রয়েছে ওর বাজারের থলে, হাঃ হাঃ…।” সঙ্গীদের ঠাট্টায় অস্বস্তি বোধ করেন টেস। তাঁর জবাব, “দেখ, বাবার সম্পর্কে আর কোন ঠাট্টা তামাশা করলে আমি তোমাদের সঙ্গে আর এক ইঞ্চিও এগিয়ে যাব না।” তাঁর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে চিবুকের রং। ভিজে আসে দু’চোখ, মাটির দিকে চেয়ে থাকেন তিনি। টেসের মনে ব্যথা দিয়েছে ভেবে ওরা আর কিছু বলে না।
টেসের অহঙ্কার তাঁকে আর মাথা তুলতে দেয় না। তিনি জানতে চান না বাবা কেন অমন আচরণ করেছেন। অন্য সবার সঙ্গে তিনি এগিয়ে যান আবৃত সবুজ চত্বরে নাচের উদ্দেশ্যে। ওখানে যেতে যেতে টেস স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন।
উপন্যাসে এভাবেই টেসকে উপস্থাপন করেছেন হার্ডি। তবে টেসের বিভিন্ন বর্ণনায় হার্ডির পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারটি সুস্পষ্ট : “A small minority, mainly strangers, would look long at her in casually passing by, and grow momentarily fascinated by her freshness, and wonder if they would ever see her again: but to almost everybody she was a fine and picturesque country girl” (14)।
এই অধ্যায়ের শেষাংশে উপন্যাসের নায়ক এ্যাঞ্জেল উপস্থাপিত। প্রচণ্ড এক ধর্মীয় আবহে তাঁর অবস্থান। তাঁর বাবাই শুধু ধর্মযাজক নন, অন্য ভাইয়েরা ধর্মানুরাগী এবং এ্যাঞ্জেলকে লন্ডনে পাঠানো হয়েছিল ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য, উদ্দেশ্য, পরবর্তীতে ধর্মযাজক হওয়া। কিন্তু এ্যাঞ্জেলের ভালো লাগেনি ধর্মীয় শিক্ষা লাভ। লন্ডনে এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এ্যাঞ্জেল, ফিরে এসে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা ছেড়ে ইহলৌকিক বিষয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠেন তিনি।
অপর দুই ভাইয়ের সঙ্গে তিনি যাত্রা বিরতি করছিলেন। হঠাৎ দূর থেকে টেস ও তার সঙ্গীদের জটলা তাঁর চোখে পড়ে। ইচ্ছে হয় ওদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে। কিন্তু দুই ভাই একেবারেই নারাজ, গ্রাম্য মেয়েদের সঙ্গে লোকজনের সামনে নাচানাচি, যদি কেউ দেখে ফেলে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, এ্যাঞ্জেল নাচের আসরে কিছুটা সময় কাটাবেন, তবে অপর দুই ভাই তাদের যাত্রা শুরু করবে। পরে এ্যাঞ্জেল দ্রুত পদক্ষেপে ভাইদের সঙ্গে মিলিত হবেন। মেয়েদের কাছে পৌঁছে যান এ্যাঞ্জেল। মনে মনে ভাবেন, কাউকে পছন্দ করে তার সঙ্গে নাচবেন।
“এই, এত ভয় পেয়ো না” সহসা লাজুক এক মেয়ের কথায় সতর্ক হন এ্যাঞ্জেল। সবার দিকে তাকিয়ে কাউকে পছন্দ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অপরিচিত মেয়েদের মধ্যে কারো ব্যাপারেই মনস্থির করতে পারেন না। হাতের কাছেই যে ছিল তাকেই বেছে নেন নাচের জন্য। সে কিন্তু লাজুক কথা বলা সেই মেয়েটি নয়। এমনকি সে টেস ডারবেফিল্ডও নয়। বংশ পরিচয়, পারিবারিক ঐতিহ্য কোন কিছুই টেসের জীবনযুদ্ধে সহায়ক হল না, নাচের পার্টনার হিসেবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতে পারল না এ্যাঞ্জেলকে। নাচের এক পর্যায়ে গীর্জার ঘণ্টা ধ্বনি শুনে এ্যাঞ্জেল চলে যেতে উদ্যত হন।
যাবার মুহূর্তে তাঁর চোখ পড়ে টেসের দিকে। নাচের পার্টনার হিসেবে তাঁকে বেছে না নেয়ার জন্য টেসের চোখেমুখে তখনও বিরক্তির ভাব স্পষ্ট। এ্যাঞ্জেলেরও মনে দুঃখ বোধের সৃষ্টি হল জড়তার জন্যে আগে টেসকে না দেখার কারণে। মনের এমন অনুভূতি নিয়েই তিনি মাঠ পেরিয়ে চলে গেলেন। চলতি পথে তিনি পিছনে ফিরে তাকান, ততক্ষণে অন্য মেয়েরা ভুলে গেছে এ্যাঞ্জেলের কথা। কিন্তু ভোলেননি শুধু একজন। দূরে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর অবস্থান দেখে এ্যাঞ্জেল বুঝে নেন, মেয়েটি সেই সুন্দরী যাঁর সঙ্গে তিনি নাচতে পারেননি।

যদিও ব্যাপারটি সামান্য, তবু তিনি বুঝতে পারেন তাঁর না দেখার কারণে মেয়েটি ক্ষুব্ধ। এ্যাঞ্জেলের মনে হল, তাঁকেই কেন নাচের সঙ্গী করা হল না, কেন তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করা হল না। এ ব্যাপারে হার্ডির পরবর্তী মন্তব্যে টেসের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুভূতি প্রকাশিত হয় : “She was so modest, so expressive, she had looked so soft in her thin white gown that he felt he had acted stupidly.” অন্যদিকে, টেসও এ্যাঞ্জেলের মুখোমুখি হবার ব্যাপারটি সহসা ভুলতে পারেন না।
অনেক নাচের পার্টনার পাবার পরও অনেকক্ষণ তাঁর নাচের আগ্রহ হয়নি। তাঁর মনে হয়, ওরা কেউ আগন্তক তরুণের মত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারেনা। যতক্ষণ পর্যন্ত পাহাড়ের ঢালে এ্যাঞ্জেলের অপসৃয়মান অবয়ব দেখা যাচ্ছিল, টেসের মনের অবস্থায় কোন পরিবর্তন হয়নি। পরে তাঁর সঙ্গে নাচতে ইচ্ছুকদের কাউকে তিনি সম্মতি জানিয়েছেন।
উপন্যাসে দেখি সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত টেসের স্বপ্ন, আদর্শ ও জীবন যন্ত্রনার প্রতিচ্ছবি। “Circumstantial will against enjoyment” কে অতিক্রম করার তাঁর বীরোচিত সংগ্রাম এবং তাঁর দুঃখজনক পরিণতির মধ্য দিয়ে। হার্ডির নেতিবাচক জীবন দর্শন “জীবনে ট্রাজেডী অনিবার্য” এর প্রতিফলন। সহজ সরল গ্রামীণ কিশোরী থেকে জীবনযুদ্ধে জর্জরিত জটিল এক নারী চরিত্রে তাঁর উত্তোরণ ঘটেছে। টেসের আত্মসম্ভ্রম ও দায়িত্ব বোধ তাঁর চরিত্রের কেন্দ্রীয় অনুষঙ্গ।
উপন্যাসের শুরুতে ফেরিওয়ালা বাবার ঘোড়ার গাড়ীতে চড়ে বাড়ী যাওয়ার ঘটনায় সঙ্গীদের হাসি-তামাশা টেসের আত্মসম্ভ্রমে আঘাত হানে এবং বাবার কাজটি যে স্বাভাবিক তা প্রমাণ করার জন্য টেস যুক্তির অবতারণা করেন। পরবর্তীতে দেখি, দুর্ঘটনায় পারিবারিক ঘোড়া প্রিন্সের মৃত্যুর দায়দায়িত্ব টেস নিজেই নিয়ে নেন এবং এই দায়িত্ব বোধ থেকেই পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কথা ভেবে মায়ের পরামর্শে ট্রানট্রিজের ডারভারভিলস্ পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে সম্মত হন, যদিও এর আগে মায়ের সে প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
টেসের এই সিদ্ধান্তই তাঁর জীবনে দুর্যোগ নিয়ে আসে। কথিত ঐ ডারভারভিলস্ পরিবারটি আসলে ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের স্টোকস্ পরিবার, আর্থিক সমৃদ্ধির কারণে সম্ভ্রান্ত ডারভারভিলস্ নাম গ্রহণ করে তারা দক্ষিণাঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছে, নির্মাণ করেছে নয়নাভিরাম এক প্রাসাদ। এটা দেখে টেসের কাছে কোন ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারের বাড়ী বলে মনে হয় না, বরং মনে হয় আধুনিক কোন প্রমোদ ভবন।
বিস্মিত টেস যখন ঠিক বুঝতে পারছেন না কি করবেন, তখনই সিগারেট মুখে কিছুটা লম্বা এক তরুণ এসে উপস্থিত। কালো বাঁকানো মোচ, হাবভাবে কিছুটা বর্বরতার ছাপ। চোখ ঘুরিয়ে সামনে এসে সে প্রশ্ন করল, “সুন্দরী, কি করতে পারি তোমার জন্য?” এ ধরনের প্রশ্নে হতবাক হয়ে যান টেস। তরুণটি আরো জানতে চায়, “আমার কাছে এসেছ নাকি মায়ের কাছে?” তরুণের এই আচরণ আরো অস্বাভাবিক মনে হয় টেসের কাছে। ক্ষীণ জবাব দেন, “আপনার মায়ের কাছে এসেছি।”
“মা’র সঙ্গেতো দেখা হবে না, তিনি পঙ্গু।… তোমার কাজটা কি আমি করতে পারি না? কি বিষয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে চাও?”
“এটা তেমন কোন বিষয় না — ঠিক বলতে পারছি না …।”
“তাহলে প্রমোদ?” “না না, কি যে বলেন।… আসলেই ব্যাপারটি বোকামী হয়েছে…
আপনাকে ঠিক বলতে পারছি না,” ভেঙ্গে ভেঙ্গে জবাব দেন টেস। “কোন অসুবিধা নেই, বোকামীর ব্যাপার-স্যাপার আমার পছন্দের। বলে
ফেল, প্রিয়তম।”
ইতস্ততঃ টেসের জবাব, “মা আসতে বললেন, অবশ্য আমিও আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ব্যাপারটা এমন হবে ভাবিনি। মহোদয়, আমি এসেছি এ কথা বলতে যে আমরা একই পরিবারের।”
“আচ্ছা, আত্মীয়তার কথা বলছ?”
“তোমরাও স্টোকস্?”
“না, আমরা ডারভারভিলস্।”
“6, হ্যাঁ, আমিও তাই বলছিলাম।”
এভাবেই ডারভারভিলস্-এর খোলসে ইন্দ্রিয়পরায়ণ আলেকজান্ডার ওরফে এ্যালেকের টেসের সঙ্গে যোগাযোগ। টেস তাঁর ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত ফিরে যেতে চান, কিন্তু এ্যালেক তাকে নিয়ে বাগানে বেড়াতে যায়, সুন্দরী কাজিন নামে ডাকে, নিজ হাতে মুখে ফল তুলে দেয় টেসের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও। পরে টেসের জন্য কিছু লাঞ্চ নিয়ে আসে এ্যালেক।
টেস যখন খাবার খাচ্ছেন, এ্যালেক সিগারেটের কুণ্ডলী ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে টেসকে দেখতে থাকে। হার্ডির মন্তব্য: সিগারেটের নীল ধোঁয়ার পেছনে তাঁর জীবন নাটকের ট্রাজিক পরিণতির রূপরেখা প্রণীত হয়। “… Tess Durbeyfield did not divine, as she innocently looked down at the roses in her bosom, that there behind the blue narcotic haze was potentially the ‘tragic mischief of her drama. ..” (47) I
টেসের জীবনের ট্রাজিক পরিণতি ঘটে উপন্যাসের দশম অধ্যায়ে। সেপ্টেম্বর মাসের এক শনিবার হাটের দিনে অনুষ্ঠিত হয় এক মেলা। কিছুটা দেরীতেই মেলায় যান টেস। কেনাকাটা শেষে টেস খুঁজতে থাকেন ট্রানট্রিজের অন্য কুটিরবাসীদের। ওদের অনেকেই তখন চলে গেছে, অন্য সবাই নাচের আসরে মগ্ন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টিসীমার মধ্যে ধরা পড়ে রাস্তার কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা এ্যালেক।
“আরে, সুন্দরী তুমি! এখানে এত দেরীতে?” টেস জানান সঙ্গীদের সাথে বাড়ী ফিরতে তিনি অপেক্ষা করছেন।
“আবার দেখা হবে” ঘাড় ফিরিয়ে বলে এ্যালেক। টেস তখনও সঙ্গীদের খুঁজছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেন টেস। সঙ্গীদের কেউ কেউ ফিরতে চায়, তবে অন্যরা আবার নাচের আসরে বসে পড়ে। টেস অসহায় বোধ করেন; তাঁর অস্থিরতা বেড়ে যায়। তিনি ভাবেন, এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর আরো অপেক্ষা করতে হবে। রাস্তায় বাজে লোকের ভীড় বাড়ছে। অজানা আশঙ্কায় তাঁর মন কেঁপে ওঠে। নিজ গ্রাম মারলটে থাকলে তিনি কম ভয় পেতেন।
নাচে তাঁর আপত্তি নেই, তবে এখানে এই পরিবেশে তিনি নাচতে অনিচ্ছুক। অপেক্ষার এক পর্যায়ে পেছন ফিরে টেস দেখলেন জ্বলন্ত সিগারের আগুন। এ্যালেক একাকী দাঁড়িয়েছিল সেখানে। টেসকে সে ইশারায় কাছে ডাকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেস এগিয়ে যান।
“সুন্দরী আমার, এখানে কি করছ?”
সারাদিনের ক্লান্তির কথা টেস তাকে বলেন; বলেন তার অন্তহীন অপেক্ষার কথা।
“মনে হচ্ছে ওরা সহসা যাবে না, আমি আর দেরী করতে পারছি না” টেস বলেন।
“অবশ্যই দেরী করোনা। সঙ্গে আমার ঘোড়া আছে। … চল তোমাকে বাড়ী নিয়ে যাই।”
কিন্তু এ্যালেকের ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে পারেন না টেস। সঙ্গীদের সাথে পায়ে হেটেই তিনি বাড়ী ফিরতে চান। এ্যালেককে বলেন, তাঁর কাছে তিনি নানা ব্যাপারে ঋণী, তাকে আর কষ্ট দিতে চান না।
“বলেছি তো, ওদের জন্য অপেক্ষা করব। আর ওরাও আমাকে খুঁজবে” টেসের জবাব। টেসের বার বার প্রত্যাখ্যানে ক্ষুব্ধ এ্যালেক। তার ব্যঙ্গাত্মক জবাব, “ঠিক আছে, মিস স্বাধীনতা, যা খুশী তাই কর। তাহলে আমি আর তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরছি না …।” কিছুক্ষণ পর ট্রানট্রিজের কুটিরবাসীরা জড়ো হচ্ছে একে একে, কিন্তু নানা ঝগড়ায় তারা লিপ্ত। তাদের এ অবস্থায় টেস লজ্জিত ও ক্ষুব্ধ।
এদের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূরে যেতে চান টেস, যদিও তিনি জানেন, এদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের আচরণের জন্য কাল অনুতপ্ত হবে। সবাই মাঠের মধ্যে এসে পড়েছে। টেস একাকী দ্রুত পায়ে ফিরতি পথে, এমন সময় একজন ঘোড়সওয়ার নিঃশব্দে ঝোপের কোণা থেকে এসে বেরিয়ে এল। এ্যালেক তাদের দিকে চেয়ে দেখল।
“তোমাদের এত হৈ চৈ কিসের?” সে জিজ্ঞাসা করল।
সহসা কোন জবাব এল না। আসলে তার কোন জবাবের প্রয়োজনও ছিলনা। অন্য সবার কাছ থেকে কিছুটা দূরে ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন টেস। তাঁর কাছে এসে এ্যালেক ঝুঁকে পড়ে, ফিস ফিস করে বলল, “আমার পিছনে লাফিয়ে ওঠ, বিড়ালদের চিৎকার থেকে আমরা মুহূর্তেই দূরে চলে যাব।” সে মুহূর্তে সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মধ্যে ছিলেন টেস। প্রায় জ্ঞান হারাবার অবস্থা।
জীবনের অন্য কোন মুহূর্তে এ ধরনের আহ্বান তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন, যেমনটি তিনি আগেও অনেকবার করেছেন। কিন্তু সঙ্কটময় মুহূর্তের সন্ধিক্ষণের এই আমন্ত্রণ তাঁর ঘৃণা ও ভীতিকে প্রতিপক্ষের ওপর এক ধরনের বিজয়ে রূপান্তরিত করে দিল। আবেগের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে ফটক ডিঙ্গিয়ে এ্যালেকের পিছনে ঘোড়ায় চড়ে বসলেন টেস।
অন্যরা ঘটনাটি বুঝে ওঠার আগেই ওরা দ্রুত অপসৃয়মান। “The Maiden” পর্বের শেষ অধ্যায়ে দেখি এ্যালেকের সাথে ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে যাচ্ছেন টেস, মুখে কোন কথা নেই। টেস এ্যালেককে জড়িয়ে বসেছেন, নিজের বিজয়ে উচ্ছ্বসিত, যদিও কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ। টেস করলেন, সবসময় তেজস্বী ঘোড়ায় এ্যালেক চড়ে, আজকের সেটি তবুও এ্যালেককে জড়িয়ে বসার পরও তাঁর আসনটি ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি এ্যালেককে অনুরোধ হাটিয়ে
সুন্দরভাবে কিছু করা হল, তাই না প্রিয় টেস?”
আপনার আমি ঋণী,” টেসের জবাব।
“আসলেই তাই।”
এ কথার জবাব দিলেন না।
“টেস, তোমাকে দেয়া সবসময় অপছন্দ কেন?”
“আমার আমি আপনাকে ভালবাসি না।”
কি নিশ্চিত?”
“মাঝে আপনার রেগে যাই।”
“হ্যাঁ, আমিও তাই আশঙ্কা করছিলাম।” এই স্বীকারোক্তির কোন প্রতিবাদ করল
“আমাকে কেন যখন আমার কারণে রেগে গেছ?”
“আপনিতো ভাল করেই জানেন কেন, আমারতো এখানে থেকে নেই।”
“প্রেম নিবেদন করে তোমাকে প্রায়ই রাগিয়েছি।”
করেছেন।”
“কতবার করেছি?”
“আপনিও জানেন, আমিও জানি অনেকবার।”
“যতবার চেষ্টা করেছি, সব সময়?”
এবারে টেস নীরব। ঘোড়া এগিয়ে যায় বেশ কিছুদূর স্বচ্ছন্দ গতিতে। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল এক কুয়াশায় চারদিক ঢেকে যায়। ঢাকা পড়ে ঘোড়ার পিঠে দুজনও। চাঁদের আলো হারিয়ে যায় ঘন কুয়াশায়। এ কারণেই হোক নাকি অন্যমনস্কতায়, অথবা ঘুম ঘুম ভাবের কারণে, টেস লক্ষ্য করেননি যে অনেক আগেই তাঁরা সেই স্থানটি ফেলে এসেছেন যেখানে মহাসড়ক থেকে ট্রানট্রিজের সরু রাস্তা চলে গেছে।
“টেসের ক্লান্তি ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ঐ সপ্তাহে প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় তাঁকে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে। প্রতিদিন সারাক্ষণই হাঁটা চলা করতে হয়েছে। আজ বিকেলে আবার বাড়তি তিন মাইল হাঁটা পড়েছে, তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে সঙ্গীদের জন্য, কোন খাদ্য বা পানীয় ছাড়াই। তারপর বাড়ীর পথে এক মাইল হাঁটতে হয়েছে, সঙ্গীদের ঝগড়ার উত্তেজনা তাঁকে স্পর্শ করেছে। আর এখন রাত প্রায় একটা। এরমধ্যে একবারই ঘুমের ঘোরে অজ্ঞাতসারে তাঁর মাথা হাল্কাভাবে স্পর্শ করেছে এ্যালেকের দেহ।” হার্ডির এই দীর্ঘ বর্ণনায় টেসের প্রতি পক্ষপাতিত্বের সুরটি কিন্তু স্পষ্ট।
টেসের কুমারীত্বের শেষ মুহূর্তগুলি হার্ডির ভাষায় প্রাঞ্জলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এ্যালেক ঘোড়া থামিয়ে ঘুমন্ত টেসকে দুর্ঘটনাক্রমে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হাত দিয়ে টেসের কোমর জড়িয়ে রাখে। হঠাৎ সতর্ক হয়ে ওঠেন টেস। কিছুটা প্রতিশোধমূলকভাবে তিনি এ্যালেককে মৃদু ধাক্কা দেন। অসতর্কভাবে ঘোড়ার ওপর থেকে সে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল রাস্তার ওপর।
“কি নারকীয় নির্দয়তা। তোমার কোন ক্ষতি করতে চাইনি, তুমি যেন না পড়ে যাও তাই…” ক্রুদ্ধভাবে উচ্চারণ করে এ্যালেক।
সন্দেহজনকভাবে বিষয়টি ভাবেন টেস। হয়ত সত্য কথাই বলেছে ভেবে টেসের কঠোরতা হ্রাস পায়। বিনীতভাবে বলেন :
সাহিত্যে নারীজীবনের রূপায়ণ
“স্যার, আমাকে ক্ষমা করুন।”
“আমার ওপর বিশ্বাস রাখতে না পারলে আমি ক্ষমা করব না,” এ্যালেক চিৎকার করে বলে। “কি ভেবেছো আমাকে, তোমার মত এক মেয়ে বার বার প্রত্যাখ্যান করবে। গত তিন মাস ধরে তুমি আমার অনুভূতির কোন গুরুত্ব দিচ্ছ না। কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছ, তিরস্কার করছ। আমি তা সহ্য করব না।”
“আমি কালই আপনাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি।”
“না, তুমি কাল যাবে না। আবার বলছি, আমার প্রতি বিশ্বাস রাখ, তোমাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখতে দাও, এখানে আমরা শুধু দু’জন, আর কেউ নেই। আমরা দু’জনেই দু’জনকে ভালভাবে চিনি। আর তুমিতো জান, আমি তোমাকে ভালবাসি, মনে করি তুমি পৃথিবীর সেরা সুন্দরী, আসলেই তুমি তাই। তোমার সঙ্গে কি প্রেমিক হিসেবে আচরণ করতে পারি না?”
প্রচন্ড অস্বস্তির সঙ্গে টেস জবাব দেন, “জানি না, কিভাবে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলব যখন…”
এ্যালেক হাত দিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বিষয়টির নিষ্পত্তি করল, যেমনটি সে ইচ্ছা করেছিল। টেস নেতিবাচক আর কিছু বলেন না। হঠাৎ করেই টেসের মনে হল, অযৌক্তিক সময় ধরে তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন, যা এই স্বল্প দূরত্বের পথে অস্বাভাবিক। তিনি দেখেন, বড় রাস্তা ছেড়ে তাঁরা সরু রাস্তায় চলছেন।
“আরে, আমরা কোথায়?” টেসের আর্তনাদ।
“বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।”
“বনের মধ্যে, কোন বন? নিশ্চয়ই আমরা রাস্তার বেশ দূরে?”
“ইংল্যান্ডের সবচেয়ে পুরানো বনের মধ্যে। এই মধুর রাতে একটু বেশী কেন ঘুরব না?” এ্যালেকের জবাব।
হার্ডির টেস: “A Pure Woman”?
“আপনি এতটা বিশ্বাসঘাতক।” হতাশা ও ক্রোধের সুর টেসের কণ্ঠে। পড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এ্যালেকের বন্ধনমুক্ত হন তিনি।
“যখনই আপনার ওপর বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছি, খুশী করতে চাচ্ছি,
কারণ একটু আগে ধাক্কা দিয়ে অন্যায় করেছি ভেবে — দয়া করে আমাকে নামতে দিন। হেঁটে বাড়ী যেতে দিন।” “হেঁটে বাড়ী যেতে পারবে না, প্রিয়তম, এমনকি যদি আবহাওয়া
পরিষ্কারও হয়। ট্রানট্রিজ থেকে আমরা অনেক মাইল দূরে, যদি সঠিকভাবে বলি,
আর এই ক্রমবর্ধমান কুয়াশায় তুমি বনের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরবে।”
টেস আকুতির স্বরে বলেন, “তাতে কিছু হবে না, দয়া করে আমাকে নামিয়ে দিন। যে জায়গায়ই হোক, কোন অসুবিধা হবে না। শুধু আমাকে নামতে দিন, স্যার, প্লিজ!”
“ঠিক আছে, তবে এক শর্তে, এই অজানা স্থানে তোমাকে আনার পর তোমাকে নিরাপদে বাড়ী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব বোধ করছি, তাতে তোমার অনুভূতি যাই হোক। কোন সাহায্য ছাড়া তোমার পক্ষে ট্রানট্রিজ ফিরে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব । সত্য কথা বলতে কি, কুয়াশা সবকিছু যেভাবে ঢেকে রেখেছে তাতে আমি নিজেই জানি না আমরা কোথায়।
যদি কথা দাও, যতক্ষণ আমি ঝোঁপের মধ্য দিয়ে কোন রাস্তা বা বাড়ী পৌঁছে বুঝে নেব আমাদের সঠিক অবস্থান, ততক্ষণ তুমি ঘোড়ার পাশে থাকবে, তাহলে স্বেচ্ছায় আমি তোমাকে এখানে রেখে যাব। ফিরে এসে আমি তোমাকে পথের সঠিক নির্দেশনা দেব। তখন পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ায় চড়ে যেমন খুশী যেতে পারবে।”
টেস মেনে নেন এই শর্ত এবং পাশেই সরে দাঁড়ান, যদিও এর মধ্যে এ্যালেক তাকে চকিত চুমু দেয়। যাবার সময় এ্যালেক বলে, “শুধু ঘোড়ার দিকে চোখ রেখ, তাহলেই চলবে, ” কিছুদূর যেয়েই আবার ফিরে আসে এ্যালেক। টেসের উদ্দেশ্যে বলে, “ভালো কথা, টেস, আজ তোমার বাবা নতুন ঘোড়া পেয়েছেন। কেউ তাকে দিয়েছে।”
বিস্মিত টেসের জিজ্ঞাসা, “কেউ দিয়েছে? আপনি?”
সাহিত্যে নারীজীবনের
এ্যালেক মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
“কি ভাল তবে একই সঙ্গে তাঁর মনে অস্বস্তি বোধ জাগে, যে এই মুহূর্তে তাকে ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে।
“বাচ্চারাও কিছু খেলনা পেয়েছে।”
“আমিতো জানতাম না আপনি তাদের কিছু পাঠিয়েছেন,” বিচলিতভাবে বিড়বিড় উচ্চারণ টেসের। “তবে না পাঠালেই ভাল হত, তাই আমার ইচ্ছা।”
“কেন প্রিয়তম?”
“এটা আমাকে বাধাগ্রস্থ করে।”
“টেসি, তুমিকি একটু হলেও আমাকে এখন ভালবাস না?”
“আমি কৃতজ্ঞ” অনিচ্ছুকভাবে টেস স্বীকার করেন, “কিন্তু আমার আশঙ্কা আমি ভালবাসি না,” উপহার সামগ্রী দেবার পেছনে তাঁর প্রতি এ্যালেকের আবেগ ছিল প্রধান অনুষঙ্গ — এমন ভাবনায় টেসের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
“কেঁদোনা প্রিয়তম, প্রিয়া আমার। এখন এখানে বসে আমার ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।” অনুভূতিহীনভাবে শুকনো পাতার ঢিবির ওপর বসে পড়লেন টেস, দেহে তাঁর মৃদু কম্পন।
“তোমার শীত করছে?” এ্যালেকের জিজ্ঞাসা।
“তেমন বেশী না, সামান্য।”
হাত দিয়ে টেসকে স্পর্শ করে এ্যালেক।
“ব্যাপার কি? তোমার পরিধানে শুধু মসলিনের পোশাক?”
“এটা আমার গ্রীষ্মকালের পোশাক, রওনা হবার সময় বেশ গরম লাগছিল। তখনতো ভাবিনি, ঘোড়ায় চড়তে হবে, রাত হয়ে যাবে।”
“সেপ্টেম্বরের রাতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে, দেখি তোমার জন্য কি করা যায়।”
নিজের পরিহিত হাল্কা ওভারকোট এ্যালেক খুলে ফেলে সস্নেহে টেসের গায়ে জড়িয়ে দেয়। “এখন ঠিক আছে, তুমি এখন উঞ্চ বোধ করবে, সুন্দরী আমার। বিশ্রাম নাও, শিগগীরই আমি ফিরে আসছি।” এ্যালেক এগিয়ে যায় ঘন কুয়াশার চতুর ভেদ করে।
পথ হারিয়ে অজানা বনে উপস্থিতির কারণ হল, এ্যালেক এক ঘণ্টার ওপর এদিক সেদিক ঘোড়া ছুটিয়েছে। হাতের কাছে যে বাঁক পেয়েছে সে দিকেই গেছে শুধু একটি উদ্দেশ্যে: যতক্ষণ বেশী টেসের সান্নিধ্য লাভ করা যায়। পথের দু’পাশের কোন বস্তুর চেয়ে চাঁদের আলোয় টেসের দৈহিক সৌন্দর্যের দিকে ছিল তার সব মনোযোগ। কিছুদর এগিয়ে যাবার পর স্থানটির সঠিক অবস্থান বুঝতে পারে এ্যালেক এবং দ্রুত পায়ে ফিরে আসে।
ততক্ষণে চাঁদ ডুবে গেছে এবং কুয়াশার আস্তরণে পুরো এলাকা গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। ভোর হতে বেশী বাকী নেই। হাত লম্বা করে এ্যালেক হাঁটছিল যাতে গাছের সঙ্গে ধাক্কা না লাগে। অন্ধকারে সে নির্দিষ্ট স্থানটি খুঁজে পাচ্ছিল না। সে বার বার এদিক সেদিক ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং হঠাৎ ঘোড়ার মৃদু চলাফেরার শব্দ শুনতে পেল। ওভারকোটের হাতা অপ্রত্যাশিতভাবে ছুয়ে গেল এ্যালেকের পা।
“টেস,” নাম ধরে ডাকল এ্যালেক।
কিন্তু কোন জবাব পেল না।
হঠাৎ পায়ে কি যেন ঠেকল।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেও সে দেখল সাদা মসলিন পরিহিত দেহটি, যা শুকনো পাতার ওপর একটু আগেই সে রেখে গেছে। এ্যালেক নিচু হল, শুনতে পেল মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। সে নতজানু হয়ে বসে আরো নিচু হল। টেসের নিঃশ্বাস ওর মুখমণ্ডলকে উষ্ণ করে তুলল। মুহূর্তের মধ্যে এ্যালেকের চিবুক স্পর্শ করল টেসের চিবুক। গভীর ঘুমে টেস আচ্ছন্ন। তাঁর চোখের পাপড়ির ওপর অশ্রুবিন্দু।
এভাবেই হার্ডির বর্ণনায় আমরা দেখি টেসের ধর্ষিতা হবার মুহূর্তটি। হার্ডির পরবর্তী বর্ণনায় কিছুটা দার্শনিকতা লক্ষ্য করা যায় : “Why it was that upon this beautiful feminine tissue, sensitive as gossamer, and practically blank as snow as yet, there should have been traced. such a coarse pattern as it was doomed to receive; why so often the coarse appropriates the finer thus, the wrong man the woman, the wrong woman the man, many thousand years of analytical philosophy have failed to explain to our sense of order.” (91)
হার্ডি মনে করেন, সঠিক যুগলের পরিবর্তে ভুল যুগলের কেন মিলন হয়, হাজার বছরের বিশ্লেষণধর্মী দর্শন তা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে এ ঘটনার মধ্যে এক ধরনের প্রায়শ্চিত্তের সম্ভাবনার কথা বলেছেন হার্ডি। টেসের পূর্বপুরুষেরা উল্লাসমুখর কোন প্রতিযোগিতা থেকে বাড়ী ফেরার পথে এই ধরনের আচরণ করেছিল তাদের সময়ের কোন কৃষকের মেয়ের সঙ্গে। তবে এটাকে তিনি সমর্থন করেননি এই বলে যে, পূর্বপুরুষদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্তানদের জন্য কাঙ্ক্ষিত বিবেচিত হলেও প্রকৃতি তা ঘৃণা করে এবং তা বিষয়টির কোন নিষ্পত্তি করে না।
টেসের ধর্ষিতা হবার পরও হার্ডি তাঁকে “a pure woman” বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নিরিখে। আর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন এক হার্ডিকে দেখি : এক মানবতাবাদী হার্ডি যাঁর দৃষ্টিতে প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ নারী। হার্ডির বিশ্বাস, প্রকৃতির মধ্যে সদা প্রবহমান কোন ক্ষতিকে পুষিয়ে নেবার যে শক্তি, তা থেকে শুধুমাত্র নারীদের নিশ্চয়ই বঞ্চিত করা হয়নি।
সুতরাং এ্যালেক কর্তৃক টেসের জীবনের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে প্রকৃতির নিয়মেই তা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে যাবে : “ the recuperative power which pervaded organic nature was surely not denied to maidenhood alone …” এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রচলিত সেই ভিক্টোরীয় মতবাদকে দৃঢ়ভাবে হার্ডি চ্যালেঞ্জ করেছেন, যাতে বলা হয়েছে একবার সতীত্ব হারালে তা চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। মনে প্রাণে টেস ছিলেন পবিত্র এবং নিষ্পাপ। এ্যালেকের চক্রান্তে তিনি দৈহিকভাবে কলুষিত হলেও তাঁকে অপবিত্র বলা যায় না, কারণ টেস
হার্ডির টেস: “A Pure Woman 2
এক দূর্ঘটনার শিকার এবং পুরো ব্যাপারটিই ছিল একপাক্ষিক। হার্ডির এই মনোভাব নিঃসন্দেহে আধুনিক ও মানবিক।
আরও পড়ুন:
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ
সহায়ক গ্রন্থ
জেমস গিবসন: Tess of the D’Urbervilles, লন্ডন: Macmillan, ১৯৮৬। পেনি বুমেলহা : Thomas Hardy and Women Sexual Ideology
and Narrative Form, Harvester, ১৯৮৪। ডেল কারমার : Critical Approaches to the Fiction of Thomas Hardy, লন্ডন: Macmillan, ১৯৭৯।
আয়ান গ্রেগর : The Great Web : The Form of Hardy’s Major
Fiction, লন্ডন: Faber, ১৯৭৪
ডগলাস ব্রাউন: Thomas Hardy, লন্ডন Longman, ১৯৫৪।