স্বাস্থ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

স্বাস্থ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : Health is the root of all happiness. অর্থাৎ ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। কারণ একটি স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ জাতিই সুষ্ঠু-সুশৃঙ্খলভাবে উৎপাদনমুখী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে । তবে স্বাস্থ্য বলতে কেবল শারীরিক সুস্থতাকে বোঝায় না। স্বাস্থ্য বলতে মূলত শারীরিক ও মানসিক উভয় প্রকার সুস্থতাকে বুঝিয়ে থাকে। তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি, অবকাঠামোগত অনুন্নয়নের ফলে স্বাস্থ্য খাত তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। তাছাড়া দেশের অধিকাংশ লোক ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী।

স্বাস্থ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

স্বাস্থ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি

এ স্বাস্থাহীনতা পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কেননা জাতীয় জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি স্বাস্থ্য খাতের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই এ সমস্যার কারণ ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য সেবায় বিরাজমান সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে একটি সুন্দর, সাবলীল, কর্মঠ ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি গঠন জরুরি । এজন্য সরকার ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

স্বাস্থ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

স্বাস্থ্যহীনতার ধারণা : সাধারণত মোটা-তাজা লোককেই স্বাস্থ্যবান বলে মনে করা হয়, যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত । রোগমুক্ত, সুস্থ ও সবল দেহকেই সুস্বাস্থ্য বলা হয়। তবে ভালো ও সুস্বাস্থ্য বলতে দেহ ও মনের সার্বিক সুস্থতাকে বোঝানো হয়ে থাকে । বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মতে, স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থার সুস্থতাকেই  বোঝানো হয়ে থাকে । শুধু রোগমুক্ত বা অসুস্থতামুক্ত থাকলেই তাকে স্বাস্থ্যবান বলা যায় না । অন্যভাবে বলা যায়, Ill health is the condition that refers to a state of improper physique which reflects to each steps of their life. অর্থাৎ, স্বাস্থ্যহীনতা বলতে এমন এক অনুপযুক্ত শারীরিক অবস্থাকে বোঝায়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।

উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শারীরিক, মানসিক, সামাজিকসহ অন্যান্য অবস্থার অসঙ্গতি ও অস্বাভাবিক অবস্থাকেই স্বাস্থ্যহীনতা বলা যায়। এটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দারুণভাবে ব্যাহত করে। ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ কোনো ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হয় না।

উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের সাথে স্বাস্থ্যের সম্পর্ক : বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে একটি বড় ধরনের অনুন্নয়নের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতাসহ অন্যান্য কারণও এ অনুন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছে। এক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানী Kocing কিছু সমস্যার কথা বলেছেন, যেগুলো অনুন্নয়নের ক্ষেত্র তৈরি করে। যেমন- সম্পদের স্বল্পতা, অনুন্নত  যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত জনশক্তির অভাব, যন্ত্রপাতি, শিক্ষা, বাসস্থান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকের স্বল্পতা ইত্যাদি স্বাস্থ্যসেবাকে বাধাগ্রস্ত করে।

ইপিআই-এর ব্যাপক সাফল্য বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে। নারীদের Reproductive Age-এর আগে যেখানে গড়ে সাতজন সন্তান জন্ম দিত, এখন সেটি ৩.৪-এ পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ১৯৬০ সালে যেখানে পাঁচ বছরের নিচে ২৪৭ জন শিশু মারা যেত, সেখানে ১৯৯৬ সালে মারা যায় ১১২ জন। শিশুমৃত্যুর হার এবং অপুষ্টির হার উন্নত বিশ্বের সাথে তুলন করলে অনুন্নত দেশগুলোতে ভয়াবহ চিত্র পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে অসুস্থতা এবং অপুষ্টির কারণ হিসেবে সামাজিক অসমতা, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক নির্যাতনকে দায়ী করা হয়। উন্নত বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার খাদ্যমান থেকে পুষ্টির পরিমাণ কমানোর জন্য প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে, সেখানে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো পুষ্টিহীনতার সম্মুখীন হয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

যার ফলে দেশগুলো কর্মক্ষম জনসংখ্যা হারিয়ে আরো অনুন্নত অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ডায়রিয়ায় প্রতি বছর বাংলাদেশে হাজার হাজার শিশু মারা যায়। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোর গ্রামীণ এলাকায় ৬৩% লোকের চমৎকার পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা রয়েছে। বাংলাদেশে এ আন্ত্রিক রোগসমস্যা সমাধানের জন্য পর্যন্ত অবকাঠামো গড়ে তুলতে না পারলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব আরও বাড়তে পারে। এজন্য প্রয়োজন কমিউনিটি অংশগ্রহণ, যার মাধ্যমে হাসপাতালের ওপর চাপ কমিয়ে নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা পালন করলে অনেক রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যেমন- ডায়রিয়ার জন্য খাবার স্যালাইন। প্রতিটি পরিবার যদি স্যালাইন বানাতে শেখে ও ডায়রিয়ামুক্ত থাকার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে তাহলে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর চাপ কমবে।

কমিউনিটি অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়ন সম্ভব, যার মাধ্যমে সমস্যা নির্ধারণ করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করতে পারে। এভাবে কোনো সম্প্রদায় জ্ঞান, দক্ষতা, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত দায়িত্ব ও কর্তব্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে। এভাবে কমিউনিটি অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রচলিত পেশাগত স্বাস্থ্য কাঠামো এবং স্থানীয় জনগণের জ্ঞান ও সম্পদ ব্যবহার করে উক্ত স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব। অবশ্য বর্তমানে আরও কিছু নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে যেগুলো সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করা দরকার, যাতে এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

এ ধরনের রোগের মধ্যে, এইডস, বার্ডস 2. ম্যাডকাউ, ইয়েলো ফিভার, ফাইলেরিয়া এবং ডেঙ্গু প্রধান। স্মরণাতীতকাল থেকে পৃথিবীতে আর্সেনিকের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে আর্সেনিক সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬১টি আর্সেনিকে আক্রান্ত। তবে ৫১টি জেলা মারাত্মক আর্সেনিক ঝুঁকির সম্মুখীন। পৃথিবীর আরেকটি বিপজ্জনক রোগ, যেটি বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে তা এইডস (AIDS) নামে পরিচিত। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)- এর রিপোর্ট অনুসারে ভবিষ্যতে ভারত হবে সবচেয়ে বেশি এইডস (AIDS) রোগীর দেশ। সম্প্রতি জাতিসংঘ শিশু তহবিল জানিয়েছে ২০১০ সালের মধ্যে আফ্রিকায় এইডস (AIDS) আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ১ কোটি ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

বর্তমানেও সেখানে উৎপাদনক্ষম পুরুষের বেশিরভাগ এইডস (AIDS)-এ আক্রান্ত। ইউনিসেফ (UNICEF)-এর মতে, সাব সাহারান আফ্রিকায় প্রতি মিনিটে একটি শিশু এইডসে আক্রান্ত হয়। আর মিনিটে অপর এক শিশু মারা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশও এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। দেশে বর্তমান এইডস (AIDS) রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫০০ জন। তাই এইডস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জনগণকে সচেতন করে তোলা আবশ্যক। সামাজিক আন্দোলনকে সফল করতে পারলে তার সুফল পাওয়া সম্ভব । গ্রামে একজন লোক হঠাৎ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে গ্রাম্য চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করা সম্ভব নয় বলে তাকে হাসপাতালে নেয়া জরুরি।

কিন্তু দ্রুত গতিসম্পন্ন কোনো যানবাহন না থাকার ফলে অন্যত্র নেয়া সম্ভব হয় না, ফলে রোগী মৃত্যু মুখে পতিত হয়। এ প্রসঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সেক্টর যেমন- কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টি, শিক্ষা ও তথ্য পরিবেশনসহ অন্যান্য অবকাঠামো ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এ খাতের উন্নয়ন সম্ভব ।

স্বাস্থ্যহীনতার কারণসমূহ : স্বাস্থ্যহীনতা বাংলাদেশের একটি মারাত্মক সমস্যা। বাংলাদেশে এ খাতে নানা সমস্যার জাল বিস্তার করে আছে। একক ও সুনির্দিষ্ট কোনো সমস্যা এর জন্য দায়ী নয়। বরং নানা ঘটনা এখানে ক্রিয়াশীল। নিচে স্বাস্থ্যহীনতার প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো :

১. অতিরিক্ত জনসংখ্যা : বর্তমান বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। ফলে জনগণের মৌলিক চাহিদার অনেকগুলোই পূরণ করা সম্ভব হয় না। দেশের প্রায় ৪৮% লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৩৩% লোক চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। নিম্ন আয় ও দারিদ্র্যের কারণে তাদের অনেকেই নিত্যদিনের মৌল মানবিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না। ফলে ভগ্ন স্বাস্থ্য, রোগব্যাধি, চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা নানাধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে।

২. মাদকাসক্তি : বর্তমানে যুবসমাজের অধিকাংশ মাদকাসক্ত। দিনের পর দিন হেরোইন, কোকেন, গাঁজা, আফিম, মারিজুয়ানা প্রভৃতি মারাত্মক মাদকের ছোবলে অনেক তাজা প্রাণ অকালে বিনষ্ট হচ্ছে। মাদকাসক্তি স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষেত্রে তাই বড় ধরনের অভিশাপ হিসেবে আবির্ভূত ।

৩. পুষ্টিহীনতা : দেশে বর্তমানে পুষ্টিহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে। দৈনিক ২২১০ ক্যালরি গ্রহণ করা তো দূরের কথা অনেকেই দু বেলা ঠিকমতো আহার করতে পারে না। বর্তমান গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৯৫% পুষ্টিহীনতায় ভোগছে।

৪. স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক জ্ঞানের অভাব : বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই অজ্ঞ এবং নিরক্ষর। অজ্ঞতার কারণে পুষ্টিকর খাদ্য নির্বাচন এবং খাদ্যের পুষ্টিমান সম্পর্কে উদাসীন। ফলে নানা স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে।

৫. কুসংস্কার : কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদির ফলে দেশের জনগণ বিশেষত, গ্রামীণ জনগণ স্বাস্থাহীনতার শিকার।

৬. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ : বাংলাদেশের ৯০% লোক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন করে। ফলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে সহজেই আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে বস্তী এলাকার লোকজন এ ধরনের রোগের শিকার হয় বেশি।

৭. ওষুধ ও খাদ্যে ভেজাল : বর্তমানে ভেজালবিরোধী অভিযানে দেখা গেছে, দেশের ৯০% খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত। ফলে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনির রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে।

৮. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : বর্তমান বিশ্বের আবহাওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সুনামি, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, টর্নেডোসহ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও অনেকাংশে স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দায়ী।

৯. দারিদ্র্য : শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা দরকার কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ দারিদ্রোর কারণে যেখানে দৈনিক ২৫ আউন্স খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন সেখানে গ্রহণ করে মাত্র ১২ আউন্স।

১০. ধর্মীয় গোঁড়ামি ও বাল্যবিবাহ : ধর্মীয় গোঁড়ামিও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দোয়ী। বাংলাদেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের বিয়ে হয় অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়। ফলে তারা অল্প বয়সে পিতামাতা হতে গিয়ে মারাত্মক স্বাস্থ্যহীনতায় ভোগে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সমস্যা সমাধানের উপায় : স্বাস্থাহীনতা বর্তমানে বাংলাদেশে একটি মারাত্মক সমস্যা। মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন সামাজিক জীবন তথা জীবনের প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। এসব প্রভাব থেকে মানবজীবনকে উদ্ধার করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সবার জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ পরিবেশ সৃষ্টি করা কারো একার পক্ষে নয়। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলেই স্বাস্থ্যহীনতা মোকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশে বিরাজমা স্বাস্থ্যহীনতা মোকাবিলা করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা একান্ত জরুরি।

১. দারিদ্র্য দূরীকরণ গ্রামীণ অর্থনীতিকে পুনর্গঠন, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এবং আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। যাতে সর্বস্তরের জনগণ প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধপত্র, সুস্থ পরিবেশ প্রভৃতি পর্যাপ্ত পরিমাণে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে তৎপর হতে পারে।

২. জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন : বাংলাদেশে এখনো পর্যন্তও জাতীয় পর্যায়ে কোনো বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশে বিরাজমান স্বাস্থাহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করতে জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

৩. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে আমাদের দেশে স্বাস্থাহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে জোরদার করার মাধ্যমে স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।

৪. স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি : স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ব্যবহার করে এবং গ্রামীণ পর্যায়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি প্রচার করে জনগণকে স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে।

৫. জনগণের আয় বৃদ্ধি : ব্যাপক শিল্পায়ন এবং বিভিন্ন ধরনের উপার্জনকারী কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। কৃষি উন্নয়নের ব্যবস্থা করে চাষযোগ্য ভূমিতে একাধিক ও বহুমুখী ফসল উৎপাদন করা সম্ভব ।

৬. কৃত্রিম পুষ্টি উদ্ভাবন : পুষ্টি সমস্যার সমাধানে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত গাছ-গাছড়া, ফলমূল থেকে কৃত্রিম আমিষসমৃদ্ধ খাদ্য প্ৰস্তুত প্রণালী সম্পর্কে ধারাবাহিক গবেষণা করে কৃত্রিম পুষ্টি উদ্ভাবনের মাধ্যমেও স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যা মোকাবিলা করা যায়।

৭. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদারকরণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবেই বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগে ভোগে। এ ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানকে তৎপর হতে হবে। খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড়, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

৮. আধুনিক চিকিৎসার প্রসার গ্রাম, মহল্লা, ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে যেসব হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র আছে সেসব কেন্দ্রে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

৯. গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা : আধুনিক ও প্রচলিত চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা গ্রাম পর্যায়ে সম্প্রসারণের মাধ্যমে গণমুখী করে তুলতে হবে। গ্রাম এলাকায় শতকরা ৮৫ ভাগ লোক বাস করে। এ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে।

১০. ধূমপান ও মাদকাসক্তি প্রতিরোধ : স্বাস্থ্যহীনতা সমস্যার ব্যাপকতার জন্য ধূমপান ও মাদকাসক্তি অনেকাংশে দায়ী । তাই এ সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য গ্রাম ও শহরে ধূমপানবিরোধী আন্দোলন জোরালো করতে হবে।

১১. ভেজাল নিয়ন্ত্রণ : খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল আমাদের দেশে একটি নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই এ সমস্যা প্রতিরোধ করতে হলে সর্বস্তরে খাদ্য ও ওষুধপত্রের ভেজাল নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করতে হবে।

১২. কুসংস্কার দূরীকরণ : স্বাস্থ্যহীনতা মোকাবিলার জন্য সর্বস্তরে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিরাজমান কুসংস্কার পরিবর্তন ও সংশোধন করতে হবে। বর্তমানে আবিষ্কৃত মাশরুম, টিরুলিনা ইত্যাদি অধিক পুষ্টিকর খাদ্য সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে গৃহীত সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি : স্বাস্থ্য ব্যতীত কোনো জাতিই কর্মঠ ও উৎপাদনমুখী জনশক্তি গড়ে তুলতে পারে না। স্বাস্থ্যহীনতা মানুষের কর্মদক্ষতা হ্রাস করে ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে তথা প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এসব প্রভাব থেকে মানবজীবনকে উদ্ধার করতে হলে সর্বাগ্রে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যা নিম্নরূপ :

১. স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ।

২. দারিদ্র্য দূরীকরণ ।

৩. জনগণের আয় ও উপার্জন বৃদ্ধি । ৪. স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ।

৫. ধূমপানবিরোধী আইন।

৬. কৃত্রিম পুষ্টি উৎপাদন ।

৭. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদারকরণ।

৮. গণমুখী চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ।

৯. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ।

১০. বহুমুখী জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন।

১১. মাতৃকল্যাণ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি চালু।

১২. ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি হাসপাতাল স্থাপন ।

১৩. পর্যাপ্ত ওষুধশিল্প স্থাপন।

১৪. ভেজালবিরোধী অভিযান নিয়মিতকরণ। ১৫. প্রতিষেধক কার্যক্রম জোরদার।

এছাড়াও সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন মহলের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ইপিআই বা সম্প্রসারিত টিকদান কর্মসূচি এ পর্যায়ে একটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প।

শিশুস্বাস্থ্য পরিচর্যা যথাযথ বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যৎ জীবনে স্বাস্থ্যসমস্যা অনেক কমে যাবে। শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি যথেষ্ট সাফল্য প্রদর্শন করেছে। পোলিও, যক্ষ্মা, হাম ইত্যাদি রোগ নির্মূলে এ কর্মসূচি ইতিমধ্যে বেশ সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। সারা দেশে এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে শিশুমৃত্যুর হার ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে জনস্বাস্থ্যের মান আশানুরূপ সফলতা পেয়েছে। শিশুদের পুষ্টির অভাব দূরীকরণের জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

অপুষ্টি দূর করার জন্য ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল বিতরণ করা হচ্ছে এবং শিশুদের অন্ধত্বের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য রাতকানা রোগের প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশুদের সাথে মায়েদের স্বাস্থ্য পরিচর্যারও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সরকার ‘সবুজ ছাতা’ ও ‘সূর্যের হাসি’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিশু এবং মায়েদের স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

এছাড়া থানা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে বহুশয্যায় উন্নীত করা হচ্ছে এবং আরো নতুন নতুন হাসপাতাল ও কমিউনিটি হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশে সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প, যা বিশ্বব্যাংকও ইউনিসেফের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে, এর ফলাফল আশাব্যঞ্জক। এখানে সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়া সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা দান এবং পরিকল্পনা গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত তাদের সম্পৃক্ত করে।

আবার ‘ওয়ান সার্ভিস’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেখানে EPI-এর কেন্দ্রগুলো, স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং সামাজিক পুষ্টিকেন্দ্রগুলো একই জায়গায় হচ্ছে। ফলে জনগণ একই জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের সেবা নিতে পারছে। এক্ষেত্রে ‘Bangladesh Medical Rereasch Center (BMRC)’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। BMRC গত ১০ বছরে ৩৯টি প্রকল্প গ্রহণ করে, যার মধ্যে ২২টি বাতিল হয় এবং ১২টি ফলাফলসহ ফেরত আসে। এছাড়া বাংলাদেশের রেফারেন্স সিস্টেম খুবই দুর্বল। এজন্য দেখা যায়, জেলা ও থানা হাসপাতালে বেড খালি থাকে। অথচ ঢাকা মেডিক্যালসহ অন্যান্য হাসপাতালে বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝেতেও রোগী থাকে ।

স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করার জন্য গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একত্রিত করে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। গ্রামের মানুষের কথা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চিন্তা করতে হবে। স্বাস্থ্য খাত অন্যান্য খাতের মতোই একটি উৎপাদনশীল খাত তা সবাইকে বোঝাতে হবে। আবার সরকারি অনুদান দিলেই যে স্বাস্থ্য খাত উন্নত হবে এ বিষয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এজন্য পরিকল্পনা একান্তভাবে জরুরি। স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন- বাংলাদেশের দৃষ্টি সমস্যা উন্নয়নের জন্য ‘Bangladesh Nutrition Food Policy করা হয়েছে । স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করার জন্য এ ধরনের আয় ও কর্মসূচি আবশ্যক। 

স্বাস্থ্য উন্নয়নের চাবিকাঠি | স্বাস্থ্যবিষয়ক | বাংলা রচনা সম্ভার

 

উপসংহার : বাংলাদেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অনুন্নয়নের ব্যাপক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে তা উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকেই দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ উন্নত বিশ্ব অনুন্নত বিশ্বকে সাহায্যে করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খত তখনই কার্যকর ভূমিকা পালন করবে যখন মানুষ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করবে। ফলে একটি স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ জাতি হিসেবে দেশ তথা পৃথিবী উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে। তাই বলা যায়, স্বাস্থ্যই উন্নয়নের চাবিকাঠি।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment