স্বরবৃত্ত ছন্দ – বিষয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “ছন্দ ও অলঙ্কার” বিভাগের একটি পাঠ।
স্বরবৃত্ত ছন্দ
এই ছন্দের একটি অতি প্রচলিত নাম ‘ছড়ার ছন্দ’ বা ‘লৌকিক ছন্দ / লোকছন্দ’। প্রাচীন ছড়াগুলো এই ছন্দে রচিত এবং এই ছন্দ মূলত লোকজীবনে নিত্যব্যবহৃত কথ্যভাষা-আশ্রিত বলেই এরূপ নামকরণের সার্থকতা স্বীকার করা চলে। রবীন্দ্রনাথও অনেক সময় একে ‘ছড়ার ছন্দ’ বা ‘লোকছন্দ’ নামে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘স্বরবৃত্ত ছন্দ আউলের মুখে, বাউলের মুখে, ভক্ত কবিদের গানে, মেয়েদের ছড়ায় বাংলাদেশের চিত্তটাকে একেবারে শ্যামল করে ছেয়ে রয়েছে।’
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এ-ছন্দ সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ নিরক্ষরের ছন্দ। সংস্কৃতের উল্কিতে এর চেহারা বদলে যায় নি; সেই জন্যই ভাষার নিজস্ব রূপটি এতে বজায় আছে।’ এই ছন্দের আর এক নাম ‘মেয়েলি ছন্দ’। সম্ভবত প্রাচীনকালে মেয়েরাই ছড়া কাটায় বেশি অভ্যস্ত ছিলেন অথবা স্বল্পশিক্ষার দরুন কথ্যভাষা ব্যবহার করতেন বলেই, মেয়েদের যোগ্য চলতি ভাষার এই ছন্দকে ‘মেয়েলি ছন্দ’ বলা হতো।
ছান্দসিক আব্দুল কাদির এ-ছন্দ সম্পর্কে বলেছেন, ‘মধ্যযুগে চৌদ্দ-স্বরের স্বরবৃত্ত বিবর্তিত হয়ে যখন চৌদ্দ অক্ষরের অক্ষরবৃত্ত পয়ারে রূপান্তর লাভ করলো, তখন স্বরবৃত্ত ছন্দ শিক্ষিত সমাজে উপেক্ষিত হয়ে পল্লীতে রাখালের কণ্ঠে, মেয়েলি ছড়ায়, ওঝার মন্ত্রে, বাউলের গানে, মাঝির ভাটিয়ালীতে ও যাত্রা-পাচালিতে আশ্রয় গ্রহণ করে।
‘ সংজ্ঞার্থ : যে ছন্দে ওঝার মন্ত্রে, : যে ছন্দে যুগ্মধ্বনি সব সময় একমাত্রা গণনা করা হয় এবং প্রত্যেক পর্বের প্রথম শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাত পড়ে তাকে স্বরবৃত্ত ছন্দ বলা হয়। সাধারণত এ ছন্দে চরণের প্রতি পর্বে চারমাত্রা ও দুই পর্বাঙ্ক থাকে। চার পর্ব বিশিষ্ট এ ছন্দের শেষ পর্ব অপূর্ণ হয়। তবে সব ক্ষেত্রে এ বৈশিষ্ট্য রক্ষিত হয় না। যেমন—
উপর্যুক্ত চরণ দুটির মাত্রা সংখ্যা যথাক্রমে (৪ + ৪ + ৪ + ১ )। পর্ব সংখ্যা চারটি। শেষ পর্বের পদ দুটি অপূর্ণ স্বরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য ১. স্বরবৃত্ত ছন্দে যে-কোন অক্ষর (মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষর) এক মাত্রার। ২. এতে যুগ্মধ্বনিকে ঠেসে উচ্চারণ করে এক মাত্রার করা হয় এবং এ-ছন্দে প্রত্যেক পর্বে কমপক্ষে একটি করে যুগ্মধ্বনির অবস্থান থাকে ।
স্বরবৃত্ত ছন্দ সচরাচর চার-এর মাত্রায় কদম ফেলে চলে; অর্থাৎ চার মাত্রার পর্ব ভাগই এ-ছন্দের আসল কথা এ-ছন্দ ‘কথ্য ক্রিয়ায় কয় যে কথা সাধুতে না বলে’।স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রত্যেক পক্তি বা চরণের প্রত্যেক পর্বের প্রথমে একটি করে প্রবল শ্বাসাঘাত ( ) পড়ে।এ-ছন্দে পর্বের অক্ষরের স্বর কোনোটাই দীর্ঘ নয়, সবগুলোই হ্রস্ব; যৌগিক স্বরান্ত অক্ষর পর্যন্ত হ্রস্ব।

এতে যুক্তব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী স্বর সংশ্লিষ্ট উচ্চারণে একমাত্রার। b. এ-ছন্দের পর্ব স্বরান্ত (মুক্ত), হলন্ত (রুদ্ধ)-এ উভয়বিধ অক্ষরের মিশ্রণে সংঘটিত এবং এর বিন্যাস রীতি— ক. চারটেই মুক্ত, খ. তিনটে মুক্ত + একটি রুদ্ধ, গ. দুটি মুক্ত + দুটি রুদ্ধ, ঘ. একটি মুক্ত + তিনটে রুদ্ধ এবং ঙ. চারটেই রুদ্ধ। এ-ছন্দের লয় দ্রুত। এর ভাব লঘু চপল। এবং এতে প্রবল শ্বাসাঘাত ও যুগ্ম-ধ্বনির প্রভাবে এক প্রকার ধ্বনি-তরঙ্গেরও সৃষ্টি হয়।
আরও দেখুন: