সুলেখার বাবা | হুমায়ূন আহমেদ | গল্প লিখন | ভাষা ও শিক্ষা ,ঘুম ভেঙেই সুলেখা দেখল গেটের কাছে একটি লোক উবু হয়ে বসে আছে। লোকটির চোয়াল ভাঙা, মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা, চোখ দুটি ফোলা ফোলা। সে কিছুক্ষণ পরপর পিক করে থুথু ফেলছে। কী বিশ্রী স্বভাব। নিজের চারদিকে কেউ এমন থুথু ছিটায়? এই তো সুলেখা দাঁত মাজছে। মুখ ভর্তি হচ্ছে ফেনায়। সে তো থুথু ফেলছে না । বেসিনে গিয়ে ফেলে আসছে। তাই নিয়ম।
সুলেখার বাবা | হুমায়ূন আহমেদ | গল্প লিখন | ভাষা ও শিক্ষা
সুলেখা ব্রাশ ঘষতে ঘষতে ফুলের টবগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। ঐ লোকটা ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বাঁ চোখের কোণে এক গাদা ময়লা। দেখলেই বমি বমি ভাব হয়। সুলেখা চেষ্টা করল লোকটার বাঁ চোখের দিকে না তাকাতে।
সুলেখার দাঁত মাজা হয়ে গেছে। এখন আর বারান্দায় শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থাকার কোনো অর্থ হয় না। সে চলেই যেত কিন্তু ঐ লোকটা তার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ফিক ফিক করে হাসছে। কী বিশ্রী দাঁত লোকটার, হলুদ এবং কালো। এই লোক বোধহয় কোনোদিন দাঁত মাজে না। আরে কী আশ্চর্য, লোকটা হাত ইশারা করে তাকে ডাকছে। সুলেখা এগিয়ে গেল। মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল, ‘ডাকছ কেন?’
লোকটি কিছু বলল না। মুখ ভর্তি করে হাসল। সুলেখা বলল, ‘নাম কী তোমার?”
‘আমার নাম নাই গো মা !”
‘সবারই নাম থাকে।
লোকটা খুব মাথা দুলিয়ে হাসছে। যেন সুলেখার কথায় খুব মজা পাচ্ছে। সুলেখা তো কোনো মজার কথা বলেনি। “তুমি হাসছ কেন শুধু শুধু ?
লোকটি কোনো উত্তর দেবার আগেই সুলেখার মা বেরিয়ে এলেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। চোখ দুটি অসম্ভব শুকনো। বাবার সঙ্গে ঝগড়া হলে মা’র মুখ এ-রকম হয়ে যায়। কে জানে আজ হয়তো বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। মা বললেন, ‘সুলেখা, তুমি এখানে কী করছ?’
‘কিছু করছি না মা।’
‘যাও, হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে যাও।’
মা রাগী রাগী গলায় ঐ লোকটাকে ধমকাচ্ছেন।
‘কোথায় তুমি ঠিকানা পেয়েছ? তোমাকে বলা হয়েছে না কোনোদিন আমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে না? কি, বলা হয়নি? চুপ করে আছ কেন? জবাব দাও। ‘
‘মনটা বড় টানে আম্মা। বড় টানে। ’
‘কী আজেবাজে কথা বলছ। তোমাকে যথেষ্ট টাকা দেয়া হয়েছে যাতে মন না টানে। তোমার তো আরো ছেলেমেয়ে আছে, আছে না?’
লোকটি খুক খুক করে কাশতে লাগল। মা ক্রমাগত কী সব বলতে লাগলেন। তার বেশির ভাগই সুলেখা বুঝল না। মা আজ ভীষণ রেগেছেন।
সে নাশতা খেতে গিয়ে দেখল বাবার মুখও গম্ভীর। সুলেখা চুপচাপ বসে আছে। একটি চটি বই হাতে নিয়ে বাবা কী যেন পড়ছে।
বুয়া এবং মা ঢুকলেন একই সঙ্গে। বুয়ার হাতে পরিজের বাটি। সে বাটিটি সুলেখার সামনে রাখল ৷ সুলেখার মা বললেন, ‘রহিমার মা ঐ লোকটাকে কিছু খাবার-টাবার দাও। রাতের ভাত তরকারি কিছু আছে? থাকলে ওকে তাই দাও। আর, ওকে বল গেইটের বাইরে গিয়ে বসতে।

সুলেখার বাবা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “কী চায়?’
“তার নাকি মন টানছে। মেয়েকে দেখতে চায়।’
‘যত ফালতু কথা। আরো টাকা আদায়ের চেষ্টা। একশ’টা টাকা দিয়ে বিদায় করে দাও। এবং ভয় দেখিয়ে দাও যে আরেকবার এলে পুলিশে দেয়া হবে। মার যেন ত্রিসীমানায় ওকে না দেখি।’ মা একটা চকচকে একশ’ টাকার নোট সুলেখার হাতে দিয়ে বললেন, ‘যাও, ঐ লোকটাকে দিয়ে আস। দিয়েই চলে
আসবে। আবার গল্প জুড়ে দিবে না। যাবে আর আসবে।’
বাবা বললেন, “ওর যাবার দরকার কী? তুমি গিয়ে দিয়ে আস।’ মা ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘যাক সুলেখাই যাক। মেয়েকে দেখতে এসেছে।’
লোকটি গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কী রোগা একটা মানুষ। নীল রঙের গেঞ্জি গায়ে। গেঞ্জিটা খুবই পরিষ্কার। কিন্তু লুঙ্গিটা অসম্ভব নোংরা।
সুলেখা টাকা হাতে এগিয়ে এল। লোকটি তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে।
সুলেখা বলল, ‘নাও, টাকা নাও। মা দিয়েছেন। ‘
লোকটি টাকা নিল না। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভালো আছ আম্মা? শইল বালা? ইস্কুলে পড়? কোন ইস্কুলে?”
সুলেখা কিছু বলল না। লোকটি ফিসফিস করে বলল, “খুব অভাবের মইধ্যে পড়ছিলাম গো। খুবই অভাব। ভাতের কষ্ট হইল গিয়া খুব বড় কষ্ট। পেটের জইন্যে এই কাম করলাম। ওমন কুকাম করলাম।’
“কী করলে?”
লোকটি তার জবাব না দিয়ে বলল, ‘আমি কে কও দেখি?” ‘কীভাবে বলব?”
‘আমারে চিনা চিনা লাগে না গো মা? ভালো কইরা দেখ। ’
সুলেখার মা বারান্দায় বের হয়ে এলেন। কর্কশ গলায় বললেন, ‘টাকা দিয়ে চলে আসতে বললাম না? কী করছ তুমি?
টাকা দিয়ে দাও।’
সুলেখা বলল, ‘টাকা নাও। ‘
লোকটি টাকা নিল না। কুঁজো হয়ে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল। একবারও পিছনে ফিরে তাকাল না । সুলেখা বলল, ‘ঐ লোকটা কে মা? তাকে তুমি বকছ কেন?”
সুলেখার মা তার জবাব দিলেন না।
আরও দেখুনঃ