সুখ কবিতা – কামিনী রায় [ মূলভাব সহ ]

কবি কামিনী রায় বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত কবয়িত্রী এবং শিক্ষাবিদা। তাঁর লেখা সুখ কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক জনপ্রিয় রচনা, যা মানবজীবনের আনন্দ, শান্তি ও সুখের গভীর অনুভূতিকে প্রকাশ করে। কামিনী রায়ের সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে নারীবাদী ভাবধারার সূচনা এবং সমাজসচেতনতার প্রতিফলন হিসেবে বিবেচিত।

কামিনী রায়ের জন্ম হয়েছিল পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) ঝালকাঠি জেলার বাকেরগঞ্জের বাসণ্ডা গ্রামে। তিনি একটি শিক্ষিত ও সংস্কৃতিপ্রেমী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চণ্ডীচরণ সেন একজন বিশিষ্ট ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী, বিচারক ও ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন। ১৮৭০ সালে তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রী ও কন্যাও কলকাতায় তাঁর মাধ্যমে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। চণ্ডীচরণ সেন ব্রাহ্ম সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তাঁর বোন যামিনী সেন লেডি ডাক্তার হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিলেন, যা ঐ সময় নারীদের ক্ষেত্রে একটি বিরল গৌরবের বিষয় ছিল।

১৮৯৪ সালে কামিনী রায়ের বিয়ে হয় স্টাটুটারি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের সঙ্গে। তাঁর দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক পরিবেশে বিদ্যাবোধ ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ বজায় ছিল, যা তাঁর কবিতা ও অন্যান্য রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে।

কামিনী রায়ের কবিতা সুখ শুধুমাত্র একটি সাহিত্যকর্ম নয়, বরং মানুষের অন্তর থেকে উঠে আসা সত্যিকারের সুখের অভিব্যক্তি। এই কবিতায় তিনি জীবনের সরল ও প্রাকৃতিক সুখের কথা বলেছেন, যা আধুনিক জীবনের জটিলতা ও অস্থিরতার বিপরীতে মানবিক শান্তির প্রতীক। তাই তাঁর সুখ কবিতা আজও পাঠকের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

 

সুখ কবিতা - কামিনী রায়
কামিনী রায়

 

সুখ কবিতা – কামিনী রায়

নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?—

এ ধরা কি শুধু বিষাদময়? য

তনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে

কেবলি কি নর জনম লয়?—

কাঁদাইতে শুধু বিশ্বরচয়িতা

সৃজেন কি নরে এমন করে’?

মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে

মানবজীবন অবনী ‘পরে?

বল্ ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈঃস্বরে,

— না,—না,—না,—মানবের তরে

আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর,

না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে।

কার্যক্ষেত্র ওই প্রশস্ত পড়িয়া,

সমর-অঙ্গন সংসার এই,

যাও বীরবেশে কর গিয়ে রণ ;

যে জিনিবে সুখ লভিবে সেই।

পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি

এ জীবন মন সকলি দাও,

তার মত সুখ কোথাও কি আছে?

আপনার কথা ভুলিয়া যাও।

পরের কারণে মরণের সুখ ; “

সুখ” “সুখ” করি কেঁদনা আর,

যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে,

ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।

গেছে যাক ভেঙ্গে সুখের স্বপন

স্বপন অমন ভেঙ্গেই থাকে,

গেছে যাক্ নিবে আলেয়ার আলো

গৃহে এস আর ঘুর’না পাকে।

যাতনা যাতনা কিসেরি যাতনা?

বিষাদ এতই কিসের তরে?

যদিই বা থাকে, যখন তখন

কি কাজ জানায়ে জগৎ ভ’রে?

লুকান বিষাদ আঁধার আমায়

মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মত,

সারাটি রজনী নীরবে নীরবে

ঢালে সুমধুর আলোক কত!

লুকান বিষাদ মানব-হৃদয়ে

গম্ভীর নৈশীথ শান্তির প্রায়,

দুরাশার ভেরী, নৈরাশ চীত্কার,

আকাঙ্ক্ষার রব ভাঙ্গে না তায়।

বিষাদ—বিষাদ—বিষাদ বলিয়ে

কেনই কাঁদিবে জীবন ভরে’?

মানবের মন এত কি অসার?

এতই সহজে নুইয়া পড়ে?

সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে

পারনা মুছিতে নয়ন-ধার?

পরহিত-ব্রতে পারনা রাখিতে

চাপিয়া আপন বিষাদ-ভার?

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে

আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে,

সকলের তরে সকলে আমরা,

প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।

 

সুখ কবিতা এর মূলভাবঃ

সুখ’ কবিতায় কবি কামিনী রায় বলেছেন, যারা স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, তারা প্রকৃত সুখী নয়। প্রকৃত সুখী তারা, যারা পরার্থপরায়ণ, অন্যের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়, পরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। কবি প্রকৃত সুখী হতে সেবা, ভালোবাসা এবং কল্যাণের মাধ্যমে অন্যের দুঃখ-ব্যথা দূর করার জন্য প্রয়োজনে ত্যাগ স্বীকার করতে বলেছেন। মানুষ শুধু নিজের সুখের জন্য পৃথিবীতে আসেনি। যারা মহৎ, তারা সব সময় অন্যের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যায়। ফুল যেমন অন্যকে মুগ্ধ করে, তেমনি আমরাও পরের কল্যাণের জন্য আমাদের জীবনকে উৎসর্গ করব।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

সুখ কবিতা আবৃত্তিঃ

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment