সাহিত্য ও জাতীয় চেতনা | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : ‘সহিত’ কথাটি সম্পৃক্ত হয়েই ‘সাহিত্য’ কথাটির উৎপত্তি। জীবনের সঙ্গেই সাহিত্যের যোগ, জীবনকে নিয়েই সাহিত্যের বিচিত্র প্রকাশ। জীবনের নিভৃত গুঞ্জন, তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অনুভূতি, মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্র, তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, তার ইতিহাস সাহিত্যের উপজীব্য। সাহিত্য মানুষের জন্য আবার মানুষের সৃষ্টিতে তা মুখরিত। মানুষ তৈরি করে সাহিত্য, তাই সাহিত্যে প্রতিফলন ঘটে মানুষের জীবনের।
সাহিত্য ও জাতীয় চেতনা | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার
সাহিত্য ও জাতীয় চেতনা
সাহিত্যের এই জীবন ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষিতে সাহিত্য সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সুনিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। রাষ্ট্রে অন্যায়-অসত্যের দাপট যতই থাক, জাতীয় চিত্তে যদি তার সমর্থন না। থাকে; তবে দেশের সাহিত্যে শোনা যায় বিদ্রোহের সুর। অতি সাধারণ মানুষের মন যেমন প্রতিকূল- অনুকূল নানা ঘটনার সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে, তেমনই সাহিত্যিকের মানব জীবনের পুষ্টিও পারিপার্শ্বিকের উপর নির্ভরশীল।
প্রকৃত পক্ষে কবি মানস দেশের গণমনেরই উন্নত সংস্কার। সাহিত্যিকের রচনার মধ্যে আমরা যেসব মানুষের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করি; যাদের কথায়, ভাবে, আনন্দে, বেদনায় ফুলে ফুলে, দুলে দুলে ওঠে, তারা প্রকৃতপক্ষে পরিচিত জনগণেরই প্রতিনিধি। লেখকের মনে যত কথা জমে থাকে তার অনেকখানি আসে জাতীয় জীবন থেকে। তাই জাতীয় চরিত্রের খবর জানতে হলে জাতীয় সাহিত্যের অনুশীলনই সর্বোত্তম পন্থা।
সাহিত্য কি : মানব হৃদয়ের বিচিত্র অনুভূতি যখন রসমধুর হয়ে ভাষায় রূপায়িত হয়ে ওঠে তখন তাকে সাহিত্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। জগৎ ও জীবনের বিচিত্র বিষয় সাহিত্যের উপজীব্য। সাহিত্যে মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার প্রতিফলন ঘটে। সেজন্য সাহিত্য মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি। সাহিত্যে শুধু ভাবের বিকাশ ঘটে তা নয় বরং তা রসমধুর হয়ে বাস্তব রূপ লাভ করে। সাহিত্য যেমন মানুষের জীবন ও পরিবেশ থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে, তেমনি তা মানুষের বিচিত্র রস পিপাসা মিটাবার জন্য বিচিত্র আঙ্গিকে রূপ লাভ করে। আর তাই বলা হয় সাহিত্য অমৃত আর সাহিত্যিকরা অমর।
সাহিত্য সৃষ্টির ইতিকথা : মানুষ নিজেকে যত স্বাধীন বলে মনে করুক সে কখনও একান্তভাবে স্বাধীন নয়। একদিকে সে যেমন ব্যক্তি বিশেষ, অপরদিকে আবার তার জাতির ভাবকল্পনা ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধি এবং সমাজের অঙ্গবিশেষ। এই হিসেবে তার মধ্যে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের চিহ্ন রয়েছে। তাই মানুষ নিজেকে বিস্তৃত করে দেখতে চায়। সে বাস্তব জগৎ ব্যতীত আর একটি কল্প জগতের স্বপ্ন দেখে। কারণ, বাস্তব জগতে তার সকল প্রকার আশা আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হয় না।
তাই কল্পনার জগতে সে জীবনের অপূর্ণতার বৃত্তাংশকে পরিপূর্ণ করে পায়। যা জীবনে পাওয়া গেল না তা-ই কল্পনায় পেয়ে লেখক আশ্বস্ত হন, কল্পনাকে লেখক সত্য বলে গ্রহণ করেন। বন্ধন জর্জরিত কবিচিত্ত তাই বিশ্বের স্বর্ণযুগ কল্পনা করেন, বেদনাহত লাঞ্ছিত কীটস তাই সৌন্দর্য ও সত্যের অভিন্নতাকে প্রত্যক্ষ করেন, বাঙালি সাহিত্যিক মরণের মধ্যে অমৃতের আস্বাদন করেন। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় সাহিত্য।
সাহিত্যের বিষয়বস্তু : সাহিত্যের উপকরণ সংগৃহীত হয় মানুষের জীবন থেকে মানুষের হৃদয়ের বিচিত্র অনুভূতি অবলম্বনেই সাহিত্য পল্লবিত হয় তার সৃষ্টি সম্ভারে। তাই সাহিত্যের মধ্যে মানুষকে প্রত্যক্ষ করা চলে। সাহিত্যের নানা শাখা প্রশাখায় তার পরে উপন্যাসে, নাটকে কবিতায়, প্রবন্ধে মানুষের কথা বলা হয়, স্পষ্ট করে তোলা হয় মানুষের পরিচয়।
তবে আলেখ্য অঙ্কনে করি সাহিত্যিকের মনে কল্পনা কঠোর বাস্তবকে রঙিন আর রননদুর করে তোলে। আর সে কারণেই সাহিত্যে প্রতিফলিত জীবন সৌন্দর্যমণ্ডিত মনে হয়। কারো মতে শিল্পের জন্যই শিল্প। বাস্তব জীবনের স্বরূপ সন্ধান সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। অপরদিকে সাহিত্য বাস্তবতার অনুসারী। নিছক আনন্দলোকে শিল্পের জন্য শিল্প নিয়ে বিচরণ করে লাভ নেই, সাহিত্য যদি জীবনের কথা না বলে।
বিষয়বস্তুর বিবর্তন: জীবনের ক্ষেত্র বিশাল ও ব্যাপক। সভ্যতার, বিশেষ করে বস্তুবাদী সভ্যতার বিস্তৃতির সাথে সাথে মানব জীবনের জটিলতা ও রহস্য অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল নর-নারীর প্রণয়, তার সংঘাত ও প্রতিক্রিয়া। বস্তুর অবসরভোগী সমাজে এটাই ছিল বড় ঘটনা এবং সেদিন সাহিত্যও ছিল এ অবসরভোগী সমাজের অবসর বিনোদনের বস্তু। বিত্তবান এই অবসরভোগীদের কেন্দ্র করেই সেদিন রাষ্ট্রীয় জীবন আবর্তিত ও আলোড়িত হতো।

তাই সাহিত্যে তার প্রতিফলন হয়েছিল। আজ অবসরভোগী সমাজ নিশ্চিহ্ন ও শক্তিহীন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও গণতন্ত্রের আবির্ভাবের ফলে এখন শ্রমিক অর্থাৎ মেহনতি জনতাই সব দেশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে এদের জীবনের বিচিত্র ঘটনা ও সমস্যা আজ বড় হয়ে উঠেছে। আধুনিক জীবন সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এ শ্রমিক শ্রেণীর জীবনও তাই আমাদের সাহিত্যের বিষয়বস্তু। অনু- বস্ত্রের সমস্যাই এদের জীবনের সমস্যা, তাই আধুনিক সাহিত্যে এই সমস্যারই ছায়াপাত হচ্ছে।
জীবনের সাথে সাহিত্যের সম্পর্ক যে কত নিবিড় ও গভীর এটা তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। তবুও একথা সত্য যে অন্ন-বস্ত্রের সমস্যা সমাধান সাহিত্যের ধর্ম নয়, সাহিত্যের কাজ নয়। জীবনের মহত্ত্ব ও সৌন্দর্যের দিকে ইঙ্গিত করা ও তার রসমূর্তি গড়ে তোলাই সাহিত্যের প্রধান ধর্ম। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের অভাব অভিযোগ ও প্রাণ ধারণের নিত্যবস্তু থেকে বঞ্চিত হলে মহত্ত্ব ও সৌন্দর্য চর্চা নিছক বিলাস হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যই সাহিত্যিক জীবনের প্রাথমিক চাহিদা ও প্রয়োজনকে বিস্মৃত হতে পারেন না। তাই সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, সমাজচিত্র ও জাতীয় চেতনার প্রতিচ্ছবি।
জাতীয় চেতনা: আমাদের জীবনের রঙ্গমঞ্চে অবিরাম অবিশ্রান্তভাবে চলছে সুখ-দুঃখের বিচিত্র অভিনয়। প্রতিটি মানুষ এর মধ্য থেকেই আহরণ করে নিজ জীবনের সঞ্জবনী সুধা। সুখ-দুঃখ, আশ- নিরাশার দ্বন্দ্বে দোলায়িত এই জীবন-সংসার থেকে এমন করে মনের নিভৃত কোণে গড়ে ওঠে ব্যক্তি, চরিত্রের পাকা বুনিয়াদ । ব্যক্তির আপন বৈশিষ্ট্য যদি বহির্জগতের এ প্রভাবকে বিকৃত না করত, তাহলে জাতির প্রতিটি লোকের চেতনা আমরা একই রকম দেখতে পেতাম।
তথাপি-ব্যক্তি জীবনের খুঁটিনাটি সহস্র ভেদ সত্ত্বেও গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায় গোটা জাতির বিশেষ বিশেষ দিকে একটা প্রবল। ঝোঁক আছে। ঐ ঝোঁকের মূলে যা থাকে তাকেই বলে জাতীয় চেতনা। এই বিশেষ ঝোঁকের জন্য একটি জাতি আর একটি জাতি থেকে স্বতন্ত্র। লেখকের মনের মণিকোঠায় সাহিত্য ফুটে ওঠে ফুলের মতো। সে ফুল ফোটানোর জন্য লেখক রস গ্রহণ করেন জাতীয় চেতনার মৃত্তিকা হতে। এ জন্যই সাহিত্যে পাওয়া যায় জাতীয় চেতনার নিদর্শন।
জাতীয় চেতনার বিবর্তন: আমরা স্বাধীন জাতি, স্বাধীনতা প্রিয় জাতি। কিন্তু আমাদের ইতিহাস পরাধীনতার ইতিহাস। সেই সুবাদে আমরা এসেছি অনেক জাতির সংস্পর্শে, আমাদের মনের কপাটেআঘাত করেছে নানা রকমের বিজাতীয় ভাবধারা। একদিন যাকে লালন করেছিলাম অতি সন্তর্পণে মনের নিভৃতে নেপথ্যে। কুৎসিত ভেবে পরম উপেক্ষায় ফেলে এসেছি জীবনপথের মাঝখানে। তাই আমরা আনকোরা, নতুন, আগাগোড়া পরিবর্তিত জাতি।
আমাদের সত্যিকার পরিচয় পাওয়া যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পাতায়। অবিরাম পরিশ্রমের পরে বিশ্রাম যেমন চিরন্তন সত্য, ঠিক তেমনই সাহিত্যিকরা যতই বাকবিস্তার করুন না কেন, যতই অপরিচয়ের রাজ্যে আমাদের নিয়ে যান না কেন, শেষ পর্যন্ত তাদেরকেও ফিরতে হয় এবং পাঠকদেরকেও ফিরাতে হয় জাতীয় চেতনার পরম নির্ভরস্থলে। সাহিত্য কল্প নাতিকা হলেও তার মূল থাকে জাতির মনোভূমিতে। গোড়া ছাড়া আগা যেমন নিতান্ত, আজগুবি, সাহিত্যিকের মনটাকেও তেমনিই স্বয়ভূ মনে করা করপনা-বিরুদ্ধ।
সাধারণ মানুষ জানে না আপন মনের রহস্য। যদিও ঘটনার সংঘাতে মাঝে মাঝে স্ফুলিঙ্গের মত নিগূঢ় চরিত্রের একটা অস্ফুট ইঙ্গিত ধরা পড়ে, তবুও সুলেখক না হলে কারও পক্ষে আপন মনকে তার সমস্ত ঐশ্বর্যসহ প্রকাশ করা সম্ভব নয়। চরিত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো অতি নিপুণ দর্শকের দৃষ্টিও এড়িয়ে যায়। সুসাহিত্যিকের লেখায় ফাঁকে ফাঁকে সেই অবরুদ্ধ আকোগুলো ফুটে উঠে; নিপুণ পঠকের হৃদয়ে দোলা দেয় বলেই তার লেখার ভিতর সারা দেশের অন্তঃপ্রকৃতির কথা মূর্ত হয়ে ওঠে।
সাহিত্য ও জাতীয় চেতনা : সাহিত্য মানুষের জীবনচিত্র। আর এ মানুষ বাস করে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশাল প্রতিবেশে। সে জন্য সাহিত্যিক পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ ও জাতীন চেতনাকে অস্বীকার করতে পারে না। সেজন্য সাহিত্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে জানা যায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে, উপলব্ধি করা যায় জাতীয় চেতনাকে। যে জাতির চরিত্র যত উন্নত, সে জাতির সাহিত্যে ধ্বনিত হয় উন্নত সুর। আবার সাহিত্যের উন্নতির সাথে শুরু হয় জাতির চরিত্রোৎকর্ষ।
বেণু ও বীণার আওয়াজ স্বতন্ত্র; যদিও উভয়েই বাজানো চলে একই গান। তেমনই প্রত্যেক জাতির আছে বিভিন্ন চারিত্রিক সত্তা, যাদের মিলনে গড়ে উঠবে একদিন মহামানবের সভ্যতা। পরানুচিকীর্ষার ফলে আমরা যদি সেই স্বাতন্ত্র্য হারাই তাতে না আসবে আমাদের জাতীয় কল্যাণ, না হবে বিশ্বের সমৃদ্ধি। সাহিত্য যেন জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ নিয়ে তৈরি বহুতন্ত্রী বীণা; যার ঝংকারে ধ্বনিত হয়। জাতির চেতনার ব্যঞ্জনা। অনুভূতি ও প্রকাশভঙ্গির নৈপুণ্যে সাহিত্য জাতির মর্মে জাগায় সুর।
বিশ্বের দরবারে পথে প্রান্তরে দেশ-বিদেশের শ্রোতা সেই সুরের অমৃত দিয়ে ভরে নেয় তাদের হৃদয়ের পাত্র। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়- পুষ্প উদ্যানের পরিচয় যেমন তার সৌন্দর্যে ও গন্ধে, একটি জাতির পরিচয় তেমনই তার সাহিত্যে।
সাহিত্যে জাতীয় চেতনার প্রভাব : সাহিত্যে মানবজীবনের যে উপকরণ প্রবেশ করে তা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনেরই বিষয়বস্তু। কারণ মানুষ নিজেই সমাজ, নিজেই রাষ্ট্র। কারণ, সমাজ বলতে সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীকেই বোঝায়। আর রাষ্ট্র তার সম্প্রসারিত রূপ। জাতীয় জীবনে আছে বিপুল বৈচিত্র্য। মানুষ তার সংকীর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তার খণ্ডাংশ হয়ত প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন যখন সাহিত্যে রূপ লাভ করে তখন কবি সাহিত্যিকরা নিজেদের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্বাচিত ও গ্রহণযোগ্য উপায়ের রূপটুকু সাহিত্যে স্থান দেন।
এতে পাঠকের চোখে সমাজের বিচিত্র রূপ প্রতিফলিত হয়। সাহিত্য এভাবে অজ্ঞাত জগতের সন্ধান দেয়। অতীত আর বর্তমান মানব সভ্যতার যে চিত্রটি পাঠক প্রত্যক্ষ করে, সেটি তার কাছে উপভোগ্য হয় । সমাজ ও জাতীয় জীবনের উপর রচিত সাহিত্য পাঠকদের সচেতন করে। সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকাশিত জাতীয় জীবনের সুখকর চিত্রটি যেমন পাঠককে আনন্দিত করে, তেমনই জাতীয় জীবনের বেদনা কাতর ছবিটিও পাঠক হৃদয়ে নাড়া দেয়। সাহিত্যের মাধ্যমে উচ্চকিত হয় বঞ্চিত মানুষের কন্ঠস্বর।
স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধিকার অর্জনের দাবি আর উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল যেমন সাহিত্যে অনুরণিত হ্যা, তেমনই শোষণের প্রতিকারের উচ্চারণও সাহিত্যে কান পেতে শোনা যায়। এভাবেই জাতীয় জীবন ও চেতনা সাহিত্যে প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হয়ে সাহিত্যের সঙ্গে জাতীয় জীবন ও চেতনার সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে।
জাতীয় চেতনায় সাহিত্যের প্রভাব: এ কথা সত্য যে, সাহিত্য কখনো মানুষকে শিক্ষা দানের দায়িত্ব গ্রহণ করে না। হৃদয়ের নিভৃত কুরো বিনোদনের আবহ সৃষ্টিই তার কাজ। কিন্তু সাহিত্যের প্রভাবে মানুষ প্রভাবিত হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এমন অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে যার পেছনে সাহিত্যের প্রভাব বিশেষভাবে কার্যকরী, যেমন-ফরাসি বিপ্লব। সাহিত্য মানুষকে সত্যিকার মানুষ করে তোলে। মানুষের দেশ, কাল, ইতিহাসকে জানার জন্য সাহিত্য সাহায্য করে।
অতীত আর বর্তমান জীবন সাহিত্যের রসময় উপজীব্য। জাতির ভবিষ্যৎ রচনায়, জাতীয় সংস্কৃতির সম্ভাব্য রূপাঙ্কনে সাহিত্য অপরিহার্য উপাদান। সাহিত্য হিংসায় কোলাহলমুখর উন্মত্ত পৃথিবীতে দুদণ্ডের শান্তি আনে, তারাগ্রস্ত মনে আনে উৎসাহের জোয়ার। একই চেতনায় উজ্জীবিত মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি এনে মানসিক প্রেরণা যোগায় এক একটি শ্রেণীর মানুষকে বাঁধে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে। মানুষের ব্যক্তি জীবনে সাহিত্যের এ প্রভাব জাতীয় জীবনকেও নিয়ন্ত্রণ করে।
সুখকর জীবনের জন্য দরকার একটি উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা। সাহিত্য এর পেছনে প্রতিনিয়ত কাজ করে। সাহিত্যের প্রেরণায় উদ্দীপ্ত জাতি নতুন রূপ লাভ করে। সাহিত্যের আদর্শে প্রভাবিত মানুষ রাষ্ট্রে ভাঙ্গাগড়ার কাজ করে। এর ফলে রাষ্ট্র পায় নতুন রূপ, এগিয়ে চলে সমৃদ্ধির পথে।
উপসংহার : জাতীয় চেতনা ও সাহিত্যের পারস্পরিক সম্পর্ক সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি জাতীয় জীবনকে সুন্দর করতে সহায়তা করে। জাতীয় চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে কোনো সাহিত্যের মধ্যেই জীবনের আনন্দ ও প্রেরণার উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে না। সে জন্য বৃহত্তর জাতীয় জীবন থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে। সাহিত্যে রূপ দিতে হবে। সার্থক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য এ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই অনুসরণযোগ্য। আবার সুন্দর জাতি গঠনের জন্য সাহিত্য থেকে প্রেরণা লাভ করতে হবে।
উন্নত লক্ষ্যে পৌঁছবার রাস্তা বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন রকম। জাতির পক্ষে সেই সুগম পথের সন্ধান রাখেন সাহিত্যিকরা। তিনি জাতীয় চেতনার অনুকূল পথেই যাত্রী। তাই সাহিত্যকে অনুসরণ করে আমরা পাই জাতির অন্তরঙ্গ পরিচয়। তবে সাহিত্যের আবেদন জাতির সংকীর্ণ সীমায় সীমাবদ্ধ নয়, এর আবেদন সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন ।।
আরও দেখুন: