কথ্য ও সাহিত্যের ভাষার বিবিধতা

বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ ও বহুমাত্রিক। এর কথ্য (বক্তৃতা) ও সাহিত্যের (লেখ্য) রূপের মধ্যে বৈচিত্র্য সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। বিভিন্ন শব্দভাণ্ডার, ব্যাকরণিক গঠন ও উচ্চারণপদ্ধতির পার্থক্যের কারণে বাংলায় দুটি প্রধান লেখ্য রূপের প্রচলন দেখা যায়—সাধু ভাষা এবং মান্য চলিত ভাষা

কথ্য ও সাহিত্যের ভাষার বিবিধতা

 

. সাধু ভাষা

সাধু ভাষা বাংলার প্রাচীন এক লেখ্য রূপ, যা মূলত সংস্কৃত ও পালি ভাষা থেকে আগত তৎসম শব্দভাণ্ডার দ্বারা প্রভাবিত। এতে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ ও জটিল ক্রিয়াবিভক্তি ব্যবহৃত হয়।

  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্যে সাধু ভাষার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিকদের রচনায় এর প্রভাব সুস্পষ্ট।
  • ব্যবহারের ধারা: দীর্ঘ বাক্যগঠন, কঠিন তৎসম শব্দ এবং অলংকারময় ভাষাশৈলী এর বৈশিষ্ট্য।
  • বর্তমান অবস্থা: আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সাধু ভাষার ব্যবহার প্রায় বিলুপ্ত। কেবলমাত্র ঐতিহাসিক সাহিত্য, পুরাতন দলিলপত্র বা কিছু আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে সীমিত আকারে এর ব্যবহার টিকে আছে।

 

কথ্য ও সাহিত্যের ভাষার বিবিধতা

 

 

. মান্য চলিত ভাষা

মান্য চলিত ভাষা, যা চলিতভাষা নামেও পরিচিত, বাংলার আধুনিক লেখ্য রূপ যেখানে কথ্য ভাষার ধারা ও বাগধারা প্রতিফলিত হয়।

  • ভাষাগত বৈশিষ্ট্য: অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত ক্রিয়াবিভক্তি, সরল বাক্যগঠন এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের শব্দসমূহের অন্তর্ভুক্তি।
  • সাহিত্যিক বিকাশ: উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থের মাধ্যমে মান্য চলিত ভাষা সাহিত্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • উৎপত্তি: নদিয়া জেলার শান্তিপুর অঞ্চলের কথ্য উপভাষা থেকে এর বিকাশ ঘটে, এজন্য একে অনেকে শান্তিপুরি বাংলা বা নদিয়া উপভাষা বলে থাকেন।
  • বর্তমান ব্যবহার: আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব রচনাই মান্য চলিত ভাষায় রচিত হয়। কলকাতা এবং দক্ষিণ–পশ্চিম পশ্চিমবঙ্গ অঞ্চলে এই ভাষার কথ্য রূপ ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

. আঞ্চলিক উপভাষার বৈচিত্র্য

বাংলা ভাষার কথ্য রূপে আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ব্যাপক।

  • বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের কথ্য ভাষা মান্য চলিত বাংলার তুলনায় ভিন্নধর্মী, যা শব্দভাণ্ডার, উচ্চারণ ও বাক্যগঠনে আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে।
  • পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও স্বতন্ত্র আঞ্চলিক উপভাষা বিদ্যমান, যা মান্য চলিত ভাষা থেকে কমবেশি ভিন্ন।
  • অধিকাংশ বাঙালি দৈনন্দিন জীবনে মান্য চলিত বাংলা ও নিজস্ব আঞ্চলিক উপভাষা—উভয় রূপে কথা বলতে সক্ষম হলেও, অনেক ভাষাবিদ এর পূর্ণ দ্বিভাষিক দক্ষতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।

 

কথ্য ও সাহিত্যের ভাষার বিবিধতা

 

বাংলা ভাষার কথ্য ও সাহিত্যিক রূপের এই বৈচিত্র্য ভাষাটিকে করেছে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত। সাধু ভাষা আমাদের সাহিত্য ইতিহাসের ঐতিহ্য বহন করে, আর মান্য চলিত ভাষা বর্তমান সাহিত্যের প্রাণশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আঞ্চলিক উপভাষাগুলি এই ভাষার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আরও গভীর করে তুলেছে, যা বাংলা ভাষাকে বিশ্বে অন্যতম বৈচিত্র্যময় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

Leave a Comment