সাধু ও চলিত ভাষারীতির পার্থক্য ও মিশ্রজনিত কারনে গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট ভাষা – বিষয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “বাংলা ভাষা” বিভাগের একটি পাঠ।
Table of Contents
সাধু ও চলিত ভাষারীতির পার্থক্য ও মিশ্রজনিত কারনে গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট ভাষা
মিশ্রজনিত কারনে গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট ভাষা :
বস্তুত, বাংলা গদ্যে বা রচনায় এবং চলিত কথাবার্তায় এ দু রীতির মিশ্রণ দূষণীয়। তাই যে-কোনো ভাষা বা রচনা হয় বিশুদ্ধ ‘সাধু ভাষা’য়, না-হয় বিশুদ্ধ চলিত ভাষায় রচিত হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে বাংলাভাষী সব মানুষকেই বিশেষভাবে সচেতন ও যত্নশীল হতে হবে।
সাধু ও চলিত ভাষারীতির পার্থক্য:
সাধু ও চলিত রীতির মিশ্রজনিত কারনে গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট ভাষা:
“সাধু” ও “কলিত ভাষা বা রীতির মিশ্রণের ফলে বাংলা ভাষায় বা গলো যে তৃতীয় রূপের প্রকাশ ঘটে, তা ‘গুরুচণ্ডালী ভাষা’-দোষে দুষ্ট বলে অভিহিত হয় এবং তা ভাষার প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। ফলে ভাষা ব্যাকরণগত দোষে ফুট হয়। এ “মুচণ্ডালী ভাষা দোষে দুষ্ট হবার জন্যে বাংলা গদ্যের প্রথম পর্যায়ের কোনো কোনো গলা লেখককেও বিদ্রূপ করে বলা হতো— শহ-গোড়া’ ‘মড়া গাহে’র দল শবদাহ’ বা ‘মড়া-পোড়া’ না বলে)। তাই, বাংলা খাদ্যে বা রচনায় এবং চলিত কথাবার্তায় এ দু রীতির মিশ্রণ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ এবং দূষণীয় ও বর্জনীয়ও বটে। নিচে গুরুচণ্ডালী দোষে দুষ্ট ভাষার একটি উদাহরণ লক্ষ করা যাক—
“ধরণীর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো জিনিস জানিবার ও বুঝিবার প্রবৃত্তি মানুষের মন থেকে যেদিন চলিয়া যাবে সেদিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে।”
উল্লিখিত বাক্যটিতে সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণের ফলে তা গুরুচণ্ডালী ভাষা-দোষে দুষ্ট। এ বাক্যটির শুদ্ধ সাধু ওচলিত রূপ হবে নিম্নরূপ :
সাধু রীতিতে সংশোধন :
ধরণীর মধ্যে যাহা সবচাইতে বড় জিনিস তাহা জানিবার ও বুঝিবার প্রবৃত্তি মানুষের মন। হইতে যেই দিন চলিয়া যাইবে সেই দিন মানুষ পুনরায় পশুত্ব লাভ করিবে।
চলিত রীতিতে রূপান্তর :
পৃথিবীর মাঝে যা সবচেয়ে বড় জিনিস তা জানবার ও বোঝবার প্রবণতা মানুষের মন থেকে যেদিন চলে যাবে সেদিন মানুষ আবার পশুত্ব লাভ করবে।
ব্যতিক্রম:
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে ছন্দের প্রয়োজনে ও মাত্রাসঙ্গতির কারণে ‘সাধু’ ও ‘চলিত’ রীতির মিশ্রণ ঘটলে সাধারণত তা দূষণীয় বলে বিবেচিত হয় না। কবিতা রচনার সময় কবিকে নির্দিষ্ট মাপে শব্দ ব্যবহার করতে হয়। ছন্দের রীতি অনুসরণ করে বিশেষ বিশেষ মাপে শব্দের প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। পংক্তির শেষে মিল রাখতে হয়। ফলে কবি শব্দের ব্যবহারে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করেন। তাই কবিদের বেলায় সাধু আর কথ্য রীতির মিশ্রণ স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। যেমন দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।’- এই দৃষ্টান্তে ‘উহারে’ শব্দটি সাধু রীতির। কিন্তু ‘দেখে’ ক্রিয়াপন কথ্য রীতির। সাধু রীতির সর্বনামপদ “উহারে’ কথ্য রীতিতে পরিবর্তিত করে ‘ওরে করলে কবিতায় ছন্দপতন ঘটবে। আরেকটি উদাহরণ লক্ষ করি—
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারা দিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি ।”
এখানে “উঠিয়া ক্রিয়াপদ সাধু রীতির, আর হয়ে” ক্রিয়াপদ কথ্য রীতির। দুটিকে যে-কোনো একটি রীতিতে প্রয়োগ করলে কবিতার ত্রুটি ঘটবে। কবিরা ছল মেলানোর সুবিধার জন্যে এ-ধরনের সাধু কথ্যের মিশ্রণ ঘটানোর ব্যাপারে সব সময়েই স্বাধীনতা পেয়ে থাকেন।

লক্ষ কর (ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন কোন ক্ষেত্রে শুদ্ধ বলে বিবেচিত হয়):
ভাষার যে বিভিন্ন উপকরণ ধ্বনি, শব্দ, পদ, বাক্য ইত্যাদি তাদের বিন্যাস ও ক্রিয়া বিধিবদ্ধভাবে চালিত করার জন্যে প্রচলিত ব্যাকরণ কতকগুলো নীতিনির্দেশ প্রস্তুত করে। কিন্তু ব্যক্তিগত প্রবণতা, বিশেষ বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতি ও সাহিত্যিক প্রেরণার জন্যে ভাষা ব্যবহারকারী সব সময় সেই প্রচলিত গতানুগতিক রীতিনীতি মেনে চলেন। না, প্রচলিত রীতিনীতি থেকে এই যে সরে আসা, এটা যদি বিশেষ ভাব প্রকাশে প্রতিবন্ধক না হয়ে বরং অপরিহার্য। হয়, বক্তার সামগ্রিক প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তাহলে আমরা ব্যাকরণের সেই নিয়ম- লঙ্ঘনকে (deviation from norms) আর অশুদ্ধ প্রয়োগ বলতে পারি না, তখন তাকে ভাষাব্যবহারে বৈচিত্র্য ( variation in the use of language’) বলে স্বীকৃতি জানাই। যেমন, ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত আলোচনা থেকে একটি সহজ দৃষ্টান্ত তুলে দিই-
িভও পারেতে কালো রঙ। / বৃষ্টি পড়ে ঝম ঝম্ ॥
এপারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুকটুক করে। গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে “
ধরিয়ে না দিলে সচরাচর চোখে পড়বে না যে, ব্যাকরণের নিয়মে ছড়াটিতে একটি অনুদ্ধ প্রয়োগ রয়েছে। ‘ভাই’ শব্দটি সাধারণত, পুংলিঙ্গ বাচক। কিন্তু তার বিশেষণটি স্ত্রীলিঙ্গবাচক হয়েছে ‘গুণবতী’। এখানে কবি স্পষ্টত ব্যাকরণের নিয়ম থেকে সরে এসেছেন। কিন্তু যদি ব্যাকরণের নিয়ম মেনে এখানে ‘গুণবান্’ শব্দটি আমরা বসাই তা হলে ছড়াটির বিশেষ রসই নষ্ট হয়ে যাবে। যে সরলা বালিকা বধুটির শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পরে তার ফেলে আসা ছোট্ট তাইটির জন্যে মন কেমন করে সেই বালিকাবধূর গ্রাম্য সারল্যের সঙ্গে ওই প্রয়োগের সামঞ্জস্য আছে। এই শব্দটি এই ছড়ার সামগ্রিক মাধুর্যের সঙ্গে যুক্ত।
কিংবা-
“খোকা এল বেড়িয়ে।/ দুধ দাও গো জুড়িয়ে
দুধের বাটি তপ্ত।/ খোকা হলেন থেপ্ত
খোকা যাবেন নায়ে / লাল জুতুয়া পায়ে“
এই ছড়ায় ‘জুড়ুয়া’ শব্দের গঠন ব্যাকরণের প্রচলিত নিয়মে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ‘জুতা’র সঙ্গে ‘উয়া’ প্রত্যয় ব্যাকরণের নিয়মে সঙ্গতিপূর্ণ হয় নি। কিন্তু শিশুটির প্রতি যে স্নেহমমতার ভাব তা তার ছোট জুতার সঙ্গেও যেন জড়িয়ে আছে। এই ভাবটি ওই বিশেষ প্রত্যয়ের সাহায্যেই প্রকাশ পেয়েছে। এই যে ব্যাকরণের নিয়মের বাতিক্রম একে অশুদ্ধ বলতে পারি না, বরং ওই বিশেষ ভাবটি প্রকাশের পক্ষে ওই প্রত্যয়টি অপরিহার্য। এই অপরিহার্য বিষয়টি হল ভাষার শৈলী গুণ। বস্তুত শৈলীবিজ্ঞানও ব্যাকরণের অপর একটি আলোচ্য বিষয়।
আরও দেখুন: