সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে | ভাব-সম্প্রসারণ | ভাষা ও শিক্ষা

সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে| ভাব-সম্প্রসারণ | ভাষা ও শিক্ষা , ভাববীজটি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি, এ ধরনের কবিতার চরণে বা গদ্যাংশে সাধারণত মানবজীবনের কোনাে মহৎ আদর্শ, মানবচরিত্রের কোনাে বিশেষ বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা, প্রণােদনমূলক কোনাে শক্তি, কল্যাণকর কোনাে উক্তির তাৎপর্যময় ব্যঞ্জনাকে ধারণ করে আছে।

সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে

যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে;

সৃষ্টিশীল যা কিছু দৃশ্যমান, তার সবকিছুই প্রবহমান। চলমানতাই জীবনের সজীবতার লক্ষ্য নিশ্চলতা মৃত্যু। স্থবিরতা ব্যক্তি ও সমাজজীবনকে যেমন স্তিমিত করে দেয়, জাতীয় জীবনকেও করে বিপর্যস ঐশ্বর্যমণ্ডিত ও সমৃদ্ধ জাতীয় জীবনে তাই গতিশীলতার কোনো বিকল্প নেই । নদীর গৌরব তার স্রোতধারার মধ্যে, স্রোতই নদীকে গতিশীলতা দান করে, তার বুকে ভরে দেয় পূর্ণতার সার্থকতা। সব জঞ্জাল, মালিন্য আর ক্লেদাক্ত আবর্জনা নদীর দুরন্ত গতিধারায় ভেসে চলে যায়।

 

সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে;

 

নদীর বহমান ধারায় প্রতি মুহূর্তে জলরাশি নিত্য-নতুন, কোনো পঙ্কিল বাধা তার জলকে মলিন করে তুলতে পারে না। সব মালিন্য ধৌত করে নদী আপন বেগে চির-চঞ্চল; উৎস থেকে মোহনার পূর্ণতার অভিমুখে নিত্য ধাবমান। এই নদীই তার গৌরব হারায় যখন কোনো কারণে তার বেগ মন্দীভূত হয়ে পড়ে, তার স্রোতধারা রুদ্ধ হয়ে যায়, তার গতি স্থির হয়ে যায়। তখন তার বুক শৈবাল বা আবর্জনায় ভরে ওঠে। তদ্রুপ, ব্যক্তিগত তথা সামাজিক জীবনে কোনো ব্যক্তি যদি স্থবির হয় তবে তার জীবনে উন্নতির আশা অবাস্তব কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। নদীর মতোই জাতির জীবনের পূর্ণতাও নির্ভর করে তার চলমানতার ওপর।

যদি কোনো জাতি উদ্যম ও সজীবতা হারিয়ে ফেলে, স্বাধীন চিন্তা তাদের মনে উদ্দীপনা সৃষ্টি না করে, তবে সে জাতি পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে সমান তালে পা ফেলে চলতে সমর্থ হয় না। যে জাতির স্বাভাবিক চলনধর্ম আছে, সে জাতিই নবীন সভ্যতাকে সহজে আত্মসাৎ করতে পেরেছে।

 

সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে;

 

সংকীর্ণ আচার-বিচার- সংস্কার সে জাতির গতিপ্রবাহকে রুদ্ধ করতে পারে না, সচলতার বেগেই সব বাধাকে অনায়াসে সে অতিক্রম করে যায়। স্বচ্ছন্দ ও নির্বাধ গতিতে এগোতে না পারলে জাতির আত্মবিকাশ ব্যাহত হয়। পদে পদে শাস্ত্রের অনুশাসন ও দেশাচারের বাধা-নিষেধ স্বতঃস্ফূর্ত বহমান জীবনধারাকে স্তব্ধ করে। চলমানতা হারিয়ে ফেলার অর্থই হল জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সফল সম্ভাবনার অপমৃত্যু। জীবনে উন্নতির চাবিকাঠি হল সংস্কারমুক্ত হয়ে গতিময়-জীবনের দিকে অগ্রসর হওয়া।

যে জাতি যতদিন উন্নয়নকামী ও কর্মঠ থাকে, ততদিন কোনোরূপ কুসংস্কার তার গতি রোধ করতে পারে না। কিন্তু সে-জাতি যদি তার পুরোনো ঐতিহ্যকে বুকে ধরে অগ্রগতির পথে না এগোয় তবে স্রোতহীন নদীর মতোই শত সংস্কার এসে তাকে ঘিরে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে সে এ-ধরা থেকে লয়প্রাপ্ত হয়। একইভাব ব্যক্তিজীবনেও গতিশীলতার প্রয়োজন রয়েছে, সংগ্রামের-সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ ফসলটি তুলে নেওয়া যায়। কর্মবীর মানুষই সৌভাগ্যের স্বর্ণশীর্ষে হয় আসীন।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বিপরীতপক্ষে যারা অলস, কর্মবিমুখ, জীবনের চলার পথ যাদের রুদ্ধ, স্থির, তাদের পদে পদে বরণ করে নিতে হয় পরাজয়, জীবনভর তাকে হতাশায়, নিরাশায় দীর্ঘশ্বাসের সেতু রচনা করতে হয়। যে জাতির জীবনধারা অচল, অসার সে জাতির অপমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। গতিশীল জীবনপ্রবাহই জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনকে করে জীবন্ত ও উজ্জ্বল।

আরও দেখুন:

Leave a Comment