সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাষণ এর একটা নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। শিক্ষার্থীরা এই নমুনাটি বারবার দেখে অভ্যাস করবেন। অভ্যস্ততা তৈরি হবার পরে শিক্ষার্থী নিজের ভাষায় নিজের মতো করে নিজের বক্তৃতা তৈরি করে নেবেন।
সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাষণ
সম্মানিত সভাপতি, আমন্ত্রিত আলোচকবৃন্দ ও সুধীবৃন্দ, আসসালামুআলাইকুম,
আজ অত্যন্ত একটি প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনায় অংশ নিচ্ছি। সন্ত্রাস বর্তমানে আমাদের দেশের একটি ভয়াবহ জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেই চলেছে। সম্প্রতি সন্ত্রাস কোনো সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে আটকে নেই, সারা দেশ জুড়ে এর সহিংস বিস্তার ঘটেছে। সরকারি অফিস, শিল্প-কারখানা, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, ব্যক্তিজীবন কিছুই আজ সন্ত্রাসী থাবা থেকে মুক্ত নয়। সন্ত্রাসীদের নির্বিচার অস্ত্রের আঘাত থেকে নিরীহ শিশু, মেধাবী ছাত্রী, সাধারণ ব্যবসায়ী, বিত্তবান শিল্পপতি, কৃতী অধ্যাপক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ, পথচারী এমনকি বিদেশি রাষ্ট্রদূতের মতো লোকও সন্ত্রাসীদের থাবার শিকার।
বোমাবাজির মতো ভয়াবহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মুহূর্তের মধ্যে ছিনিয়ে নিচ্ছে শত শত মানুষের অমূল্য জীবন, ভেঙে দিচ্ছে তাদের সাজানো সংসার। চারদিকে সন্ত্রাসী তৎপরতা এমনভাবে অক্টোপাসের মতো আকড়ে ধরেছে যে ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা কারোর নেই। মানুষ আজ সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসের নগ্ন ছোবল থেকে আজ আর কেউই নিরাপদ নয়। এ কারণে আজ সর্বমহল থেকে দাবি উঠেছে, ‘সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ চাই’। সুধীবৃন্দ, আপনারা অবগত যে সন্ত্রাসে সম্প্রতি নতুন মাত্রা পেয়েছে। সহিংস সন্ত্রাসের সঙ্গে যোগ হয়েছে বোমাবাজি, অতি সম্প্রতি গ্রেনেড হামলা ও আত্মঘাতী বোমাবাজি।
এই তো কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের দেশে আমরা সন্ত্রসি শব্দটা ব্যবহার করে আসছি ছিঁচকে ছিনতাইকারী, পটকা ফোটানোওয়ালা, বড়জোর দাগি খুনি-চাঁদাবাজদের বোঝাতে। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদ বলতে যা বোঝায়, তার কোনো অস্তিত্ব এ দেশে ছিল না। এমনকি যখন উদীচীর সম্মেলনে কিংবা ছায়ানটের আসরে বোমা পড়ল, তখনো এটাকে একটা বিচ্ছিন্ন তৎপরতা বলেই অনেকে হালকাভাবে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন বোমা পড়েছে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর, বোমা পড়েছে জাতীয় নেতৃবৃন্দের ওপরে, মাজার, সিনেমা হল, গির্জা, আহমদিয়া মসজিদ ইত্যাদির ওপর, তখন আমরা কিছুটা সচেতন হই।

বুঝতে পারি আমরা ঢুকে পড়েছি সন্ত্রাসবাদের সর্বনাশা অগ্নিগোলকের ভেতরে। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর এ দেশ ছেড়ে গেছেন। আর কত না সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী পালিয়ে যাচ্ছে আসার আগেই । সুধী, আমাদের সবকিছু নিয়ে আমাদের সহস্র বছরের ইতিহাস, আমাদের ভাষা-সঙ্গীত-সাহিত্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, আমাদের মধুসূদন, রবীন্দ্র-নজরুল, বেগম রোকেয়া, লালন, আমাদের পির-দরবেশ- আউলিয়া, আমাদের সকল রাজনৈতিক দল পনেরো কোটি মানুষকে সন্ত্রাস নামের এই মহাব্যাধিতে গ্রাস করতে চলেছে। আমরা এটা সহ্য করতে পারব না।
এত গরিব দেশ, এত দুর্বল অর্থনীতির একটা দেশের পক্ষে সন্ত্রাসবাদের বিলাসিতা সাজে না। আমরা এর প্রতিকার চাই সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে চাই। বাংলাদেশ একটি দরিদ্র কিন্তু উন্নয়নশীল দেশ। দারিদ্র্য বিমোচন করে ব্যাপক উন্নয়নই এর লক্ষ। এই দেশ আগুনে পুড়ে যাওয়া জনবসতির মতো ছাই ভস্ম আর পোড়া কাঠ নিয়ে পড়ে থাকবে বিরানভূমির মতো এই দেশের কোনো ভবিষ্যৎ থাকবে না— এটা আমরা মানতে পারি না। তীব্র ভাষায় আমরা এর প্রতিবাদ করছি। সুধীবৃন্দ, এখন এটি আর কারো অজানা নয় যে, রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
১ জানুয়ারি, ২০০৫, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তেও এর পক্ষেই মত দেওয়া হয়েছে, বলা হয়েছে যে, ‘এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, অস্ত্রের রাজনীতি চালু করার পশ্চাতে বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানও কম নয়— প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলও এ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক নেতারা নিজেরাও সশস্ত্র ক্যাডার পালন করেন।… আমাদের বৃহত্তম দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ পৃথকভাবে দেশে অব্যাহত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে।…
তাই সন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বাক্ষর রাখতে হবে। আমরাও বলি শুধু দুই প্রধান দলের বিবাদ, মারামারি, হানাহানির কারণেই এ সন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছি না। বর্তমান ধারার অদূরদর্শী রাজনীতি চলতে থাকলে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা ও হিংস্রতা আরও তীব্র এবং অধিকতর ব্যাপক হবার আশঙ্কা বেশি থাকবে। সন্ত্রাসরোধে তাই সুস্থধারার রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। বোমাবাজি ও সন্ত্রাসী তৎপরতার ভয়াবহ পরিণতি থেকে রাজনৈতিক নেতা ও জনগণকে রক্ষা করতে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অবসানের জন্য আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই একমাত্র পথ।
আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সন্ত্রাস বিরোধী ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। তবেই আমরা সন্ত্রাসমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারব। প্রিয় সুধীবৃন্দ, আসুন আমরা একটা স্বপ্ন দেখি। আমাদের নেতারা আগুন নিয়ে এই আত্মহননের খেলার শেষপ্রান্তে এসে ঘুরে দাঁড়াবেন। তারা এক্ষুনি বন্ধ করবেন এই সন্ত্রাসের উৎস। সন্ত্রাসবাদীদের উচ্ছেদ করবেন সমূলে। এখনই।
দেশ আজ ভয়ানক বিপদের মধ্যে। তা থেকে দেশটাকে তারা ঘুরিয়ে নিয়ে আসবেন উন্নতির দিকে। আমাদেরও এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। পতনের শেষ বিন্দুসীমায় দাঁড়িয়ে আসুন আমরা ফিরে দাঁড়াই। ঘুরে পথ চলতে শুরু করি। আসুন আমরা একটা স্বপ্ন দেখি। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে আমরাও হব পৃথিবীর এক সেরা দেশ। যেদিন আমরা সত্যিকার গর্বভরে গাইতে পারব : সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি। ধন্যবাদ সকলকে।
আরও দেখুন: