Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

শিষ্টাচার নীতি রচনা [ ১০০০+ শব্দ ]

শিষ্টাচার নীতি রচনার একটা নমুনা তৈরি করবো আজ। এই রচনাটি আমাদের “প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ দূষণ” সিরিজের একটি রচনা। আমাদের সকল রচনা শিক্ষার্থীদের ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করার জন্য নয়। এই রচনা থেকে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের নিজের ভাষায় লিখবেন।

শিষ্টাচার নীতি রচনা

| নীতি চরিত্র মূল্যবোধ | বাংলা রচনা সম্ভার ,  ভূমিকা : যে গুণাবলী মানব চরিত্রকে সুন্দর, আকর্ষণীয় ও গৌরবান্বিত করে তোলে তার মধ্যে শিষ্টাচার বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ মানব চরিত্রের অলঙ্কার। সুন্দর আদব-কায়দা মানবজীবনের সম্পদ। জীবনকে যথার্থভাবে বিকশিত করা এবং যথার্থরূপে উপভোগ্য করার জন্য শিষ্টাচার অপরিহার্য। নিজেকে অন্যের কাছে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যে উপস্থাপনের জন্য শিষ্টাচার বা সুন্দর আদব-কায়দার কোনো বিকল্প নেই। জীবনের সফলতার জন্য সৌজন্যবোধ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের মনে মানুষ যদি স্মরণীয় হতে চায় তবে তার শিষ্টাচার তাকে প্রভূত পরিমাণে সাহায্য করবে। তাই শিষ্টাচার মানব চরিত্রের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয় তার জন্য নিরন্তর অনুশীলন চলে ।

শিষ্টাচার সম্পর্কিত ধারণা :

আচরণে ভদ্রতা ও সুরুচিবোধের যৌক্তিক মিলনের নাম শিষ্টাচার। শিষ্টাচার মনের সৌন্দর্যের বাহ্য উপস্থাপনা। তার মার্জিততম প্রকাশ ঘটে সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে। যে মানুষ যত বেশি শিষ্ট তার প্রিয়তাও তত বেশি। আর এ শিষ্টতা তার চরিত্রকেও করে আকর্ষণীয়। মানুষের মাঝে লালিত সুন্দরের প্রকাশ তার চরিত্র। শিষ্টতা সেই সুন্দরের প্রতিমূর্ত রূপ। অন্তর্গত মহত্ত্ব মানুষকে উদার করে। আর সেই উদারতা ব্যক্তিকে ঝড় করে না, তাকে শিষ্ট আর ভদ্র হতে শেখায়। মানুষের মাঝে এ মহত্ত্বের পরিশীলিত প্রকাশই শিষ্টতা। সাধারণভাবে চালচলন, কথাবার্তায় যে ভদ্রতা, শালীনতা আর সৌজন্যের পরিচয় পাওয়া যায় তা-ই শিষ্টতা। শিষ্টাচার যেমন ব্যক্তিজীবনের তেমনি সমাজজীবনেরও গৌরবসূচক আভরণ ।

 

আচরণে যদি মানুষ শিষ্ট না হয়, ব্যবহারে উগ্রতা যদি পরিহার না করে তবে কখনো শিষ্টাচারী হওয়া সম্ভব নয় । স্বাভাবে কৃত্রিমতা পরিহার করতে না পারলে কখনো পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া যায় না। মানবিক সত্তা তার স্ফুরণে চরিত্রের সাধুতাকে অবলম্বন করে, তার প্রকাশ ঘটে শিষ্ট স্বভাবে। ঔদ্ধত্য আর উচ্ছৃঙ্খলতা এখানে পরাজিত হয়। অহঙ্কার অন্যকে ছোট ভাবতে শেখায়। শিষ্টতা বিপরীতভাবে মানুষকে সম্মান করতে শেখায়। কদর্যতা আর অশ্লীলতা শিষ্টাচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কাজেই ব্যক্তিকে হতে হয় আচরণে মার্জিত, বক্তব্যে সৎ, সরল আর স্পষ্ট। বিনয় মানুষকে ছোট করে না, বরং পরায় সম্মানের মুকুট। এ বিনয় শিষ্টতার অঙ্গভূষণ ।

শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :

আচরণে যে জাতি যত বেশি সভ্য সে জাতি তত বেশি সুশৃঙ্খল ও উন্নত। কেবল পশুপাখির মতো বেড়ে ওঠাই মানুষের লক্ষ্য নয়। আত্মোন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ ও জাতীয় জীবনে কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য। আর তা করতে হলে  শিষ্ট আচরণের অনুশীলন ছাড়া বিকল্প নেই। শিষ্টাচারের প্রথম প্রকাশ ঘটে ব্যক্তিস্বভাবে, যা ক্রমাগত ব্যক্তি থেকে আলোর বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা সমাজে, রাষ্ট্রে।

এর আলোতে উজ্জ্বল ব্যক্তির আত্মিক মুক্তির সাথে যোগ হয় বৈষয়িক আাগতি। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজের অপরাপর দশ জনের সাথে যোগাযোগ আর ভাবের আদান-প্রদান করতে হয়। এরই মাঝে শিষ্টজন সহজে সকলের মন জয় করতে পারে। পারস্পরিক সম্প্রীতির জন্য এর খুবই প্রয়োজন। কেননা সম্প্রীতি না থাকলে হিংসা আর হানাহানি সমাজকে ঠেলে দেয় বিশৃঙ্খলার দিকে।

শিষ্টাচারী ব্যক্তি দরিদ্র হতে পারে, কিন্তু তার সৌজন্য আর বিনয়ের মাধ্যমে সে সকলের প্রিয়তা অর্জন করে। শিষ্টজন সহজেই অর্জন করেন অন্যের আস্থা। অন্যের সহানুভূতি লাভ করার জন্য শিষ্টজনই উত্তম। অপরদিকে শিষ্টাচারীকে সকলে সম্মানের চোখে দেখে। সামাজিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্য শিষ্টাচারের বিকল্প নেই। এতে করে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সকলের আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। চূড়ান্ত পর্যায়ে আসে সুষম উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি ।

শিষ্টাচার ও ভদ্রতা :

অনেকে শিষ্টাচার ও ভদ্রতার মধ্যে একটি সীমারেখা টেনে থাকেন। তাদের মতে শিষ্টাচার আন্তরিক গুণ, আর ভদ্রতা বাহ্যিক আচরণ মাত্র। ভদ্রতা অনেক সময়ই শুধু মৌখিক ও কৃত্রিম; কিন্তু শিষ্টাচার মার্জিত রুচিসম্পন্ন হৃদয়ের স্বীয় গুণ। আমরা দুটিকে পৃথক করে দেখতে রাজি নই । মৌখিকই হোক আর আন্তরিকই হোক, অপরের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করাই শিষ্টাচার। কারণ তার দ্বারা শিষ্টাচারের উদ্দেশ্য সফল হয়। মৌখিকভাবে আরও প্রতি শিষ্ট ব্যবহার করলে আমার প্রতি তার কোনোরূপ বিরাগ জন্মানোর হেতু দেখি না।

অধিকন্তু মৌখিকভাবে ভদ্র ব্যবহার করতে করতে তা আন্তরিক গুণে পরিণত হতে পারে। আমাদের সকল সাধনাই এরূপ, বহিরঙ্গ থেকে অন্তরঙ্গে প্রবাহিত হয়; গেরুয়া বসনই মনের বৈরাগ্য আনে, পূজার মন্ত্রই ভক্তিতে পরিণত হয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, বিদ্যা ও পাণ্ডিত্যের সাথে শিষ্টাচারের বিশেষ সম্পর্ক নেই। খ্যাতনামা পণ্ডিতও অশিষ্ট হতে পারেন। তবে তাও সত্য যে, প্রকৃত বিদ্যা যেমন বিনয় দান করে তেমনি তা মানুষকে শিষ্ট এবং সুজন হতেও শিক্ষা দেয় ।

শিষ্টাচার ও সত্যাচরণ :

কেউ কেউ বলতে পারেন শিষ্টাচার রক্ষা করতে হলে সত্যকে অনেক সময় ক্ষুণ্ণ করতে হবে। কিন্তু সেরকম আশঙ্কার কারণ নেই। প্রকৃত সত্যাচরণের অর্থ অন্যের হৃদয়-বেদনার কারণ হওয়া নয়। দুই-একটি বিশেষ ক্ষেত্র বাদ দিলে সত্য ভাষণের সাথে শিষ্টাচারের বিরোধ বড় একটি পরিলক্ষিত হয় না।

 

শিষ্টাচার ও ছাত্রসমাজ :

জ্ঞানার্জনে নিষ্ঠা, অভিনিবেশ আর শৃঙ্খলাবোধের পাশাপাশি শিষ্টাচারের অনুশীলন খুবই জরুরি। নৈতিক চরিত্রের উৎকর্ষের জন্য ছাত্রজীবনেই ব্যবহারে ভব্যতা আর শিষ্টতার সম্মিলন ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই । কাজেই দেখা যাচ্ছে জ্ঞানের সাথে শিষ্টাচারের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ । ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ ঘটে পোশাক-পরিচ্ছদে। রুচিশীল আর সরল জীবনযাপনের পাশাপাশি পোশাকের ক্ষেত্রেও সুরুচির পরিচয় থাকা দরকার।

শিষ্টাচার ও সমাজ :

সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিষ্টাচারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তা না হলে বিদ্বেষ, হিংসা, হানাহানি আর অশান্তি জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠায় সমাজব্যবস্থা ও সমাজ কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব প্রদর্শন করা দরকার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যৌক্তিক সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিলে শিষ্টাচারী হওয়া  যাবে না। সমাজে নিজের অবস্থান সম্পর্কে থাকতে হবে সতর্ক। সামাজিক অবস্থান শিষ্টাচারের মাত্রা নির্ধারণ করে। একইভাবে ক্রোধ আর প্রতিহিংসার মতো চারিত্রিক দোষগুলো অতিক্রমের চেষ্টা থাকতেই হবে। এসব বিপরীতমুখী দিকগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য দরকার, চারিত্রিক দৃঢ়তা।

শিষ্টাচার ও রাষ্ট্র :

জাতীয় জীবনে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিষ্টাতার প্রকাশ পায় রাষ্ট্র পরিচালনায়, নেতৃত্ব প্রদানকারীদের মধ্যে। এর প্রভাব পড়ে গোটা দেশজুড়ে। আবার আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিষ্টতার বিকল্প নেই। চরম লাভ-লোকসানের ব্যাপার ব্যবসায়-বাণিজ্যেও শিষ্টাচারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

চক্ষুলজ্জা ও শিষ্টাচার :

চক্ষুলজ্জা নামে একটি সামাজিক উপসর্গ শিষ্টাচারের বেনামীতে লোকসমাজে প্রচলিত আছে। চক্ষুলজ্জার খাতিরে অসত্যকে সত্য বলে স্বীকার করা একটি গুরুতর সামাজিক ব্যাধি । শিষ্টাচারের সঙ্গে দৃঢ়তার মিশ্রণই এই ব্যাধির সঠিক চিকিৎসা। এ দেশে অমায়িক এবং লোকপ্রিয় মানুষের খুবই অভাব। তাই আমাদের সমাজে এখনো শিষ্টাচার নামক স্বভাবটি গড়ে উঠতে পারেনি।

শিষ্টাচার অর্জনের উপায় :

শিষ্টাচার নিজ থেকে মানবহৃদয়ে জন্ম নেয় না। একে বরণ করে নিতে হয়। এর চর্চা শুরু হয় শিশুকাল থেকেই। তাই শিশু কোন পরিবেশে, কার সাহচর্যে কীভাবে বেড়ে উঠছে সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে প্রয়োজন শিক্ষার। কেননা আমৃত্যু চলতে থাকে শিষ্টাচারের অনুশীলন। শিশু পরিবার-পরিজন, সঙ্গী-সাথী কিংবা প্রতিবেশী যাদের সাহচর্যে থাকে তাদের কাছ থেকেই আচরণ শেখে। তাই সৎসঙ্গ শিষ্টাচারী হতে সাহায্য করে। স্কুল-কলেজেও শিক্ষার্থীরা শিষ্টাচারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। ভালো বইও একজন সৎ অভিভাবকের মতোই শিষ্টাচার শেখাতে পারে।

শিষ্টাচারহীনতার পরিণাম :

শিষ্টাচারের অভাব ঘটলে মানুষের জীবনে শুধুই অহং ও রুক্ষতা অবশিষ্ট থাকে। শিষ্টাচারহীন মানুষ অমার্জিত, রুক্ষ ও অভদ্র হয়ে থাকে। ব্যক্তির শিক্ষা কিংবা ক্ষমতা যতই থাকুক, অশিষ্ট আচরণের কারণে সে মানুষের কাছে পরিত্যাজ্য ও অশ্রদ্ধ হয়ে থাকে। মানুষের মনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এদের জীবন বৃথা, পশুর মতোই জৈবিক প্রাণী ছাড়া এরা অন্যকিছু নয়।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উপসংহার :

শিষ্টাচার মানবজীবনকে সুন্দর করে। উচ্চতা মানুষকে যেখানে অধঃপতনের দিকে ধাবিত করে, বিনয় সেখানে আনে সফলতা। মানুষের অগৌরবসূচক বৈশিষ্ট্যগুলো শিষ্টাচারের প্রলেপে ঢাকা পড়ে যায়। চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো যখন মানুষের শ্রদ্ধা কেড়ে নেয় তখনই সে সাবধান হয়ে বিনয় ও সদাচরণ করে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে হয় নিজের শ্রদ্ধা ও সুভাশিস। শিক্ষা-দীক্ষা দ্বারা মার্জিত রুচিশীলতা ফুটে ওঠে চরিত্রের মধ্যে। সকল মানুষের সাথে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে শিষ্টাচারের মধুর স্পর্শে। শিষ্টাচারের মাধ্যমে যেমন অন্যের সন্তুষ্টি বিধান করা যায়, তেমনি নিজের স্বার্থও লাভ করা যায়।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version