যুব সমাজের অবক্ষয়ের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত ভাষণ এর একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হবে আজ। এটি শুধুমাত্র ধারণা দেবার জন্য। মুখস্থ করে ব্যবহার করার জন্য নয়। শিক্ষার্থীরা ভাষণটি আত্মস্থ করতে চেষ্টা করবেন। এরপর স্থান, কাল, পাত্র ভেদে নিজেদের মতো করে লিখবেন বা উপস্থাপন করবেন।
যুব সমাজের অবক্ষয়ের কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত ভাষণ
‘যুব সমাজের অবক্ষয়ের কারণ ও প্রতিকার’ বিষয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা। যে কোনো জাতির প্রাণস্পন্ন লুকিয়ে থাকে যুব সমাজের ভেতরে। এই প্রাণস্পন্দন নিয়েই জাতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যায়। দেশের যুবসমাজ যদি জ্ঞানে, কর্মে, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে উন্নত মানসিকতায় গড়ে উঠতে পারে তাহলে দেশের সমৃদ্ধি অবধারিত। আর যুবসমাজ যদি অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয় তাহলে সে জাতির ভাগ্যে যে কী দুর্দশা নেমে আসে— বোধ করি আপনাদের তা বুঝিয়ে বলতে হবে না।
আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত যুবক-যুবতি বেকার। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা প্রতিনিয়ত অস্থির জীবন-যাপন করছে। ফলে আমাদের যুবক শ্রেণির সিংহভাগ অজ্ঞাতে বা জ্ঞাতসারে অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে। সুধি, যুবসমাজের এই যে অবক্ষয়, এর জন্য কেবল যুবকদেরকে দোষ দেয়া চলে না। আপনারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, যুবসমাজের অবক্ষয়ের জন্য আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থাটাই দায়ী। কেননা আমরা আমাদের যুব সমাজের জন্য সুস্থ, সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারি নি।
যে যুবক স্বপ্ন দেখত আদর্শ মানুষ হয়ে সে এই সমাজেরই বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, দেশ ও জাতির সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করবে— সে যুবক কেন মাদকাসক্ত হয়, কেন বই-এর বদলে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়, কেন খুন, জখম আর রাহাজানিতে মত্ত থাকে তা অবশ্যই আমাদের ভেবে দেখা দরকার। সুধীবৃন্দ, নানা কারণে যুবসমাজ অবক্ষয়ের শিকার হতে পারে। বর্তমানে আমাদের সমাজ জীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এ অবক্ষয় যুবসমাজকেও প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই।
যুবসমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো কোন পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসরমান। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই আমাদের যুবসমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও যুবসমাজের অবক্ষয়ের আর একটি কারণ। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, ফলে শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য, সমাজসেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং স্বেচ্ছাচারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করছে। সরকারি চাকুরেদের মধ্যে কে কত বড় তোষামোদকারী, মিথ্যা, অন্যায় এবং কুটকৌশল প্রয়োগে কে কত পরিপক্ক, দেশনেত্রী জননেত্রী- পল্লীবন্ধুদের কে কতবড় সেবাদাস তার উপর নির্ভর করেছে রাষ্ট্রের বা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ভার।
অথচ অমিত সম্ভবনাময় আমাদের যুবসমাজকে নিয়ে কেউ ভাবছে না। সবাই নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। গোটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার দুর্নীতিবাজেরা বিদেশি অর্থ, সাধারণের বাস্তুভিটা, খাল-বিল-নদী-নালা- পাহাড়, বন-বাদাড় দখল করে বিলাস-ব্যাসনে মত্ত হয়েছে। ওইদিকে সেদিনের টগবগে যুবকটি শিক্ষা শেষে চাকরি না পেয় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। ক্লিষ্ট, ক্লান্ত, ধ্বস্ত জীবনকে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে সে বেঁচে আছে।

জীবনযুদ্ধে পরাজিত দিশেহারা এই যুবকটি যদি পথ খুঁজতে খুঁজতে বিপথগামী হয়ে পড়ে কিংবা অজ্ঞাতে কোনো নৈতিক অবক্ষয়ের পথে পা বাড়ায়, তবে সে দোষ কার? কে নেবে তার ভার? হে সচেতন সুধীসমাজ, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে, আজ বেকারের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে হয়েছে চার কোটি পৌনে চার কোটি। বেকারত্বের অভিশাপ যে কতটা কষ্টদায়ক, তা ভুক্তভোগীরাই জানে। লেখাপড়া শেষ করেও যখন চাকরি মেলে না, তখন হতাশা আর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে অসহায় এই যুবকটির করণীয় কী?
কত নির্মম অত্যাচার- অবিচারের বাঁকে বাঁকে সালাম-বরকত মনুমিয়া, জোহা-জহুর-শম্ভু, আনোয়ারা, দীপালী, বসুনিয়ারা বুকের রক্ত ঝরিয়ে দিয়ে গেল, একাত্তরে দেশে রক্তের বান ডেকে গেল কিন্তু হায় তা সবই বুঝি আজ নব্য লুটেরা ও সন্ত্রাসীদের হিংস্র থাবায় বিস্মৃতির অতলান্তে হারিয়ে যাবার জোগাড়। যে রক্তের বানে ইতিহাস হল লাল— সে ইতিহাসকে বিকৃতি, কাটা-ছেঁড়া আর গোঁজামিলে গোঁজামিলে ভরে তোলা হলো। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকানো ভুলে গেলাম। অতীতের গৌরব-মহিমার কথা ভুলিয়ে দিতে ওই ভুইফোঁড় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ রাজনীতিক-আমলা-ব্যবসায়ীরা সব শিয়ালের একই রা গোছের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
আর এজন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করাটাকেই তারা অগ্রাধিকার বিবেচনা করে। ফলে শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে শিকড়হীন সস্তা-স্থূল বিনোদনের রমরমা আজ সুধী, আপনারা সবাই জানেন, বর্তমানে টেলিভিশনের সঙ্গে ডিশ এন্টেনা যুক্ত হয়ে আমাদের ঘরে এসে গেছে এমন এক বিজাতীয় সংস্কৃতি যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। ফলে এসব সস্তা বিনোদনে আকৃষ্ট হয়ে আমাদের যুবসমাজ অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য অগ্রগতির হাওয়া বাংলাদেশেও আঘাত হানবে এতে আর বিচিত্র কী?
কিন্তু সে প্রযুক্তি যদি সমাজদেহের জন্য কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি ডেকে আনার কারণ হয় তাহলে রাষ্ট্র পরিচালকদেরকে সে ব্যাপারে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। একইসঙ্গে মিডিয়াকেও হতে হবে সোচ্চার। সুধীবৃন্দ, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধও এখন গৌণ হয়ে উঠেছে। ধর্মের মূল বাণী, ন্যায়-নীতি-সাম্য, মানুষের কল্যাণ— এ সবই আজ কেবল কথার কথা মাত্র! তাই আজ তরুণসমাজের অবক্ষয়ের চিত্রটা এতটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। যুবকদের সুসংগঠিত করে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে হলে তাদের মধ্যে নীতিজ্ঞান ও সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে হবে।
তারা সচেতন হলে কোনো রকম অন্যায় কুমন্ত্রণা তাদের বশীভূত করতে পারবে না। সমাজে যতদিন অন্যায় অবিচার মাথা উঁচু করে থাকবে ততদিন যুবসমাজকে সুপথে আনা কষ্টকর। ধর্ম ও শিক্ষার আলো. ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সামনে থেকে অন্ধকার দূর করতে হবে। সুস্থ ও সুন্দর সংস্কৃতির বিকাশ, ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি সম্ভব হলে যুবসমাজকে সঠিক পথে আনা সম্ভব হবে। সুধী, যুবকরাই দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং জাতির কর্ণধার। তাদের মনে এ চেতনাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। যে- ‘কোনো মূল্যে অবক্ষয়ের হাত থেকে আমাদের তরুণসমাজকে রক্ষা করতে হবে। যুবসমাজকে অবক্ষয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে পারলেই আমরা একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারব।
পৃথিবীতে বীর, বিপ্লবী, ত্যাগী মহৎ মানুষের সংখ্যা কম নয়। দেশে দেশে এই মহৎ মানুষেরা ত্যাগের আদর্শ রেখে গেছেন। তারা এ পৃথিবীকে করতে চেয়েছেন সুন্দর, কল্যাণকর, শান্তিময়। কিন্তু মানুষের এই স্বপ্ন আজো সার্থক হয় নি। যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে তারা জীবন উৎসর্গ করেন মানুষ সেই ত্যাগ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনকে আরো দুঃখময় করে তোলেন। মানুষ জীবন দেয় ঠিকই কিন্তু তার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হয় না। সমাজ থেকে হিংসা, দ্বেষ, হানাহানি, অশান্তি দূর হয় না, মানুষের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। তবে কি—
‘বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা / তার যতো মূল্য সেকি ধরার ধুলায় হবে হারা?”
না তা হতে পারে না, দিন আসবেই। সুদিন ও শুভদিন। মানুষ সেই সুদিন ও শুভদিনেরই প্রত্যাশা করে। সেজন্যই এতো আয়োজন, এতো পরিকল্পনা, এতো শ্রম, এতো সাধনা। কখনো কখনো আঁধার ঘনিয়ে এলেও, হতাশা দ্যাখা দিলেও শেষ পর্যন্ত মানুষের এই স্বপ্ন ও সাধনা ব্যর্থ হতে পারে না। পথভ্রষ্ট যুবকরা আলোর পথে ফিরে আসুক, সমাজ থেকে দূর হোক সব অন্ধকার, মুছে যাক অবক্ষয়ের চিত্র, তারুণ্য শক্তির জয় হোক, এই কামনা করে আমার বক্তব্য শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ ।
আরও দেখুন: