মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে আজকের আলোচনা| আমরা আজ এই বিষয়ে একটি নমুনা রচনা তৈরি করব। শিক্ষার্থীরা রচনাটি পড়ে ধারণা নেবেন। তারপর নিজের মতো করে নিজের ভাষায় লিখবেন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য ভাষা আন্দোলনে যতটা আলোড়িত হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধে তার চেয়ে বেশি আন্দোলিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ অনুষঙ্গটি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে বিভিন্নভাবে। এর মাধ্যমে সাহিত্যের ভাব, ভাষা, প্রকাশভঙ্গি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে; বাংলা সাহিত্যে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।
মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলা সাহিত্য
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা, স্বদেশপ্রেম, মানবতাবাদী আবেগের স্ফুরণ ঘটেছিল তা প্রকাশ করার জন্য সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক বিশেষ করে কবিতা প্রধান বাহন হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য রচনা করেছেন কিন্তু তারা যেন তৃপ্ত হচ্ছেন না। মুক্তিযুদ্ধের বিশালতা, গভীরতা, ব্যাপকতা এবং ভয়াবহতা সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে উঠে এসেছে। আমাদের সাহিত্যের মুক্তিযুদ্ধ চেতনাসমৃদ্ধ অংশ দ্বারা আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মুখোমুখি হই ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশের কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন হাসান হাফিজুর রহমান। তার সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র’ গ্রন্থটি ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তার এ গ্রন্থটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর অনুপুঙ্খ বিবরণ উপস্থাপন করে । বিশিষ্ট কবি- সাহিত্যিকদের মধ্যে যাদের বিভিন্ন লেখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে তাদের মধ্যে শামসুর রাহমান, এম আর আখতার মুকুল, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জাহানারা ইমাম, সেলিনা হোসেন, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, বদরুদ্দিন উমর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনা যে সমস্ত গ্রন্থে সুনিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সিপাই’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নীল দংশন’ ও ‘নিষিদ্ধ লোবান’, আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘বাংলাদেশ কথা কয়’, শওকত ওসমানের ‘নেকড়ে অরণ্য’ ও ‘জাহান্নাম হতে বিদায়: জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ এবং সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’।
এ সমস্ত গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ভয়াবহতা, হিংস্রেতা, ঐক্যবদ্ধতা, বাঙালি জাতির প্রত্যাশার অনুপম প্রকাশ ঘটেছে। এসব সাহিত্য বাংলা ভাষাকে করেছে সমৃদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবান্বিত সাহিত্য বাঙালি জাতি তথা বাংলা ভাষার অন্যতম সমৃদ্ধ ধারা।
বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব আলোচনার ক্ষেত্রে উপন্যাস, গল্প, নাটক ইত্যাদি অংশগুলোর উল্লেখ করার পর আমরা এখানে প্রধানত বাংলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব আলোচনা করছি।
মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে ‘হে স্বদেশ’ (১৩৭৮) এবং ‘উত্তরণে অমরত্ব (১৯৮২) নামক দুটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। দুটি সংকলনেই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কবিতা প্রাধান্য পেয়েছে। এরপর প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের কবিতা” (১৯৮৪) এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত কবিতা’ (১৯৮৭) । এসব সংকলনের কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়গুলো চোখে পড়ে তা হলো:
ক. অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ভীতি, শঙ্কা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবন ও যুদ্ধকে অবলোকন ।
খ. যুদ্ধক্ষেত্রে শক্ষা ও তাঁতির মধ্য দিয়ে সহযোদ্ধার মৃত্যু শরুহননের উল্লাস এবং বিজয়ের নিয়ে লেখা কবিতা।
গ. সাধারণভাবে মুক্তিযুদ্ধ জনতার সংগ্রামের উদ্দীপনা, শোষণ ও নীপিড়নের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিবাদের উচ্চারণ।
ঘ. যুদ্ধ পরবর্তীকালে রচিত যুদ্ধের স্মৃতিচারণ, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঘরে ফেরার আনন্দ ও স্বজন হারানোর বেদনা ইত্যাদি |
মুক্তিযুদ্ধের কবিতা আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই আসেন পল্লী কবি জসিমউদ্দীন। ১৯৭১ সালের ২ মে মাংসযজ্ঞ শুরুর পরপরই তিনি লিখেছেন ‘দগ্ধগ্রাম’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কবিতা। তিনি সহজ সরল ভাষায় লিখেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের নগ্ন ইতিহাস-
“মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খান খান
পিতার সামনে মেয়েরে কাটিয়া করিল রক্তস্নান”
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে অবরুদ্ধ বয়ঃবৃদ্ধ কবি যেন মানসিকভাবে মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হয়েছেন—
“আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মৃত্যু পিছনে আগে
ভয়াল বিশাল নখর মেলিয়া দিবস রজনী জাগি।”
১৯৭১ সালের ২ মার্চ সোনার বাংলা খচিত পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের যে চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল, বাঙালি জাতীয় চেতনার যে ঐক্য সংগঠিত হয়েছিল তার প্রকাশ বিভিন্ন কবির কবিতায় ফুটে উঠেছে। বেগম সুফিয়া কামালও তার প্রথম শহীদ বাংলাদেশের মেয়ে কবিতায় এ চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশকে পাক হানাদার মুক্ত করার দীপ্ত শপথ নিয়ে যে নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে ত্যাগ স্বীকার করেছিল, সবাই প্রাণ বিসর্জনে প্রস্তুত হয়েছিল, তার প্রকাশ ঘটেছে কবি বেগম সুফিয়া কামালের কবিতায়।
বাংলাদেশের আধুনিক কবিদের মধ্যে অগ্রজ আবুল হোসেন ‘পুত্রদের প্রতি’ কবিতায় এক বাঁশিওয়ালার কথা বলেছেন, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো যিনি সব ছেলেদের ঘরছাড়া করবেন, যারা আর ফিরবে: না, যাদের মুখ আর দেখা যাবে না। স্বাধীনতা আর মুক্তির জন্য একটি পুরো প্রজন্য ঘড়ছাড়া হলো । কেউ তাদের সেদিন ধরে রাখতে পারেনি ঘরে।
এভাবে বাংলা কবিতায় যে নতুন ভাবধারা ও আঙ্গিকের সংযোগ হয়েছে তা বাংলা কাব্যধারাকে করেছে সমৃদ্ধ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর, ভয়াবহ বন্দীদশা তথা মুক্তিযুদ্ধে মানুষের একাত্মতা সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যের কবিতায় অবরুদ্ধ ঢাকার চিত্রকল্প চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে—
“এ বন্দী শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
মনের মতন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।”
কিন্তু শামসুর রাহমানকে দখলদার বাহিনী অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে ‘স্বাধীনতা’ ও ‘বাংলাদেশ’ এ দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরক শব্দ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেনি। কারণ বন্দীদশায় করি এ দেশের গাছের পাতায়, ফুটপাতে, পাখির পালকে, নারীর চোখে, দুরন্ত বস্তির ছেলেটার মুঠোয় সর্বদাই স্বাধীনতা নামক শব্দটি জ্বলতে দেখেছেন । আর লিখেছেন যে, এ স্বাধীনতা পেতে বাঙালিকে আর কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ দেশে হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের চিত্র, বাঙালির আত্মত্যাগের কথা প্রকাশের সাথে সাথে এ দেশীয় দালালদের অত্যাচার ও উৎপাতের চিত্র ফুঠে উঠেছে বিভিন্ন কবির কবিতায়। একদিকে পাকিস্তানী বাহিনী অপরদিকে দালাল বাহিনীর উৎপীড়ন, অত্যাচার, হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণে নিরীহ বাঙালির জীবন ছিল মানবেতর। তাদের (পাকসেনা) প্রতি অপরিসীম ঘৃণায় শেষ পর্যন্ত কবি অভিশাপ দেন অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতায় –
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙ্গে যেতে….
অভিশাপ দিচ্ছি, ওরা বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত কেড়াক বয়ে গলিত নাছোর মৃতদেহ।
এমন অভিনব কবিতা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তাই বাংলা কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব অপরিসীম।
উল্লিখিত কয়েকজন কবি ছাড়াও অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে কবিতা ও সাহিত্য রচনা করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান থেকে শুরু করে আজকের সর্বশেষ কবি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য রচনা করে চলেছেন।

পরিশেষে বলা যায়, সমসাময়িক বিশাল ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ বাংলা সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এসেছে নানান নতুন শব্দ, নির্মাণ শৈলী এবং প্রকাশভঙ্গি । যদিও এসব সাহিত্যকর্ম সম্পূর্ণতা অর্জন করেনি তথাপি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা প্রকাশে যেসব খণ্ডচিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে। সুতরাং বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব অপরিসীম।
আরও দেখুন: