মুক্তিযুদ্ধের চেতনা | ভাষা আন্দোলন-স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম যুগ-যুগান্তর ধরে চলে এসেছিল। অবশেষে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে বিজয় সূর্য উদিত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম তথা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ দিন পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদিকে যেমন করুণ, শোকাবহ, লোমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমাবাশ্রিত ও বীরত্বপূর্ণ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা | ভাষা আন্দোলন-স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ | বাংলা রচনা সম্ভার
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি : বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি । ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এক গড়মূলক যুদ্ধে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ- দৌলাকে পরাজিত করার মাধ্যমে ইংরেজরা এ দেশ অধিকার করে। তারপর ২০০ বছর বাঙালি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর পদানত ছিল।
বিজাতীয় শাসন, শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়নের যাঁতাকলে জাতি নিষ্পেষিত হয়েছে। মনের গোপনে লালিত স্বাধীনতার স্পৃহা আর বুলিনুষ্ঠিত স্বপ্নসাথ থেকে বিভিন্ন সময় এ দেশের মানুষের মনে জন্য নিয়েছে বিক্ষোভ, আন্দোলন আর সংগ্রামের চেতনা। ফলে ব্রিটিশরা এ দেশ ছেড়ে যেতে রাখা হয়। ১৯৪৭ সালে জন্য হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের। স্বাধীন পাকিস্তানের একাংশরূপে পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম হয়।
কিন্তু বাঙালিদের দুর্ভাগা, নামে স্বাধীন হলেও প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল জাতি ভোগ করতে পারেনি। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র সম্পূর্ণ নিজেদের করায়ত্ত রেখে ঔপনিবেশিক শাসকদের মতোই আরেক শোষণের ইতিহাস রচনা করে। বৈষম্যের নীতি বিস্তার করে তারা এ দেশের মানুষের শিক্ষা- দীক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক মর্যাদা সকল ক্ষেত্রে চরম অবহেলা প্রদর্শন করে। সর্বক্ষেত্রে অধিকার হারিয়ে জনমতে যে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ জমা হয়েছিল, তা-ই অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের অগ্রযাত্রার আরো একটি মাইলফলক হিসেবে স্থাপিত হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পাক সরকারের চরম পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন ও জাতীয় চেতনার বিজয় ঘোষিত হয়। ফলে শুরু হয় দমননীতি। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দেশে নিরঙ্কুশ সামরিক শাসন চলে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ঘটে চরম বিস্ফোরণ। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু কুচক্রী ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে গড়িমসি করার ফলে বাঙালির মনে অসন্তোষ তীব্রতর হতে থাকে। অতঃপর সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধিকার।
আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্য ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া সরকার বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম গণহত্যা সংঘটিত করে। আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবকেও বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতার এই অমোঘ ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই সারা বাংলাদেশে মুক্তিপাগল হাজার হাজার ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরুর প্রতিরোধ আর মুক্তির সংগ্রাম।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ইতিহাস : মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকালীন ইতিহাস মূলত শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। কারণ, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের আগ পর্যন্ত আমরা পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠী দ্বারা বহুবার বহুভাবে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার শিকার হয়েছি। এ সময় আমাদের ভাষার ওপর আঘাত এসেছে। গণতন্ত্রের ওপর আঘাত এসেছে, আঘাত এসেছে গণ মানুষের ওপর।
অতি সুকৌশলে নানা রকম বাহানা তুলে আমাদের বার বার হয়রানি করা হয়েছে, আমাদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করা হয়েছে, অধিকারবোধকে করা হয়েছে ধূলিস্যাৎ। কিন্তু বীর বাঙালি এ অনিয়ম, অত্যাচার, অবিচার কখনো মেনে নেয়নি। এর বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে এবং অবশেষে তাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে, স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।
আমাদের অস্তিত্বের ওপর প্রথম আঘাত : দেশ বিভাগের পর আমাদের ওপর প্রথম আঘাত আসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে গণপরিষদে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা দিলে গণপরিষদের দেশপ্রেমিক বাঙালি সদস্য প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। এরপর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে এক জনসভায় উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ এভাবে ঘোষণা দিলে বীর বাঙালি এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এ দেশের তরুণ সমাজ বুকের তাজা রক্ত ত্যাগের মাধ্যমে, নিজেদেরকে উৎসর্গের মাধ্যমে এ দেশের সংগ্রামী জনতা তাদের ওপর নেমে আসা জুলুম ও নির্যাতনকে প্রতিরোধ করে।
মুজিবনগর সরকার গঠন ১৯৭১ :সালের এপ্রিল মাসে মুজিবনগরে জাতির জন্য ‘সামাজিক ন্যায়বিচারের” অঙ্গীকার নিয়ে ঘোষিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক সনদ। পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোরা’। আওতায়, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হওয়া সত্ত্বেও সরকার পরিচালনা ও সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে ‘ন্যায়বিচার’ ভিত্তিক তাদের প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত ছিল। দীর্ঘ বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে এ দেশের জনগণ স্বাধিকারের দাবির প্রতি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে রায় প্রদান করেছিল।
কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক এ দেশবাসীর ব্যালটের রায়কে বুলেটের মাধ্যমে বানচাল করার অপচেষ্টার প্রত্যুত্তরে শুরু হয়েছিল ‘৭১-এর রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের শুরুতে, *৭০-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে নির্বাচিত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ মুজিবনগর আম্রকাননে দ্রুত একত্রিত হয়ে ১০ এপ্রিল (১৯৭১) দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সম্মুখে নিম্নোক্ত ঘোষণাটি প্রদান করেছিলেন :
“বাংলাদেশের জনগণ (১৯৭০-এর নির্বাচনে) নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যেই ম্যান্ডেট প্রদান করিয়াছে সেই ম্যান্ডেট অনুযায়ী আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আমাদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ-এ রূপান্তরিত করার ঘোষণা প্রদান করিতেছি।’
স্বাধীনতার এ ঘোষণাটিকে কার্যকর করার লক্ষ্যে গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ১৭ এপ্রিল গঠিত হয়েছিল প্রবাসী মুজিবনগর সরকার এবং কর্নেল (অব) এম এ জি ওসমানীকে নিযুক্ত করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক। অতএব, স্বাধীনতার ঘোষণায় উল্লেখিত সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও “সামাজিক ন্যায়বিচার’- এ তিনটি স্লোগানের মাধ্যমে তিনটি সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের প্রতি। এ অঙ্গীকারই ছিল আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মৌল-চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব ও চেতনার বিকাশ : বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ থেকে যে চেতনা – লাভ করেছে তা জাতির সকল আন্দোলনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে। সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে। আবদ্ধ হয়েছে এই যুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ঐক্যবদ্ধ জাতি দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে— তার পেছনে মুক্তিলঘামের আত্মত্যাগ কাজ করেছে।
অত্যাচার আর শোষণের কালো হাত গুঁড়িয়ে দেয়ার শক্তি ও প্রেরণা এসেছে এই স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে। বাংলাদেশের মানুষের স্বজাত্যবোধের পুরণের উৎস এই যুদ্ধ। ‘৭১ সাল দেশে ও জাতির নতুন ইতিহাসের জন্মদাতা। অধিকার আদায়ের জন্য আত্মসচেতন হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। এই দিনগুলোতে মানুষ নতুন করে জেগে উঠেছিল। সে ভাত চেতনা ছড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষের পরবর্তী কর্মকাণ্ডে।
শত তেত্রিশ বছর ধরে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকশিত হয়েছে আমাদের সমাজজীবনে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, নারীমুক্তি আন্দোলন, নারীশিক্ষা, গণশিক্ষা, সংবাদপত্রের ব্যাপক বিকাশ, সর্বোপরি পণতান্ত্রিক অধিকার চেতনা ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে সমাজে। এরশাদ সরকারের নয় বছরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে প্রবল গণজোয়ারের মধ্য দিয়ে নবতর বিজ্যা অর্জন ও তান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারও প্রেরণা যুগিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহিত্যে- বিশেষ করে কবিতা ও কথাসাহিত্যে এক নবতর সাহিত্যধারার জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশে কবিতা চর্চা ও কথাসাহিত্য চর্চা আজকে যতটা ব্যাপ্তি পেয়েছে তার পেছনে বড় প্রেরণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছে গানে এবং নাটকে। গণসচেতনতামূলক বক্তব্যধর্মী নাটক ব্যাপকভাবে রচিত হয়েছে স্বাধীনতার পর। আমাদের দেশাত্মবোধক গানের ক্ষেত্রে এক নতুন জোয়ার এনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অসংখ্য গীতিকার রচনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়গাথা তাদের গানে। তবে আমাদের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি। খুব সামান্য সংখ্যক চলচ্চিত্রেই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা প্রকাশ পেয়েছে।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিফলন : যে স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সেই স্বপ্ন নানা কারণেই গত তেত্রিশ বছরেও সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর বারবার সামরিক অভ্যূত্থান, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, যুবসমাজের মধ্যে সৃষ্টি হতাশা, বেকারত্ব, জনস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অবক্ষন্য স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে চলেছে।
প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সভা-সমিতি, বিবৃতিতে বারবার যে কথাটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারণ করেছেন তা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার কথা। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কার্যকলাপ বারবার সংঘটিত হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে এবং বাইরে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন গত তেত্রিশ বছরে।
বর্তমানে আমাদের সমাজজীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এ অবক্ষয় যুবসমাজকেও প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুবসমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মতো কোনো মহৎপ্রাণ মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই আজ মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। যুব সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো কোনো পরিকল্পনা নেই, ফলে তারা প্রতিনিয়ত অবক্ষয়ের দিকে সরমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই আমাদের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও যুবসমাজের অবক্ষয়ের আর একটি কারণ একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অপরদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশা, শিক্ষাজগতে নৈরাজ নামে নিজের স্বার্থ হাসিল এবং চারিতা যুবসমাজকে বিপথগামী করেছে। তরুণসমাজ বিশ্ববো প্রত্যক্ষ করে, সমাজে সমাজবিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপতি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সাধ মানুষের মূল্য তুচ্ছ । সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবর্জিত । অথচ বানী-কর্মীরা তাদের খাতির করে। রাজনৈতিক নেতাদের তারা ডান হাত। জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করেও তারা আইনের চোখে নিরাপদ।
প্রশাসন প্রয়োজনমতো এদের ব্যবহার করে। কী তাদের মূলধন। তারা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, অজনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই মূলধন নিয়েই শুর সমাজের বিশিষ্ট মানুষ। আজ তাই মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধও গৌণ হয়ে উঠেছে। বস্তুত সমাজের সর্বস্তরে আজ যে মূল্যবোধের অভাব, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া যুবকদের মাঝে প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে। এভাবে তরুণসমাজকে বিপদগামী করার জন্য আরও নানা উপকরণ সদা-সক্রিয় |
আজ আমাদের যুবকদেরকে সুসংগঠিত করে সভ্য এবং ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদেরকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা সম্রামে আমাদের যে আত্মত্যাগ ছিল, সমগ্র জাতি একতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যে জীবন উৎসর্গ করেছিল। তা আবার পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে তরুনদেরকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তারা সচেতন হলে কোনোরকম অন্যায় কুমন্ত্রণা তাদেরকে বর্ণী যতদিন অন্যায়-অবিচার মাথা উঁচু করে থাকবে।
ততদিন যুবসমাজকে সুপথে আনা কষ্টকর। ধর্ম শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সামনে থেকে অন্ধকার দূর করতে হবে। রীতিমতো শরীরচর্তা এবং নানারকম খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বেকার সমস্যা দূর করতে হবে। তাছাড়া যারাই সমাজে আপনাকর্মে পিয় হয় তাদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। খুবকরাই দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এবং জাতির কর্ণধার। তাদের মনে এ চেতনাবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশনেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংবদ্ধ প্রধান ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ।
এজন্য দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের ইতিহাস ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ, লক্ষ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী লাখ লাখ মানুষ। তাদের তাজা প্রাণ দিয়েছে, শত-সহস্র মা-বোন ইয়াত দিয়েছে সমাজ ও জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
উপসংহার: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জাতির অস্তিত্বের সংগ্রাম। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে যে শোষণ আর অত্যাচারের শুরু হয়েছিল তার অবসান ঘটে এই যুদ্ধের মাধ্যমে। সময় জাতি, জাতির সর্বপর্যায়ের মানু দেশের মুক্তির জানা আত্মোৎসর্গের চেতনায় নিজেদের উৎসর্গ করেছিল বলেই প্রবল শক্তিধর হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। এই সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষকে সীমাহীন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ত্রিশ লক্ষ মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গের মনোভাব নিয়ে সকলের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আরও দেখুন:
- সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ | ভাষা আন্দোলন-স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ | বাংলা রচনা সম্ভার
- ছয় দফা আন্দোলন | ভাষা আন্দোলন-স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ | বাংলা রচনা সম্ভার
- কহিল গভীর রাত্রে সংসার বিরাগী | সারাংশ সারমর্ম | ভাষা ও শিক্ষা
- জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব | ভাষা আন্দোলন-স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ | বাংলা রচনা সম্ভার