মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মীনা বাজার

মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মীনা বাজার

জাহাঙ্গীর টের পায় প্রতিপক্ষের তরবারির বাঁকানো ফলা পিছলে গিয়ে তাঁর গিল্টি করা চামড়ার পর্যাণের গভীরে কেটে বসার পূর্বে উরু রক্ষাকারী ধাতব শৃঙ্খল নির্মিত বর্মের ইস্পাতের জালিতে ঘষা খায়। সে তার কালো ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরে সে শত্রুর হাত চিরে দেবার অভিপ্রায়ে তরবারি হাঁকায় লোকটা তখন নিজের অস্ত্র দিয়ে আরেকবার আঘাত করতে সেটা সরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। সে অবশ্য, অন্য অশ্বারোহী ভীষণ ভাবে নিজের ধুসর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরায় জন্তুটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে, লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়। জটার হাচড়পাঁচড় করতে থাকা সামনের পায়ের খুর তার বাহনের উদরে এসে লাগে। অন্যটা তার পায়ের গুলের উপরের অংশে আঘাত করে। আঘাতটা যদিও পিছলে যায় কিন্তু এটা তাঁর পায়ের নিচের অংশ অবশ করে দেয় এবং তাঁর পা রেকাব থেকে ছিটকে আসে।

জাহাঙ্গীরের ঘোড়াটা যন্ত্রণায় চিহি শব্দ করে একপাশে সরে যেতে, সে ভারসাম্য হারায় কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে, নিজের বাহনকে শান্ত করে এবং রেকাবে পুনরায় পা রাখতে সক্ষম হয়। অন্য লোকটা ততক্ষণে পুনরায় তাকে আবার আক্রমণ করতে এগিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীর তার কালো ঘোড়ার ঘামে ভেজা গলার কাছে নুয়ে আসতে তার প্রতিপক্ষের তরবারির ফলা বাতাসে ফণা তোলার মত শব্দ করে ঠিক তার শিরোস্ত্রাণের পালক স্পর্শ করে বের হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর তার ঘোড়াটা বৃত্তাকালে ঘুরিয়ে নিয়ে পুনরায় শত্রুর মুখোমুখি হবার ফাঁকে চিন্তা করার খানিকটা অবসর পেতে ভাবে, রাজা বিদ্রোহী হলেও একজন সত্যিকারের যোদ্ধা যে হামলার সময় তাঁর মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছে। উভয় যোদ্ধাই নিজেদের বাহনের পাঁজরে তাদের গোড়ালি দিয়ে গুঁতো দেয় এবং একই সাথে সামনে এগিয়ে আসে আক্রমণ করতে। জাহাঙ্গীর এবার তার প্রতিপক্ষের গলা লক্ষ্য করে নিজের তরবারি হাঁকায়। আঘাতটা প্রথমে ইস্পাতের বক্ষাবরণীর প্রান্তে আটকে যায় কিন্তু তারপরে মাংসে এবং পেশীতন্তুতে কামড় বসায়। রাজার বাঁকানো তরবারির ফলা তার তরবারি ধরা হাতের লম্বা চামড়ার দাস্তানা চিরে ভেতরে ঢুকতে জাহাঙ্গীরও একই সময়ে হুল ফোঁটানর মত যন্ত্রণা অনুভব করে এবং সাথে সাথে তাঁর হাত বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। ঘোড়ার মুখ দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে সে দেখে তার প্রতিপক্ষ ধীরে ধীরে নিজের পর্যাণ থেকে একপাশে কাত হয়ে যাচ্ছে এবং তারপরে ভোতা একটা শব্দ করে ধুলি আচ্ছাদিত মাটিতে আছড়ে পড়তে তার হাত থেকে তরবারির বাট ছিটকে যায়।

জাহাঙ্গীর নিজের পর্যাণ থেকে লাফিয়ে নিচে নামে এবং পায়ের আঘাতপ্রাপ্ত গুলের কারণে খানিকটা দৌড়ে, খানিকটা খুড়িয়ে ভূপাতিত লোকটার দিকে নিজেকে ধাবিত করে। তার ঘাড়ের ক্ষতস্থান থেকে যদিও টকটকে লাল রক্ত স্রোতের মত বের হয়ে তার ঘন, কালো কোঁকড়ানো দাড়ি এবং বুকের বর্ম সিক্ত করছে, সে তখনও নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।

‘আত্মসমর্পণ করো, জাহাঙ্গীর আদেশের সুরে বলে।

‘আর তোমার প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে নিজের জানটা খোয়াই? কখনও না। আমি এই লাল মাটির বুকেই মৃত্যুবরণ করবো বহু পুরুষ ধরে যা আমার পরিবারের অধিকারে রয়েছে–আমাদের ভূমি দখলকারী তোমাদের লোকের চেয়ে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। শব্দগুলো রক্তের বুদ্বুদের সাথে মিশে তার ঠোঁট দিয়ে বের হতে সে তার দেহের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে তার পায়ের ঘোড়সওয়াড়ীর জুতোর ভিতরে রক্ষিত একটা ময়ান থেকে খাঁজকাটা ফলাযুক্ত লম্বা একটা খঞ্জর টেনে বের করে আনে। সে আঘাত করার জন্য নিজের হাত পিছনে নেয়ার পূর্বেই জাহাঙ্গীরের তরবারি আরো একবার লোকটার গলায় আঘাত হানে, এবার তার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরে আঘাত করতে, তার দেহ থেকে তাঁর মাথাটা প্রায় আলাদা হয়ে যায়। লোকটা পিছনে শুয়ে পরলে, তার রক্ত ছিটকে এসে ধুলো লাল করে দিতে থাকে। তার দেহটা একবার কি দুইবার মোচড় খায় এবং তারপরে সে নিথর হয়ে পড়ে থাকে।

জাহাঙ্গীর প্রাণহীন শবদেহটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তার উধ্ববাহুর ক্ষতস্থান থেকে তাঁর নিজের উষ্ণ আর পিচ্ছিল রক্ত এখনও তার হাত বেয়ে গড়িয়ে তার দাস্তানার ভেতরের আঙুলের জমা হচ্ছে। সে গলা থেকে আহত হাত দিয়ে নিজের মুখ মোছার কাপড়টা টেনে নিয়ে পায়ের গুলুইয়ের ক্ষতস্থানে সেটা কোনোমতে হাল্কা করে জড়িয়ে রাখে যেখানে খুরের আঘাতে সেখানের ত্বকের সাথে নিচের চর্বির স্তর ভেদ করে তার পায়ের গোলাপি রঙের মাংসপেশী বের করে ফেলেছে।

সে আজ সহজেই নিহত হয়ে, তার উচ্চাকাঙ্খ পরিপূর্ণ করা শুরু করার আগেই, অনায়াসে প্রাণ হারাতে এবং সিংহাসন হারাতে পারতো। সে কেন। মির্জাপুরের রাজার বিরুদ্ধে অভিযানে যে এই মুহূর্তে তাঁর পায়ের কাছে হাত-পা ছড়িয়ে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে তার মন্ত্রণাদাতাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে নিজে ব্যক্তিগতভাবে সেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? খসরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সে যেমন করেছিল ঠিক তেমনই রাজার সৈন্যদের বিরুদ্ধে হামলা করার সময় নিজের দেহরক্ষীদের পিছনে ফেলে সে কেন দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়েছিল? মির্জাপুরের রাজা বস্তুতপক্ষে তার সিংহাসনের জন্য তেমন সত্যিকারের হুমকির কারণ ছিল না, সামান্য এক অবাধ্য জায়গীরদার, রাজস্থানের মরুভূমির সীমান্তে অবস্থিত একটা ছোট রাজ্যের শাসক যে রাজকীয় কোষাগারে বাৎসরিক খাজনা পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সে তার মন্ত্রণাদাতাদের যা বলেছিল–সে দেখাতে চায় যে সে তার অধীনস্ত কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের অবাধ্যতা সহ্য করবে না তাঁরা যতই ক্ষমতাধর কিংবা তুচ্ছ হোক এবং বিদ্রোহীদের শাস্তি দিতে সে কারো উপরে নির্ভরশীল হতে চায় না–সেটা ছিল আংশিক উত্তর।

অভিযানটায় তাঁর নিজের নেতৃত্ব দেয়ার পিছনে অবশ্য অতিরিক্ত আরো একটা কারণ রয়েছে সেটা সে নিজেই নিজের কাছে স্বীকার করে। অভিযানটা আগ্রা থেকে এবং সুফি বাবার নিষেধ সত্ত্বেও তাকে নিজের কাছে ডেকে পাঠাবার প্রায় অপ্রতিরোধ্য বাসনা থেকে তাকে সরিয়ে রেখে, তাঁর মেহেরুন্নিসার ভাবনায় চিত্তবিক্ষেপ ঘটাবে। রক্তক্ষরণ আর গরমের কারণে সহসা দুর্বলবোধ করায় জাহাঙ্গীর তার লোকদের পানি নিয়ে আসতে বলে। তারপরেই পৃথিবীটা তাঁর সামনে ঘুরতে শুরু করে।

কয়েক মিনিট পরে তার সংজ্ঞা ফিরে আসতে সে মাটিতে বিছানো একটা কম্বলের উপর নিজেকে শায়িত দেখতে পায় যখন দু’জন হেকিম উদ্বিগ্ন মুখে মরুভূমির সূর্যের নিচে তার ক্ষতস্থানের রক্তপাত বন্ধ আর সেলাই করছে। সংজ্ঞা ফিরে আসবার সাথে সাথে একটা আকষ্মিক ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। রাজা এখন মৃত এবং অভিযান শেষ হওয়ায় সে এখন সহজেই নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য আগ্রায় যথাসময়ে ফিরে যেতে পারবে। মেহেরুন্নিসার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য সুফি বাবার কঠোর নির্দেশ ভঙ্গ না করেই উৎসবের আয়োজন তাকে নিশ্চিতভাবেই তার সাথে আবারও অন্তত দেখা করার সুযোগ দেবে। হেকিমদের একজনের হাতে ধরা সুই তাঁর ঊর্ধ্ববাহুর ত্বক ভেদ করতে লোকটা তার উন্মুক্ত ক্ষতস্থানের দুই পাশ সেলাই করতে শুরু করায় যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ খোঁচা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর হাসি চেপে রাখতে পারে না।

*

 

বালিতে রক্তের দাগ ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

‘আচ্ছা, আগ্রা দূর্গ সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?’ মেহেরুন্নিসা গিয়াস বেগের আবাসস্থলে বসে থাকার সময় তার ভ্রাতুস্পুত্রীকে জিজ্ঞেস করে। সে মনে মনে ভাবে, আরজুমান্দ বানু দেখতে কি রূপসী হয়েছে। কাবুলে খুব ছোটবেলায় দেখার পরে মেয়েটাকে সে আর দেখেনি। আরজুমান্দের বয়স এখন চৌদ্দ বছর কিন্তু তাঁর বয়সের অনেক মেয়ের মত কোনো বেমানান আনাড়িপনা তার ভিতরে নেই। তাঁর মুখটা কোমল ডিম্বাকৃতি, ভ্রু যুগল নিখুঁতভাবে বাঁকানো, এবং মাথার ঘন কালো চুল প্রায় তার কোমর ছুঁয়েছে। তার চেহারায় তার পার্সী মায়ের আদল স্পষ্ট যিনি তাঁর যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন মারা গিয়েছেন কিন্তু তার চোখ আবার তাঁর বাবা, আসফ খানের মত, কালো রঙের।

‘আমি কখনও এরকম কিছু দেখিনি–এতো অসংখ্য পরিচারিকা, এত অগণিত আঙিনা, এতগুলো ঝর্ণা, এত এত রত্নপাথর। আমরা যখন দূর্গে প্রবেশ করছিলাম তারা আমার আব্বাজানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে তোরণদ্বারে দামামা বাজিয়েছিল।’ সবকিছুর অভিনবত্ব দেখে উত্তেজনায় আরজুমান্দের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে।

মেহেরুন্নিসা স্মিত হাসে। তার কেবল মনে হয় সে যদি আবার এই বয়সে যেতে পারতো… ‘আকবরের রাজত্বকালের সময় থেকে, বিজয়ী সেনাপতির আগমনকে সম্মান প্রদর্শন করতে দামামা বাজাবার রীতির প্রচলন হয়েছে। বাজনা শুনে আমিও যারপরনাই গর্বিত হয়েছি।’

মেহেরুন্নিসার আব্বাজান কয়েক সপ্তাহ পূর্বে তাকে পত্র মারফত জানিয়েছিলেন যে তাঁর বড় ভাই আসফ খান দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে লড়াইয়ের সময় নিজেকে এতটাই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছেন যে সম্রাট তাকে আগ্রায় ডেকে পাঠিয়েছেন এখানের সেনানিবাসের দায়িত্ব গ্রহণ করতে। দুই সপ্তাহ পূর্বে আসফ খান আগ্রা এসে পৌঁছেছেন। মেহেরুন্নিসার প্রথমে ফাতিমা বেগম এবং পরে কর্তৃত্বপরায়ণ খাজাসারার কাছ থেকে গিয়াস বেগের আবাসস্থলে আসবার জন্য ছুটি পেতেই এতদিন সময় লেগেছে এবং সে তার ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।

‘তোমার আব্বাজান কোথায়? আমি এখানে কেবল সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে পারব।’

“তিনি সম্রাটের সাথে নতুন পরিখাপ্রাচীরাদিনির্মাউ বিষয়ে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যত শীঘ্র সম্ভব তিনি আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন।’

মেহেরুন্নিসা শুনতে পায় তার আম্মিজান লাডলিকে আঙিনার পাশেই একটা কামরায় গান গেয়ে শোনাচ্ছে। মেয়েটা খুব দ্রুত তার অনুপস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং সে জানে যে তার ব্যাপারটা সম্বন্ধে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যদিও সেটা তাকে খানিকটা আহত করে যে তাঁর মেয়ে সত্যিই তার অনুপস্থিতি তেমনভাবে উপলব্ধি করে না। তার পরিবার শনৈ শনৈ উন্নতি লাভ করছে। সম্রাটের কোষাগারের দায়িত্ব নিয়ে গিয়াস বেগকে সবসময়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাঁর আম্মিজান অন্তত তাকে তাই বলেছেন, তাছাড়া আসফ খানও স্পষ্টতই জাহাঙ্গীরের অনুগ্রহভাজনদের তালিকায় শীর্ষেই রয়েছে। সেই কেবল, মেহেরুন্নিসা, যে ব্যর্থ হয়েছে। সম্রাটের কাছ থেকে সে এখনও কোনো ইঙ্গিত পায় নি এবং ফাতিমা বেগমকে খিদমত করার একঘেয়েমি প্রতিদিনই আরো বিরক্তিকর হয়ে উঠছে।

‘ফুফুজান, কি ব্যাপার? আপনাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

নাই কিছু না। আমি ভাবছিলাম কতদিন পরে আমরা সবাই আবার একত্রিত হয়েছি।’

‘আর সম্রাটের মহিষীদের কথা বলেন? তাঁর স্ত্রী, রক্ষিতা, তাঁরা সবাই কেমন দেখতে? আরজুমান্দ নাছোড়বান্দার মত জিজ্ঞেস করে।

মেহেরুন্নিসা তাঁর মাথা নাড়ে। আমি তাঁদের কখনও দেখিনি। তাঁরা হেরেমের একটা পৃথক অংশে বাস করে যেখানে সম্রাট আহার করেন আর নিদ্রা যান। আমি যেখানে বাস করি সেখানে প্রায় সব মহিলাই, আমার গৃহকত্রীর মত, বয়স্ক।

আরজুমান্দকে হতাশ দেখায়। রাজকীয় হেরেম আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম।’

‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম-’ মেহেরুন্নিসা সেই সময়েই বাইরের করিডোরে পায়ের শব্দ শুনতে পায়, এবং প্রায় সাথে সাথেই আসফ খান ভেতরে প্রবেশ করেন।

‘আমার প্রিয় বোন! পরিচারিকাদের কাছে শুনলাম তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে। মেহেরুন্নিসা তাঁর আসন ছেড়ে পুরোপুরি উঠে দাঁড়াবার আগেই সে তাকে তার বাহুর মাঝে জাপটে ধরে মেঝে থেকে প্রায় শূন্যে তুলে নেয়। ভাইজান তাঁদের আব্বাজানের মতই লম্বা কিন্তু আরো চওড়া আর থুতনি চৌকা। সে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তুমি বদলে গিয়েছে। আমি তোমায় শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন তুমি নিতান্তই একজন বালিকা–আরজুমান্দের চেয়ে বেশি বয়স হবে না, এবং অনেকবেশি লাজুক। কিন্তু এখন তোমায় দেখে…’

‘আসফ খান আপনার সাথে দেখা হয়েও খুব ভালো লাগছে। আমিও যখন শেষবার আপনাকে দেখেছিলাম তখন আপনি কৃশকায় লম্বা পা আর মুখে ফুস্কুড়িবিশিষ্ট একজন তরুন যোদ্ধা, সেও পাল্টা খোঁচা দেয়। আর এখন আপনি আগ্রা সেনানিবাসের দায়িত্বে রয়েছেন।

আসফ খান কাঁধ ঝাঁকায়। সম্রাট আমার প্রতি সদয়। আমি আশা করি আমার ভাইও আমার মতই ভাগ্যবান হবে। আমি যদি পারতাম তাহলে মীর খানকে গোয়ালিওর থেকে এখানে বদলি করে আনতাম তাহলে আমাদের পরিবার সত্যিই আবার একত্রিত হতে পারতো। আমাদের অভিভাবকদের, বিশেষ করে আম্মিজান এতে খুবই খুশি হতেন… কিন্তু আরো খবর রয়েছে। সম্রাট সামনের মাসে আগ্রা দূর্গে আয়োজিত রাজকীয় মিনা বাজারে অংশ নিতে আমাদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’

‘সেটা আবার কি? আরজুমান্দ বিভ্রান্ত চোখে তার আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু মেহেরুন্নিসা তাঁর কৌতূহল নিবৃত্ত করতে উত্তর দেয়।

‘বাজারটা হলো নওরোজেরই একটা অংশ–রাশিচক্রের প্রথম রাশি মেষে সূর্যের প্রবেশ করা উপলক্ষ্যে সম্রাট আকবরের প্রবর্তন করা আঠারো দিনব্যাপী নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান। ফাতিমা বেগম সবসময়ে অভিযোগ করেন যে উৎসব শুরু হবার দুই সপ্তাহ আগে থেকে মিস্ত্রিরা দূর্গের উদ্যানে সুসজ্জিত শিবির স্থাপন করা আরম্ভ করলে হারেমে তখন কেবল তাদের হাতুড়ির আওয়াজ শোনা যায়।’

‘আর রাজকীয় মিনা বাজার?

‘অনুষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটা অনেকটা সত্যিকারের বাজারের মতই পার্থক্য হল এখানে রাজপরিবারের সদস্য আর অভিজাতেরা কেবল ক্রেতা। দূর্গের উদ্যানে রাতের বেলা এটা আয়োজন করা হয়। অমাত্যদের –স্ত্রী আর কন্যারা–আমাদের মত মেয়েরা–টেবিলের উপরে পট্টি করে বাঁধা রেশম আর তুচ্ছ অলংকারের পসরা সাজিয়ে বসে এবং বিক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাঁদের সম্ভাব্য ক্রেতাদের রাজকুমারী আর রাজপরিবারের প্রবীণাদের আর সেই সঙ্গে সম্রাট আর তাঁর যুবরাজদের সাথে দর কষাকষি আর হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে। অনুষ্ঠানটা এতটাই ঘরোয়া যে সব মেয়েরা এদিন নেকাব ছাড়াই চলাফেরা করে।

‘আব্বাজান, আমি যেতে পারবো, আমি পারবো না?’ আরজুমান্দকে সহসা উদ্বিগ্ন দেখায়।

‘অবশ্যই। আমাকে এখন আবার তোমাদের ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আমাকে আরো কিছু সামরিক সমস্যার তদারকি করতে হবে কিন্তু আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো।’

আসফ খান চলে যেতে, মেহেরুন্নিসা আরজুমান্দ বানুর সাথে বসে তার উৎসুক সব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মনটা অন্য কোথায় পড়ে থাকে। ফাতিমা বেগম তাকে বাজারের সব কথাই বলেছেন কিন্তু সবকিছু তার পছন্দ হয়নি এবং এমন কিছু তিনি বলেছেন মেহেরুন্নিসা অবশ্যই যা তার ভাস্তির সামনে বলতে পারবে না। মিনা বাজার আসলে একটা মাংসের বাজার–এর বেশি কিছু না। আকবর এটা শুরু করেছিলেন কারণ তিনি নতুন শয্যাসঙ্গিনী পছন্দ করার একটা সুযোগ চেয়েছিলেন। কোনো কুমারী মেয়ে যদি তার চোখে ধরতো তাহলে তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য মেয়েটাকে প্রস্তুত করতে তিনি খাজাসারাকে আদেশ দিতেন। বৃদ্ধার আপাত সহানুভূতিশীল চেহারায় ভ্রুকুটি দেখে মেহেরুন্নিসা আঁচ করে যে বহু দিন আগে বাজারে এমন কিছু একটা হয়েছিল যাতে তিনি আহত হয়েছেন। তিনি সম্ভবত আকবরের বাছবিচারহীন যৌন সংসর্গ অপছন্দ করেন। আরজুমান্দের মতই মেহেরুন্নিসাও অন্তরের গভীরে উত্তেজনা অনুভব করে–বাজারই একমাত্র স্থান যেখানে সে নিশ্চিতভাবেই সম্রাটকে দেখতে পাবে। কিন্তু ফাতিমা বেগম কি তাকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবেন?

*

এক সপ্তাহ পরের কথা ফাতিমা বেগমের দমবন্ধ করা আবাসস্থলে সন্ধ্যার মোমবাতি জ্বালানো হতে মেহেরুন্নিসা তাঁর প্রশ্নের উত্তর পায়। যেদিন থেকে সে বৃদ্ধাকে তার আমন্ত্রণের কথা বলেছে তিনি বাকচাতুরীর আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। মেহেরুন্নিসা এখন যদিও নিজেকে সবচেয়ে সুন্দর পোষাকে এবং মূল্যবান অলঙ্কারে সজ্জিত করেছে, তিনি তাঁর মুখাবয়বে একটা একগুয়ে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে রাখেন মেহেরুন্নিসা যার অর্থ ভালোই বুঝে।

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি একজন বিধবা। বাজারে অংশগ্রহণ করাটা আপাত দৃষ্টিতে তোমার জন্য সমীচিত হবে না। আর এসব হাঙ্গামায় যাবার জন্য আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তুমি বরং আমাকে পার্সী কোনো কবিতা পড়ে শোনাও। আমাদের দুজনের জন্যই সেটা বাজারের হট্টগোল আর অশিষ্টতার চেয়ে আনন্দদায়ক হবে।

মেহেরুন্নিসা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কবিতার একটা খণ্ড তুলে নেয় এবং হতাশায় কম্পিত আঙুলি দিয়ে লাল রঙের সুগন্ধি কাঠের মলাটের রূপার বাকল ধীরে ধীরে খুলে।

*

 

বালিতে রক্তের দাগ ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

আগ্রা দূর্গের বিশাল দূর্গপ্রাঙ্গন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, খুররম ভাবে যখন সে, তিনবার তূর্যবাদনের সাথে, তাঁর বড় ভাই পারভেজের সাথে তাদের আব্বাজান জাহাঙ্গীরকে অনুসরণ করে সেখানে প্রবেশ করে, তাদের তিনজনেরই পরনে আজ সোনার জরির কারুকাজ করা পোষাক। গাছের ডাল আর ঝোঁপঝাড় থেকে ঝুলন্ত কাঁচের রঙিন গোলাকার পাত্রে মোমবাতি জ্বলছে এবং সোনা আর রূপার তৈরি কৃত্রিম গাছে রত্ন-উজ্জ্বল ছায়া–লাল, নীল, হলুদ, সবুজ-মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হয়। দেয়ালের চারপাশে সে মখমল দিয়ে মোড়া ছোট ছোট উন্মুক্ত দোকানে পলকা অলঙ্কারের পসরা। সাজিয়ে মেয়েদের সেখানে অপেক্ষমান দেখে। তাঁর দাদাজানের সময়ের মতই পুরো ব্যাপারটা জমকালো দেখায়। সমস্ত নওরোজ উৎসবকালীন সময়ে আকবরের আনন্দ সে এখনও প্রাঞ্জলভাবে মনে করতে পারে। ‘সম্পদশালী হওয়াটা ভালো–বস্তুতপক্ষে এটা আবশ্যিক। কিন্তু একজন সম্রাটের জন্য সেটা প্রদর্শন করা যে তুমি সম্পদশালী সেটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর অর্থ আকবর ভালোই বুঝতেন। খুররমের ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি রয়েছে যেখানে সে ঝলমলে হাওদার নিচে আকবরের পাশে বসে রয়েছে আর তারা আগ্রার সড়ক দিয়ে হাতির পিঠে চড়ে চলেছে। নিজের প্রজাদের কাছে নিজেকে দর্শন দেয়ার বিষয়ে বরাবরই আকবরের দুর্বলতা ছিল এবং তাঁরাও এজন্য তাকে ভালোবাসতো। আকবর ছিলেন সূর্যের মত এবং তার খানিকটা প্রভা খুররম ভাবে তাঁর নিজের উপরেও পড়েছে। তাঁর আব্বাজান জাহাঙ্গীর অবশ্য এই মুহূর্তে, যিনি হীরকসজ্জিত অবস্থায় জ্বলজ্বল করছেন, তাঁর অমাত্যদের পরিবেষ্টিত অবস্থায় এগিয়ে চলেছেন সবসময়ে ছায়াতেই অবস্থান করেছেন। খুররম যখন ছোট ছিল তখনও তার চারপাশে উৎকণ্ঠা আঁচ করতে পারতো–তার আব্বাজান আর দাদাজানের মাঝে, তার আব্বাজান আর তার সৎ-ভাইদের ভিতরে বড় যে সেই খসরুর মাঝে, যে তাঁদের আব্বাজানের রাজত্বকালে আয়োজিত প্রথম নওরোজের আনন্দ এখানে ভাগাভাগি করার বদলে গোয়ালিয়রে অজ্ঞাত কোনো ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে বন্দি রয়েছে। খুররম প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে রূপার কারুকাজ করা চাঁদোয়ার নিচে একই কাপড় দিয়ে মোড়ানো বেদীর দিকে তাঁর আব্বাজানকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাবার সময় ভাবে, খসরু অবাধ্য আর সেই সঙ্গে আহাম্মক, বেদীস্থলটা দুপাশে প্রজ্জ্বলিত মশালের আলোয় আলোকিত।

জাহাঙ্গীর বেদীতে আরোহণ করে এবং বক্তৃতা আরম্ভ করে। আজ রাতে আমাদের নওয়োজ উৎসবের যবনিকাপাত হবে যখন আমরা নতুন চন্দ্র বৎসরকে স্বাগত জানাব। আমার জ্যোতিষীরা আমাকে বলেছে যে আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য আগামী বছরটা আরো সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। আমার দরবারের মেয়েদের সম্মান জানাবার এখন সময় হয়েছে। রাতের তারা যতক্ষণ না আকাশ থেকে মিলিয়ে যায় তারাই, আমরা নই, এখানের। অধীশ্বর। তারা তাদের দ্রব্যের জন্য যা দাম চাইবে আমরা অবশ্যই সেটাই দিতে বাধ্য থাকবো যদি না আমরা তাঁদের অন্যভাবে ভুলাতে পারি। রাজকীয় মিনা বাজার শুরু হোক।’

জাহাঙ্গীর বেদী থেকে নেমে আসে। খুররমের কাছে মনে হয় যে তার আব্বাজান নামার সময় এম মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়ে তার চারপাশে তাকিয়ে দেখেন যেন নির্দিষ্ট কাউকে তিনি খুঁজছেন, এবং তারপরে তাঁর মুখাবয়বে হতাশার একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠে। কিন্তু জাহাঙ্গীর সাথে সাথে নিজেকে সংযত করে নেন এবং হাসিমুখে মেরুন রঙের মখমল বিছানো একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে যান খুররম চিনতে পারে পারভেজের দুধ-মায়ের একজন সেখানে বিক্রেতা সেজে স্মিত মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পারভেজ আব্বাজানের পিছনেই রয়েছে কিন্তু খুররম দাঁড়িয়ে যায়। পারভেজের এই দুধ-মা দারুণ বাঁচাল মহিলা এবং এই মুহূর্তে তার আর পারভেজের ছেলেবেলা সম্বন্ধে লম্বা গল্প শোনার মানসিকতা তার নেই। তার পরনের কোমর পর্যন্ত আঁটসাট কোটটা ভীষণ ভারি আর অস্বস্তিকর। সে শক্ত কাপড়ের নিচে নিজের চওড়া কাঁধ খানিকটা নমনীয় করতে চেষ্টা করলে টের পায় পিঠের চেটালো অস্থির মাঝ দিয়ে ঘামের একটা ধারা নিচের দিকে নামছে।

খুররম তাঁর আব্বাজানকে অনুসরণ করার চেয়ে আঙিনার নির্জন প্রান্তের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তাঁর ধারণা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েরা তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাদের মাঝে হয়তো কোনো সুন্দরী রয়েছে যদিও এই মুহূর্তে আগ্রা বাজারের বর্তুলাকার নিতম্ব আর ভরাট বুকের এক নর্তকী তার সমস্ত মনোযোগ দখল করে রেখেছে। খুররম তারপরে খেয়াল করে প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে সাদা জুই ফুলের একটা সুবিস্তৃত ঝাড়ের কাছে প্রায় অন্ধকারের ভিতরে একটা ছোট দোকানে মাটির কিছু জিনিষপত্র বিক্রির জন্য রাখা আছে। দোকানে দীর্ঘাঙ্গি, হালকা পাতলা দেখতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে মেয়েটার মুখটা দেখতে পায় না কিন্তু মেয়েটা যখন তার দোকানের পসরাগুলো সাজিয়ে রাখছে তখন সে তার চারপাশে আন্দোলিত লম্বা, ঘন চুলে হীরা আর মুক্তার ঝলক লক্ষ্য করে। খুররম আরো কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটা আপনমনে গান গাইছে এবং খুররম যখন দোকানটা থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে এসে দাঁড়ায় তখনই কেবল সে তার অস্তিত্ব টের পায়। বিস্ময়ে মেয়েটার কালো চোখ বড় দেখায়।

খুররম আগে কখনও এমন নিখুঁত মুখশ্রী দেখেনি। আমি তোমায় চমকে দিতে চাইনি। তুমি কি বিক্রি করছো?

মেয়েটা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উজ্জ্বল নীল আর সবুজ রঙে চিত্রিত একটা ফুলদানি এগিয়ে দেয়। ফুলদানিটা মামুলি হলেও দেখতে খুবই সুন্দর। অবশ্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা ঘন, দীপ্তিময় পাপড়িযুক্ত লাজুক চোখ দুটিকে কোনোভাবেই সাধারণ বলা যাবে না। খুররমের নিজেকে বেকুব মনে হয় এবং তাঁর কথা জড়িয়ে যায় আর সে ফুলদানির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে কি বলা যায়।

‘আমি নিজে এটা রং করেছি। আপনার পছন্দ হয়েছে? মেয়েটা জানতে চায়। সে চোখ তুলে মেয়েটার দিকে আবার তাকালে সে দেখে মেয়েটা খানিকটা আমুদে ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে ভাবে, মেয়েটার বয়স কোনোমতেই চৌদ্দ কি পনের বছরের বেশি হবে না। দরবারে আরব বণিকদের আনা মুক্তার মত একটা দীপ্তি মেয়েটার কোমল ত্বকে এবং তাঁর পুরু ঠোঁট গোলাপি রঙের আর কোমল।

‘ফুলদানিটা আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি এর দাম কত চাও?

‘আপনি কত দিতে চান? মেয়েটা নিজের মাথা একপাশে কাত করে।

‘তুমি যা চাইবে।

‘আপনি তাহলে একজন ধনবান ব্যক্তি?

খুররমের সবুজ চোখে বিস্ময় ঝলসে উঠে। মেয়েটা কি তাকে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে এবং তার আব্বাজান যখন কথা বলছিলেন তখন বেদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি? যদি নাও দেখে থাকে, তারপরেও সবাই নিশ্চিতভাবেই যুবরাজদের চেনে… ‘ঠিকই বলেছো আমি যথেষ্ট ধনী।

‘বেশ।

‘দরবারে তুমি কতদিন ধরে রয়েছে?

‘চার সপ্তাহ।’

‘তুমি এর আগে তাহলে কোথায় ছিলে?

‘সম্রাটের সেনাবাহিনীকে আমার আব্বাজান আসফ খান একজন সেনাপতি। সম্রাট তাকে আগ্রা সেনানিবাসের অধিনায়কত্ব দেয়ার পূর্বে তিনি দাক্ষিণাত্যে কর্মরত ছিলেন।

‘আরজুমান্দ… আমি তোমাকে এতক্ষণ একা রাখতে চাইনি…’ মধু-রঙা আলখাল্লায় মার্জিতভাবে সজ্জিত একজন মহিলা দ্রুত এগিয়ে আসে যার কাটা কাটা চেহারার সাথে মেয়েটার মুখের স্পষ্ট মিল রয়েছে। বয়স্ক মহিলাটা সামান্য হাপাচ্ছে কিন্তু খুররমকে দেখার সাথে সাথে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং মাথা সামান্য নত করেন এবং মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘মহামান্য যুবরাজকে ধন্যবাদ আমাদের দোকানে পদধুলি দেয়ার জন্য। আমাদের পসরাগুলো মামুলি হলেও আমার নাতি সবগুলো নিজের হাতে তৈরি করেছে।

 

বালিতে রক্তের দাগ ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

‘সবগুলো জিনিষই দারুণ সুন্দর। আমি সবগুলোই কিনতে চাই। তুমি কেবল দামটা আমায় বলো।’

‘আরজুমান্দ, তোমার কাছে উনি জানতে চাইছেন?

আরজুমান্দকে, যে এতক্ষণ আন্তরিকতার সাথে খুররমকে পর্যবেক্ষণ করছিল, অনিশ্চিত দেখায়, তারপরে সে বলে, একটা সোনার মোহর।

‘আমি তোমায় দশটা দেবো। কর্চি আমার এখনই দশটা মোহর দরকার, খুররম তার কয়েক পা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সহকারীকে ডেকে বলে। কর্চি সামনে এগিয়ে আসে এবং আরজুমান্দের দিকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো এগিয়ে ধরে। না, ওগুলো আমাকে দাও।’ তার সহকারী তার ডান হাতের তালুতে স্বর্ণমুদ্রার একটা স্রোত অর্পণ করে। খুররম ধীরে হাত তুলে ধরে এবং মেয়েটার দিকে মোহরগুলো বাড়িয়ে দেয়। বাতাসের বেগ বেড়েছে এবং

আরজুমান্দকে দেখে মনে হয় চারপাশে আন্দোলিত কাঁচের গোলক থেকে রংধনুর প্রতিটা রং বিচ্ছুরিত যেন তাকে জারিত করেছে। সে তার হাতের তালু থেকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো একটা একটা করে তুলে নেয়। তার হাতের তালুর ত্বকে মেয়েটার আঙুলের স্পর্শ তাঁর এযাবতকালের অভিজ্ঞতার মাঝে সবচেয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহী অনুভূতি। চমকে উঠে, সে মেয়েটার মুখের দিকে তাকায় এবং মেয়েটার কালো চোখের তারায় তাকিয়ে নিশ্চিত প্রমাণ দেখে যে সেও একই অনুভূতিতে দগ্ধ। শেষ মুদ্রাটা তুলে নেয়া হতে সে পুনরায় হাত নামিয়ে নেয়। তাঁর কেবলই মনে হয় মেয়েটার ত্বক তাকে স্পর্শ করার যে অনুভূতি তার স্থায়িত্ব যেন অনন্তকালব্যাপী হয়… সহসা তাঁর এই অনুভূতির কারণে সে অনিশ্চিত, বিভ্রান্তবোধ করে।

“তোমাকে ধন্যবাদ।’ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে, দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে। প্রধান দোকানগুলোর চারপাশে ভিড় করে থাকা কোলাহলরত মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির মাঝে ফিরে আসবার পরেই কেবল তার মনে হয় যে সে তার ক্রয় করা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে আসেনি এবং মেয়েটাও তাকে পেছন থেকে ডাকেনি।

*

খুররমের ঘামে ভেজা বুকে জামিলা ঠাট্টাচ্ছলে হাত বুলায়। আমার প্রভু, আজ রাতে আপনার দেহে বাঘের শক্তি ভর করেছিল। সে আলতো করে তার কানে ঠোকর দেয় এবং তার নিঃশ্বাসে সে এলাচের গন্ধ পায় মেয়েটা চিবাতে পছন্দ করে।

‘এসব বন্ধ করো।’ সে খানিকটা জোর করে তার হাত সরিয়ে দেয় এবং আলতো করে নিজেকে তার আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঠের নক্সা করা অন্তঃপট দিয়ে যদিও কক্ষটা, পাশের ঘর যেখানে মেয়েটা অন্যান্য নর্তকীদের সাথে আহার করে, আলাদা করে ঘেরা রয়েছে যেখানে সে রাতের বেলা ঘুমায় কিন্তু সে তারপরেও একজন বৃদ্ধাকে মেঝের এবড়োথেবড়ো হয়ে থাকা মাটিতে প্রবলভাবে শুকনো লতাপাতার তৈরি ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করতে দেখে। মেয়েরা তাদের খদ্দেরদের কাছ থেকে যা আদায় করে তাতে তার বেশ ভালোই দিন চলে যায়।

খুররম একটা ধাতব পাদানির উপরে রাখা মাটির পাত্র থেকে নিজের মুখে পানির ঝাপটা দেয়।

“কি ব্যাপার? আমি কি আপনাকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছি? জামিলা কথাটা বললেও তার মুখের আত্মবিশ্বাসী হাসি বুঝিয়ে দেয় যে নিজের পারঙ্গমতার বিষয়ে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

নাহ্। অবশ্যই তুমি ব্যর্থ হওনি।

‘তাহলে কি ব্যাপার? জামিলা তার পার্শ্বদেশ ঘুরিয়ে নিয়ে দাঁড়ায়।

সে তার গোলাকৃতি সুন্দর মুখশ্রী, মেয়েটার নধর, ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দিকে চোখ নামিয়ে আনে যে গত ছয়মাস ধরে তার আনন্দসঙ্গী। সে বাজারের পরুষ আবহাওয়া বেশ উপভোগ করে এবং মেয়েরা–এত মুক্ত আর সাবলীল মনে হয় আগ্রা দূর্গে খাজাসারা তার জন্য যেসব রক্ষিতাদের হাজির করতে পারবে তাদের চেয়ে অনেক কম ভীতিকর যেখানে সবসময়ে অসংখ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। জামিলা তাকে রতিকর্মের খুটিনাটি শিখিয়েছে। সে আগে ছিল অতিশয়-ব্যগ্র, এক আনাড়ি কিন্তু জামিলা তাকে শিখিয়েছে কীভাবে একজন নারীকে তৃপ্তি দিতে হয় এবং আনন্দদান কীভাবে তার নিজের তৃপ্তি বর্ধিত করতে পারে। মেয়েটার উষ্ণ সুনম্য দেহ, তাঁর উদ্ভাবন কুশলতা তাকে বিমুগ্ধ করতো। কিন্তু এখন সেসব অতীত। সে ভেবেছিল জামিলার সাথে সহবাস করলে হয়তো সে আরজুমান্দের প্রতি নিজের আবিষ্টতা থেকে মুক্তি পাবে কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। এমনকি সে যখন জামিলার দেহ পরম আবেশে আঁকড়ে ধরেছিল তখনও সে আরজুমারে মুখ দেখতে পেয়েছে। রাজকীয় মিনা বাজার যদিও দুইমাস আগে শেষ হয়েছে, সে আসফ খানের মেয়ের কথা কিছুতেই নিজের মাথা থেকে দূর করতে পারছে না।

‘শয্যায় ফিরে চলেন। আপনার নিশ্চয়ই কিছু শক্তি এখনও অবশিষ্ট আছে এবং আমিও আপনাকে নতুন কিছু একটা দেখাতে চাই…’ জামিলা’র আদুরে কণ্ঠস্বর তাঁর ভাবনার জাল ছিন্ন করে। সে বিছানায় টানটান হয়ে বসে আছে, তার মেহেদী রাঙান স্তনবৃন্ত উদ্ধত, এবং সেও তার দু’পায়ের সংযোগস্থলে পরিচিত সক্রিয়তা অনুভব করে। কিন্তু এটা পুরোটাই হবে কেবল আরো একবার সহবাসের অভিজ্ঞতা। সে আর জামিলা অনেকটা যেন যৌনক্রিয়ায় মিলিত হওয়া দুটি পশু, শীর্ষ অনুভূতির জন্য ক্ষুধার্ত আর উদ্গ্রীব হলেও পরস্পরের প্রতি কারো কোনো আন্তরিক অনুভূতি কাজ করে না। সে যদি তার কাছে না আসতো মেয়েটা তাহলে অন্য কাউকে খুঁজে নিত, এবং সে আর তার নর্তকীর দল যখন আগ্রা ত্যাগ করবে তখন সে সহজেই তার বদলে অন্য কাউকে পেয়ে যাবে। তাদের এই ক্ষিপ্ত সহবাস, একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণের উর্ধ্বে পৌঁছে দেয়া, একটা অস্থির বাসনাকে পরিতৃপ্ত করার আকাঙ্খ ছাড়া আর কিছুই নয়। আরজুমান্দের ভাবনা এখন যখন তার মনে সবসময়ে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন এসব কিছু তার জন্য আর যথেষ্ট নয়।

*

 

বালিতে রক্তের দাগ ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

‘আব্বাজান, আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’

‘কি কথা?’ জাহাঙ্গীর নীলগাইয়ের অণুচিত্রটা সরিয়ে রাখে যা সে নিজের নিভৃত ব্যক্তিগত কক্ষে বসে পর্যবেক্ষণ করছিল। দরবারের পেশাদার শিল্পী প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয় সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে, এমনকি কৃষ্ণসার মৃগের চামড়ার হালকা নীলাভ আভাস, এর চোখের জটিল আকৃতি… খুররম ইতস্তত করে। আমরা কি একা থাকতে পারি…

‘আমাদের একা থাকতে দাও, জাহাঙ্গীর তাঁর পরিচারকদের আদেশ দেয়। শেষ পরিচারকটার বের হয়ে যাবার পর দরজা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হবার আগেই, খুররম অনেকটা বোকার মত কথা শুরু করে। আমি একজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই।’

জাহাঙ্গীর স্থির দৃষ্টিতে নিজের ছেলের দিকে তাকায়–তার এখন প্রায় ষোল বছর বয়স এবং ইতিমধ্যেই একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মতই লম্বা এবং পেষল দেহের অধিকারী হয়ে উঠেছে। তাঁর আধিকারিকদের ভেতরে খুব জনই তাকে কুস্তি কিংবা তরোয়ালবাজিতে পরাস্ত করার সামর্থ্য রাখে।

‘তুমি ঠিকই বলেছে, জাহাঙ্গীরকে চিন্তাকুল দেখায়। আমার প্রায় তোমার মতই বয়স ছিল যখন আমি আমার প্রথমা স্ত্রীকে গ্রহণ করি কিন্তু আমাদের তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। আমি বিবেচনা করে দেখবো কে তোমার জন্য যোগ্য পাত্রী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। জয়সলমিরের রাজপুত শাসকের বেশ কয়েকজন বিবাহযোগ্য কন্যা রয়েছে এবং তাঁর পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন আমার হিন্দু প্রজাদের প্রীত করবে। অথবা আমি আমাদের সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরেও খুঁজে দেখতে পারি। পারস্যের শাহ পরিবারের কারো সাথে বিয়ে হলে মোগলদের কাছ থেকে কান্দাহার কেড়ে নেয়ার বাসনা ত্যাগ করতে তাকে হয়তো আরো বেশি আগ্রহী করে তুলবে…’ জাহাঙ্গীরের মন দ্রুত ভাবতে শুরু করে। সে তার উজির মাজিদ খানকে ডেকে পাঠাতে পারে এবং তাঁর অন্যান্য কয়েকজন পরামর্শদাতাকেও সম্ভবত ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠান যায়। আমি খুব খুশি হয়েছি খুররম, তুমি ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি আমার সাথে আলোচনা করেছো। তোমার প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠার বিষয় এটা দৃশ্যমান করেছে এবং সেই সাথে তুমি আসলেই যে তোমার প্রথম স্ত্রীকে গ্রহণ করার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আমার আবার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যখন আমি বিষয়টা নিয়ে আরো ভালোভাবে চিন্তা করবো–আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সেটা খুব শীঘ্রই হবে।’

‘আমি আমার স্ত্রী হিসাবে আমার পছন্দের মেয়ে ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছি।’ খুররমের কণ্ঠস্বর জোরালো শোনায় এবং তাঁর সবুজ চোখের মণিতে আন্তরিক অভিব্যক্তি খেলা করে।

বিস্ময়ে জাহাঙ্গীরের চোখের পাতা কেঁপে উঠে। কে সে?

‘আগ্রায় অবস্থিত আপনার সেনানিবাসের সেনাপতির কন্যা।

‘আসফ খানের মেয়ে? তুমি তাকে কোথায় দেখতে পেলে?

‘রাজকীয় মিনা বাজারে আমি তাকে দেখেছি। তার নাম আরজুমান্দ।

‘মেয়েটার বয়স কত হবে? একজন বিবাহযোগ্যা কন্যার পিতা হিসাবে আসফ খানের বয়স কমই বলতে হবে।

‘মেয়েটা আমার চেয়ে সম্ভবত সামান্য কয়েক বছরের ছোট হবে।

জাহাঙ্গীর ভ্রূকুটি করে। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় যে এটা কেবল এক ধরনের তারুণ্যপূর্ণ মোহ–সম্ভবত ব্যাপারটা তাই ছিল–কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভূত। খুররমের নজর কেড়েছে যে কিশোরী সে সম্ভবত মেহেরুন্নিসার ভাস্তি এবং সেই সাথে তাঁর কোষাধ্যক্ষ গিয়াস বেগের নাতনি। বহু বছর আগে গিয়াস বেগ যখন কপর্দকশূন্য অবস্থা আর হতাশা নিয়ে আকবরের দরবারে প্রথমবার আসে তখন তাঁর দাদিজান হামিদা তাকে যা কিছু কথা বলেছিলেন তার মনে পড়ে। কি বলেছিলেন যেন? কথাগুলো অনেকটা এমন ছিল, অনেক ঘটনাই ঘটে যা এলোমেলো মনে হবে, কিন্তু আমি প্রায়শই উপলব্ধি করি আমাদের অস্তিত্বের ভিতর দিয়ে একটা ছক প্রবাহিত হচ্ছে অনেকটা যেন কোনো দিব্য কারিগরের হাত তাঁতে বসে নক্সা বুনছে… একদিন এই গিয়াস বেগ আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য হয়ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তার দাদিজান হামিদার ভবিষ্যতের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষবৎ দেখার ক্ষমতা ছিল। তার কথাগুলো কেবল একজন নির্বোধই খারিজ করবে।

‘খুররম। তোমার বয়স এখনও অনেক কম কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি মনস্থির করে ফেলেছে। তোমার হৃদয় যদি এই মেয়েটাকে পাবার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়, আমি তাহলে আপত্তি করবো না এবং তার পরিবার আর আমাদের পরিবারের ভিতরে বৈবাহিকসূত্রে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হবার ইঙ্গিত দিতে আমি নিজে তাঁর আঙুলে বাগদানের অঙ্গুরীয় পরিয়ে দেবো। আমি তোমায় কেবল একটা অনুরোধই করবো যে বিয়ে করার পূর্বে তুমি কিছুদিন একটু অপেক্ষা করো।

জাহাঙ্গীর নিজ সন্তানের চোখে বিস্ময় দেখতে পায়–স্পষ্টতই সে এত সহজে উদ্দেশ্য সাধনের ব্যাপারটা আশা করে নি–কিন্তু তারপরেই সেটা মিলিয়ে গিয়ে আনন্দের হাসিতে পরিণত হয় এবং খুররম তাকে আলিঙ্গণ করে। আমি অপেক্ষা করবো এবং আপনি আর যা কিছু বলবেন সব করবো…’

‘আমি আসফ খানকে ডেকে পাঠাবো। আমাকে তার সাথে অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ততদিন পর্যন্ত বিষয়টা গোপন রাখবে। তোমার আম্মিজানকেও এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলার প্রয়োজন নেই।

খুররম বিদায় নিতে জাহাঙ্গীর যখন কক্ষে আবার একা হয়, সে নিজের মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। খুররমের সাথে তার কথোপকথন অনেক ভাবনার স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছে। খুররম মোটেই খসরুর মত না, যার বিশ্বাসঘাতকতা সে এখনও ক্ষমা করতে পারে নি, সে সবসময়েই একজন অনুগত সন্তান যাকে নিয়ে যেকোনো লোক গর্ববোধ করতে পারে। তার ইচ্ছে করে যে খুররমের বয়সে সে যদি এমন আত্মবিশ্বাসী হতে পারতো এবং সেই সাথে নিজের সন্তানকে সে ভালো করে চিনতো, কিন্তু নিজের প্রিয় নাতির জন্য আকবরের চরম পক্ষপাতিত্ব পুরো ব্যাপারটাকে কঠিন করে তুলেছে। আকবরের সংসারে খুররম প্রতিপালিত হয়েছিল। তাঁর দাদাজানই ছিলেন সেই ব্যক্তি–তাঁর নিজের আব্বাজান নয়–যিনি প্রথমবারের মত যুবরাজকে পাঠশালায় নিয়ে যাবার মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসবই এখন অতীতের কথা, এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পিতা আর পুত্র একত্রে প্রচুর সময় অতিবাহিত করার সুযোগ পেয়েছে।

সে যাই হোক, খুররমের অনুরোধে নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে সে নিজেই নিজেকে বিস্মিত করেছে। মোগল সাম্রাজ্যের একজন যুবরাজ নিজেই তার স্ত্রী নির্বাচন করতে পারে। আরজুমান্দ যদিও অভিজাত এক পার্সী পরিবারের সন্তান কিন্তু তারপরেও তাঁর নিজের মনে এমন একটা সম্বন্ধের কথার কখনও উদয় হতো না। কিন্তু সে নিজেই খুব ভালো করেই জানে যে, পছন্দ এখানে সবসময়ে পরিণতি লাভ করে না। হুমায়ুন আর হামিদার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। মেহেরুন্নিসার প্রতি সে যেমন অনুভব করে সেজন্য কেউ তাকে বাধ্য করে নি এজন্যই নিজের সন্তান এভাবে অতিক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে প্রেমে পড়ায় সে তাকে কোনোভাবেই অভিযুক্ত করতে পারে না। গিয়াস বেগের পরিবারের মেয়েরা মনে হয় তাঁর মত লোকদের সম্মোহিত করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু খুররমের মত তাকেও অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে…

আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ

Bangla Gurukul Logo মীনা বাজার ( দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]

Leave a Comment