মিঃ ও মিসেস ক্রফট -পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিঃ ও মিসেস ক্রফট

মিঃ ও মিসেস ক্রফট -পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]

মিঃ ও মিসেস ক্রফট

সে রাতে হোটেলে নাচের আসর বসেছিল। নিক তার বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে রাতের খাওয়া সারতে এসেছিল। আমাদের দেখে আন্তরিক উষ্ণ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।

কাঁধখোলা বেগুনি রঙের পোষাক পরেছে সে। এক উজ্জ্বল, উচ্ছল মহিলা। আমি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মন্তব্য না করে পারি না। পোয়ারো আমার কথায় সমর্থনসূচক মাথা নাড়ে। সঙ্গীদের থেকে একেবারে বৈপরীত্যমূলক উদাহরণ। ফ্রেডেরিকা রাইস পরেছেন সাদা রঙের পোষাক। ওরা সবাই মহা উৎসাহে নাচানাচি করল। বেশ সুন্দরী মহিলা। পোয়ারোর কথায় আমি সোৎসাহে বলি–আমাদের নিক তো?

না হে, আমি অন্য মহিলাটির কথা বলছি।

একটু থেমে পোয়ারো কয়েকমুহূর্ত পর আবার বলে–উনি কি বিষণ্ণ? অসুখী? কেউ জানে না। আমি তোমায় বলতে পারি হেস্টিংস, উনি একটা চলমান রহস্যের খনি।

তুমি কি ঠিক বলতে চাইছ?

পোয়ারো মৃদু হাসে। তারপর এক সময়ে বলে-তুমি নিজেই এক সময় সব বুঝতে পারবে, শুধু আমার কথাটা মাথায় গেঁথে রাখ।

আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।

নিক আর শ্যালিঙ্গার তখনও নাচছে। ফ্রেডেরিকা এবং লাজারুম নাচ শেষ করে চেয়ারে এসে বসেছে। লাজারুম তারপর উঠে দাঁড়ায় এবং বাইরে বের হয়ে যায়। মিসেস রাইস তখন একা।

পোয়ারো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আমিও তাকে অনুসরণ করি। ওর পদ্ধতিটাই হচ্ছে সরাসরি এবং মূল লক্ষ্যভিত্তিক।

মাদাম, যদি অনুমতি দেন, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই।

মিসেস রাইস আঙুল দিয়ে তার সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলেন–নিশ্চয়ই। বসুন।

শীতল, অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বর।

মাদাম আমি জানি না আপনার প্রিয় বান্ধবী আপনাকে জানিয়েছেন কি না, আজ আবার ওর ওপর একটা প্রাণঘাতি হামলা হয়েছিল।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ধূসর চোখ দুটোয় আতঙ্ক ভরে উঠল–তার মানে?

মাদাম জোয়েল বার্কলিকে আজ সকালে গুলি করে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।

সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব পাল্টে যায়। মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে–নিক বলেছে নিশ্চয়ই আপনাকে।

না মাদাম, আমি নিজের চোখে ঘটনাটা ঘটতে দেখেছি। এই যে বুলেটটা। পোয়ারোর মেলে ধরা হাতের তালুতে বুলেটটা।

বিস্ফারিত চোখে বুলেটটার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ফ্রেডেরিকা, কিন্তু…. কিন্তু…… তার মানে………

মানেটা হচ্ছে খুবই সহজ। ওটা মাদাম জোয়েল বার্কলির কল্পনা নয়। বাস্তবে গত কয়েকদিন ধরেই ওনাকে খুন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পোয়ারো বলে–আচ্ছা মাদাম, এখানে আসবার আগে আপনি কোথায় ছিলেন?

টাকিস্টকে। বন্ধুদের সঙ্গে।

বেশ, আমি কি আপনার সেই বন্ধুদের নামগুলো জানতে পারি? নিমেষের মধ্যে মহিলার যুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠল–সেকথা আপনাকে বলব এরকম কোনও কারণ আছে কি?

না না, সেরকম কিছু নয়। টাকিস্টকে আমারও বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আছে। তাই জানতে চাইছিলাম আপনি তাদের চেনেন নাকি। যেমন, বুকানন, আমার একজন বন্ধু। চেনেন আপনি?

মিসেস রাইস উদাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন–না, আমি চিনি না। আচ্ছা আমরা অবান্তর প্রসঙ্গে সময় কেন নষ্ট করছি? আপনি বরং নিকের কথা বলুন। কে ওকে গুলি করেছে? কেন?

আমি তা জানি না, এখনও কিন্তু নিশ্চিত থাকতে পারেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি সেটা খুঁজে বের করে ফেলব। আমার নাম এরকুল পোয়ারো। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।

অতি বিখ্যাত মানুষ। সে আপনার মহানুভবতা। এবার মিসেস রাইস খুব ধীরে ধীরে কেটে কেটে বললেন-আপনি আমাকে কি করতে বলেন এখন?

সত্যি কথা বলতে কি এবার আমরা দুজনেই যথেষ্ট অবাক হই। আমরা কেউই এমুহূর্তে ওনার মুখ থেকে এধরনের কথা আশা করি না।

আমি আপনাকে অনুরোধ করব আপনার বন্ধুর ওপর একটু নজর রাখতে। পোয়ারো শান্ত গলায় বলল।

ঠিক আছে। সেটাই যথেষ্ট।

পোয়ারো কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায়।

পোয়ারো আমি একটু দূরে সরে আসবার পর বললাম-তুমি কি আস্তিনের তাসগুলো সরাসরি দেখিয়ে দিলে না?

আবার আমরা আমাদের টেবিলে ফিরে এলাম।

পোয়ারো তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল–তাছাড়া আমি আর কি করতে পারতাম। আমার কাছে প্রথম কাজ হল সবার আগে মিস বার্কলির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। তবে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

কি? আমি সোৎসাহে প্রশ্ন করি।

মিসেস রাইস টাকিস্টকে ছিলেন না।

কোথায় ছিলেন তাহলে?

আঃ, এরকুল পোয়ারো ঠিকই সঠিক তথ্য খুঁজে বার করবে।

হান্ডসাম লাজারুম এতক্ষণে ফিরে এসেছেন। মহিলা তাকে সব বলছেন।

আহ–চমৎকার, লোকটা অতীব ধূর্ত হে। আমাদের দিকে সে তাকাচ্ছেই না।

আহ-হা, যদি আমার এখন জানা থাকত।

আমি অবাক গলায় প্রশ্ন করি কি?

সেটা সোমবারই জানতে পারবে।

একটু পরেই নিক ওর নাচের সঙ্গীর থেকে আলাদা হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমার উল্টো দিকের চেয়ারটায় আমার মুখোমুখি এসে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল–এ যেন মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে নেচে চলা।

প্রসঙ্গ বদল করার জন্য পোয়ারো বলে–আপনি খুব সুন্দর নাচেন মাদাম জোয়েল।

লাজুক মুখে পোয়ারোর প্রশংসাটা গ্রহণ করে সে বলে–ধন্যবাদ।

এরপর আরও কিছু কথাবার্তার পর নিক উঠে চলে যায়।

কথাটা আমার মোটেই ভাল লাগল না। নিকের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমি পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বলি–কিন্তু কথাটা সত্যের খুব কাছাকাছি। সেটা মানতেই হবে। আর গোটা ব্যাপারটা মেয়েটা যে খুব সাহসভাবে গ্রহণ করেছে সেটাও মানতেই হবে। পোয়ারো দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে।

পরের দিন ছিল রবিবার। আমরা হোটেলের টেরেসে বসেছিলাম। সাড়ে এগারোটা। হঠাৎ পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়। চল হেস্টিংস, আমরা এক্ষুনি একটা পরীক্ষা করব।

কি?

মাদাম ও তার দুই বন্ধু গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাস্তা পরিষ্কার। চল, চল উঠে পড়।

আমি অবাক গলায় বলি–কিসের রাস্তা……..

পোয়ারো আমার জামা ধরে টানে–গেলেই দেখতে পাবে। কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ঘাস বিছানো সরু পথটা একেবারে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। সেখানে এখন কয়েকজন স্নানার্থী দেখা যাচ্ছে। আমরা সরু পথটা ধরে এবার ডাইনে মোড় নিলাম। কিছুটা হাঁটবার পরই আমরা সেই লোহার মরচে ধরা দরজাটার সামনে এসে পড়লাম যার মাথার ওপর লেখা আছে এন্ড হাউস, (ব্যক্তিগত সম্পত্তি)।

পোয়ারো সতর্ক চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। না, ধারে কাছে কেউই নেই। আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম। অবশেষে বাগান পেরিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম ভোলা ফ্রেঞ্চ (গরাদহীন) জানালাগুলোর সামনে।

পোয়ারো আবার সতর্ক চোখে চারপাশ দেখে নেয় একবার।

না, আমাদের দেখার মত কেউ নেই এখানে। অনায়াসে জানালা টপকে আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ি। সোজা এসে হাজির হলাম বাইরের বসার ঘরে। সময় নষ্ট না করে পোয়ারো ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। আমিও এর পিছু নিলাম। পোয়ারো সোজা নিকের ঘরে ঢুকে পড়ল এবং নিকের বিছানার উপর বসে পড়ল। আমাকেও ইশারায় বসতে বলল।

দেখলে তো, কিরকম সহজ কাজ? কেউ বাধা দেওয়া দূরে থাক, কেউ টের পর্যন্ত পেল না। আমরা এখন নিরাপদে যা খুশি করতে পারি। পোয়ারো চাপা গলায় বলল।

পোয়ারো তুমি বলছ যে কোনও অচেনা মানুষ ঘটনাগুলোর পেছনে আছে, সেই তত্ত্বটাকে বাদ দিতে চাইছ?

অবশ্যই হেস্টিংস, অবশ্যই। কোনও পাগল বা অচেনা ব্যক্তির কাজ এটা মোটেই নয়। এখানে কাজগুলো যে করছে সে অবশ্যই নিকের ঘনিষ্ট বৃত্তের মানুষ।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম, আর তখনই থমকে গেলাম।

যাকে দেখে আমরা থমকে গেলাম সেও আমাদের দেখে প্রথমটায় থতমত খেয়ে যায়, চড়া গলায় প্রশ্ন করে–কে আপনারা? এখানে কি করছেন?

আহ-হ, পোয়ারো হাসিমুখে বলে–আপনি মসিয় ক্রফট, তাই তো?

হ্যাঁ, কিন্তু এখানে আপনারা…….

পোয়ারো বিনীত ভঙ্গিতে বলে, নিচে গিয়ে বসে কথা বলা যায় না?

বেশ। আমরা দুজন ভদ্রলোকের পেছন আবার একতলায় নেমে এলাম।

আমি এরকুল পোয়ারো।

লোকটির মুখের কালো মেঘ এবার দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যায়।

ওহ, আপনিই সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা।

এবার পোয়ারো আমারও পরিচয় করিয়ে দেয়।

আমি এবং পোয়ারো দু’জনে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি।

কিন্তু আপনি এখানে কেন? কোনও গণ্ডগোল ঘটেছে নাকি?

পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে-গণ্ডগোল? সেটা নির্ভর করে ঘটনাকে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখবেন।

অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোক টাক মাথা সত্ত্বেও বেশ সুপুরুষ। তার চেহারার গড়ন, মুখশ্রী বেশ আকর্ষক। সবচেয়ে বেশি যেটা নজর কাড়ে-ওর লাল চোখের তীক্ষ্ণ, হৃদয়ভেদী দৃষ্টিকা।

আসলে আমি বাগানের টমেটো আর নারকেল দিতে এসেছিলাম মিস বার্কলিকে। মাঝে মাঝেই এভাবে জানালা টপকে এ বাড়িতে ঢুকি আমি। ফলের ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে ফিরে যাবার সময়ে ওপরের ঘরে পায়ের শব্দ এবং পুরুষের আওয়াজ পাই। যেহেতু এখানে চোর বা ডাকাতের উৎপাত নেই, তাই আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। দেখতে আসছিলাম ব্যাপারটা কি।

একটু থেমে মিঃ ক্রফট আবার বললেন–কিন্তু আপনি এখানে কেন? ব্যাপারটা কি?

খুব সামান্য ব্যাপার। মাদাম বার্কলির শোবার ঘরের একটা ভারি তৈলচিত্র তারের বাঁধন ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল, উনি আপনাকে নিশ্চয়ই বলেছেন?

হ্যাঁ, ভাগ্যের জোরে উনি খুব বেঁচে গেছেন।

আমি মাদামকে কথা দিয়েছিলাম যে ছবিটা আটকাবার জন্যে একটা মোটা শিকল এনে দেব। হাতে এরকম বিপত্তি আর না ঘটে। মাদাম আমায় বলেছিলেন, আজ সকালে তিনি বন্ধুদের নিয়ে বেরোবেন। আমি এসেছিলাম কতটা শেকল ঠিক লাগবে প্রয়োজন যতটুকু সেই মাপটা নিতে। বালক সুলভ সরল মুখে পোয়ারো বলে।

ওহ, তাহলে এই ব্যাপার।ক্রফট একটা গভীর শ্বাস ছাড়ে। আবার পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে চকচকে চোখে বলে–আমার সৌভাগ্য যে বিখ্যাত এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে আমার আলাপ হল। মিঃ পোয়ারো, আপনি কি এখন ব্যস্ত? যদি তা না হয় তাহলে আমার বাড়িতে এক কাপ চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করব।

নিশ্চয়ই। আমার হাতে এখন সেরকম কোনও কাজ নেই।

বাহ, চমৎকার, পোয়ারো আমার দিকে তাকায়–তুমি মাপ ঠিকমত নিয়েছ তো হেস্টিংস? আমি পোয়ারোকে আশ্বস্থ করার ভান করি।

ক্রফট মানুষটি যে কথা বলতে ভালবাসেন অল্পক্ষণেই বুঝে যাই আমরা। ওর বাড়ি যে মেলবোর্নের কাছে ছোট্ট এক শহরে, ওর প্রথম জীবনের সংগ্রাম–সবই ওই সামান্য আলাপের মধ্যে জমিয়ে দেয়। এমন কি তার স্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় সবিস্তারে জানাতে ভুল করে না। আমরা বরাবরই ভেবেছি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব, আর এই দেশটাতে বেড়াতে আসা আমাদের সবসময়ই তীব্র ইচ্ছা দিল।ইতালিতে থাকার সময়েই ওর স্ত্রী মারাত্মকভাবে আহত হন ট্রেন দুর্ঘটনায়। মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাত পেয়ে তিনি প্রায় পঙ্গু। ডাক্তারেরা সবাই একটা কথা বলেছেনবিশ্রাম, সময়ই ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলবে চোটটা। কথা বলতে বলতেই আমরা ক্রফটের বাড়ি এসে পৌঁছলাম। বাড়িতে পা দিয়েই মিঃ ক্রফট উচ্চস্বরে ডাক দিলেন–কোয়ি, কোয়ি, দেখ কারা এসেছেন। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন-ভেতরে আসুন।

আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে এলাম। মিঃ ক্রফট আমাদের নিয়ে সোজা ওর শোবার ঘরে এসে হাজির হলেন। সোফা, বিছানা, আলমারি দিয়ে সাজানো সুন্দর একটা ঘর। রোগা ফ্যাকাশে চেহারার মাঝবয়সী এক মহিলা বিছানায় শুয়েছিলেন। মিঃ ক্রফট আমাদের সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিলেন। পোয়ারোর নাম শুনে মহিলার দু’চোখ খুশিতে ঝিলিক মেরে উঠল। দেখা গেল তিনি পোয়ারোর কীর্তিগুলোর প্রায় সব খবরই রাখেন। পোয়ারো (এবং আমিও) সসম্ভ্রমে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করলাম। মিসেস ক্রফট পোয়ারোর সঙ্গে তার কয়েকটা পূর্বতন সমাধান হওয়া মামলার বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। এমন কি তিনি এও জানালেন পোয়ারো যে গোয়েন্দাগিরি থেকে অবসর নিয়েছেন কাগজ পড়ে সেটাও জানেন। মিসেস ক্রফটের সঙ্গে কথায় কথায় এসে পড়ল নিকের প্রসঙ্গ। মিসেস মিলি ক্রফট দেখা গেল আমাদের বন্ধুর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। মেয়েটি সত্যিই প্রাণবন্ত। আমাদের বাড়িতে যখন আসে যেন আনন্দে মাতিয়ে দিয়ে যায়। দুর্ভাগ্য নিক এখানে বেশিদিন এসে থাকে না। হয়তো ও সেটা করত যদি না ওর সব বিষয়ে নাক গলানো ওই তুতো ভাইটি তাতে সবসময় বাগড়া দিত। নিকের ইচ্ছে মত কোনও কাজ ও করতে দেয় না। ক্রমে মিলি ক্রফটের কথায় একটা আদল যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শেষপর্যন্ত পোয়ারো প্রশ্নটা না করে থাকতে পারল না।

মাদাম, আহ-হ, তাহলে এম. চার্লস ভ্যাইস আমাদের সুন্দরী বন্ধুটিকে ভালবাসেন? বার্ট ক্রফট মৃদু আপত্তির গলায় বলেন–কি দরকার মিলি ওসব পরচর্চায়? তাতে অবশ্য কান দিলেন না মিলি।

আহ, আমাদের নিক এত বোকা নয়। একটা সামান্য উকিল। চালচুলো নেই। কোন দুঃখে ওকে বিয়ে করতে যাবে বলন তো? আমার মনে হয় কি ওই নাবিক ভদ্রলোক, শ্যালিঙ্গারকেই শেষপর্যন্ত বিয়ে করবে। আমি তাহলে খুশি হব। যদিও, ভদ্রলোকের বয়স নিকের তুলনায় একটু বেশি। আর নিকের বান্ধবী, রাইস। ওকেও আমার বেশ ভাললাগে। যদিও, সম্প্রতি ওকে খুবই দুঃখী দেখায়। বিষণ্ণ দেখায়। তবে মেয়েটার প্রতি আমার বিশেষ রকম আগ্রহ হবার কারণ আছে। তাই না বার্ট? আচমকাই মিঃ ক্রফট উঠে দাঁড়ালেন-ওসব কথা এখন থাকুক। মিলি ওসবে জড়াবার দরকার নেই। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তারপর তিনি বলেন–আপনি কি অস্ট্রেলিয়ার নানা রকম সুন্দর সুন্দর ছবি দেখা পছন্দ করবেন? পোয়ারো এক কথায় রাজি হয়ে গেল।

এর মিনিটদশ পর আমরা ক্রফটের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। খুবই ভাল মানুষ। আমি রাস্তায় বের হয়ে বললাম। হুস, তোমার ওদের খুব পছন্দ হয়েছে তাই না।

পোয়ারোর কথায় আমি অবাক ভঙ্গিতে বললাম, কেন? তোমার পছন্দ হয়নি? পোয়ারো গভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। শুধু কয়েকটা খটকা………

খটকা? আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলি–পোয়ারো দিনে দিনেই তুমি সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ হয়ে উঠছ।

তুমি কি বলছ হেস্টিংস। একেবারে ঠিক। আমি সবাইকে সন্দেহ করি হেস্টিংস। সব কিছুকে সন্দেহ করি।

 

 

০৬.

মিঃ ভাইস

সোমবার, সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম, পোয়ারো একটা সুন্দর ড্রেসিং গাউন পরে বিছানায় বসে আছে।

হেস্টিংস। তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে নিয়ে তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।

বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে আমি বলি–কি কাজ?

আমি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখেছি। সেটা মাদাম জোয়েলের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। আমি তৈরি হয়ে এসে যখন পোয়ারোর হাত থেকে চিরকুট নিতে যাব, ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে–হেস্টিংস, প্রিয় হেস্টিংস, কতদিন ধরে বলছি চেহারাটায় একটু গোয়েন্দাসুলভ গাম্ভীর্য যোগ কর। চুলের সিঁথিটা মাঝখান দিয়ে কর। একটুকরো দাড়ি রাখ থুতনিতে। আমার মত। একটু গোয়েন্দা সুলভ বানাও তোমার মধ্যবিত্ত চেহারাটাকে। আমার কথায় তো তুমি কান দেবার প্রয়োজনই মনে করও না। আমি গম্ভীর মুখে চিরকুটটা পোয়ারোর হাত থেকে নিলাম।

মিস বার্কলি এক তলায় বসবার ঘরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন। অন্য দিনের তুলনায় আজ তার চোখের কালি কিছুটা গাঢ় মনে হল। আমি পোয়ারোর চিরকুটটা তার হাতে তুলে দিলাম।

সকাল ১০টা নাগাদ মিস বার্কলি আমাদের হোটেলে এলেন। ওনার হাতে একটা টেলিগ্রাম। সেটা পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেন-আশাকরি আপনি সন্তুষ্ট হবেন।

পোয়ারো টেলিগ্রামটা পড়ে। আমিও। পৌঁছচ্ছি। আজ ৫.৩০ বিকেলে। ম্যাগি। কিন্তু আপনি ভুল করছেন। ম্যাগির মস্তিষ্ক বলে কোনও বস্তুই নেই। কাজকর্মে খুব পটু ঠিকই। কিন্তু কোনও গুপ্তঘাতককে চিহ্নিত করতে পারবে, আমায় রক্ষা করবে, এটা ম্যাগির কাছে খুবই বেশি রকম দাবি করা হচ্ছে।

পোয়ারো উদাস ভঙ্গিতে বলে–আর কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার?

জর্জ?

এবার তীব্র বিদ্রূপ ভেসে ওঠে নিকের গলায়–জর্জ ওর নাকের ডগায় কিছু বসে থাকলেও তাকে দেখতে পায় না।

মিস বার্কলি এবার টুপিটাকে খুলে সোফার ওপরে ছুঁড়ে ফেলেন, আপনি যাকে ঢুকতে দেবার কথা চিরকুটে লিখেছেন, আমি বাড়িতে বলে এসেছি তাকে বিনা দ্বিধায় যেন ঢুকতে দেওয়া হয়। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ রহস্যময় লাগছে আমার কাছে। আপনি কি গোপন মাইক্রোফোন জাতীয় কিছু বসাতে চাইছেন?

না, না, মাদাম, অত প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কোন ব্যাপার নয়। আমি খুব সামান্য একটা ব্যাপার শুধু জানতে চাই–ব্যাপারটা, বেশ মজার আর উত্তেজক।

হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবে। মিস বার্কলি উদাস ভঙ্গিতে বলে। আমাদের দিকে পিঠ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর যখন সে ঘুরে দাঁড়ায়, ওর মুখের বেপরোয়া ভাবটা সম্পূর্ণ উবে গেছে। অনেক কষ্টে চোখের জল ধরে রেখেছিল।

না, তা না। নিশ্চিতভাবেই নয়। আমার ভয় করছে। ভীষণ রকম ভয় করেছে। ওর মুখে এখন এক শিশুসুলভ অসহায়তা।

না, না, মাদাম, আপনি ভয় পাবার মতো মেয়েই নন। আমি এবং হেস্টিংস দুজনেই জানি সেটা।

না, এটা সাহস নয়। নিক সজোরে তার মাথা নাড়ে-বলতে পারেন এটা এক ধরনের শ্বাসরোধ অপেক্ষা কখন সেই অনিবার্যতাই ঘটবে তার প্রতীক্ষা করা এবং কিভাবে সেটা ঘটবে?

এটা পরিস্থিতির চাপ মাদাম। এসব নিয়ে অকারণ উত্তেজিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

ছোট্ট চেয়ারটায় প্রায় ঢুকে বসেছিল নিক। ওর সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট হাতের আঙুলগুলো প্রবলতর নার্ভাসভাবে উদ্দেশ্যহীন নড়ে বেড়াচ্ছিল। পোয়ারো কয়েক পলক ঠান্ডা চোখ ওর সেই অস্থিরতা লক্ষ্য করে। তারপর শান্ত গলায় বলে–মাদাম, আমার মনে হয় আপনি কিছু বলতে চাইছেন। দয়া করে আমাকে সব কথা খুলে বলুন।

না, তেমন কিছু নয়, সেরকম কিছু নেই।

পোয়ারো নিরুত্তেজক শান্ত গলায় বলে-আপনি আমাকে কিছু একটা বলেননি। তাই না?

নিক সন্ত্রস্থ চোখে তাকায়। আমি আপনাকে ছোটখাট সব ব্যাপারটাই বলেছি।

দুর্ঘটনাগুলো, আপনার ওপর হামলার ব্যাপারে নিশ্চয়ই বলেছেন।

নিক বিভ্রান্ত চোখে তাকায়।

কিন্তু আপনি আমায় আপনার হৃদয়ের-মনের সব কথা বলেননি। আপনার জীবনের সবকিছু………

সেক্ষেত্রে কেউ তাহলে এটা করতে পারে?

আহ আপনি তাহলে সেকথা মেনে নিচ্ছেন? পোয়ারো সোৎসাহে বলে।

মেয়েটি সম্মতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। পোয়ারো খুব গভীর মনযোগের সঙ্গে ওর অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করার পর বলে-হয়তো তাই।

তাহলে? আমাকে বলবার মত আপনার কোনও কথা আছে–গোপন কিছু?

আমি খুঁটিয়ে ওকে লক্ষ্য করছিলাম। এক পলকের জন্য ওর চোখের পাতায় বিদ্যুতের ঝলক খেলে যেতে লক্ষ্য করলাম। তারপর দ্রুতই আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে এল নিক।

বিশ্বাস করুন, সত্যি সত্যি আমি আপনাকে সব কিছুই বলেছি–এই স্টুপিড় বিজনেসের সঙ্গে যা জড়িত। যদি আপনার মনে হয় আমি অন্য কারও বিষয়ে অন্য আরও কিছু জানি, তাহলে ভুল করছেন আপনি। আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি বোকা নই। আমি অবশ্যই বুঝতে পারছি, ওই দুর্ঘটনাগুলোর কোনটাই আসলে দুর্ঘটনা নয়। সেগুলো কারও দ্বারা ঘটানো হত্যার চেষ্টা এবং সেটা আমারই ঘনিষ্ঠতম কারও দ্বারা ঘটানো। আর সেটাই আমাকে কাঁটার মত বিধছে। কারণ আমার সামান্যতম ধারণাও নেই এটা কে হতে পারে অন্তত কে হওয়া সম্ভব, সেই ধারণাটুকুও নেই আমার।

মেয়েটি আবার একবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে একভাবে। পোয়ারো ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইঙ্গিত করে আমাকে চুপ করে থাকতে বলে। আমার মনে হয় ও আশা করছে কিছু একটা প্রতিক্রিয়া ঘটবে মেয়েটির মধ্যে। মেয়েটির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবার হয়তো ভেঙে যাবে এবং সে এবার সত্যি কথা বলবে। কিন্তু তখনকার স্বর ও কথার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। যেন দূর থেকে স্বপ্নজড়ানো কোনও কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।

আপনি জানেন, সবসময় চিরদিন আমি কি ভাবতাম? এন্ড হাউসকে খুব ভালবাসতাম আমি। সেখানকার পারিপার্শ্বিকে আমি একটা নাটক করব ভেবে এসেছি চিরদিন। নানারকম বিষয়ও ভাবতাম। অবশেষে, যেখানে সত্যিই এক নাটক ঘটছে, যা নাকি আমি পরিচালনা করছি না। যদিও সেই নাটকের মুখ্য চরিত্রে আমি। অথচ প্রথম অঙ্কেই আমার মৃত্যু লেখা রয়েছে। বলতে বলতে ওর গলা ভেঙে যায়।

না, না, মাদাম জোয়েল…….. পোয়ারো ব্যস্ত গলায় বলে–এভাবে বলবেন না। এটা এক ধরনের হিস্টিরিয়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নিমেষে, চকিতে ঘুরে ধারাল চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায় সে–ফ্রেডি নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে, আমি হিস্টিরিয়াগ্রস্থ? তীক্ষ্ণ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে গলায় কাঠিন্য এনে বলে, ফ্রেডি যা বলে সবসময় তা সত্যি বলে বিশ্বাস করে নেবার কোনও কারণ নেই।

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর পোয়ারো যে প্রশ্নটা করে সেটা সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। আমাকে একটা কথা বলুন তো মাদাম, আপনি কি কখনও এন্ড হাউস বিক্রি করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন?

না।

আপনি যদি ভাল দাম পান, বাড়িটা কি বিক্রি করে দেবার চিন্তাভাবনা করেছেন?

কয়েকমুহূর্ত নীরবতা……… তারপর নিক আবার কথা বলে-না, কখনও না। অবশ্য প্রস্তাবটা যদি অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণীয় হয়, সেক্ষেত্রে বিক্রি না করাটা তো চরম বোকামি হবে, তাই না?

যদিও, আমি এই বাড়িটাকে এত ভালবাসি সেহেতু এটাকে বিক্রি করার কথা ভাবিই না।

আমি বুঝতে পারছি। নিক দরজার দিকে এগোতে থাকে–আজ রাতে বাজি পোড়ানোর উৎসব হবে। আপনারাও আসুন না। তারপর আমাদের সঙ্গেই ডিনার করবেন।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এত খুব আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হবে। পোয়ারো এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সামান্য হেসে নিক ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

পোয়ারো এবার ওর টুপির দিকে হাত বাড়ায়। আয়নায় নিজেকে দেখে ঠিকঠাক মত টুপিটাকে মাথায় বসায়। কোটের ওপর হাত বুলিয়ে সেটা যথাযথ নিভাজ আছে কিনা পরীক্ষা করে নেয়।

আমি কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি–কি ব্যাপার হে? আমরা কি কোথাও বের হচ্ছি?

অবশ্যই।

কোথায়?

কিছু আইনগত ব্যাপার………

আমি মাথা নাড়ি–ওহ, তাই তো, বুঝেছি।

মেসার্স ভ্যাইস, ট্রেভরনিয়ন অ্যান্ড উইনার্ডের অফিসটা শহরের প্রধান রাস্তায় অবস্থিত। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আমরা অফিসে প্রবেশ করলাম। তিনজন কেরানি সেই ঘরে কাজ ছিল। পোয়ারো তাদের একজনকে বলল যে মিঃ চার্লস ভ্যাইস-এর সঙ্গে দেখা করতে চায়। কেরানিটি পাশের একটা ফোন তুলে নিয়ে দু-চারটে কথা বলল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল-আমার সঙ্গে আসুন। তিনি আমাদের একটা দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তারপর দরজাটা বাইরে থেকে টেনে খুলে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের ঢোকবার পথ করে দিলেন।

আমি সত্যিই আপনাকে ধন্যবাদ দেবার, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার মত এক বিদেশী আপনার পরামর্শ এবং মূল্যবান সাহায্য না পেলে সত্যি সমস্যায় পড়ে যেতাম। আইনি জটিলতা সত্যি এক বিরাট সমস্যা আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কাছে।

মিঃ চালর্স ভ্যাইস এই সময়েই জানতে চাইলেন তার কাছে আমাদের কে পাঠিয়েছেন?

মিস বার্কলি, পোয়ারো সময় নষ্ট না করে উত্তর দেয়–তিনি আপনার সম্পর্কিত তাই না? সামান্য থেমে পোয়ারো আবার যোগ করে–সত্যি, অসাধারণ সুন্দর, চার্মিং মহিলা উনি। উনিই আপনার কথা আমাকে বলেছেন। আমি শনিবার ১২.০০–১২.৩০ নাগাদ আপনার কাছে দেখা করার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু শুনলাম আপনি বেরিয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, মনে পড়েছে, শনিবার আমি একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলাম।

আপনার বোন একা থাকেন। তিনি এতবড় বাড়িতে নিশ্চয়ই নিঃসঙ্গ বোধ করেন?

খুবই স্বাভাবিক।

যদি কিছু মনে না করেন মিঃ ভ্যাইস, একটা কথা জানাবেন? বাড়িটা কি বিক্রি হবার কথা আছে?

আমি তো অন্তত সেরকম কিছু জানি না। পোয়ারো দু’হাতের আঙুলগুলো জড়ো করে কিছু একটা ভাববার ভান করে, তারপর বলে–আসলে, আমি একটা এই ধরনের সম্পতি কেনার খোঁজে রয়েছি। পারিবারিক সম্পত্তি। ভ্যাইস মাথা ঝাঁকায়–আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ……… একটু থেমে সামান্য চিন্তা করে সে আবার বলে–আমার বোন তার এই পারিবারিক সম্পত্তির ওপর নিবেদিতপ্রাণ।

এর কয়েকমিনিট পর আমরা আবার রাস্তায় নেমে এলাম। তাহলে? প্রিয় বন্ধু, চার্লস ভ্যাইসকে দেখে তোমার কি মনে হল?

খুবই নেতিবাচক চরিত্র। তবে যথেষ্ট কৌতূহলজনক– আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বললাম। সেরকম শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষ নয়, বলছো?

পোয়ারো প্রশ্রয়ের গলায় প্রশ্ন করে–না, অবশ্যই নয়। উনি হচ্ছেন সেই ধরনের মধ্যমেধার মানুষ, যার সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের ইচ্ছে হবে না কারও।

হুম। পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে–আমাদের কথপোকথনের মধ্যে তোমার ওনার কোন বিষয় অস্বাভাবিক বা মিথ্যাচার বলে মনে হয় নি? পোয়ারো আবার প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, অবশ্যই। এন্ড হাউস বিক্রির ব্যাপারটা।

একেবারে ঠিক ধরেছ। পোয়ারো সমর্থনের গলায় বলে–তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে-মাদাম জোয়েল বার্কলি-র এন্ড হাউসের ব্যাপারে মনোভাবটা তোমার ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর নিবেদিতপ্রাণ বলে মনে হয়েছে?

না, কখনওই ওনাকে এ বিষয়ে অতখানি অনড় মনে হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীমান ভাইটি এভাবে বাড়িয়ে ব্যাপারটাকে বলছেন কেন? এর সহজ ব্যাখ্যা-ব্যাপারটা নিয়ে এদের দু’জনের কেউ একজন মিথ্যা বলছেন। এখন আমাদের যথাসম্ভব দ্রুত জানতে, খুঁজে বের করতে হবে সেটা কে? এবং কেন?

পোয়ারো আবার আমার দিকে কৌতুকের চোখে তাকায়–আরও একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ্য করেছ কি হেস্টিংস?

সেটা কি?

শনিবার ১২.০০ টার পর উনি অফিসে হাজির ছিলেন না।

 

 

০৭.

 ট্রাজেডি

সন্ধ্যাবেলা আমরা এন্ড হাউসে হাজির হলাম। নিক আমাদের দেখে বিস্ময়ের গলায় বলে–ওহ আপনারা?

পোয়ারো বিনীত গলায় প্রশ্ন করে-আপনি কি কারও অপেক্ষায় রয়েছেন মাদাম জোয়েল?

নিক একটা ড্রাগন-ছাপ সাদা কিমানো পরেছিল। কিছুটা বিরক্ত গলায় ও বলে–আসলে বিকেলের মধ্যে আমার পোষাকটা পৌঁছে দেবার কথা ছিল। সেটা এখনও এল না। কিছুক্ষণ পরই বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। নিক দরজা খুলে দিল। এই যে ম্যাগি তুমি এসে গেছ তাহলে। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হলেন সেই গোয়েন্দা এবং ওই ভদ্রলোক ওনার সহকারী। গোপন ঘাতকের হাত থেকে ওনারাই আমাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। চল, আমরা সবাই বসবার ঘরে গিয়ে বসি। তারপর ওনারাই পুরো ব্যাপারটা তোমাকে বলবেন।

ম্যাগি বার্কলি আমাদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমরা সবাই বাইরের ঘরে এসে বসলাম। প্রথম দর্শনেই মেয়েটির প্রতি আমার একটা বেশ ভাল মনোভাব জন্মাল। মেয়েটির চেহারায় ব্যক্তিত্ব এবং চালচলনে শান্ত ঠান্ডা আত্মবিশ্বাসের ছায়া আছে। এগুলোই আমাকে আকর্ষণ করল সম্ভবত। পুরানো সময়ের চোখে দেখলে নিঃসন্দেহে সুন্দরী বলা যায়। তবে–যদি আধুনিক সংজ্ঞা নিয়ে বিচার করা হয় তবে–না, মোটেই স্মার্ট বলা যাবে না মেয়েটিকে। কোনরকমে সাজসজ্জা, প্রসাধনের চড়া প্রলেপবিহীন একটি সরলতর মুখ। পোষাকও খুবই সাধারণ মানের। একটা কালো সান্ধ্য পোক।

গভীর নীল চোখ তুলে শান্ত গলায় ম্যাগি বলে–নিকের কাছে ঘটনার কথা সব জেনে আমি তো স্তম্ভিত হয়ে গেছি। একটু থেমে সে আবার বলে–সত্যি বলতে কি, ব্যাপারটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। কেউ কেন নিকের ক্ষতি করতে চাইবে? নিকের মত মেয়ের তো কোনও শত্রু থাকতে পারে না। মেয়েটির গলায় সত্যি সত্যি অবিশ্বাস ঝরে পড়ে। সেই অবিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছিল পোয়ারোর দিকে মেয়েটির দৃষ্টিতেও স্বাভাবিক হয়তো। ম্যাগি বার্কলির মত সেকেলে ধারনার মেয়েদের কাছে। বিদেশী মানুষেরা সবসময়ই সন্দেহের বস্তু।

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মিস বার্কলি, ঘটনাগুলো সবই সত্যি বাস্তব। কোনও ভুল নেই–পোয়ারো শান্ত গলায় বলে। ম্যাগি কোন উত্তর দিল না বটে, কিন্তু ওর মুখের রেখায় অবিশ্বাসের ভাঁজগুলো সামান্যও পরিবর্তন হল না।

পোয়ারো এবার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে–মিস বার্কলি, আপনি কি স্কটিশ?

আমার মা ছিলেন স্কটল্যান্ডে।

আপনার বোন সত্যিই খুব সাহসের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটাকে সামলাচ্ছেন। উনি আমাদের কথা দিয়েছেন, একদম স্বাভাবিক থাকবেন।

এবার আমি বলি,–সেটাই তো একমাত্র পথ।

তাই নাকি? ম্যাগি তার শান্ত অথচ ধারাল গলায় বলে।

মানে আমি বলতে চাইছি–মনের ভেতর যাই হয়ে চলুক, ঘটুক, বাইরের লোকেদের কাছে সেটা প্রকাশ করে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সবার জন্যেই সেটা অস্বস্তিকর।

আমাদের কথা আরও কিছুটা এগোবার সময় ফ্রেডরিকা রাইস ঘরে ঢুকলেন এবং ওকে অনুসরণ করে একটু পরেই লাজারুমও চলে এল। এরপর নিকও সেজেগুজে এসে হাজির হল। কৃষ্ণকালো একটা হাঁটুঝুল দুর্দান্ত ফ্রক পরেছে সে। কাঁধে জড়িয়েছে চীনা মাল। ভারি চমৎকার দেখাচ্ছিল ওকে।

শুভ সন্ধ্যা এবং স্বাগতম কটেল। সহাস্যে, খুশির ভঙ্গিতে বলল নিক।

আমরা সবাই গ্লাস হাতে নিলাম। নিকের স্বাস্থ্য কামনা করে চুমুক দিলাম। লাজারুম তার হাতের গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরল–নিক, চমৎকার শাল। নিশ্চয়ই খুব পুরানো জিনিসটা?

হ্যাঁ, এটা আমার প্রপিতামহের তম্য প্রপিতামহ ওদেশে ভ্রমণ সেরে ফেরার সময়ে নিয়ে এসেছিলেন।

জিনিসটা সত্যি চমৎকার। এরকম জিনিস আজকাল আর পাওয়া যায় না।

জিনিসটা খুবই গরম। যদিও কালো রং আমার একেবারেই পছন্দ নয়।

ঠিকই তো। তোমাকে আগে কখনও কালো রং পরতে দেখিনি। আজ হঠাৎ কেন এটা পরলে?

জানি না। নিক কাঁধ ঝাঁকায়। ব্যাপারটাকে কিছুটা উড়িয়ে দেবার বেপরোয়া ভঙ্গি করে।

কিন্তু আমি ওর দু’ঠোঁটের ভাঁজে, তীক্ষ্ণতর অভিব্যক্তিতে দেখলাম স্পষ্ট বেদনা, হতাশার ছায়া। মানুষ কেন কি করছে সবসময় কি তা বুঝতে পারে? দার্শনিকতা ছুঁয়ে যায় নিকের পরের কথাগুলোতে।

এরপর আমরা রাতের খাবার খেতে গেলাম। লক্ষ্য করলাম একটি পুরুষ চাকরকে এই অনুষ্ঠানের জন্যে ভাড়া করা হয়েছে। লোকটার চেহারাটা আমার কাছে বেশ রহস্যজনক মনে হল। খাবার তেমন আহামরি কিছু নয়। শ্যাম্পেনটি সে তুলনায় বেশ ভাল।

জর্জ এখনও এল না। চিন্তিত স্বরে কথাগুলো বলে আমাদের দিকে তাকায়–কাল রাতে ও প্লাইমাউথ গেছে। আজ সন্ধ্যাতে ফিরে আসবার কথা। যে কোনও সময় সে চলে আসবে। নাচ শুরু হবার আগেই সে এসে পড়বে আশা করা যায়।

ঠিক সেসময় জানালার বাইরে একটা টানা, তীক্ষ্ণ গর্জন শোনা গেল। টানা, চাপা গর্জন।

ওহ এই স্পিডবোটগুলো……. জ্বালিয়ে মারল– লাজারুম বিরক্তির গলায় বলে।

ওগুলো স্পিডবোটের শব্দ নয়। সি প্লেন-নিক ওর স্বভাবোচিত শান্ত গলায় বলে।

হ্যাঁ, আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ– লাজারুম জবাব দেয়।

কথার প্রসঙ্গ এবার ধীরে ধীরে ক্রমে সেই দিকে ঘুরে যায়। কথা প্রসঙ্গেই লাজারুম একসময় বলে–মাইকেল স্যাটন যদি তার বিশ্ব পরিক্রমায় সফল হন, তাহলে সত্যি সেটা আমাদের দেশের পক্ষে ও স্যাটনের জন্যে তো অবশ্যই গৌরবজনক ঘটনা হবে। খুবই দুঃখের ব্যাপার যে ওনার সঙ্গে কি কি ঘটেছে তাই এখনও পর্যন্ত জানা গেল না।

আমার মনে হয় উনি এখনও ভাল আছেন, ঠিক আছেন। নিকের কথার জবাবে লাজারুম অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ভগবান যেন তাই করেন। তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।

সবাই ওনাকে পাগল স্যাটন বলে, তাই না?–এবার ফ্রেডরিকা রাইস বলে।

হ্যাঁ, ওদের বংশটাই একটু পাগলাটে। ওর এক কাকা গত সপ্তাহে মারা গেলেন। তিনি কোটিপতি ছিলেন। একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি চালাতেন। তারও পাগলাটে বলে দুর্নাম ছিল।

লাজারুমের কথার প্রত্যুত্তরে ফ্রেডরিকা বলে–নারীবিদ্বেষী হিসাবেও উনি যথেষ্ট কুখ্যাত ছিলেন। আমার মনে হয়, তোমরা মিথ্যে ভয় পাচ্ছ, মাইকেল স্যাটন মোটেই মারা যাননি। ওনার কিছু হয়নি।

নিক এবার যেন কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা বলে।

তোমার সাথে ওনার পরিচয় ছিল। তাই না?–লাজারুম প্রশ্ন করে।

গত বছর আমার আর ফেড্রির সঙ্গে লা টকিউটয়ে ওনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। চমৎকার মানুষ উনি। তাই না ফ্রেডি?।

নিকের প্রশ্নে মিসেস রাইস কটাক্ষ হানলেন, আমাকে জিজ্ঞাসা কর না প্রিয়তমা। ওনার আগ্রহ তোমার বিষয়েই শুধুমাত্র ছিল। উনি তত একবার তোমাকে বাইরেও নিয়ে গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, স্কারবরো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা-কথা শেষ করে, সবার থেকে অনুমতি নিয়ে নিক উঠে দাঁড়াল নাহ, আর দেরি করার মানে হয় না। আমি ফোনটা করেই আসি। দেখি জর্জের আসতে আর কত দেরি হবে।

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ন’টা বেজে গেছে। ভেজাট এবং রাম দেওয়া হয়েছে যার যার পছন্দ মত। পোয়ারো লাজারুমের সঙ্গে শিল্প বিষয়ে কথাবার্তা বলতে লাগল। ফ্রেডরিকা রাইস দু’হাতের ওপর থুতনি ভর দিয়ে নিঃশব্দে, স্বাস্নালু ভঙ্গিতে বসে রইলেন। আমি ম্যাগি বার্কলির সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতে লাগলাম। এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকমিনিট। নটা বেজে কুড়ি মিনিট নাগাদ দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে নিক বার্কলি।

সবাই এবার বাইরে এস।

সবাই বাধ্য অনুগতভাবে উঠে দাঁড়াই। ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন অতিথি এসে হাজির হয়েছেন। সব মিলিয়ে বারো জনের মত। নিক খুবই ভাল গৃহকর্ত্রী দেখা গেল। সবাইকে একই রকম উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানাল। অতিথিরা প্রায় কেউই তেমন আগ্রহী হবার মত নয়। তবে অতিথিরা একজন ছিলেন চার্লস ভ্যাইস।

আমরা সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দূরে সমুদ্র ও বন্দর আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিল। উপভোগ্য-এর মনোরম দৃশ্য। যেন একটা হীরের নেকলেশ, মনে হচ্ছে দূর থেকে বিদ্যুতের আলোয় সজ্জিত সেই জায়গাটাকে। বয়স্কদের জন্যে বাগানে কয়েকটা চেয়ারও পাতা রয়েছে। এবার বাজি পোড়ানো শুরু হল। প্রথমটা একটা রঙিন হাউস। নানা রঙের আগুনের তারা ছড়াতে ছড়াতে আকাশমুখী হয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় সে বিস্ফোরিত হল।

রাতটা ছিল ঘন অন্ধকারে ঘেরা। নতুন চাঁদ দেখা দিতে আরও তিন দিন বাকি এবং এক আপাদমস্তক গ্রীষ্মরাতের আদর্শ উদাহরণ আজকের রাতটা। খুবই শীতলতম রাত। সমুদ্রের ঝড়ো হিমেল হাওয়ায় আমার পাশে দাঁড়ানো ম্যাগি বার্কলি কঁপছিল। একটা কোট গায়ে চড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। এই সময় ফ্রেডরিকাও বলে উঠলেন–ম্যাগি, আমার ঘর থেকে আমার একটা কোট নিয়ে এস না।

ও শুনতে পাবে না। দাঁড়াও, আমি এনে দিচ্ছি।

নিক বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমার নিজের জন্যও দরকার গরম জামার। এই শালে এত ঠান্ডা মানছে না–হালকা গলায় বলে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ শিষ দিয়ে সমুদ্রের বুক থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠে এল। বাজি পুড়েই চলেছে। চোখ ভরিয়ে দেবার মত দৃশ্য। দেখতে দেখতে আমি আমার পাশেই দাঁড়ানো এক বয়ষ্ক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে গল্প শুরু করে দিয়েছিলাম।

বুম বুম বুম আকাশে একের পর এক বাজি বিস্ফোরিত হয়েই চলেছে এবং তারপর কোনটা সোনালি রাশি হয়ে ঝরে পড়ছে, কোনটা থেকে নীল হাউস আরও উপরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আবার কোনটা সবুজ বলের সারি হয়ে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এসব।

পোয়ারো এতক্ষণ কোথায় যেন উঠে গিয়েছিল। এবার আবির্ভাব ঘটল তার। আমার কানের কাছে মুখটা এনে বলল–বড্ড, একঘেঁয়ে ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত। আমি সবিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। পায়ের তলায় মাটিটা পর্যন্ত সাতাত করছে। শীতে পা’দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে।

আমার বিস্ময় উত্তোরোত্তর বেড়ে চলে–শীত? এমন চমৎকার রাতে তোমার শীত লাগছে?

চমৎকার রাত? পোয়ারো গোঁফে হাত বুলোত বুলোতে বলে–হ্যাঁ, তা তুমি বলতে পারও বটে। যতক্ষণ না তোমার চাঁদিতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, তুমি কি বুঝতে পারও যে সত্যি বৃষ্টি পড়ছে? এখানেও যদি একটা থার্মোমিটার থাকত তুমি বুঝতে পারতে আমি কতটা সত্যি বলছি।

আমি প্রখর চোখে এবার পোয়ারোর দিকে তাকাই। তোমার মতলবটা কি বলত? আসল কথাটা এবার বল দেখি।

পোয়ারো এবার পরম মমতায় আমার কাঁধে হাত রাখে। প্রিয় বন্ধুবর, আমি বলতে চাইছি তুমি একটা গ্রীষ্মপ্রধান দেশ থেকে এসেছ। এদেশের শীত নিয়ে তোমার এভাবে ছেলেখেলা করা উচিত নয়।

আমি এবার মুচকি হেসে (কম দিন ওর সঙ্গে তো নেই। ওর ইশারা কোন দিকে চলেছে বুঝতে এখন আর দেরি হয় না, অসুবিধা হয় না) বলি–ঠিক আছে। আমার মত পা তুলে হাঁটতে হাঁটতে (মাটির ভিজে ভাব থেকে পা বাঁচানোর নাটক) আসতে থাকে সে।

আমরা বাড়ির একশো গজের মধ্যে চলে এসেছিলাম। বুঝলে হেস্টিংস, আমাদের সবারই হৃদয়ের মধ্যে একটা শিশু লুকিয়ে আছে।

আমি আচমকা পোয়ারোর হাতটাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। পোয়ারোর হাত আঁকড়ে ধরে মৃদু টান মারলাম। পোয়ারো মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি আঙুল দেখালাম। আমার অঙ্গুলি নির্দেশ লক্ষ্য করে পোয়ারো তাকায় সেদিকে। আমাদের সামনেই….. আমাদের আর ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটার মাঝখানে…… আবছা একটা শরীর। কালো চীনা শাল জড়ান।

মন দেউই ডাই, স্পেনিশ ভাষায় পোয়ারো ফিস ফিস করে বলে ওঠে–হে ভগবান।

 

 

০৮.

ভয়ঙ্কর শাল

বোধহয় খুব বেশি হলে ৪০ সেকেন্ডের মত থমকে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। আতঙ্ক%A