Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম | সামাজিক সমস্যা ও বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম | সামাজিক সমস্যা ও বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : আধুনিক বিশ্বে নিত্যনতুন আবিষ্কার মানব জীবনকে একদিকে যেমন দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য ও গতিময়তা, অন্যদিকে তেমনি সঞ্চারিত করেছে হতাশা ও উদ্বেগের। পুরাতন সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে দিনে দিনে, নতুন মূল্যবোধও সবসময় গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।

মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম | সামাজিক সমস্যা ও বিষয়াবলী | বাংলা রচনা সম্ভার

মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

সামগ্রিকভাবে হতাশা, আদর্শহীনতা, বিভ্রান্তি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক-ধর্মীয় নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি নানাবিধ কারণ যুবসমাজকে মাদকাসক্ত করে তুলছে। তাই বর্তমান বিশ্বসভ্যতা যে কয়টি মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন, মাদকাসক্তি তার অন্যতম। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ বিস্তারে বিশ্ববাসী আজ শঙ্কিত। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু তরুণের তাজা প্রাণ। বিঘ্নিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তাই আন্তর্জাতিকভাবে মাদকের ভয়াবহতা রোধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রতি বছর ২৬ জুনকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালন করা হয় ।

 

মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তি: মাদকদ্রব্য হচ্ছে সেসব বস্তু যা গ্রহণের ফলে স্নায়ুবিক বৈকল্যসহ নেশার সৃষ্টি হয়। সুনির্দিষ্ট সময় পর পর তা সেবনের দুর্বিনীত আসক্তি অনুভূত হয় এবং কেবল সেবন দ্বারাই সে তীব্র আসক্তি (সাময়িক) দূরীভূত হয়। এর কুপ্রভাব ও ভয়াবহতা মারাত্মক ।

বাংলাদেশে যেসব মাদকদ্রব্যের সেবন সর্বাধিক সেগুলো হলো গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, রেকটিফাইড স্পিরিট, মদ, বিয়ার, তাড়ি, পঁচুই, ঘুমের ওষুধ, প্যাথেড্রিন ইনজেকশন ইত্যাদি। এসব মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে নেশা সৃষ্টিকে মাদকাসক্তি বলা হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, মাদকাসক্তি হচ্ছে চিকিৎসা গ্রহণযোগ্য নয় এমন দ্রব্য অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রমাগত বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করা এবং এসব দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া।

মাদকাসক্তির কারণ: মাদকাসক্তির কারণ বহুবিধ। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানী, গবেষক ও চিকিৎসকরা মাদকাসক্তির অন্তরালে যে কারণগুলো সক্রিয় বলে চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো:

১. সঙ্গদোষ: মাদকাসক্তির জন্য সঙ্গদোষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোনো বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হলে সে তার সঙ্গীদেরও নেশার জগতে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে সুস্থ সঙ্গীটিও নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’

২. কৌতূহল : কৌতূহলও মাদকাসক্তির একটি মারাত্মক কারণ। মাদকাসক্তির ভয়াবহতা জেনেও অনেকে কৌতূহলবশত মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে। এভাবে একবার দু বার গ্রহণের ফলে এক পর্যায়ে সে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

৩. সহজ আনন্দ লাভের বাসনা : মানুষ অনেক সময় আনন্দ লাভের সহজ উপায় হিসেবে মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

  1. প্রথম যৌবনের বিদ্রোহী মনোভাব : কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে ছেলেমেয়েদের বিদ্রোহী মনোভাবের মধ্য দিয়েই তাদের ব্যক্তিত্ব অনেকাংশে গড়ে ওঠে। এই বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে তারা ভালোমন্দ বিচার না করে সামাজিক অনেক নিয়ম-কানুনের সঙ্গে মিশে যেতে চায় অথবা ভাঙ্গতে চায় । এই বিদ্রোহী মনোভাব তাদেরকে অনেক সময় মাদকাসক্ত করে তোলে ।

৫. মনস্তাত্ত্বিক বিশৃঙ্খলা : তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তি বিস্তৃতির একটা প্রধান কারণ হলো হতাশা। পরীক্ষায় ফেল, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, সেশন জট, বেকারত্ব প্রভৃতি কারণে তারা শোক, বিষাদ ও বঞ্চনার চেতনাকে নেশায় আচ্ছন্ন করতে চায় ।

৬. পারিবারিক কলহ : প্রতিটি সন্তানই চায় তার পরিবারের অভ্যন্তরে মা ও বাবার মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকুক । কিন্তু অনেক পরিবারে মা ও বাবার মধ্যে সুসম্পর্কের পরিবর্তে প্রায়শ দ্বন্দ্ব ও কলহ লেগে থাকে, যা অনেক সন্তানই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। ফলে এক পর্যায়ে এসব সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে অন্যভাবে মানসিক প্রশান্তি খোঁজার চেষ্টা করে ।

৭. পরিবারের অভ্যন্তরে মাদকের প্রভাব : এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের অনেকের পিতা-মাতার মধ্যে নেশার অভ্যাস ছিল। পরিবারের অভ্যন্তরে মাদকের প্রভাবে এসব পিতা-মাতার সন্তান সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।

৮. ধর্মীয় মূল্যবোধের বিচ্যুতি : ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জ্ঞান মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ ও আতৃত্বের বিকাশ ঘটায় এবং মানুষকে চরিত্রবান করে তুলে সঠিক পথে পরিচালিত করে। কিছু সাম্প্রতিককালে ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি মদকাসক্তি বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

৯. চিকিৎসাসৃষ্ট মাদকাসক্তিঃ বহু নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি মাদকদ্রব্য প্রথম গ্রহণ করে ডাক্তারের নির্দেশে। তারপর সতর্ক তত্ত্বাবধানের অভাবে ও ব্যবস্থাপত্রে ঘন ঘন ব্যবহারের কারণে সেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধই একদিন তাকে মাদকাসক্ত করে তোলে ।

১০. মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা : নেশাজাতীয় বস্তুটি যদি মানুষের হাতের কাছে না থাকে তবে মানুষ নেশা বা মাদকাসক্ত হবার সুযোগ পাবে না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় হয়। মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার কারণে মাদকাসক্তদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।

মাদকাসক্তিতে কারা বেশি আক্রান্ত : যেসব পরিবারে পারিবারিক বন্ধন শিথিল, মা-বাবা, ভাই-বোনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা কম, সেসব পরিবারের সদস্যরাই বেশি মাদকাসক্ত হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অধিকাংশ মাদকাসক্তের গড় বয়স ১৮-৩২ বছর। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, এই সময়টিই জীবনের সোনালী সময়। এই সময়ই মানুষ পরিবার, দেশ, জাতি তথা বিশ্বের জন্য বেশি শ্রম দেয়। এক জরিপে প্রকাশ, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে মাদকাসক্তরা বছরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে।

মাদকাসক্তি ও বিপন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম : বিশ্বব্যাপী মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং চোরাচালানের মাধ্যমে এর ব্যাপক প্রসার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। মাদকের নিষ্ঠুর ছোবলে অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ এবং অংকুরেই বিনষ্ট হচ্ছে বহু তরুণের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। মাদকদ্রব্য তরুণ সমাজের এক বিরাট অংশকে অকর্মণ্য ও অচেতন করে তুলেছে, অবক্ষয় ঘটাচ্ছে মূল্যবোধের।

ফলে সুস্থ সামাজিক বিন্যাস, সুন্দর পরিবেশ ও জাতীয় স্থিতিশীলতা এক বিরাট হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। মাদকাসক্তির ধ্বংসাত্মক ও ঋণাত্মক প্রভাবে বাংলাদেশের গোটা সমাজ তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামজিক ও জাতীয় জীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো :

১. যুবসমাজের ওপর প্রভাব: মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার আমাদের দেশের যুবসমাজের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, কৌতূহল প্রভৃতির কারণে আমাদের দেশের যুবসমাজের এক বিরাট অংশ মাদকদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মাদকদ্রব্যের ওপর এ নির্ভরশীলতা যুবসমাজের এক বিরাট অংশকে অবচেতন ও অকর্মণ্য করে তুলেছে।

২. সামাজিক বিশৃঙ্খলা: যারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তারা যে কোনো উপায়ে মানকজাতীয় দ্রব্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর মাদকাসক্তরা মানবদ্রব্য সপ্তাহের জন্য চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িত হয়। এভাবে সমাজের বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।

৩. অন্যান্য সামাজিক সমস্যার জন্ম দেয়: মাদকাসক্তি সমস্যাকে কেন্দ্র করে সমাজে আরো বহু ধরনের সামাজিক সমস্যার জন্য হচ্ছে। কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা তাদের মনের চাহিদা মেটানোর জন্য যে কোনো ধরনের কাজ করতে প্রস্তুত থাকে। এ চাহিদা পূরণের জন্য তারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুট, ধর্ষণ, পতিতালয়ে গমন, পারিবারিক ভাঙ্গন প্রভৃতি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে।

৪. অবৈধ ব্যবসা: মাদকদ্রব্যের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক এবং সম্পূর্ণ আইনবিরোধী। কারণ এর পুরো ব্যবসাই চোরাইপথে অবৈধভাবে করতে হয়। সরকারকে ফাঁকি দিয়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা লাভের আশায় রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্নে এই অবৈধ ব্যবসা করছে ।

৫. শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি: মাদকদ্রব্যের সেবন বা ব্যবহার মানসিক ও শারীরিকভাবে আসক্তদের মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের দেশে ক্রমাগতহারে অকর্মণ্য যুবক-যুবতীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, যারা কর্মক্ষমতা হারিয়ে পরিবার ও সমাজে অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

৬. নৈতিক অধঃপতন: মাদকদ্রব্যের সাথে অবৈধ যৌনসম্পর্ক, পাপ এবং পতিতাবৃত্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বাহ্যিক আচরণ বা মুখোশ খুলে যায়। আসক্তদের বিবেক লোপ পায়। ফলে অতিরিক্ত মাদক সেবনের পর স্বভাবতই যৌনসংক্রান্ত যে কোনো ব্যাপারে ব্যক্তির মাঝে চরম নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়।

৭. পারিবারিক ভাঙ্গন ও হতাশা বৃদ্ধি: মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচারের ফলে আমাদের দেশের বহু লোক কোনো না কোনোভাবে এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর প্রভাবে আসক্ত ব্যক্তির দ্বারা পরে সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক ভাঙ্গন এবং পুরো সমাজ ব্যবস্থায় সর্বস্তরের লোকের মাঝে দেখা দিয়েছে হতাশা।

৮. সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়: মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা যেহেতু আসক্ত হবার পর তাদের চেতনা হারিয়ে ফেলে, তাই পরবর্তীকালে তারা পূর্বের আদর্শ ও মূল্যবোধ ধরে রাখতে পারে না। আমাদের দেশের মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে ক্রমেই সরে পড়ছে।

৯. অপরাধ প্রবণতার হার বৃদ্ধি: আমাদের দেশে মাদকাসক্তি সমস্যা ক্রমাগতভাবে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি করছে। নেশা গ্রহণের ফলে ব্যক্তির মাঝে অস্বাভাবিকতা, অপ্রকৃতিস্থতা, বিচারবুদ্ধিহীনতা ও পাশবিকতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির ফলে সমাজে অপরাধ ও অনাচার বেড়ে যাচ্ছে।

১০. শিক্ষার ওপর প্রভাব : মাদকাসক্তি সমস্যা আমাদের দেশের শিক্ষার ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। কারণ মাদকাসক্তির প্রভাবে অনেক মেধাবী ও ভালো ছাত্রছাত্রী মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তাদের সুন্দর ও সুস্থ ছাত্রজীবনের অবসান ঘটিয়ে ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যারা ফিরে আসছে তারাও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারছে না। সুতরাং দেখা যায়, মাদকাসক্তি সমস্যা আমাদের দেশের শিক্ষার ওপরও মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মাদকাসক্তি সমস্যা সমাধানের উপায় : বিশ্বজুড়ে মাদকাসক্তি একটি জটিল সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এ সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। চলছে বিভিন্ন গবেষণা ও প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি। প্রতিটি শাস্ত্র, বিষয় ও ধর্মে মাদককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর প্রতিকারে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মের ঊষালগ্নে ও নবী করিম (স)-এর মদিনা হিজরতের পর চিন্তাশীল সাহাবাগণ মাদকের ক্ষতিকারক বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে থাকেন।

তারা বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ থেকে লক্ষ্য করেন যে, এসব নেশা উদ্রেককারী মাদকবন্ধু আসক্তদের বিবেকবুদ্ধি লুপ্ত করে দেয়। ফলে ব্যবহারকারী বেসামাল হয়ে পড়ে এবং নানা ধরনের সামাজিক অনাচার সৃষ্টি করে, যা সুস্থ সামাজিকতার পথে খুবই ক্ষতিকর। বিষয়টি তারা নবীজীর নজরে আনেন। এ সময়ে মাদকের প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ক্ষতিকারক বিভিন্ন দিক সম্পর্কে একাধিক আয়াত নাজিল হয়। যেমন—

১. হে ঈমানদারগণ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের ধারে কাছেও যেও না । (সূরা নেসার, আয়াত ৪৩)

২. হে মুমিনগণ, এই যে মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের কার্য বৈ তো নয় ৷ অতএব এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। (সূরা মায়েদা, আয়াত ১০)

৩. তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ, আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে মানুষের জন্য যে উপকারিতা রয়েছে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়।

(সূরা বাকারা, আয়াত ২১৯)

পবিত্র কুরআনে যে কাজগুলো করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে তা পালন করা এবং এ ব্যাপারে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রতিটি মুসলমানের প্রতি জোর তাগিদ রয়েছে।

কোনো সমাজেই মাদকাসক্তি কাম্য নয়। তাই ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য প্রতিটি বিষয়ে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে এসব বদ নেশার প্রতি নিষেধমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। মাদকাসক্তি সমস্যার পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান । তাই এই সমস্যা মোকাবিলা ও প্রতিরোধ করার জন্য বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রতিকারমূলক, প্রতিরোধমূলক ও পুনর্বাসনমূলক ব্যবস্থা । নিচে এসব ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হলো :

ক. প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ : মাদকাসক্তদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থা বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের সুস্থ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা বলা হয় । আসক্ত ব্যক্তিদের প্রথমে তার পরিবেশ থেকে সরিয়ে আনা হয়, যাতে সে আর পুনরায় মাদক গ্রহণ করার সুযোগ না পায়। পরে তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক করার জন্য কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ব্যক্তি পরিপূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে তার হারানো ক্ষমতা ফিরে পায় এবং স্বাভাবিকভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

খ. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা : মাদকাসক্তির করাল ছোবল থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে রক্ষা করার জন্য যেসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বা কার্যক্রম নেয়া হয় তাকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলে। মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয় সেগুলো নিম্নরূপ :

১. মাদকদ্রব্যের উৎপাদন ও আমদানি নিষিদ্ধকরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাথে সমন্বিত

কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা।

২. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম চালু করা ।

৩. বিভিন্ন সভা, সমিতি, সেমিনার, আলোচনা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলোতে প্রচারের মাধ্যমে মাদক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা ।

৪. মাদক প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনের বাস্তবায়ন করা।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারজনিত সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী। লাভজনক এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক চোরচালানী চক্র গড়ে উঠেছে। এ সমস্যার ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ‘এ বিশ্বকে মাদকমুক্ত করা এক বিশাল সমস্যা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য মাদকাসক্তি নিরাময় ও প্রতিরোধ আন্দোলনে আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

এর পূর্বশর্ত হিসেবে ধূমপান ও মাদকবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে হবে। সরকারি মহল থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সমাজকর্মী, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদসহ সকল শ্রেণীর মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণপূর্বক মাদকমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলে এ বিশ্বকে সবার বাস উপযোগী করে তুলতে হবে।

 

আরও দেখুন:

Exit mobile version