মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা , ‘মাদকাসক্তির কুফল’ শীর্ষক একটি ভাষণ |
মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে ভাষণ রচনা | ভাষণ | ভাষা ও শিক্ষা
‘মাদকাসক্তির কুফল’ বিষয়ক মহতী অনুষ্ঠানের সম্মানিত সভাপতি, মাননীয় প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ— সকলের প্রতি আমার আন্তরিক সালাম ও শুভেচ্ছা। আজকের এই জনসমাবেশ আমাদের নাগরিক সচেতনতারই নিদর্শন। এই জমায়েত কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক দাবিকে কেন্দ্র করে নয়। আমাদের অনেক সামাজিক সমস্যা আছে। কিন্তু আজ একটি সমস্যায় আমরা এতখানি বিপন্ন বোধ করছি যা এমনভাবে আগে আমরা কখনো করি নি। আমরা খেয়াল করি আর না করি, মাদকাসক্তি আমাদের যুবসমাজে ইতোমধ্যে একটি ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া হয়ে উঠেছে।
যে যুবসমাজ একটি জাতির প্রাণস্পন্দন, সে যুবসমাজ ক্ষয়িষ্ণু হতে চলেছে! এটা বড়ই কষ্টের ও বেদনার দুঃসংবাদ। সুধী, যুবসামাজ আমাদের অহঙ্কার। জাতীয় যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুবসমাজের অংশগ্রহণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে, তার সবগুলোতেই যুবসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। যুবসমাজ যদি সুস্থ, সুন্দর ও গঠনমূলক পথে না চলে তা হলে জাতির উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত যে, ২০০৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালিত এক জরিপে জানা গিয়েছিল, বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা এখন প্রায় ৫০ লাখেরও বেশি। আর মাদকসেবীর অধিকাংশেরই বয়স ২১-৩৫ বছরের মধ্যে। তাই আমরা যদি এখনই সংঘবদ্ধ হতে না পারি, সমবেত প্রয়াস গড়ে তুলতে না পারি তবে অনেক পরিবারেই নেমে আসবে ড্রাগের সর্বনাশা অভিশাপ।
সংক্রামক রোগ আসার আগেই তার সম্ভাবনা প্রতিরোধ করা দরকার। একবার রোগের সংক্রমণ ঘটলে তাকে নির্মূল করা কঠিন। সুধীবৃন্দ, আপনাদের মধ্যে যারা যুবক, তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, এবং ব্যথিত চিত্তে বলতে চাই মাদক দ্রব্য এক সর্বনাশা নেশা। এ নেশা আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এ নেশার ছোবলে হাজার হাজার তরুণের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। মাদকাসক্ত তরুণসমাজ আজ নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত। তাই মাদকাসক্তির এ মরণ নেশা থেকে দেশের যুবসমাজকে বাঁচাবার জন্যে মাদকাসক্তির কারণ উদ্ঘাটন করে এর প্রতিকার জরুরি।
সুপ্রিয় সুধীসমাজ, মানুষ মাত্রই সুখ-শান্তির প্রত্যাশী। সকলেই মুক্ত পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে উদার নীলাকাশ আর সবুজ প্রকৃতির রূপ আস্বাদন করতে চায়। কিন্তু নানা হতাশা ও ব্যর্থতার অশুভ ছায়া তাদের এ আকাঙ্ক্ষার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তখন তারা নীতিহীন ও বিবেকবর্জিত হয়ে মদ, গাঁজা, আফিম, পেথেড্রিন, হেরোইন ও ইয়াবার মতো মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনেকেই নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পেরে হতাশা, দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা দূর করার জন্যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, বেছে নেয় আত্মহননের পথ।

তাছাড়া, বেকারত্ব, দারিদ্র্যের কশাঘাত এবং কুসংসর্গও মানুষকে মাদকাসক্ত করে তোলে। সুধীবৃন্দ, আপনারা যারা যুবক, আপনাদের এটা অজানা নয় যে, মাদকাসক্তির ক্ষতিকর প্রভাব কতটা ভয়ঙ্কর। এ দেশের যুবসমাজের বড় একটা অংশ মাদকাসক্ত হওয়ার ফলে আমাদের জনশক্তি ক্রমশ দুর্বল ও নির্জীব হয়ে পড়ছে, রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে সামাজিক চিন্তাস্রোত। ফলে নতুন কিছু উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অবনতি ঘটছে মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক সম্পর্কের, ধুঁকে ধুঁকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে গোটা জাতি।
সুধী, মাদকসেবী নিজেও জানে না কী ভয়ঙ্কর পথে সে পা বাড়িয়েছে। খেয়ালে বশে হউক, হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানিতেই হোক, কিংবা সংগদোষেই হোক কোনোভাবে একবার মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে কিছুদিন পর মাদকই তাকে গ্রাস করতে শুরু করে। মাদকের টাকা যোগাড় করার জন্য হেন দুষ্কর্ম নেই যা করতে কুণ্ঠিত হয় না মাদকসেবীরা জীবন-বিধ্বংসী এই নেশার কবলে পড়ে কতো যে সম্ভবনাময় তরুণের জীবন ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একজন মাদকসেবীর করুণ পরিণতি স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না যে সে কীভাবে সুন্দর এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ- স্পর্শ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছে।
ক্লিফ্ট, ক্লান্ত, ধ্বস্ত জীবনকে আঁকড়ে অকালমৃত্যুর জন্য বেঁচে আছে। এই বাঁচার মধ্যে না আছে প্রাণ, না আছে আনন্দ। নিষ্প্রাণ নিস্তরঙ্গ সে জীবন, স্রোতহীন ও বদ্ধ নদীর মতো। সুধীবৃন্দ, মাদকাসক্তিকে বলা হয় মরণ-নেশা। মৃত্যুই এর অনিবার্য পরিণতি। এই নেশা ধীরে ধীরে স্নায়ুকে দুর্বল করে দেয়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে নিঃশেষ করে দেয়। ক্রমশ ভোঁতা, অসাড় হয় এদের মননশক্তি। এদের ক্ষিদে পায় না। ঘুম হয় না। সময়ের বোধ কমে যায়। হাসিকান্নার বোধ থাকে না। ওজন কমে যায়। ধীরে ধীরে এক অস্বাভাবিক জীবনস্মৃত অবস্থায় পৌঁছে যায়।
মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ফলে স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতায় বাধাসহ মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হতে পারে। মাদক ব্যবহারের সঙ্গে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে সমস্যা জড়িত তা হল যে সমস্ত মাদকসেবী ইনজেকশন নেয় তাদের মধ্যে এইচআইভি-র বিস্তার হতে পারে। মাদকাসক্তির কুফল অতি মারাত্মক বলে বিবেচনা করা হয়, বিশেষত এ কারণে যে মাদকাসক্তি দেহে ক্ষতির কাজটি চলে ধীরগতিতে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির পক্ষে এর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে না, ফলে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। হে সুধী সচেতনমহল, হে তরুণসমাজ, আসুন আমরা সচেতন হই, সতর্ক হই, ঝাঁপিয়ে পড়ি এই মরণ নেশার বিরুদ্ধে।
দয়স্তয়ভস্কি বলেছিলেন, ‘মানুষের কাছে তার জীবনের চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই। এই জীবন সে মাত্র একবারই পায়।’ বর্তমান পৃথিবীর মানুষেরও জীবনদর্শন আজ জীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ। জীবনকে যতোভাবে সুখী, সমৃদ্ধ ও পায় পূর্ণ করে মনে। পাখিবার মোনুষেরই জীব পৃথিবীর আনু মেরনের, পরার জীবনকে যতোবে অসুখ নেই। আমরা বুঝতে পারছি না পৃথিবীতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে, নতুন রেনেসাঁস। এই নতুন রেনেসাঁস ও নতুন জীবনদর্শনের তাৎপর্যই আলাদা।
এই নতুন জীবনদর্শনের মূল কথাই হচ্ছে জীবনকে ঋদ্ধ ও পরিপূর্ণ করা। জীবনে দুঃখ আছে, গ্লানি আছে, পরাজয় আছে, ব্যর্থতা আছে, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। মানুষ তার উদ্যম ও প্রচেষ্টা দিয়ে এই ব্যর্থতাকে জয় করেছে। জয় করে চলেছে। মানুষের এই জয়ের ইতিহাসই বর্তমান পৃথিবী। মাদকের মতো একটা নিষ্প্রাণ তুচ্ছ বস্তু শুধু খেয়ালের ভুলে একটা সজীব প্রাণবন্ত অসীম সম্ভাবনাময় জীবনকে নিষ্প্রাণ করে দিতে পারে না, এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে পারে না।
অন্তত, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’— সেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ এটা মেনে নিতে পারে না, মাদকের মতো একটা নিষ্প্রাণ বস্তুর কাছে জীবনকে সঁপে দিতে পারে না। কখনোই না। এক মুহূর্তের জন্যেও না। সুধী, মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। বিপথগামী তরুণ সমাজকে আজ সুস্থ পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।
এর যথার্থ প্রতিকার ও প্রতিরোধকল্পে সরকারের পাশাপাশি সকল শ্রেণির মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, পারিবারিক প্রতিরোধ জোরদার এবং ধর্মীয় অনুভূতি সৃষ্টিকরণসহ মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন করতে হবে। আর তবেই সমাজে ন্যায়বিচার, মানবিক চেতনা ও আদর্শবাদ প্রতিষ্ঠা পাবে; মাদকাসক্তির কালনাগিনীর হাত থেকে রক্ষা পাবে গোটা দেশ ও জাতি। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন— আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
আরও দেখুন: