মধ্যরাতে অতিথি
মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]
![মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ] 1 মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/05/51SfNznGSWL._SX324_BO1204203200_-196x300.jpg)
মধ্যরাতে অতিথি
রুস্তম বেগ, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। বিদায় নেবার প্রসঙ্গ আপনি এখন কিভাবে বলতে পারলেন?
সুলতান, পৃথিবীর অধিশ্বর, আমার আত্মীয়-সম্পর্কিত ভাই শাহ তামাস্প, কাঝভিন থেকে রওয়ানা দেবার আগে আমাকে সুনির্দিষ্ট আদেশ দিয়েছিলেন যে যদি আপনার অভিযানের সাফল্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে- যদি ছয়মাস পরে আপনার সাফল্যের ব্যাপারে আমার মনে সন্দেহের জন্ম হয়। আমি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাহলে যেন স্বদেশে ফিরে যাই। আমি যথেষ্ট ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছি কিন্তু এখন সেই সময় সমাগত। আমরা পারস্য থেকে যাত্রা শুরু করার পরে ছয়মাস অতিক্রান্ত হয়েছে… দুই মাস হতে চলেছে আমরা বোমাবর্ষণ বন্ধ করে এই নিষ্ফল কাবুল অবরোধ আরম্ভ করেছি। তীব্র শীত আর বিরূপ পরিবেশে আমার লোকেরা কষ্ট পাচ্ছে, আর তারচেয়েও বড় কথা এর ফলে কি লাভ হবে? দূর্গপ্রাসাদ আর শহরে পর্যাপ্ত পরিমাণ রসদ মজুদ রয়েছে প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর থেকে আপনার ভাইয়ের সৈন্যরাই বরং আমাদের উত্যক্ত করে, আমাদের খাবারের লোভ দেখায়…সুলতান আমি দুঃখিত কিন্তু আমি নিরূপায়। শাহ্ তাঁর বাহিনীকে অন্য কোথায় কার্যকরভাবে মোতায়েন করার পথ নিশ্চয় খুঁজে পাবেন… রুস্তম বেগ তালু বাইরের দিকে রেখে হাত উপরে তুলে যেন তার নিয়ন্ত্রণের অতীত এহেন পরিস্থিতির উদ্ভাবন হওয়াতে সে নিজে ব্যক্তিগতভাবে অনুতপ্ত। কিন্তু হুমায়ুনের সাথে একান্তে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে গত আধঘন্টা ধরে বরাবরের ন্যায় একই রকম বিনয়ের সাথে সে সবকিছু এগিয়ে গিয়েছে।
বিস্মিত আর হতবাক হুমায়ুন অবশ্য এখন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের চরাচরগ্রাসী ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করে। আমি আপনাকে যেমন বলেছি, শাহ তাসাম্প সময়সীমা বা সময়সূচী সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলেননি। তিনি নিজেকে আমার ভাই হিসাবে উল্লেখ করে আমার পুরুষানুক্রমিক স্বদেশ আর সেই সাথে হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরুদ্ধারে আমাকে সাহায্য করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন…তিনি ভালো করেই জানতেন কাজটা সময়সাপেক্ষ। আমরা বিষয়টা একত্রে আলোচনা করেছি…
সুলতান আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি যদি আমার সৈন্যদের নিয়ে পারস্যে ফিরে না যাই তাহলে আমি আমার আদেশ অমান্য করবো। যা আমি করতে পারি না।
বেশ, আপনি যখন কাঝভিন পৌঁছাবেন তখন আপনার আত্মীয় সম্পর্কিত ভাইকে এটা বলবেন- যে আমি আমার লড়াই অব্যাহত রাখবো এবং যত সময়ই প্রয়োজন হোক আমি আমার শত্রুদের এমনভাবে পরাস্ত করবো তারা আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এবং আগ্রায় আমার সিংহাসনে যখন আমি পুনরায় অধিষ্ঠিত হব আমি এটা জেনে সন্তুষ্ট থাকবো যে এই অসামান্য গৌরবের অধিকারী মোগলরা এবং একমাত্র মোগলরা।
রুস্তম বেগের মুখাবয়বে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না।
আপনি কখন বিদায় নিতে চান?
তিন কি চারদিন সুলতান আমার লোকেরা যত শীঘি যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ করতে পারবে। আমি কামানগুলো আপনার কাছে রেখে যাব। কামানগুলো শাহ্ আপনাকে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ দিয়েছেন।
রুস্তম বেগ যদি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা আশা করে তবে তাকে আশাহত হতে হবে, সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ হয়েছে এটা বোঝাতে হুমায়ুন বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াবার সময় ভাবে। আপনি আর আপনার লোকেরা পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নির্বিঘ্নে ফিরে যেতে পারবেন বলেই আমি আশা করি। শাহকে বলবেন আমাকে তার দেয়া সহযোগিতার জন্য তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এবং একটাই কেবল খেদ যে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সেটা বলবৎ ছিল।
সুলতান, আপনার বার্তা আমি তাঁকে পৌঁছে দেব। আর আশা করি আপনার প্রতি সৌভাগ্যের দেবী পুনরায় একদিন প্রসন্ন হবেন।
রুস্তম বেগ বিদায় নিয়ে চলে যাবার পরে, হুমায়ুন কিছুক্ষণ একাকী বসে থাকে। কোনো ধরনের আগাম হুশিয়ারি না দিয়েই পার্সী সেনাপতি নিজের অভিপ্রায় ঘোষণা করেছেন। এই বিপর্যয় মোকাবেলা করতে এবং এখান থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে চিন্তাভাবনার জন্য তার সময় প্রয়োজন। একটাই আশার কথা তার নিজের লোকদের সংখ্যা এখন পার্সী সৈন্যদের প্রায় সমান এবং তারা যেখানে লড়াই করছে সেটা তাদের নিজেদের এলাকা। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাদের কষ্টসহিষ্ণু করে তুলেছে এবং সমভূমিতে অরক্ষিত অবস্থার মতো অস্থায়ী শিবিরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে যে তুষারপাত, বরফ আর তীব্র বায়ুপ্রবাহ সেসব কিছুই তাঁদের হতোদম করতে পারবে না। পার্সী সৈন্যদের বিদায় নেবার মতো হুমায়ুনকে যা প্রায় একই রকমের মনঃপীড়া দেয়, সেটা হল তার সাফল্য সম্বন্ধে রুস্তম বেগের হতাশাজনক মূল্যায়ন। অবরোধ শুরু করার প্রথম দিন থেকেই হুমায়ুন একদিনের জন্যও নিজেকে আশাহত হতে দেয়নি, প্রতিদিনই শত্রুকে পরাভূত করার পথ খুঁজে পাবার আশা করেছে… কামরানের অবস্থানের কোনো দূর্বলতা সনাক্ত করতে পারবে। তেমন কোনো কাঙ্খিত সাফল্যের দেখা না পেলেও, তাকে কেবল ধৈর্য ধারণ করতে হবে- কামরানের রসদ অনিবার্যভাবে একসময় শেষ হবেই।
অনেকসময়, অবশ্য, যুদ্ধযাত্রার মতোই ধৈর্য ধারণ করতেও আত্মসংযমের পরিচয় দিতে হয়। দূর্গপ্রাকারে নিজের শিশু সন্তানের স্মৃতিই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে দূর্গপ্রাসাদ আক্রমণ করা থেকে হুমায়ুনকে বিরত রেখেছে। নিজের সন্তানের জন্য তার এই অনুভূতি কামরানের ধাপ্পাবাজি বন্ধ করতে তাঁর অনীহা- রুস্তম বেগ সম্ভবত তাঁর দূর্বলতা ভেবে বসেছে। বেশ, তবে তাই হোক। একাকী লড়াই চালিয়ে যেতে- এইমাত্র রুস্তম বেগকে সে ঠিক যা বলেছে- যদি সে বাধ্য হয়, সে তাই করবে।
তাবুর পর্দার ফাঁক দিয়ে যা তখনও আধখোলা অবস্থায় ঝুলছিল, হুমায়ুন বাইরে তাকিয়ে দেখে শীতের আলোয় খুব দ্রুত অন্ধকার মিশে যায়। সে শীঘ্রই তার সেনাপতিদের ডেকে পাঠাবে কি ঘটেছে তাঁদের বলতে। পার্সীদের বিদায় নিতে দেখলে বোধহয় তারাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। পারস্য থেকে হুমায়ুনের নেতৃত্বে তার বাহিনী অভিযান শুরু করার প্রথমদিকে যে সৌহার্দ্য বিদ্যমান ছিল কাবুলের আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত গোত্রের লোকজন বর্ধিত সংখ্যায় তাঁর দলে যোগ দিতে শুরু করলে সেটা ততই হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। তিনদিন আগেই, পার্সী আর তাঁর লোকদের ভিতরে সংঘটিত এক সহিংতার কথা জাহিদ বেগ তাঁকে জানিয়েছিল। এক তাজিক গোত্রপতি, কয়েকজন পার্সি তাঁর রসদ চুরি করেছে বলে ধারণা করে, তাদের শিয়া সারমেয় বলে গালি দেয়। বচসার এক পর্যায়ে তাজিকদের একজন মুখে চাকুর পোচ খায় আর পার্সীদের একজনের দেহের একপাশ আগুনে মারাত্মকভাবে ঝলসে যায়, বেচারাকে জ্বলন্ত কয়লার পাত্রের উপর ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল। এটা সম্ভবত উভয়পক্ষের জন্যই ভালো হল যে খিজিল-বাঁশ রা- লাল-টুপির দল হুমায়ুনের লোকেরা পার্সীদের শিয়া ধর্মমত ঘোষণা করতে তাঁদের মাথার চোঙাকৃতি টুপি আর এর পেছনদিকে ঝুলন্ত টকটকে লাল কাপড়ের ফালির জন্য তাঁদের এই নাম দিয়েছে- বিদায় নিচ্ছে। সে অবিলম্বে শিয়া ধর্মমতের প্রতি তাঁর স্মারক আনুগত্যের বিষয়টাও আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করবে। তার লোকেরা এটা দেখেও উদ্দীপিত হবে।
হুমায়ুনের নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে থেকে গলার স্বর ভেসে আসতে তার ভাবনায় ছেদ পড়ে। তারপরেই তাবুর পর্দা সরিয়ে দিয়ে জওহর মাথা নীচু করে ভেতরে প্রবেশ করে। সুলতান, বৈরাম খান আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।
![মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ] 2 মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/05/s-l1600-210x300.jpg)
চমৎকার!
বৈরাম খান তাবুর ভিতরে আসতে হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে তার গলার ক্ষতস্থানটা এখনও গোলাপি আর জায়গাটা কুঞ্চিত হয়ে আছে এবং নতুনের মতো দগদগ করছে। লোকটা একজন পোড় খাওয়া যোদ্ধা আর চতুর সমরবিদ। রুস্তম বেগ পার্সী সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হলেও, প্রায় শুরুর দিন থেকেই হুমায়ুনের মনে হয়েছে বৈরাম খানই পার্সীদের আসল নেতা আর সেনাপতি। তার খারাপই লাগছে এমন একজন যোদ্ধাকে হারাতে হবে বলে।
বৈরাম খান, আপনি কি কিছু বলতে চান?
বৈরাম খান স্বভাব বিরুদ্ধ ভঙ্গিতে ইতস্তত করে, যেন সে যা বলতে চায় সেটা বলাটা মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। তারপরে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সে নীল চোখে হুমায়ুনের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থেকে, কথা শুরু করে। রুস্তম বেগ আপনাকে কি বলেছে আমি সেটা জানি…আমি দুঃখিত।
আপনাকে এজন্য কেউ দোষ দেবে না। আমি যেজন্য দুঃখিত সেটা হল যে আপনার সহযোগিতা থেকে আমি বঞ্চিত হব।
সুলতান, বৈরাম খান তাঁর সহজাত ভদ্রতার বিপরীতে কথা বলে উঠে, আমার কথাটা আগে একটু শোনেন। কাবুলে আসবার পথে গিরিকরে আমরা যখন অতর্কিত হামলার সম্মুখীন হয়েছিলাম তখন আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। আমি সারা জীবনে যতবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি কোনোবারই মৃত্যুকে এত কাছে থেকে অনুভব করিনি…আমি মানসপটে ততক্ষণে দেখে ফেলেছি সেই নির্জন প্রান্তরে আমার কবর খোঁড়া হচ্ছে। কিন্তু আপনি দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়ে আমাকে আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে আপনার এই ঋণ শোধ করার একটা সুযোগ দেবার জন্য আমি অনুরোধ করছি।
বৈরাম খান, তুমি ঋণী নও। একজন মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সহযোদ্ধা বন্ধুর প্রাণসংশয় হয়েছে দেখতে পেলে সে যা করতো আমি ঠিক সেই কাজটাই করেছি।
আমি রুস্তম বেগের সাথে পারস্যে ফিরে যাবার চেয়ে আপনার সাথেই থাকেতে বেশী আগ্রহী আর আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আপনার এই অভিযানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। আপনি কি আমাকে আপনার সেনাবাহিনীতে একটা সুযোগ দেবেন?
হুমায়ুন কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ায় এবং সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বৈরাম খানের দুবাহু আকড়ে ধরে তার চোখের দিকে তাকায়। সমগ্র পার্সি সেনাবাহিনীতে একজনও মানুষ, নেই যাকে আমি আমার পাশে লড়াই করার জন্য চাই কেবল…
*
সুলতান…সুলতান…উঠুন। তার কাঁধ ধরে কেউ একজন আলতো করে নাড়া দিচ্ছে… নাকি পুরোটাই কেবল একটা স্বপ্ন? হুমায়ুন তার পাশেই শুয়ে থাকা তন্দ্রাচ্ছন্ন হামিদার দেহের কোমল উষ্ণতার আরও কাছাকাছি নিজেকে সরিয়ে আনে। কিন্তু ঝাঁকিটা ক্রমেই আরো প্রবল হয়ে উঠছে। হুমায়ুন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে হাতে তেলের একটা প্রদীপ নিয়ে জয়নাব তাঁদের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দপদপ করতে থাকার আলোর প্রেক্ষাপটে, সে দেখে জয়নবকে উত্তেজিত দেখাচ্ছে, তার মুখের জন্মচিহ্নটা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী গাঢ় মনে হয়।
কি ব্যাপার? তার পাশে শুয়ে থাকা হামিদা ঘুম ভরা চোখ খুলে জানতে চায়।
আধঘন্টা আগে একজন আগত শিবিরে প্রবেশে চেষ্টা করে। প্রহরীরা তাঁকে থামিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে, সে নিজের পরিচয় না দিয়ে তাঁকে জাহিদ বেগের কাছে নিয়ে যেতে বলে। জাহিদ বেগ তার সাথে কথা বলার পরে, আপনি সুলতানার সাথে জেনানাদের তাবুতে অবস্থান করছেন জানা থাকায়, তিনি আমাকে ডেকে পাঠান এবং আমাকে আদেশ দেন আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে।
এতো তাড়াহুড়ো করার কারণ? সকাল পর্যন্ত কি সে অপেক্ষা করতে পারতো না?
জাহিদ বেগ আমাকে কিছুই বলেনি…কেবল বলতে বলেছে যে আপনি যেন এখনই সেখানে দর্শন দেন…
বেশ, চলো দেখা যায়। হুমায়ুন শয্যা ত্যাগ করে এবং ভেড়ার চামড়ার আস্তরন দেয়া একটা লম্বা আলখাল্লা দেহের চারপাশে ভালো করে মুড়ে নিয়ে তাবুর বাইরে হিমশীতল বাতাসে বের হয়ে আসে। লোকটা কে হতে পারে? কামরান সম্ভবত কোনো বার্তাবাহক প্রেরণ করেছে কিন্তু এভোরাতে সেটা সে কেন করতে যাবে এটা অবশ্য একটা রহস্য। জ্বলন্ত কয়লার একটা ধাতবদানি ব্রাজিয়ার যাকে বলে সেখান থেকে নির্গত আলোয় সে জাহিদ বেগকে লম্বা, চওড়া কাঁধের এক লোকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লোকটা পরণে গাঢ় রঙের আলখাল্লা যার মস্ত কাবরণী সামনের দিকে টেনে দিয়ে সে নিজের মুখটা আড়াল করে রেখেছে। কামরানের প্রেরিত কোনো গুপ্তঘাতক কি লোকটা… কিংবা পারস্যের শাহের অনুগত ঘাতক?
জাহিদ বেগ লোকটা কি সশস্ত্র?
না, সুলতান। লোকটা তাকে তল্লাশি করার সময় আমাদের সহযোগিতাই করেছে।
হুমায়ুন লোকটার কাছাকাছি এগিয়ে যেতে, লোকটা ধীরে, ইচ্ছাকৃতভাবে মস্ত কাবরনী পিছনের দিকে সরিয়ে দেয়। ব্রাজিয়ারের আবছা আলোয় হুমায়ুন সাথে সাথে চিনতে পারে যে লোকটা হিন্দাল, চওড়া মুখে ঘন দাড়ির জঙ্গল কিন্তু তার সৎ-ভাইকে এখনও তার চিনতে ভুল হয় না। এক মুহূর্তের জন্য, দুই ভাই নির্নিমেষ ভাবে নিরবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতোকিছু ঘটনা ঘটে যাবার পরেও, হুমায়ুনের মনে সহসা হিন্দালের স্মৃতি পুনরায় জাগরুক হয়ে উঠে- মাহামের কোলে শিশু হিন্দাল, কিভাবে ছোট ভাইকে সে প্রথমবারের মতো ঘোড়ায় চড়তে শিখিয়েছিল, প্রথমবারের মতো খরগোশ শিকার করে হিন্দালের সেই উল্লসিত অভিব্যক্তি; তারপরে পরবর্তী সময়ের স্মৃতি হিন্দালের বিদ্রোহের সময় তার মুখের অভিব্যক্তি, মালদেব আর মির্জা হুসেনের কাছে নির্বাসিত হুমায়ুনের প্রথমবার যাত্রার সময় কিভাবে বিশ্বস্ত তার সাথে সে হুমায়ুনের সঙ্গী হয়েছিল; তারপরে সবকিছু ছাপিয়ে যায় তাঁদের শেষবার দেখা হবার স্মৃতি হামিদার কারণে কিভাবে তারা একে অপরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং কিভাবে হুমায়ুনের পায়ের কাছে থুথু ফেলে রক্তাক্ত, চোখে মুখে কালশিরে পড়া কিন্তু তখনও উদ্ধত হিন্দাল ঘোড়া নিয়ে চলে গিয়েছিল।
আমাদের একটু একা থাকতে দাও, আর দেখবে কেউ যেন আমাদের বিরক্ত না করে। জাহিদ বেগ অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত হুমায়ুন অপেক্ষা করে, পুরোটা সময় সে তীক্ষ্ণ চোখে হিন্দালের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপরে জিজ্ঞেস করে, এখানে তুমি কেন এসেছো? এবং এভাবে আমার সামনে নিজেকে কেন একাকী সমর্পন করেছো?
গত কয়েকমাস যাবত কামরানের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার পরে কাবুলের উত্তরপূর্বে জাগিশের উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে আমার শেষ বিশ্বস্ত বন্ধুদের আশ্রয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও খবর পৌঁছে যায়। কামরান কি করেছে জানতে পারি- আপনার কামানগুলো যখন কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরে গোলাবর্ষণ করছিল তখন সে কিভাবে আকবরকে এর দূর্গপ্রাকারে উন্মুক্ত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। তার কীর্তিকলাপ দেখে আমি শিউরে উঠি- সবকিছুই আমাদের যোদ্ধার রীতিনীতির প্রতি একটা চরম অবমাননা আর আমাদের পরিবারের সম্মানে কলঙ্ক লেপন করেছে।
চমৎকার অনুভূতি, কিন্তু তুমি এখনও আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি। আমরা পরস্পরের সাথে এসো খোলাখুলি আলোচনা করি। তুমি কেন এখানে এসেছে?
আকবরকে উদ্ধারে সাহায্য করতে।
হুমায়ুন এতোটাই চমকে যায় যে কিছুক্ষণের জন্য সে বাকরুদ্ধ হয়ে ব্রাজিয়ারের উপরে শান্তভাবে নিজের বিশাল দুটো হাতে ওম পোহাতে থাকা তার সৎ-ভাইয়ের অবয়বের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। নিরবতা ভঙ্গ করে হিন্দাল কথা বলে উঠে। আপনি নিজেকে প্রশ্ন করছেন যে কেন আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাইবো। ব্যাপারটা সহজ। রক্তে বাঁধন যা আমৃত্যু আমরা বহন করবো তারপরেও আপনার আর আমার ভিতরে কোনোমতেই সমঝোতা হওয়া অসম্ভব। এটা অপরিবর্তনীয়। আজ রাতে আমি হামিদা কেবলমাত্র হামিদার কথা ভেবেই এসেছি…তার কাছে তার সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করে তার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে…সে নিশ্চয়ই অসম্ভব মনোকষ্টে…।
![মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ] 3 মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/05/88-1-210x300.jpg)
হুমায়ুন আড়ষ্টভঙ্গিতে দেহের ভর বদলায়, হামিদা প্রসঙ্গে হিন্দালের সাথে আলোচনা করতেই তাঁর অস্বস্তিবোধ হয় এবং তার চেয়েও বড় কথা হামিদার সন্তানকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে কিভাবে সে হামিদাকে আশাহত করেছে, সেসব নিয়ে তো সে হিন্দালের সাথে আরও কথা বলতে চায় না।
যদি সত্যিই তুমি হামিদার কষ্ট লাঘব করার ভাবনা থেকে এখানে এসে থাকো তাহলে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো। সে পুনরায় চুপ করে থাকে তারপরে নিজের গর্ব গলধঃকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। আমি যেমন বলেছি যে আমরা খোলাখুলি আলোচনা করবো সেই বাস্তবতা মেনে বলছি, আকবরকে হারাবার পর থেকে মানসিক শান্তি বা সত্যিকারের বিশ্রাম এই দুটি জিনিষ হামিদা ভুলেই গেছে…কিন্তু তুমি যখন সাহায্যের কথা বলেছে, তখন আসলে কি বোঝাতে চেয়েছো? কোনো ধরনের সফলতা ছাড়াই আমি আজ প্রায় চার মাসাধিক কাল ধরে দূর্গপ্রাসাদ অবরোধ করে রেখেছি। আমি আমার সেনাবাহিনীর সহায়তায় যা করতে পারিনি সেখানে তুমি একাকী কি করতে পারবে বলে মনে করো?
আমি কামরানের আস্থা অর্জন করে দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করতে পারি। একবার ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে আমি আকবরকে উদ্ধারের একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারবো।
কিভাবে? কামরান তোমাকে কেন আমার চেয়ে বেশী বিশ্বাস করবে?
আমি তাঁর আস্থা অর্জন করতে পারবো, কারণ আমি তাকে ভালো করে চিনি কারণ আমি তার দুর্বলতা সম্বন্ধে অবগত রয়েছি। সে আপনাকে ঘৃণা করে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে সেই আমাদের পরিবারের স্বাভাবিক প্রধান। নিজের সম্বন্ধে তাঁর আত্মগর্ব, তাঁর আত্মশ্লাঘা ব্যবহার করে আমি তাকে বোঝাব যে আমার বোধোদয় ঘটেছে এবং আমি পুনরায় তার মিত্র হতে আগ্রহী…আপনার বিরুদ্ধে বাবরের অন্যান্য পুত্রদের তার অধীনে একত্রিত করতে চাই। কিন্তু এসব নির্ভর করছে একটা বিভ্রম সৃষ্টি উপরে…
বলতে থাকো।
আপনাকে অবশ্যই প্রথমে অবরোধ তুলে নিতে হবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে হবে যেন মনে হয় আপনি আপনার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কাবুল ত্যাগ করছেন। পাহাড় থেকে আমার নিজের লোকদের নিয়ে আসবার জন্য তাহলে আমার সামনে একটা পথ খুলে যায় এবং কামরানকে আমি তাহলে মৈত্রীর প্রস্তাব করতে পারি…
তুমি বলতে চাইছো এত সপ্তাহ পরে আমি অবরোধ তুলে নেব, যখন আমি কামরানের উপরে অবরোধ আরও কঠোর করার কথা ভাবছি।
আপনাকে সেটাই করতে হবে। কাবুলের আশেপাশে আপনি শিবির স্থাপন করে অবস্থান করলে আমার পরিকল্পনা সফল হবে না। কামরানকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আপনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
তুমি বড্ডবেশী দাবী করছো। তোমার এতো সব ভালো কথার পরেও আমার বিশ্বাস তুমি ইতিমধ্যেই কামরানের সাথে সন্ধি করেছে এবং সেই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে আমার সাথে চালাকির চেষ্টা করতে।
আমি আমাদের মরহুম আব্বাজানের স্মৃতির কসম করে বলছি এর মাঝে কোনো ধরনের ছলনা নেই… হুমায়ুনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিঃশঙ্কভাবে হিন্দালের তামাটে চোখ ফিরিয়ে দেয়।
বেশ মানলাম- ধরো আমি তোমার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করলাম, তারপরে তাহলে কি ঘটবে?
কামরানের মনে ধারণা জন্মাবে যে সে আপনাকে পরাস্ত করেছে। নিজের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সে তখন আমার গল্প আরো সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকবে- যে স্বয়ং আপনার পক্ষেও যখন তাঁকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি, আমি তাকে আমাদের পিতার প্রকৃত উত্তরাধিকারি হিসাবে মেনে নিতে এবং তার অধীনস্ত থাকতে প্রস্তুত আছি।
তোমার আসলেও মনে হয় সে তোমার কথা বিশ্বাস করবে?
নিজেকে নিয়ে তাঁর আত্মগর্বকে মোটেই ছোট করে দেখবেন না। আর তাছাড়া, সে কেন আমাকে অবিশ্বাস করবে? আমি কেন পাহাড়ে পলাতক পাহাড়ী জীবনের বদলে মোগল যুবরাজের বিচ্ছুরিত গৌরবের একটা অংশের অধিকারী হতে চাইব না যার সৌভাগ্যের সূর্য উদীয়মান যখন আপনি ভাগ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি। আর আমার সাথে আগত অতিরিক্ত লোকদের সাহায্য লাভ করে সে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তারপরে একবার দৃর্গপ্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারলে আমি আকবরকে কাবুল থেকে গোপনে বের করে আনবার একটা পথ ঠিকই খুঁজে পাবো…কিন্তু এজন্য একটু সময় প্রয়োজন। আমাকে যে কেবল কামরানের আস্থাই অর্জন করতে হবে তা নয় আমাকে সেই সাথে উপযুক্ত সুযোগও খুঁজে পেতে হবে…
কামরানের আম্মাজান গুলরুখের কি খবর? সে তাঁর সন্তানের মতোই ধূর্ত সম্ভবত তাঁর সন্তানের চেয়েও ধূর্ততর। সে যদি কামরানের সাথে থাকে তাহলে তাঁকে সহজে প্রতারিত করতে পারবে না।
হিন্দালকে বিস্মিত দেখায়। গুলরুখ মারা গিয়েছে। কাবুল থেকে কান্দাহারে আগমনের সময় তাঁকে বহনকারী গরুর গাড়িটি দরীতে পড়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত খবরটা শুনেছেন।
না। হুমায়ুন ধাক্কাটা হমজ করে। নিজের সন্তানের উচ্চাকাঙ্খ চরিতার্থ করতে যে মহিলা তাঁকে আফিম আর সুরার নেশায় আসক্ত করেছিল তার জন্য সে সামান্যই দুঃখবোধ করে। তারপরেও তুমি নিজেকে ভীষণ বিপদের সম্মুখীন করতে চাইছে। আচ্ছা ধরে নিলাম তোমার উদ্দেশ্য সফল হল, তুমি বিনিময়ে আমার কাছে কি আশা কর?
কিছু না। আমি যা কামনা করতাম আপনি তাঁর পুরোটুকুই ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং আপনার পক্ষে সেটা ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব…
![মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ] 4 মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/05/empireofthemoghulbrothersatwar-2d865842-10c0-49de-82b5-3d4704f4ed1f-195x300.webp)
দুই ভাই মুহূর্তের জন্য নিরবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন যখন সে হিন্দালকে আবার সামনে পেয়েছে, হুমায়ুন অনুধাবন করে নিজের অপরাধবোধ সম্বন্ধে, তাকে আহত করার কারণে নিজের খেদ সম্বন্ধে কতকিছু সে তাকে বলতে চায়। কিন্তু তার সৎ-ভাই তার কথা বিশ্বাস করবে না এবং তাছাড়া কোনভাবেই আর বাস্তবতাকে পরিবর্তন করা সম্ভব না হামিদাকে হুমায়ুন এতো প্রবল আবেগ দিয়ে ভালোবাসে অন্য কোনো রমণীর জন্য যা সে কখনও অনুভব করেনি। সে যদি আবারও সুযোগ পায় তাহলে হামিদাকে পাবার জন্য তার সংকল্প আগের মতোই নির্মম হবে।
দুই ভাইয়ের কথোপকথনের পুরোটা সময় হুমায়ুনের মুখ থেকে হিন্দাল তার দৃষ্টি একবারের জন্যও সরায়নি। বেশ, আপনার কি মতামত? আপনার শিবির ত্যাগ করার পূর্বে ধরে নিচ্ছি যে আপনি আমাকে যেতে দিতে প্রস্তুত- আমাকে অবশ্যই সেটা জানতে হবে আর সূর্যোদয়ের পূর্বে আমাকে অবশ্যই এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। আপনার শিবিরের অনেক মানুষই আমায় চেনে এবং তাদের ভিতরে হয়ত গুপ্তচরও রয়েছে। আমার পরিকল্পনা সফল হবার সামান্যতম সম্ভাবনাও শেষ হয়ে যাবে, এখানে আমার উপস্থিতির কথা যদি কামরানের কানে পৌঁছে…
আমার পুরো ব্যাপারটা ভেবে দেখার জন্য একটু সময় প্রয়োজন। আমি জাহিদ বেগকে বলে দিচ্ছি, তোমাকে তার তাবুতে নিয়ে যেতে এবং আমি না আসা পর্যন্ত সে তোমার সাথে থাকবে। সকাল হতে এখনও ঘন্টা তিনেক সময় বাকি আছে। তুমি তোমার উত্তর দুই ঘন্টার ভিতরে পেয়ে যাবে।
হিন্দাল চলে যেতে, হুমায়ুন খোলা প্রান্তরে শীতের তোয়াক্কা না করে পায়চারি করতে থাকে। হিন্দালের পরিকল্পনাটা দুর্দান্ত আর সাহসী কিন্তু সে যদি তাঁর কথায় রাজি হয় তাহলে অনেক কিছুই তাকে বিশ্বাসের উপরে ছেড়ে দিতে হবে। সম্রাট হবার পর থেকে নিজের পরিবারের সদস্যদের বিশ্বাস করে কতবার তাঁকে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে হয়েছে?…কিন্তু আজকে রাতে হিন্দালের কণ্ঠস্বরের প্রতিটা চড়াই উতরাই, তাঁর প্রতিটা অভিব্যক্তির ভিতরে দৃঢ় প্রত্যয়ের একটা ছাপ স্পষ্ট টের পাওয়া গেছে। তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, হামিদার সাথে এ বিষয়ে আলোচনা না করে সে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, বেচারী কেন তাঁর এতে দেরী হচ্ছে দেখে নিশ্চয়ই এতোক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
সে ঠিকই অনুমান করেছিল। হুমায়ুন তাঁদের তাবুতে যখন ফিরে আসে তখন দেখে যে হামিদা শয্যায় উঠে বসে রয়েছে এবং তার জন্য অপেক্ষা করছে, আকষ্মিক নিদ্রাভঙ্গের কারণে তাঁর মাথার ঘন কালো চুল কাঁধের উপরে আলুথালু হয়ে পড়ে রয়েছে এবং তার অভিব্যক্তিতে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্টই বোঝা যায়। রাতের বেলা যে লোকটা একাকী শিবিরে এসেছে- সে আর কেউ না, হিন্দাল, হামিদা কোনো কথা বলার আগেই হুমায়ুন তাকে অবগত করে।
হিন্দাল?
হ্যাঁ। আকবরকে উদ্ধারের ব্যাপারে সে আমাদের সাহায্য করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আমি যদি অবরোধ তুলে নেই এবং এখান থেকে চলে যাবার ভাণ করি, সে দূর্গপ্রাসাদের গিয়ে কামরানকে মৈত্রীর প্রস্তাব দেবে। কামরানের আস্থা একবার অর্জন করার পরে সে আকবরকে কাবুল থেকে গোপনে বের করে আনবার একটা উপায় খুঁজে বের করবে।
সে কি সত্যিই আমাদের ছেলেকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে…।
হামিদার ভেতরে আশার কুড়ি এরই ভিতরে পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে হুমায়ুন বুঝতে পারে। মানে, সম্ভবত…কিন্তু প্রশ্ন হল আমরা কি হিন্দালকে আদৌ বিশ্বাস করতে পারি?
হামিদার আশাবাদী অভিব্যক্তি হোঁচট খায়। অন্ধকারে একাকী আপনার শিবিরে এসে হিন্দাল বিশাল একটা ঝুঁকি নিয়েছে। সে মারাও যেতে পারতো। আর তাছাড়া পুনরায় আপনার সামনে দাঁড়াতে যথেষ্ট সাহসের প্রয়োজন হয়েছে।
মানলাম, কিন্তু সে যদি সাপের গালে আর ব্যাঙের গালে চুমু দেবার খেলায় নেমে থাকে তাহলে ঝুঁকির তুল্যমূল্য সম্ভাব্য পুরষ্কারের কথাও সে হয়তো ঠিকই বুঝতে পেরেছে। যদিও সে শপথ করে বলেছে যে কামরানের সাথে তার কোনো প্রকার সংশ্রব নেই, অবরোধ তুলে নেবার জন্য আমাকে বাধ্য করতে কিংবা হিন্দাল আর তার লোকেরা কাবুলে গিয়ে কামরানের সাথে যাতে যোগ দিতে পারে- এটা কোনো ধরনের চালাকি। হামিদা আর হুমায়ুন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে তাবুর পুরু চামড়ার দেয়ালে কেবল বাতাসের আছড়ে পরার শব্দ শোনা যায়। আমি যদি এখন কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেই তাহলে কামরানের অবস্থা শক্তিশালী হবে এবং তাঁকে পরাস্ত করা আর আমাদের সন্তানকে উদ্ধার করার সুযোগ ক্ষীণ হয়ে যাবে, হুমায়ুন অবশেষে নিরবতা ভেঙে বলে।
হামিদা চোখে মুখে একটা বিষণ্ণ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে মুখের উপর থেকে চুলের গোছা পেছনে সরিয়ে দেয়। আপনাকে সতর্কতার সাথে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, হিন্দাল কেন আমাদের সাহায্য করতে চায়?
ঠিক এই প্রশ্নটার উত্তর আমি জানতে চেয়েছিলাম। সে বলেছে যে একটা শিশুর জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে কামরান আমাদের পরিবারের সম্মানহানির কারণ হয়েছে…
পারিবারিক সম্মান কি আসলেই তাঁর কাছে এতোটাই মূল্যবান?
সম্ভবত মূল্যবান। তারপরে সে আমাকে আরেকটা, সম্ভবত আরো গাঢ় একটা কারণের কথা বলে। আমাকে না, সে তোমাকে সাহায্য করতে চায়। সে জানে তুমি কেমন মনোকষ্টে আছে এবং সে তোমার যন্ত্রণার উপশম করতে চায়…
![মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ] 5 মধ্যরাতে অতিথি -( ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার -এম্পায়ার অভ দ্য মোগল ) -অ্যালেক্স রাদারফোর্ড [ অনুবাদ সাহিত্য ]](https://banglagoln.com/wp-content/uploads/2022/05/19184900-195x300.jpg)
হুমায়ুনের কথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে, হামিদার চোখমুখ লাল হয়ে উঠে আর সে মাথা নামিয়ে নেয়। হামিদার জন্য হিন্দালের অনুভূতি নিয়ে তারা দুজনে কখনও খোলাখুলি আলোচনা করেনি কিন্তু অবশ্যই সে বিষয়টা জানে। হামিদা কিছুক্ষণ অস্থির হয়ে পায়চারি করে ঠিক যেমনটা হুমায়ুন সামান্য আগে হিম শীতল শীতের রাতে করেছিল, তারপরে সে মুখাবয়বে দৃঢ়তার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে হুমায়ুনের সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার মনে হয় হিন্দাল সত্যি কথা বলছে। সবচেয়ে বড় কথা হল যে তাকে বন্দি করে রেখেছিল সেই কামরানের প্রতি তার কোনো অনুরাগ থাকার কথা নয়… আমাদের উচিত তাঁকে বিশ্বাস করা। সে যদি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে কামরানের মতো সেও আমাদের সন্তানের প্রাণের জন্য আমাদের ভয়কে নিজের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাবার দোষে দোষী হবে। আমার বিশ্বাস তাঁকে দিয়ে এমন জঘন্য কাজ সম্ভব নয়। হুমায়ুন অনুগ্রহ করে আসুন এই সুযোগটা আমরা গ্রহণ করি।
হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে তাঁকে নিজের কাছে টেনে আনে এবং তাঁকে সজোরে আকড়ে ধরে রেখে তার দেহের পরিচিত চন্দনের সুগন্ধ প্রাণ ভরে গ্রহণ করে। হিন্দালকে বিশ্বাস করার জন্য তাঁর এই উদগ্রীব বাসনা কিংবা হামিদার জন্য তার ভালোবাসা কোনটার দ্বারাই তার প্রভাবিত হওয়া উচিত হবে না। এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলির একটা। কিন্তু সে মনে মনে যতই বিষয়টা নিয়ে বিশ্লেষণ করুক, তার মনের গভীরে যুক্তির চেয়ে সহজাত কোনো একটা অনুভূতি তাকে বারবার বলতে চায়। হামিদা ঠিকই বলেছে- হিন্দাল যা বিশ্বাস করে সেটাই সে বলেছে এবং তাদের তাকে বিশ্বাস করা উচিত। কিন্তু তার মানে এই না যে হিন্দালের পরিকল্পনা সফল হবেই। তার পরিকল্পনা খুবই বিপজ্জনক, কিন্তু সবাই যদি নিজেদের অংশ ভালোভাবে সম্পন্ন করে তাহলে হয়তো কাজ হলেও হতে পারে।
বেশ তাই হবে, হুমায়ুন অবশেষে মন্তব্য করে। আমি হিন্দালকে গিয়ে বলছি যে আমরা তার প্রস্তাব গ্রহণ করেছি যে আমাদের সন্তানের জীবন তার হাতে সমর্পণ করতে তুমি রাজি হয়েছে।
তাকে বলবেন মাহাম আগা আর তার সন্তানকেও যেন সে বের করে নিয়ে আসে। কামরান যখন জানতে পারবে আকবর পালিয়েছে তারা তখন সমূহ বিপদের সম্মুখীন হবে।
হুমায়ুন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমাকে আরো অনেক কিছুই তার সাথে আলোচনা করতে হবে- কাবুল থেকে কতদূরে আমি আমার বাহিনী সরিয়ে নিয়ে যাবো। যখন প্রয়োজন হবে তখন সে আমাদের কোথায় খুঁজে পাবে সেটাও তার জানা থাকা দরকার। হুমায়ুন ঝুঁকে গিয়ে হামিদার কপালে চুমু খায়। হামিদা, এবিষয়ে কারো সাথে এখনই আলোচনা করবে না। এই পরিকল্পনা সফল করতে হলে আমার লোকদের আসলেই বিশ্বাস করাতে হবে যে আমরা কামরানের কাছে কাবুল ছেড়ে যাচ্ছি।
রাতের আধারে হুমায়ুন আরো একবার পা রাখলে তাঁর আব্বাজানের রোজনামচার কিছু কথা তার মনে পড়ে।
কোন সম্রাটের জন্য সতর্কতা মূল্যবান আর গ্রহণযোগ্য একটা বিষয় কিন্তু একজন সত্যিকারের মহান শাসকের সেই সাথে এটাও জানা উচিত কখন তাঁকে ঝুঁকি নিতে হবে।
আমাদের আরও পোষ্ট দেখুনঃ
- হোটেলের পথে চলতে চলতে -মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস (১৯২৩) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
- লন্ডন এক্সপ্রেস -মার্ডার অন দ্য লিঙ্কস (১৯২৩) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
- দ্য ইনক্রেডিবল থেফট -মার্ডার ইন দ্য মিউস (১৯৩৭) ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
- তেল ইয়ারিমাহ -মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]
- আত্মহত্যা নাকি খুন -মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া ( এরকুল পোয়ারো সমগ্র-আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ) [ অনুবাদ সাহিত্য ]