ভোগে নয় ত্যাগেই মনুষ্যত্বের বিকাশ – ভাব-সম্প্রসারণের একটি নমুনা তৈরি করে দেয়া হল। আগ্রহীরা এখন থেকে ধারণা নিয়ে নিজের ভাষায় নিজস্ব ভাষণ তৈরি করবেন। কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় অনেক সময় ভাব-সংহত বাক্য বা চরণ থাকে, যার মিত-অবয়বে লুক্কায়িত থাকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত গূঢ় কথা, নিহিত থাকে ভূয়োদর্শনের শক্তি। ইতিময়, রূপকাশ্রয়ী স্বল্প-বাক উক্তিগুলো বিশ্লেষণে বের হয়ে আসে গত জীবন সম্পর্কে বৃহৎ ভাব, জীবনের অদ্ভুদর্শন।
ভোগে নয় ত্যাগেই মনুষ্যত্বের বিকাশ
মনুষ্যত্বই মানুষের মহাপরিচালক। আর ত্যাগের মহিমাই পারে মানুষের এ মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ ও বিকাশ ঘটাতে। ত্যাগের মাধ্যমে সম্পদ চলে যায়, ফিরে আসে আনন্দ, ভ্রাতৃত্ব আর মনুষ্যত্ব। ত্যাগের মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা, ত্যাগই মানুষের একমাত্র আদর্শ হওয়া উচিত।
জগৎসংসারে ভোগ ও ত্যাগ দুটি বিপরীতমুখী দিক। ভোগ ও ত্যাগের দরজা সবার জন্যেই উন্মুক্ত। মানুষ ভোগে আনন্দ পেলেও তৃপ্তি পায় না। কিন্তু ত্যাগের মাধ্যমে আনন্দ ও তৃপ্তি দুটোই লাভ করা যায়। তাই ভোগ নয়, ত্যাগই জীবনের লক্ষ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। ত্যাগ মনুষ্যত্বকে বিকশিত করে। মনুষ্যত্বের কল্যাণেই মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা এবং শ্রেষ্ঠ। শুধু মানুষ হিসেবে জন্ম নিলেই মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না। মানুষকে তার স্বীয় চেষ্টায় এ মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হয়।
মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানোর মধ্যেই মানবজীবনের সার্থকতা নিহিত। ভোগের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে না। ভোগ মানুষকে জড়িয়ে ফেলে পঙ্কিলতা, গ্লানি ও কালিমার সঙ্গে। তাদের অর্জিত সম্পদ নিজের স্বার্থ ব্যতীত সমাজের অন্য কোনো কাজে আসে না। তাই, পরের দুঃখে তাদের হৃদয়-মনও কাঁদে না। তারা স্বার্থান্ধ ও সংকীর্ণচিত্ত বলে সমাজে মর্যাদাহীন। ত্যাগ মানুষকে নিয়ে যায় মনুষ্যত্বের উদার ভূমিতে।
পরের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার আদর্শ ও উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের মধ্যেই নিহিত থাকে। মনুষ্যত্বের গুণে মানুষ নিজের স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে পরার্থে, দীনদুঃখীদের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়। স্বামী বিবেকানন্দ, মাদার তেরেসা প্রমুখ ব্যক্তিদের চরিত্র ত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ত্যাগের মাধ্যমেই তাঁদের মনুষ্যত্ব তথা মানবিক গুণাবলি ফুটে উঠেছে। ভোগ ও সুখ নিয়ে মানুষের নানারকম ধারণা।

সুখের জন্যে অনেকেই বিলাস-ব্যসনে মত্ত হয়ে ওঠে এবং ভোগ- বিলাসের নানা উপকরণের আয়োজন করে। কিন্তু কোনোভাবেই ভোগাকীর্ণ জীবন সুখের সন্ধান দেয় না। কেননা ভোগই যদি সুখের আকর হতো তবে বিত্ত ও ক্ষমতাবানরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী বলে গণ্য হতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এঁরাও জীবনে প্রকৃত সুখী হতে পারেন না। একমাত্র মহৎ কর্মের মধ্য দিয়েই সুখ পাওয়া যায়। দেশব্রতী, মানবব্ৰতী কর্মেই মানুষ লাভ করে জীবনের সার্থকতা। দেশের জন্যে মানবতার জন্যে যাঁরা আত্মত্যাগ করেন তাঁদের মতো সুখী আর কে আছে? বস্তুত পরের জন্যে স্বার্থ ত্যাগ করার মধ্যেই মানুষের মানবিক গুণাবলির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।
এ-জীবনের পরম শান্তি ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে’র মধ্যে নিহিত। যথার্থ সুখ পরিভোগ প্রবণতার মধ্যে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় নিরন্তর কাজের মধ্যে। দেশব্রতী ও মানবব্রতী ভূমিকার মধ্যে ।
আরও দেখুন: