ব্যাকরণ কী ও কেন?

ব্যাকরণ কী ও কেন ? ব্যাকরণ পড়ার আগে দরকার এই প্রশ্নটির উত্তর। এক কথায় ভাষার অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা আবিষ্কারের নামই ব্যাকরণ। আঠারো শতকের পঞ্চম দশকে বাংলা ভাষার অভ্যন্তরশৃঙ্খলা উদ্ঘাটনের চেষ্টা শুরু হয় বিদেশিদের দ্বারা ও লাতিন- ইংরেজি ব্যাকরণ- কাঠামোতে আসার ১৭৪৩: হ্যালেড ১৭৭৮)। তবে বাংলা ব্যাকরণের বয়সকাল মাত্র আড়াই শ বছর, যেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বাস হাজার বছর।

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রেভারেন্ড জেমস কিথের ‘বঙ্গভাষার ব্যাকরণ (১৮-২০)*, আর বাঙালিদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়ই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। রামমোহনের পরবর্তী বহু বিদগ্ধ ভাষাতত্ত্ববিদ ও বৈয়াকরণের অক্লান্ত শ্রম ও সাধনায় আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। বাংলা ব্যাকরণের আলোকেই আমরা প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার গঠন-প্রকৃতি ও শুদ্ধতার সঙ্গে পরিচিত হতে পারি।।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ কথা বলা শিখেছে মুখে মুখে। পরবর্তীতে সেই মৌখিক ভাষা কাঠামোকে বিশ্লেষণ: করে ব্যাকরণ তার ব্যাখ্যা দিয়েছে। তাই ব্যাকরণ কথা বলার ভাষা শেখার বিদ্যা নয়, বরং কোনো একটি নির্দিষ্ট ভাষার সৃষ্টিকাল থেকে বর্তমানকালের প্রচলিত ভাষা-বৈশিষ্ট্যকে বিশ্লেষণ করে তার একটি সর্বজন গৃহীত রূপ নির্দেশ করার শাস্ত্র। ব্যাকরণ ভাষার ভেতরের শৃঙ্খলা আবিষ্কার করে। “কোনো একটি জাতি যখন নিজের ভাষার মানরূপ স্থির করতে চায়, দূর করতে চায় ভাষার নানা রকম বিশৃঙ্খলা, তখন তাদের মধ্যে উৎসাহ দেখা দেয় ব্যাকরণ চনার।

এমন উৎসাহ দেখা গিয়েছিল প্রাচীন গ্রিসে, পুরোনো ভারতে, আঠারো শতকের ইংল্যান্ডে। ব্যাকরণবিদেরা খুঁজে খুঁজে বের করেন নানা সূত্র, বহু নিয়ম। ভাষার কিছু কিছু ব্যাপারকে তাঁরা ঘোষণা করেন অশুদ্ধ বলে। অন্যরা মেনে নেয়- ব্যাকরণরচয়িতার অনুশাসন। তখন ভাষা পেতে থাকে স্থির ও সুস্থিত রূপ। মানুষের মন যত পরিণত হয়েছে, সে তার জীবন ও ভাষাকে তত শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছে।

 

ব্যাকরণ কী ও কেন

 

ব্যাকরণ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ— বিশেষভাবে বিশ্লেষণ। “ভাষাকে বর্ণনা করে বা বিশ্লেষণ করে দেখাবার চেষ্টা থেকেই ব্যাকরণের জন্য, কিন্তু কী বর্ণনা করে দেখানো হবে। দেখানো হবে কীভাবে ধ্বনিগুলো উচ্চারিত হয়, শব্দগুলো কীভাবে গঠিত হয়, তাদের রূপান্তরই-বা কীভাবে সাধিত হয়, সেগুলো বাক্যে কীভাবে বিন্যস্ত হয়- এ সব। এ সব যদি আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি তা হলে ভাষার কোনটি স্বভাবধর্ম তা ঠিকমতো বুঝতে পারব, কীসে তার অধর্মচ্যুতি তাও বুঝতে পারব। ব্যাকরণের এই সূত্র বাংলা ব্যাকরণের বেলায়ও খাটে।

দীর্ঘদিন ব্যবহারে ভাষায় যেসব রীতি প্রচলিত হয়েছে তার বিশ্লেষণই ব্যাকরণের বিষয়বস্তু। ভাষা মনের ভাব প্রকাশ করে, আর, ব্যাকরণ সেই মনের তারকে শুদ্ধরূপে প্রকাশে সাহায্য করে। জনসাধারণের মুখে মুখে ভাষা নানা রূপ- রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বহতা নদীর মতো প্রবাহিত হয়ে চলে।

ব্যাকরণ সেই ভাষার মৌল প্রবণতা, সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও উচ্চারণ-পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে নিয়ম রচনা করে তার বিশুদ্ধ প্রয়োগের পথ অঙ্কিত করে দেয়। ভাষাকে অবলম্বন করেই ব্যাকরণের সৃষ্টি। ভাষার গতি-প্রকৃতি, তার স্বরূপ, ধরন-ধারন ব্যাকরণে রূপ লাভ করে। ভাষার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ব্যাকরণ থেকে ধারণা লাভ করা যায়। ভাষা সৃষ্টি হয়েছে আগে, ব্যাকরণ এসেছে ভাষার পথ ধরে। ভাষা ব্যবহারের ফলে যখন বিশেষ কিছু নিয়ম পাড়িয়ে গেছে তখন তা হয়ে উঠেছে ব্যাকরণের বিষয়। ব্যাকরণের নিয়ম- কানুন ভাষাকে বিশুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে।

সেজন্যে ব্যাকরণকে ‘ভাষা সংবিধান’ বলা হয়। সংবিধান বা শাসনতন্ত্রে যেমন রাষ্ট্রের আইনকানুনের সমাবেশ থাকে, তেমনি ব্যাকরণে থাকে ভাষার আইনকানুন। বিধিবিধানের সাহায্যে যেমন দেশ বা সংগঠন পরিচালিত হয়, তেমনি ভাষার সংবিধান বা আইনকানুন বা ব্যাকরণ জানা থাকলে তারা শুনস্তূপে ব্যবহার করা যায়।

ভাষা হৃদয়-মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এবং ব্যাকরণ তার নিয়ম-শৃঙ্খলা বা শাসন-শৃঙ্খলা। কোনো ভাষা শিখতে, জানতে বা লিখতে গেলে দেখা যায় সেই ভাষার বর্ণমালা থেকে শুরু করে বাক্যসংযোজন-প্রণালি পর্যন্ত সব কিছুতেই কোনো না কোনো নিয়মনীতি রয়েছে, যা মাতৃভাষার ক্ষেত্রে থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় তা আছে বলে মনে হয় না। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা বলেই এমনটি মনে হয়। আসলে ভাষা মুখ থেকে উচ্চারিত কতকগুলো এলোপাথাড়ি ধ্বনির সমষ্টি নয়।

বরং মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ধ্বনিগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল নিয়ম ও অর্থ থাকে। যেমন- “আমি “উচ্চতর স্বনির্ভর বিশুদ্ধ ভাষা-শিক্ষা’ বইটি পড়ি”— এই বাক্যটিকে যদি লেখা বা বলা হয়। “বইটি ভাষা-শিক্ষা আমি উচ্চতর পড়ি বিশুদ্ধ স্বনির্ভর’ তাহলে কোনো সঠিক অর্থ যেমন হয় না, তেমনি এর ভেতর বন্ধুবা প্রকাশের কোনো নিয়ম বা শৃজলাও লক্ষ করা যায় না।

কারণ এখানে বাংলা ভাষায় বাক্য গঠনের রীতি-নীতি মানা হয় নি। কাজেই দেখা যায়, ব্যাকরণ কোনো ভাষার উপাদান উপকরণ প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে তার রীতি-নীতি ও নিয়ম-পদ্ধতি আবিষ্কার করে ভাষার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার সন্ধান দিয়ে থাকে। ভাষার এই অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য উদ্ঘাটন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা আবিষ্কার করে তার সুবিন্যস্ত ও সুসংহত বর্ণনার নামই ব্যাকরণ।

এক এক ভাষার নিয়ম-শৃঙ্খলা অন্য ভাষার চেয়ে আলাদা। ফলে প্রতিটি ভাষার ব্যাকরণও কমবেশি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ভাষাভেদে ব্যাকরণের নামকরণও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, বাংলা ভাষার জন্যে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, ইংরেজি ভাষার জন্য English Grammar ইত্যাদি।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

উৎস-নির্দেশ:

১. মানোএল দা আসসুম্গ্সাঁও সবর্থথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। তীর রচিত ব্যাকরণ  ‘Vocabulario Em idioma Bengalla, E Portuez : Dividido em duas partes.’ অর্থাৎ বাংলা ও পর্তুগিজ ভাষার  শব্দকোষ : দুই ভাগে বিভক্ত।
প্রকাশকাল ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ। তখন ছাপার জন্য বাংলা অক্ষর তৈরি হয় নি বলে বইটি রোমান অক্ষরে মুদ্রিত হয়। বইটিতে ঢাকার
ভাওয়াল-অঞ্চলে তখনকার দিনে  প্রচলিত বাংলা ভাষার কিঞিৎ পরিচয় আছে।

২. ইংরেজ বিদ্বান নাথানিয়েল ব্যাসি হ্যালহেড (Nathaniel Brassey Halhed) ১৭৭৮ খিস্টাব্দে হুগলি থেকে ইংরেজি ভাষায়
তার বাংলা সাধু ভাষার ব্যাকরণ  (A grammar of the Bengal Language) প্রকাশ করেন ।

* বাংলা একাডেমি; বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার-ব্যাকরণ, প্রথম খণ্ড, ২০১১, ঢাকা ।

৩. বাঙালিদের মধ্যে প্রথমে মনীষী রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২- ১৮৩৩) ইংরেজি ভাষায় তাঁর ব্যাকরণ লেখেন ১৮২৬, খ্রিস্টাব্দে। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে এর বাংলা অনুবাদ ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ প্রকাশিত হয়।

8. ড. হুমায়ুন আজাদ, কতো নদী সরোবর বা বাংলা ভাষার জীবনী।

৫. জ্যোতিভূষণ চাকী, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, জানন পাবলিশার্স। কলকাতা।

Leave a Comment