রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “বৈশাখ” কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী প্রকৃতিচিত্রণ ও আবেগঘন কবিতা। এতে কবি বৈশাখ মাসের প্রখর তাপ, ঝড়, ধুলো, রৌদ্র ও প্রকৃতির রুক্ষ রূপকে এক অনন্য শৈলীতে তুলে ধরেছেন। বৈশাখ এখানে শুধু ঋতুর প্রতীক নয়, বরং শক্তি, পুনর্জাগরণ ও প্রতিবাদী মানসিকতার প্রতিচ্ছবি।
কবিতায় রবীন্দ্রনাথ গ্রীষ্মের তীব্রতা ও ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বৈশাখী ঝড়কে একদিকে ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে, অন্যদিকে সৃষ্টির পূর্বলক্ষণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। বৈশাখের প্রখরতা যেন পুরনো, জীর্ণ, নিস্তেজকে ভেঙে নতুনের জন্য পথ করে দেয়।
প্রকৃতির এই উগ্র রূপকে কবি কেবল ঋতুচিত্রণ হিসেবে নয়, জীবনের সংগ্রাম ও মানসিক দৃঢ়তার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। ফলে “বৈশাখ” কবিতাটি কেবল একটি ঋতুকবিতা নয়, বরং জীবনদর্শন ও সাহসেরও এক শক্তিশালী রূপক।
বৈশাখ কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ছায়ামূর্তি যত অনুচর
দগ্ধতাম্র দিগন্তের কোন্ ছিদ্র হতে ছুটে আসে!
কী ভীষ্ম অদৃশ্য নৃত্যে মাতি উঠে মধ্যাহ্ন-আকাশে
নিঃশব্দ প্রখর
ছায়ামূর্তি তব অনুচর!
মত্তশ্রমে শ্বসিছে হুতাশ।
রহি রহি দহি দহি উগ্রবেগে উঠিছে ঘুরিয়া,
আবর্তিয়া তৃণপর্ণ, ঘূর্ণচ্ছন্দে শূন্যে আলোড়িয়া
চূর্ণরেণুরাশ
মত্তশ্রমে শ্বসিছে হুতাশ।
দীপ্তচক্ষু হে শীর্ণ সন্ন্যাসী,
পদ্মাসনে বস আসি রক্তনেত্র তুলিয়া ললাটে,
শুষ্কজল নদীতীরে শস্যশূন্য তৃষাদীর্ণ মাঠে
উদাসী প্রবাসী–
দীপ্তচক্ষু হে শীর্ণ সন্ন্যাসী!
জ্বলিতেছে সম্মুখে তোমার
লোলুপ চিতাগ্নিশিখা, লেহি লেহি বিরাট অম্বর,
নিখিলের পরিত্যক্ত মৃতস্তূপ বিগত বৎসর
করি ভস্মসার।
চিতা জ্বলে সম্মুখে তোমার।
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে,
যাক নদী পার হয়ে, যাক চলি গ্রাম হতে গ্রামে,
পূর্ণ করি মাঠ।
হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ।
সকরুণ তব মন্ত্রসাথে
মর্মভেদী যত দুঃখ বিস্তারিয়া যাক বিশ্ব-‘পরে,
ক্লান্ত কপোতের কণ্ঠে, ক্ষীণ জাহ্নবীর শ্রান্তস্বরে,
অশ্বত্থছায়াতে–
সকরুণ তব মন্ত্রসাথে।
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ
তোমার ফুৎকারলুব্ধ ধুলা-সম উড়ুক গগনে,
ভ’রে দিক নিকুঞ্জের স্খলিত ফুলের গন্ধসনে
আকুল আকাশ–
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ।
তোমার গেরুয়া বস্ত্রাঞ্চল
দাও পাতি নভস্তলে, বিশাল বৈরাগ্যে আবরিয়া
জরা মৃত্যু ক্ষুধা তৃষ্ণা, লক্ষকোটি নরনারী-হিয়া
চিন্তায় বিকল।
দাও পাতি গেরুয়া অঞ্চল।
ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ!
ভাঙিয়া মধ্যাহ্নতন্দ্রা জাগি উঠি বাহিরিব দ্বারে,
চেয়ে রব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে
নিস্তব্ধ নির্বাক।
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
বৈশাখ কবিতা এর ব্যাখ্যা ঃ
বৎসরের প্রথম দিনে পহেলা বৈশাখে রবীন্দ্রনাথ বাঁধা জয়ের অভিযাত্রায় ডাক দিয়েছেন সকলকে , ‘ এসো, এসো ,দলে দলে বাহির হয়ে পড়ো – – নববর্ষের প্রাতকালে পূর্ব গগণে আজ জয়ভেরি বেজে উঠেছে। সমস্ত অবসাদ কেটে যাক জয় হোক তোমার,জয় হোক তোমার প্রভুর । কালবৈশাখীর কালো মেঘ আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেললেও অভয়বানী শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মানুষ কে সাড়া দিতে হবে ,বুক পেতে গ্রহন করতে হবে এ ঝড়কে।কারন নড়বড়ে যা কিছু সব ভেঙ্গে শক্ত দৃঢ় ঘাতসহ যা কিছু তাই অক্ষত থাকবে নতুন যাত্রার অবলম্বন হিসেবে। বৈশাখ যদিও সাহসী বৈরী অশান্ত তবু তার সৃষ্টিশীলতা কল্পনাকেও হার মানায়।
প্রেম প্রকৃতি আর মানুষের গান নিয়ে রবি এলেন বৈশাখে আমাদের মাঝে একরাশ পূর্ণতা নিয়ে। কবিগুরু বৈশাখ কে আমাদের মাঝে উপস্থাপন করেছেন বিশেষ দর্শন নিয়ে। বাঙালি ঐতিহ্যের প্রাচীনতম ধারাবাহিকতায় বাউল জারি সারি আর কীর্তন আবহমান কাল ধরে চলে আসলেও রবির আবির্ভাবের পর বাঙালির বৈশাখ উদযাপন অনেকটা বদলে গেছে । হয়তো এ মাসে জন্য নিয়েছিলেন বলে এ মাসের প্রতি বিশেষ টান কবিগুরুর। পৃথিবীর সকল বাঙালি বর্ষ বরণের সাথে নিজেকে একাত্ম করে বৈশাখের আনন্দ ধারায় । বিশ্বকবি নিজের মতো করে বৈশাখ পালনের মাধ্যমে দিনটি কে আরো মহিমান্বিত করেছেন।
বৈশাখে বর্ষবরণের যে ধারা অব্যাহত আছে রবীন্দ্রনাথের এসো ,এসো,এসো হে বৈশাখ ,কাহারবা তালের এই গানের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ভাবনার এক নিপুণ নির্মাণ এর পরিচয় পাওয়া যায়। বৈশাখ এলে আমরা অনুভব করি অসাম্প্রদায়িক এই সাংস্কৃতিক উৎসব কতটা শক্তিশালী। রবীন্দ্রনাথের গানের ‘ মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা শুচি হোক ধরা’ চরণটি যেন সমস্ত বাঙালির প্রাণের কথা। কবিগুরু চেয়েছেন সমস্ত জরা ব্যাধি বৈশাখী বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে অগ্নিস্নানের এক অপরূপ স্নিগ্ধতার সন্ধান পেতে।
বৈশাখ কবিতা আবৃত্তি ঃ