বিশ্বায়ন ও উন্নয়নশীল বিশ্ব | অর্থনীতি, উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : বিশ্বায়ন নিয়ে সভা-সেমিনার, আলোচনা-পর্যালোচনা অব্যাহত থাকলেও বিশ্ব যে দ্রুতহারে বদলাচ্ছে তাতে এ প্রক্রিয়া, কোন অবস্থায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। বিশ্বায়ন মূলত একটি সর্বব্যাপী ও সার্বক্ষণিক চলমান প্রক্রিয়া। তথ্যপ্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসারের ফলে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মানুষই একটি একীভূত বিশ্বব্যবস্থায় মিলিত হচ্ছে। ক্রমেই লীন হচ্ছে ভৌগোলিক সীমারেখা ও চিন্তার ভিন্নতাসূচক স্বাতন্ত্র্যবোধ।
বিশ্বায়ন ও উন্নয়নশীল বিশ্ব | অর্থনীতি উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন | বাংলা রচনা সম্ভার
বিশ্বায়ন ও উন্নয়নশীল বিশ্ব
মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করলেও প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্কের ফলে। এভাবে মানুষ একে অপরের খুব কাছে আসতে পারছে। কিন্তু এ কাছে আসা, পরিচিত হওয়া এবং পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ায় লিও হওয়ার ফলে এসেছে লাভালাভের প্রশ্ন। শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় উন্নত দেশগুলো তাদের সুবিধাজনক অবস্থানের ফলে জিতে গিয়ে লাভবান হচ্ছে আর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্রমাগত ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
বিশ্বায়নের ধারণা : বিশ্বায়নের ধারণা নির্মাণ খুব সহজ নয়। একে অভিহিত করা হয়েছে এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে, যা রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের পুরনো কাঠামো ও সীমানাকে অবলুপ্ত করছে। বিশ্বায়নকে বলা হচ্ছে একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ক্রমবর্ধমান পরাজাতীয়করণ (Trans-nationalization), যার ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক বিশ্ব সীমানা, এক বিশ্ব সম্প্রদায়।
এটি এমন একটি সর্বব্যাপী অভিজ্ঞতা যে আমাদের জীবনের অধিকাংশ দিকই এর আওতাভুক্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে আবার বিশ্বায়নকে বি-আঞ্চলিকীকরণ (Delocalijation) প্রক্রিয়া বলে অভিহিত করেন। এর অর্থ হলো স্থানিক দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণ ও জীবনবোধ এ প্রক্রিয়ায় একটি বৈশ্বিক অবয়বে বিলুপ্ত হচ্ছে এবং মানুষ আর পুরোপুরি স্থানীয়ভাবে তাদের জীবনযাপন করতে পারছে না। বিশ্বায়নের ফলে মানুষ এখন আর কোনো ভৌগোলিক কিংবা সীমানার গণ্ডীতে আবদ্ধ নয় ।
গিডেন্স (Giddens) বিশ্বায়নের প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্থানিক অভিজ্ঞতার মূলসূত্রটিই বদলে গেছে, নৈকট্য ও দূরত্ব পরস্পরের সাথে এমনভাবে একত্র হয়েছে যার তুলনা অতীত থেকে মেলা ভার।’
অনেকে বিশ্বায়নকে রাষ্ট্রীয় সীমানার মাপকাঠিতে বিচার করেছেন। সেক্ষেত্রে বিশ্বায়নকে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় সীমানার এক প্রকার বিলুপ্তি হিসেবে। বিশ্বায়ন রাষ্ট্রীয় সীমানাকে উঠিয়ে একটি বৈশ্বিক পটভূমি রচনা করেছে যেখানে পণ্য, অর্থ, চিন্তা-চেতনা ও তথ্যসহ কোনো কিছুকেই আর রাষ্ট্রীয় সীমানায় সীমায়িত করা যাচ্ছে না।
বরং দ্বিজাতীয়, বহুজাতীয় প্রভৃতি নানা ধারা কিংবা ব্যবস্থায়। এগুলোর অবাধ গমনাগমন হচ্ছে। মানুষ পরস্পরের খুব কাছে আসছে এবং বিশ্বকে ক্রমেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছে। আর এ অবস্থার প্রেক্ষিতেই এসেছে গ্লোবাল ভিলেজ (Global Village) ধারণাটি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারের ফলে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল ও মানুষ একটি। সর্বব্যাপী বিশ্বব্যবস্থার অধীন এবং এ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ আছে বলেও মনে হয় না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিশ্বায়ন কোনো একক প্রতিনা নয় বরং এটি একটি সর্বব্যাপী ও সার্বিক প্রক্রিয়া। বিশ্বায়ন রাষ্ট্রীয় সীমানার প্রাচীর ভেঙ্গে অর্থনৈতিক যোগাযোগ ও লেনদেন, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, রাজনৈতিক মিথষ্ক্রিয়া প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপকতর পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ফলে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাচেতনা এবং বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।
বিশ্বায়ন ও উন্নয়নশীল বিশ্বে তার প্রভাব : বিশ্বায়নের যে ধারণা, প্রক্রিয়া ও প্রবণতা তা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনোভাবে স্পর্শ করলেও এর প্রভাব সকল রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমান নয়। তাই পৃথিবীর সকল দেশ এ প্রক্রিয়ায় আবশ্যকীয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেও এর প্রভাব কোন দেশের ও অঞ্চলের ওপর কতটুকু পড়ছে, কারা কোন প্রক্রিয়ায় এর কতটুকু ফল ভোগ করছে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বায়নের ফলে উন্নত দেশগুলোর সাথে আবশ্যকীয়ভাবে নানা ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে এ থেকে তাদের লাভবান হওয়ার সুযোগ খুবই কম। ইতিমধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যেমন—
ক. বিশ্বায়নের অর্থনীতি : আসলে বিশ্বায়নের অর্থই হচ্ছে উচ্চতর পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বায়ন হচ্ছে গোটা বিশ্বকে একটি একক বাজার হিসেবে ধরে নিয়ে অর্থনৈতিক উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে পুঁজির আধিপত্য এবং পুঁজিবাদী দেশগুলোর স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্যই স্বাক্ষরিত হয় পাটি (GATT) চুক্তি, প্রতিষ্ঠা করা হয়। WTO-এর মতো সংস্থা। ইতিমধ্যে এ ধরনের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার নেতিবাচক ফল সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
ধনী-দরিদ্র বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি, বিশ্বজুড়ে ব্যাপক দারিদ্র, নিরক্ষরতা আর মানব বঞ্চনাই এ ধরনের পুঁজিবাদী বিশ্বায়’নের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন মাত্রা ও পর্যায়ে বিশ্বায়’নের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছে। এ ধরনের দ্বন্দ্ব বা ক্ষোভের একটি মাত্রা হলো উত্তর-দক্ষিণ। দক্ষিণের দেশগুলো অভিযোগ করছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা চালুর ফলে প্রতি বছর ২৭০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য বৃদ্ধির যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল তার সিংহভাগই নিয়ন্ত্রণ করবে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা উন্নত দেশগুলো। ব্রাউন এবং কলিগস ১৯৯৬ সালে একটি খসড়া হিসেবের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, গ্যাট চুক্তির ফলে প্রতি বছর ১৩৬ বিলিয়ন ডলার সেবাখাতে অতিরিক্ত বাণিজ্য হবে যা মোট বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ।
তাদের হিসাব অনুযায়ী এর মধ্যে ৩৯ বিলিয়ন ডলার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ৩৭ বিলিয়ন ডলার, জাপান ২৪ বিলিয়ন ডলার, কানাডা ৯ বিলিয়ন ডলার, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ৫ বিলিয়ন ডলার এবং মাত্র ২৫ বিলিয়ন ডলার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্যান্য দেশের সেবাখাতে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে। এখন প্রশ্ন হলো কেন এমনটা হবে। কারণ এর মাধ্যমে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর টিকে থাকাই দায়। বরং অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে তাদের অর্থনীতির নিজস্ব যা ছিল তা-ও হারিয়ে যেতে বসেছে। উন্নয়নশীল এসব দেশ পরিণত হয়েছে উন্নত দেশগুলোর পণ্যের বাজারে।
তাছাড়া বিশ্বায়নের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দেশীয় শিল্প চরমভাবে মার খাচ্ছে। বিদেশী বিনিয়োগের নামে দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যও পড়েছে চাপের মুখে। এমতাবস্থায় এ সকল দেশের অর্থনীতি তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ক্রমশ উন্নত দেশের সাহায্য, বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজি আর বিশ্বসংস্থার মাতব্বরির কাছে জিম্মি হয়ে আছে।
খ. বিশ্বায়নের সংস্কৃতি : জ্যান নেডারভিন (Jan Nerderveen) মনে করেন, বিশ্বায়ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি সংকর সংস্কৃতি (Hybrid Culture) সৃষ্টি করবে। তিনি এর নাম নিয়েছেন “তৃতীয় সংস্কৃতি”। এ নয়া সংস্কৃতি এখন স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত। Juyuveera-এর মতে, বিশ্বায়ন থেকে যে সামাজিক সম্পর্ক উদ্ভূত হয় তা গোটা বিশ্বকে ক্রমান্বয়ে একটা একক প্রধান অর্থনীতি, একক সরকার ব্যবস্থা এবং একক সংস্কৃতিতে সংহত করে। এই একক সংস্কৃতি স্থানীয় সংস্কৃতির পৃথক বৈশিষ্ট্য ও জনগণের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চাহিদার প্রতি অসংবেদনশীল, কৃত্রিম ও অগভীর।
কারণ সংস্কৃতির মৌলিক যে বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ জনগণের আচার-আচরণ, জীবনযাত্রার প্রতিফল ঘটানো তা এ সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত। বরং বিশ্বায়ন থেকে জাত এ নয়া সংস্কৃতি বিনোদন ও যৌনতার পৃষ্ঠপোষকতাই কেবল করে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সংস্কৃতির এ ধারা প্রায় সর্বাংশেই উন্নত থেকে স্বল্পোন্নত দেশের দিকে ধাবিত। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ১৯৯৯ সালের মানব উন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একক বৃহত্তম রপ্তানি শিল্প বিমান, কম্পিউটার, গাড়ি নয়, তা হচ্ছে বিনোদন, সিনেমা এবং টিভির অনুষ্ঠান।

হলিউডের ফিল্ম ৩ হাজার কোটি ডলার আয় করেছে। কেবল টাইটানিক ছবিটি ব্যবসা করে ১৮০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ফর্বস জানিয়েছে, পর্নোগ্রাফি এখন ৫৬ বিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাণিজ্য। তাই দেখা যাচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ম্যাগাজিন, সিডি, ভিডিও, ইন্টারনেটের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির বিস্তারকে আশঙ্কাজনকভাবে শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে।
সিনেমায় সহিংসতা ও যৌনতার বৃদ্ধি এবং সঙ্গীতে পশ্চিমা ঢং অনুকরণ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে উপগ্রহ সম্প্রচার ব্যবস্থার বিস্তার এ ব্যবস্থাকে আরো বেগবান করেছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রচারিত অনুষ্ঠানের ধরন ও বিষয়বস্তুর সাথে স্থানীয় মূল্যবোধের প্রত্যক্ষ সংঘাত অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। বাংলাদেশে টিভি সিক্স, টিভি ফোর, ফ্যাশন টিভি, এনসিএন প্রভৃতি চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার কারণে বাংলাদেশে এগুলোর প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়।
গ. তথ্যের পণ্যায়ন ও বিশ্বায়ন : বিশ্বায়নের আরেকটি অভিঘাত হলো এটি পরাজাতিক পশ্চিমা সংস্কৃতিকে আমাদের জীবনযাপনের একমাত্র মডেল হিসেবে চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে তৈরি হচ্ছে ‘প্যাকেটবন্দি দর্শক-শ্রোতা যাদের আনুগত্য ব্রান্ডনেম পণ্যে আবদ্ধ আর সামাজিক বাস্তবতাকে যারা উপলব্ধি করে পণ্য পরিতৃপ্তির মাপকাঠির মধ্য দিয়ে।
ফলে সৃষ্টি হয়েছে এমন এক ভোতা-সংস্কৃতি যে সংস্কৃতিতে প্রথাগত উৎপাদনমুখী কাজে নীতির চেয়ে ভোগের নীতিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ভোক্তা সংস্কৃতির এ বিস্তার তথ্যকে বিক্রনযোগ্য, লাভজনক একটি পণ্যে পরিণত করেছে। আর তথ্যকে পণ্যে পরিণত করে একে যত বেশি সম্ভব গ্রাহকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার তাড়না থেকেই দেখা দিয়েছে তথ্যমাধ্যমের বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা। তাছাড়া এসব তথ্যমাধ্যম উন্নয়নশীল’ বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে উল্টো নিজেদের ব্যবসা করার অপকৌশল নিয়েই ব্যস্ত।
ঘ. বিশ্বায়ন ও সমাজব্যবস্থা : বিশ্বায়ন আরেকটি অভিঘাত হানছে সমাজব্যবস্থায়। বিশ্বায়’নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ তাদের নিজ নিজ সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধকে হারিয়ে ক্রমেই একটি পশ্চিমা ধ্যান-ধারণানির্ভর সমাজব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সমাজসমূহ তাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে এবং তা নতুন প্রজন্মকে স্ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে এ সকল সমাজের কাঠামো, সামাজিক স্তরায়ন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধ সর্বত্রই এক ধরনের হযবরল অবস্থা দেখা দিচ্ছে। ফলে সমাজে দেখা দিচ্ছে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য। পরিবার কাঠামোতে আসছে ভাঙন, পরিচ্ছন্ন বোধ ও বিশ্বাসের স্থান দখল করছে যৌনতা ও হিংস্রতানির্ভর এক বিকৃত সামাজিক ব্যবস্থা।
ঙ. শিক্ষা : বিশ্বায়নের অভিঘাত থেকে তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাও মুক্ত নেই। শিক্ষা মূলত মানুষের আত্মিক ও চিন্তাশক্তির বিকাশ, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতার সাথে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করে। বিশ্বায়’নের ফলে তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা তার স্থানিক সম্প্রদায়গত (Community) বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ভিনদেশী রঙে একটি মেকি রূপ ধারণ করেছে।
এ শিক্ষাব্যবস্থা অতীষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থারই সৃষ্টি করে থাকে। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত জনগণও তাদের বাস্তব জীবনে তেমন উপকৃত হতে পারে না। কেননা এ শিক্ষার সিলেবাস, পাঠদান পদ্ধতি এবং অন্তর্নিহিত ধ্যান-ধারণার সবই অভীষ্ট জনগোষ্ঠীকে একটি ভিনদেশী তথা পশ্চিমা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত করে তোলার মানসে রচিত। ফলে এ সকল সমাজে এমন একটি শ্রেণীর জন্ম হচ্ছে, যারা দেশীয় সবকিছুতেই নাক সিঁটকায়, যা যে কোনো জাতির উন্নতির জন্য মারাত্মক হুমকি।
চ. বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তি : বর্তমান যুগকে চিহ্নিত করা হচ্ছে মানব ইতিহাসের চতুর্থ যোগাযোগ বিপ্লবের কাল হিসেবে। মানুষ যখন ভাষার ব্যবহার শুরু করল, প্রথম বিপ্লবটি শুরু হয়েছিল তখন। লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন সূচনা করেছিল দ্বিতীয় বিপ্লবের। তৃতীয় বিপ্লটি ঘটেছিল স্থানান্তরযোগ্য মুদ্রাক্ষরভিত্তিক মুদ্রণ ও প্রকাশনা প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে। আর চতুর্থ বিপ্লবটি হচ্ছে ডিজিটাল ইলেকট্রনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিপ্লব। উপগ্রহ সম্প্রচার প্রযুক্তি, আধুনিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ও কম্পিউটার-এ তিনের সমন্বয়ে বিশ্বজুড়ে গড়ে ওঠেছে তথ্যের মহাসরণী (Information highway) নামে দ্রুতগতির এক বিস্তৃত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক।
উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতি ও দেশই কোনো না কোনোভাবে এ যোগাযোগ নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিগতভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা উন্নত দেশগুলো দুর্বল তথ্য অবকাঠামোর স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর চেয়ে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া থেকে অনেক বেশি লাভবান হচ্ছে। এমনকি এ সকল দেশে উন্নত দেশগুলোর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে সাংস্কৃতিক অবনয়ন, ব্যক্তির গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা লঙ্ঘন, সমাজের পরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংস ও সর্বোপরি সামাজিক ক্ষমতার ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ বিনষ্ট হচ্ছে।
উপসংহার : বিশ্বায়নের যে বিস্তৃত প্রক্রিয়া ও অভিঘাত তা উন্নয়নশীল’ বিশ্বকে উন্নত বিশ্বের সাথে যুক্ত করার মাধ্যমে অনেক সুবিধাদানের কথা ছিল। কেননা বিশ্বায়’নের ফলে এ সকল দেশ উন্নত দেশগুলোর খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায় এবং আধুনিক জীবনবোধের সাথে পরিচিত হতে পারে। এ জীবনবোধ তাদের একটি উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখায়। উন্নত দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
ফলে অনুন্নত দেশগুলোতে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। মোটের ওপর সকলে লাভবান না হলেও কিছু কিছু দেশ যেমন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনসহ আরো অনেক দেশই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে সক্ষম হয়। এমনকি ক্রমাগত অভিঘাত সহ্য করেও অনেক দেশ তাদের আপন আপন ধ্যান-ধারণা, প্রতিষ্ঠান, পদ্ধতি টিকিয়ে রেখে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সকল ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার সামর্থ্য অর্জন করছে। সুতরাং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে যদি সবার জন্য উপযোগী করতে হয় তাহলে উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই অনুন্নত দেশের জনগণের লাভালাভের দিকে নজর দিতে হবে।
এজন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও অন্যের সংস্কৃতি গ্রহণে সচেতন এবং আপন আপন সংস্কৃতির উন্নয়নে সচেষ্ট হতে হবে। প্রতিযোগিতার মাঠে নেমে প্রতিযোগীর ঘাড়ে। দোষ না চাপিয়ে প্রতিযোগীকে হারানোর সামর্থ্য অর্জনের মাধ্যমে জিততে হবে। কেননা আমরা যতো অপছন্দই করি না কেন এ মুহূর্তে বিশ্বায়নের বৃহত্তর প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই।
আরও দেখুন: