বিশিষ্টার্থক শব্দ নিয়ে আজ আলোজনা করবো। এই পাঠটি ভাষা ও শিক্ষা সিরিজের নির্মিতি অংশের পাঠ। আমরা কথা বলতে গিয়ে বা লিখতে গিয়ে মূলত দুটো কাজ করি। এক শব্দের পাশে শব্দ সাজিয়ে বাক্য রচনা করি, আর জুতসই বা লাগসই শব্দ বাছাই করি, যাতে আমার প্রকাশ সুন্দর আর মনোগ্রাহী হয়। শব্দ বাছাই আর শব্দ সাজানো- এ দুটোই রচনার কাজ। আমরা একটি শব্দ অপরিচিত হলে অভিধান দেখি, শব্দটির অর্থ খুঁজি। আবার এরকমও বলি যে, বাক্যে ব্যবহৃত এ বিশেষণটা চলবে না, এর চেয়ে লাগসই আর একটা বিশেষণ চাই। ইংরেজ কবি কিট্স একবার কবিতা লিখতে গিয়ে এইরকম মুশকিলে পড়েছিলেন।
বিশিষ্টার্থক শব্দ | নির্মিতি | ভাষা ও শিক্ষা
তাঁর সমস্যাটা ছিল blue-এর চেয়ে নীল বোঝায় এরকম একটা বিশেষণ খুঁজে বের করা। স্বভাবতই এরকম পরিস্থিতিতে আমরা সমার্থশব্দকোষ খুঁজব। ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে কোনো শব্দের অপ্রীতিকর, অবাঞ্ছিত অনুষঙ্গ থাকলে অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের সৌজন্যবোধ সেই শব্দটির ‘মার্জিত’ রূপ খুঁজতে প্ররোচিত করে। উদাহরণ হিসেবে ‘মৃত্যু’র কথাই ধরা যাক। প্রয়াণ, ইহলোক ত্যাগ, পরলোকগমন, তিরোধান, দেহাবসান, দেহান্ত, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ, গঙ্গাযাত্রা ইত্যাদি।
এগুলো সবই সমার্থক শব্দ—ভেবে দেখতে হবে কোন শব্দটি আমি ব্যবহার করব। উপযুক্ত শব্দ ব্যবহারের মধ্যেই ভাষার সৌকর্য বেশি করে ফুটে ওঠে। ভাষার প্রধান কাজ সংবাদ জ্ঞাপন ও বিনিময়, কমিউনিকেশন। ভাবের আদান-প্রদানের জন্যই ভাষার সৃষ্টি। এ- বাক্যে ‘আদান’ ও ‘প্রদান’ শব্দ দুটি একটি অপরটির বিপরীত মনোভাব প্রকাশ করে। ভাষার সৌন্দর্য সৃষ্টি এবং ভাব প্রকাশের ব্যাপকতার জন্য বিপরীত শব্দের সঙ্গেও পরিচয় থাকা চাই। আবার ‘পরপর’ শব্দ সাজিয়ে একটি বাক্যকে ছন্দোবদ্ধ করে তোলা যায়- “বৃষ্টি পড়-পড়, ত্বরা করে বাড়ি চল”।
এখানে ‘পরপর’ এবং ‘পড়-পড়’ শব্দ দুটি যে প্রায় সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু আভিধানিক অর্থের সঙ্গে যখন শব্দের ব্যবহারিক অর্থের পার্থক্য ঘটে তখন আমাদের একটু সচেতন হতেই হয়। যেমন ধরা যাক, ‘হাত’ শব্দটির মুখ্যার্থ মানব-শরীরের প্রত্যঙ্গ বিশেষ, এ হলো আক্ষরিক বা আভিধানিক অর্থ। কিন্তু যখন বলি, ছেলেটির ছবি আঁকায় হাত আছে, তখন এর আভিধানিক অর্থও বদলে যাচ্ছে (এ বিষয়ে আমরা নেছি)। এক্ষেত্রে ‘হাত’ শব্দটি বাগর্থতত্ত্বে জেনেছি)।
এক্ষেত্রে ‘হাত’ শব্দটি বাক্যে ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। কোনো ভাষার যে কোনো শব্দই অর্থ প্রকাশ করে— কখনও একটি অর্থ, কখনও একাধিক অর্থ। শব্দটি কোন অর্থ প্রকাশ করছে তা আমরা বুঝতে পারি যখন সম্পূর্ণ বাক্যটি আমরা পড়ি বা কানে শুনি। অর্থাৎ বাক্যের ভেতর দিয়ে সম্পূর্ণরূপে বলবার কথা বা ভাব প্রকাশিত হয় তখন আমরা বহু-অর্থবিশিষ্ট কোনো শব্দের একটি মাত্র নির্দিষ্ট অর্থ বুঝতে পারি। এ রকম অজস্র শব্দই রয়েছে বাংলাভাষায়। বৈয়াকরণগণ এ ধরনের শব্দগুলোকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করে বিভিন্ন নামকরণ করেছেন, যেমন : সমার্থক শব্দ, ভিন্নার্থক শব্দ, সমোচ্চারিত ও প্রায় সমোচ্চারিত শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ ইত্যাদি। এ-অধ্যায়ে আমরা এসব বিষয়ে বিস্তৃত জানতে পারব।
আরও দেখুন: