সিডর/আইলা উপদ্রুত এলাকায় বিপর্যস্ত জনজীবনের বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা ,স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় সিডরের (১৫ নভেম্বর ২০০৭) তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূল। উপকূলবাসী হাজার হাজার মানুষ মরে গেছে কিংবা জিবনৃত হয়ে বেঁচে আছে এই ভয়াল দানবের ধ্বংসলীলার শিকার বা সাক্ষী হয়ে। এই ঝড়ে উপকূলীয় জনপদের বেঁচে যাওয়া অসংখ্য নারী কেউ কোলের সন্তান হারিয়েছেন, কারো বসতবাড়ি উড়ে গেছে, কারো হয়তো স্বামী নিখোঁজ রয়েছে, কেউ আবার সবই হারিয়েছে।
সিডর/আইলা উপদ্রুত এলাকায় বিপর্যস্ত জনজীবনের বিবরণ দিয়ে প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
একদিকে প্রিয়জন-পরিজন হারানোর শোক, সহায়-সম্পদ হারানোর বেদনা, নিজের শারীরিক ক্ষতি, ক্ষুধার তারণা অন্যদিকে জীবনের তাগিদ। ধ্বংসস্তূপ থেকে নতুন করে জেগে ওঠার তাড়া। সন্তানসম্ভবা হলে নিজের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি প্রাণ বাঁচানোর আকুতি, নতুন জীবনের স্বপ্ন। সবকিছু নিয়ে নিরন্তর এক সংগ্রামে লিপ্ত উপকূলীয় জনপদের মানুষ।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ১ কোটি মানুষের বসবাস। আর এখানেই আঘাত হেনেছে সিডর ঘূর্ণিঝড়। ফলে জানমালের ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৩১টি জেলার ২০০টি উপজেলার ১ হাজার ৮১১টি ইউনিয়ন ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রায় ৮০ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। ফলে ব্যাপক প্রাণহানিসহ শস্য, ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, পশু-পাখি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাঁধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুধু তাই নয়, দুর্গত অঞ্চলের মানুষজন এখন কর্মহীন-খাদ্যহীন-গৃহহীন। তাদের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত।
ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের মানসিক ধকলে তারা এখন বাকরুদ্ধ ও ম্রিয়মাণ, বিশেষত শিশুরা। সরকারি হিসেবে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহাণির সংখ্যা ৩৩০০ বলা হলেও রেড ক্রিসেন্টের তথ্য মতে এ সংখ্যা ৫-১০ হাজার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ৩০টি জেলার ২১০টি উপজেলার ২০ লাখ একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। সাড়ে বার লাখ গবাদি পশু মারা গেছে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের বরাতে জানা গেছে, ৩০ জেলার ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কম-বেশি এখন বিধ্বস্ত। এদিকে বনবিভাগের তথ্য মতে, সুন্দরবনের ৪ লাখ হেক্টরেরও বেশি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা ছিল কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ২৫ হাজার কি. মি. সরবরাহ লাইনের মধ্যে ২০ হাজার কি. মি. ক্ষতিগ্রস্ত। ১০ হাজার ২০০টি টিউবওয়েল সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে।
সিডর ঘূর্ণিঝড়ের সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৫ কোটি ডলারেরও বেশি বলে আন্দাজ করা হচ্ছে। সিপিডির মতে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্য ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে দুর্গত এলাকার প্রায় ১৪ লাখ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষা জীবন এখন বিপন্ন। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে। বরিশাল বোর্ডের অধীনে এবার ৭০ হাজার ছাত্রছাত্রীর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবার কথা। কিন্তু এদের অধিকাংশই ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ে তাদের বইখাতা-কলমসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ খুইয়েছে।
ফলে কমপক্ষে ২০ হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু এসব দৃশ্যমান পরিমাপযোগ্য বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতির বাইরেও এমন অনেক অপূরণযোগ্য মানবিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, যা কেবল আর্থিক মূল্যে বিচার করা সম্ভব নয়। লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার সংকট, স্বজন হারানোর শোক, মানসিক আঘাত এগুলো কখনোই কী পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে ?
বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারিভাবে ঘূর্ণিঝড় কবলিত অঞ্চলে জরুরি ত্রাণ সহায়তা ও পুনর্বাসন চলছে। ঘূর্ণিঝড় আক্রান্ত মানুষজনদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার ৩ পর্বের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সেইসঙ্গে ডিসেম্বর ‘০৭ থেকে মার্চ ‘০৮ পর্যন্ত ১২টি জেলায় ২৬ লাখ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ভিজিএফ এর আওতায় রাখা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে দুর্গত এলাকায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদান করার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে কৃষি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৩ শ কোটি টাকা। মৎস্য ও পশু সম্পদ খাতের পুনর্বাসনের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা এবং গৃহায়ণে ৫০ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে অপর্যাপ্ততা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে যে, দুবলার চর, নিঝুমদ্বীপসহ অনেক নির্জন চর এলাকার অনেক মানুষের হাতে এখনও কোনো প্রকার ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ বিতরণে যে সমন্বয়হীনতা ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায় তার প্রধান শিকার হয় নারী-শিশুরা। কেননা কেউ অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতি করতে চাইলে এদেরকে তালিকা থেকে বাদ দেয়াই সবচেয়ে সহজ। অথচ এই ত্রাণ ও সহায়তা নারী-শিশুদের জন্যই বেশি জরুরি, কারণ তাদের প্রয়োজন এবং সমস্যাই বেশি।

দেখা যায় সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রসূতি, গর্ভবতীসহ নবজাতক শিশু ও অতিবৃদ্ধদের প্রতি আলাদা নজর রাখার চিন্তাভাবনার কথা বলা হলেও বাস্তবে জরুরি সাহায্য ও ত্রাণের কাজে সাধারণত কোনো আলাদা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। পুরুষের সঙ্গে একই লাইনে সন্তানকোলে নারী ত্রাণের অপেক্ষায়- দাঁড়িয়ে থাকে। অনেকে ঝড় ও জলস্রোতে পরনের কাপড়টুকু ছাড়া আর সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তারা হয়তো পোশাকের অভাবে সবসময় লাইনে দাঁড়াতে পারে না। এই অবস্থায় কোনো নারী আসন্নপ্রসবা হলে তার তো ঘরের বাইরে যাবার উপায়ই থাকবে না। উপায়ন্তর না দেখে তারা দূষিত পানি কিংবা বাসি-পচা খাবার খেলে এর পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। আর তাই প্রয়োজন দূরদর্শী, লাগসই, চাহিদাভিত্তিক ও দীর্ঘমেয়াদি নিরলস পুনর্বাসন কর্মকাণ্ড ।
আরও দেখুন:
- হরতাল সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
- বৃক্ষরোপণ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
- ক্যাবল টিভির সুফল ও কুফল সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন রচনা | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা
- বন্যা দুর্গত এলাকার বিপর্যস্ত জনজীবনের বিবরণ দিয়ে একটি প্রতিবেদন | প্রতিবেদন | ভাষা ও শিক্ষা