বাস্তু ত্যাগী – জসীম উদ্‌দীন

বাস্তু ত্যাগী কবিতাটি – কবি জসীম উদ্‌দীনের রচনা : বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ১৯০৩ খ্রি : ১ লা জানুয়ারি তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়ি জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতার নাম আনসারউদ্দীন । তিনি ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক । পিতার একমাত্র পুত্রসন্তান জসীম উদ্দীন। হিতৈষীস্কুলে পড়া শেষ করে জসিম উদ্দীন ভর্তি হন ফরিদপুর জেলা স্কুলে। কবি জসীম উদ্দীন বি.এ. পাস করেন রাজেন্দ্র কলেজ থেকে। বি.এ পাস করে এম . এ . পড়ার জন্য কলকাতা চলে যান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার দুটি কাব্যগ্রন্থ “রাখালী” এবং “নকশী কাথার মাঠ” পড়ে জসিম উদদীনকে বাংলাদেশের মুসলমান চাষীদের প্রতিনিধিত্বকারী পল্লীকবি হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন ।

বাস্তু ত্যাগী - জসীম উদ্‌দীন

 

বাস্তু ত্যাগী – জসীম উদ্‌দীন

দেউলে দেউলে কাঁদিছে দেবতা পূজারীরে খোঁজ করি,
মন্দিরে আজ বাজেনাকো শাঁখ সন্ধ্যা-সকাল ভরি।
তুলসীতলা সে জঙ্গলে ভরা, সোনার প্রদীপ লয়ে,
রচে না প্রণাম গাঁয়ের রুপসী মঙ্গল কথা কয়ে।
হাজরাতলায় শেয়ালের বাসা, শেওড়া গাছের গোড়ে,
সিঁদুর মাখান, সেই স্থান আজি বুনো শুয়োরেরা কোড়ে।
আঙিনার ফুর কুড়াইয়া কেউ যতনে গাঁথে না মালা,
ভোরের শিশিরে কাঁদিছে পুজার দুর্বাশীষের থালা।
দোল-মঞ্চ যে ফাটিলে ফাটিছে, ঝুলনের দোলাখানি,
ইঁদুরে কেটেছে, নাটমঞ্চের উড়েছে চালের ছানি।

কাক-চোখ জল পদ্মদীঘিতে কবে কোন রাঙা মেয়ে,
আলতা ছোপান চরণ দুখানি মেলেছিল ঘাটে যেয়ে।
সেই রাঙা রঙ ভোলে নাই দীঘি, হিজলের ফুল বুকে,
মাখাইয়া সেই রঙিন পায়েরে রাখিয়াছে জলে টুকে।
আজি ঢেউহীন অপলক চোখে করিতেছে তাহা ধ্যান,
ঘন-বন-তলে বিহগ কন্ঠে জাগে তার স্তব গান।
এই দীঘি-জলে সাঁতার খেলিতে ফিরে এসো গাঁর মেয়ে,
কলমি-লতা যে ফুটাইবে ফুল তোমারে নিকটে পেয়ে।
ঘুঘুরা কাঁদিছে উহু উহু করি, ডাহুকেরা ডাক ছাড়ি,
গুমরায় বন সবুজ শাড়ীরে দীঘল নিশাসে ফাড়ি।

ফিরে এসো যারা গাঁও ছেড়ে গেছো, তরুলতিকার বাঁধে,
তোমাদের কত অতীত-দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।
সুপারির বন শুন্যে ছিঁড়িছে দীঘল মাথার কেশ,
নারকেল তরু উর্ধ্বে খুঁজিছে তোমাদের উদ্দেশ।
বুনো পাখিগুলি এডালে ওডালে, কইরে কইরে কাঁদে,
দীঘল রজনী খন্ডিত হয় পোষা কুকুরের নামে।

কার মায়া পেয়ে ছাড়িলে , এদেশ, শস্যের থালা ভরি,
অন্নপূর্ণা আজো যে জাগিছে তোমাদের কথা স্মরি।
আঁকাবাঁকা রাকা শত নদীপথে ডিঙি তরীর পাখি,
তোমাদের পিতা-পিতামহদের আদরিয়া বুকে রাখি ;
কত নমহীন অথই সাগরে যুঝিয়া ঝড়ের সনে,
লক্ষীর ঝাঁপি লুটিয়া এনেছে তোমাদের গেহ-কোণে।
আজি কি তোমরা শুনিতে পাও না সে নদীর কলগীতি,
দেখিতে পাও না ঢেউএর আখরে লিখিত মনের প্রীতি ?

হিন্দু-মুসলমানের এ দেশ, এ দেশের গাঁয়ে কবি,
কত কাহিনীর সোনার সুত্রে গেঁথেছে সে রাঙা ছবি।
এদেশ কাহারো হবে না একার, যতখানি ভালোবাসা,
যতখানি ত্যাগ যে দেবে, হেথায় পাবে ততখানি বাসা।
বেহুলার শোকে কাঁদিয়াছি মোরা, গংকিনী নদীসোঁতে,
কত কাহিনীর ভেলায় ভাসিয়া গেছি দেশে দেশ হতে।
এমাম হোসেন, সকিনার শোকে ভেসেছে হলুদপাটা,
রাধিকার পার নুপুরে মুখর আমাদের পার-ঘাটা।

অতীতে হয়ত কিছু ব্যথা দেছি পেয়ে বা কিছুটা ব্যথা,
আজকের দিনে ভুলে যাও ভাই, সে সব অতীত কথা।
এখন আমরা স্বাধীন হয়েছি, নুতন দৃষ্টি দিয়ে,
নুতন রাষ্ট্র গুড়িব আমরা তোমাদের সাথে নিয়ে।
ভাঙ্গা ইস্কুল আবার গড়িব, ফিরে এসো মাস্টার।
হুঙ্কারে ভাই তাড়াইয়া দিব কালি অজ্ঞানতার।
বনের ছায়ায় গাছের তলায় শীতল স্নেহের নীড়ে,
খুঁজিয়া পাইব হারাইয়া যাওয়া আদরের ভাইটিরে

১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক "কবর" কবিতা নির্বাচিত হওয়ার পর ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে জসীম উদ্‌দীন (সনদ হাতে)। Jasim Uddin received reception at Rajenra College, Faridpur after the selection of Kabar poem by the University of Calcutta while he was a student of I. A class in 1928
১৯২৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক “কবর” কবিতা নির্বাচিত হওয়ার পর ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে জসীম উদ্‌দীন (সনদ হাতে)। Jasim Uddin received reception at Rajenra College, Faridpur after the selection of Kabar poem by the University of Calcutta while he was a student of I. A class in 1928

আরও পড়ুন:

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

Leave a Comment