Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেম | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার

স্বদেশপ্রেম সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী উপাদান। বিশ্বের প্রায় সকল ভাষার সাহিত্যেই দেশপ্রেম একটি শক্তিশালী আবেগ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা জাতিসত্তা, ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে তুলে ধরে। তবে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে এই অনুভূতির তেমন কোনো পরিচয় মেলে না। সে সময় সাহিত্য প্রধানত ধর্মীয়, পৌরাণিক কিংবা নিছক রোমান্টিক উপাখ্যানে সীমাবদ্ধ ছিল।

বাংলা সাহিত্যে স্বদেশপ্রেমের স্পষ্ট আবির্ভাব ঘটে উনিশ শতকের বাংলা রেনেসাঁ-র সময়, যখন মানুষ নতুন করে চিন্তাভাবনার মুক্ত আবহে নিজেকে, সমাজকে ও দেশকে উপলব্ধি করতে শুরু করে। ইউরোপের মধ্যযুগেও দেশপ্রেমের ধারণাটি অনুপস্থিত ছিল; সেখানে ধর্ম, রাজা বা সাম্রাজ্যের জন্য আত্মত্যাগকেই বীরত্ব হিসেবে দেখা হতো।

দেশকে একটি আত্মপরিচয় হিসেবে উপলব্ধি করে তাকে ভালোবাসা এবং সেই অনুভবকে সাহিত্যে প্রকাশ করার প্রবণতা রেনেসাঁরই উপহার। ফলে সাহিত্যে দেশপ্রেমের উপস্থিতি এক আধুনিক ভাবধারার ফল, যা বাংলা সাহিত্যের গতিধারায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

Table of Contents

বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেম

ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেশপ্রেমের বিকাশ

বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের চিন্তা ও চেতনার সুস্পষ্ট বিকাশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, বিশেষত উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে, যখন বাঙালি সমাজ প্রথমবারের মতো ইংরেজি শিক্ষা, ইউরোপীয় জ্ঞানচর্চা ও আধুনিক বৌদ্ধিক চেতনার সংস্পর্শে আসে। এই শতাব্দীকে বাংলার আধুনিক রেনেসাঁ-এর সূচনালগ্ন বলা চলে, যেখানে প্রাচীন বিশ্বাস ও আধুনিক চিন্তার মধ্যে একটি টানাপোড়েন তৈরি হয়, আর সেই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় নতুন ধরণের স্বদেশবোধ

এই নবজাগরণের অন্তরালে প্রধান প্রেরণা হিসেবে কাজ করে ব্রিটিশদের দীর্ঘ শাসন ও শোষণনীতি, যা একদিকে যেমন পশ্চিমা শিক্ষার দরজা খুলে দেয়, তেমনি বাঙালির মনে গেঁথে দেয় নিপীড়িত হওয়ার বেদনা। ব্রিটিশ শাসনের অন্যায্যতা ও বৈষম্যমূলক নীতি ধীরে ধীরে বাংলার মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলে। বিশেষত উনিশ শতকের প্রথমার্ধে গঠিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা মূলত হিন্দু সমাজ থেকে উঠে আসে, তারাই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় শিক্ষা ও চেতনার আলোয় নিজেদের আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে শুরু করে।

এই শিক্ষিত শ্রেণির হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে দেশপ্রেম, আত্মবোধ, এবং জাতিসত্তা-সংক্রান্ত বিষয়াবলির। তারা অতীত ভারতের গৌরবগাথাকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায় এবং তার ভিত্তিতে একটি জাতীয় চেতনা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। এসময় সাহিত্যে যেমন পুরাণনির্ভর ঐতিহাসিক কল্পনাচার উঠে আসে, তেমনি বৃটিশ বিরোধিতার সূক্ষ্ম সুরও ধ্বনিত হতে থাকে।

তবে এই সময়ের দেশপ্রেম একটি সাম্প্রদায়িক রঙ ধারণ করে। যেহেতু হিন্দু সমাজই সর্বাগ্রে ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, এবং ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় প্রশাসনিক ও বৌদ্ধিক শ্রেণিতে স্থান করে নেয়, তাই স্বভাবতই মুসলমানদের দীর্ঘ শাসনকালের প্রতি একটি অবচেতন বিরুদ্ধতা তাদের মানসিকতায় গড়ে ওঠে। ফলে অনেক সাহিত্যকর্মে দেশপ্রেমের প্রকাশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ছায়া দেখা যায়, যা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিমুখতা বা অসহিষ্ণুতা হিসেবে প্রতিফলিত হয়।

এমন এক সময়ে, যখন ভারতের প্রকৃত ‘জাতীয়তাবাদ’ ধারণাটি এখনও পূর্ণতা পায়নি, তখনকার সাহিত্যিকরা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে দেশপ্রেম গড়ে তুলতে শুরু করেন। এই ধারা অনেক ক্ষেত্রে উগ্র স্বজাত্যবোধে রূপ নেয়, আবার কখনও তা কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও ইতিহাসমুগ্ধতাজনিত আবেগে সীমাবদ্ধ থাকে। অপরদিকে, কিছু সাহিত্যিক আবার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ দেশপ্রেম প্রকাশে সচেষ্ট হন।

অতএব, ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য দেশপ্রেমকে নিয়ে আসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যদিও তা একক ও সর্বজনীন চরিত্র ধারণ করতে পারেনি, তথাপি এই সময়ের সাহিত্যই পরবর্তীকালের আসল জাতীয়তাবাদী চেতনা ও মুক্তিসংগ্রামের ভিত্তিভূমি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 

বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের বহুমাত্রিক প্রকাশ

বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের প্রকাশ বিচিত্র ও বহুমুখী। কেউ দেশপ্রেমকে দেখেছেন ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক আবেগের আলোকে, কেউ বা দেখেছেন সর্বজনীন মানবিকতার প্রেক্ষাপটে। একদল কবি মুগ্ধ হয়েছেন দেশের প্রকৃতি, মাটি ও মানুষের রূপ-রসে; অপরপক্ষে কেউ কেউ ব্যথিত হয়েছেন জাতির দুঃখ, দুর্দশা ও পরাধীনতায়। বাংলা কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, গল্প ও লোকসাহিত্য—সকল শাখায় দেশপ্রেমের রূপান্তরিত প্রকাশ লক্ষণীয়। তবে বিশেষভাবে বাংলা কাব্যেই দেশপ্রেমের সর্বাধিক সৃজনশীল বিকাশ ঘটেছে।

নিচে ঊনবিংশ শতাব্দীর কয়েকজন প্রধান সাহিত্যিকের রচনায় দেশপ্রেমের প্রকাশ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

ঈশ্বর গুপ্ত (১৮১২১৮৫৯)

ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন ব্যঙ্গ-রচনায় প্রাজ্ঞ, যদিও তার রচনায় সরাসরি রাজনৈতিক চেতনার তীব্র উপস্থিতি নেই। তবে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণে ঊনবিংশ শতকের শিক্ষিত সমাজের যে আত্মবিসর্জনের প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে তিনি গলা তুলেছিলেন। নিজের স্বদেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকে তিনি লেখেন:

কতরূপ স্নেহ করি
দেশের কুকুর ধরি,
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।

এই উক্তিতে যেমন আছে উগ্র স্বজাত্যবোধ, তেমনি ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে বিকৃত আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ। যদিও সাহিত্যিক গুণ বিচারে এই কবিতাগুলোর মূল্য তুলনামূলক কম, তথাপি সে সময়কার সামাজিক-রাজনৈতিক স্রোতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে তা গুরুত্বপূর্ণ।

 

রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭১৮৮৭)

রঙ্গলালকে বলা হয় স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের কবি। তার “স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে” কবিতাটি বহু মানুষের চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল। তবে এ কথা সত্য, সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে তার কটূ মন্তব্য এবং ব্রিটিশ অধিকারের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন তার রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তার চিন্তাধারা যতটা আবেগপ্রবণ, ততটা দৃঢ় রাজনৈতিক নয়।

 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪১৮৭৩)

মধুসূদনের রচনায় সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য খুব একটা না থাকলেও, তার অন্তরের গভীরে এক নিঃসীম স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল। মেঘনাদবধ কাব্যে বিভীষণের প্রতি মেঘনাদের দীপ্ত ভাষণ সেই স্বাধীনচেতা ভাবনারই প্রতিফলন। এছাড়া, তার চতুর্দশপদী কবিতার “পরিচয়” কবিতায় দেশের প্রকৃতির প্রতি যে মুগ্ধতা প্রকাশ পেয়েছে, তা শান্ত, কোমল ও অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমের এক অনন্য নিদর্শন:

যে দেশে কুহরে পিক বসন্ত কাননে,
দিনেশে যে দেশে সেবে নলিনী মুবর্তী;
চাঁদের আমোদ যথা কুমুদ সদনে,
সে দেশে জনম মন…”

এই কবিতার আবেগ দেশকে ভালোবাসার এক নিঃশর্ত অনুভবকে তুলে ধরে।

 

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮১৯০৩) নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭১৯০৯)

হেমচন্দ্রের রচনায় স্বাধীনতার কল্পনা প্রায়শই সাম্প্রদায়িক আবরণে দৃশ্যমান, এবং অনেক সময় তা সাহিত্যিক উৎকর্ষতা থেকেও বঞ্চিত। তবে তার ব্যঙ্গকবিতায় ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শোষণ ও দমননীতির বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ আছে। নবীনচন্দ্র সেনও প্রায় একই ধরনের চেতনায় দেশপ্রেম প্রকাশ করেছেন। তাঁর কাব্য রৈবতকবুর ক্ষেত্রপ্রভাস-এ তিনি ভারতের প্রাচীন ঐক্যবদ্ধ সভ্যতার কল্পনা রচনা করেছেন, যা এক ধরণের ঐতিহাসিক আত্মপরিচয়ের সন্ধান।

 

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ বিশ শতকের সূচনালগ্নে দেশপ্রেম

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ এবং বিশ শতকের শুরুতে বাংলা সাহিত্য দেশে-বিদেশে শিক্ষা ও চেতনার নতুন ধারা গ্রহণ করে আরও পরিপক্ব হতে থাকে। এ সময় সাহিত্যিকরা দেশপ্রেমের অনুভূতিকে কখনও উগ্র জাতীয়তাবাদের রূপে, কখনও বা মানবিক মূল্যবোধে উদারভাবে প্রকাশ করেন। এই সময়ের দেশপ্রেমধর্মী সাহিত্যচর্চায় যে বৈচিত্র্য ও পরিপক্বতা দেখা যায়, তা বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন দিশা দেয়।

 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮১৮৯৪)

বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের পথিকৃৎ হলেও তার দেশপ্রেমচর্চা একদিকে যেমন ঐতিহাসিক, তেমনই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আচ্ছন্ন। তাঁর অনেক উপন্যাসে তিনি হিন্দু ভারতের গৌরবময় অতীত কল্পনা করেছেন এবং মুসলিম চরিত্রগুলোর প্রতি অবজ্ঞা বা বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি তার সহনশীলতা এবং মুসলিম বিদ্বেষ উনিশ শতকের দেশপ্রেমচর্চায় একটি বিতর্কিত অধ্যায় রচনা করে।

তবে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ তিনি মাঝে মাঝে সমাজ ও রাষ্ট্রের সংকটকে ব্যঙ্গ ও কটাক্ষের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যেখানে তার চিন্তাশীল ও উদার দেশপ্রেমের কিছু আভাস পাওয়া যায়।

 

দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০১৮৭৩)

দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটক বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের এক বাস্তব ও সংগ্রামী রূপের পথিকৃৎ। এখানে ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষকসমাজ—হিন্দু নবীনমাধব ও মুসলিম তোরাপ—একসাথে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই নাটক হিন্দুমুসলমানের সম্মিলিত সংগ্রামের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেম প্রকাশের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে ওঠে।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১১৯৪১)

বিশ্বদর্শী ও মানবতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ দেশকে কেবল মাটির টান বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভালোবাসেননি, বরং একটি বৃহৎ মানবিক চেতনার অংশ হিসেবে কল্পনা করেছেন। তিনি দেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন, কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ কিংবা সাম্প্রদায়িকতায় তার স্থান নেই।

রবীন্দ্রনাথ ভারততীর্থ কবিতায় ভারতবর্ষকে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সংস্কৃতির মহামিলনক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন। সৈয়দ আলী আহসান যথার্থই বলেছেন—

“রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তার মধ্যে উচ্চ আদর্শবাদ নিহিত আছে…
রঙ্গলাল-হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের নিছক গোত্রপ্রীতি নয়,
কিংবা মধুসূদনের মাধুর্যপূর্ণ মাতৃভূমিপ্রীতিও নয়;
বরং তার মধ্যে তিনি একটি সুমহান সত্য এবং পরম ঐক্যের পরিচয় দিতে চেয়েছেন।”

রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম তাই কেবল আবেগের নয়, চেতনার—যা বিশ্বমানবতার সঙ্গে ভারতবর্ষকে যুক্ত করে।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩১৯১৩)

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক ও কবিতায় দেশপ্রেম ও মানবতা হাত ধরাধরি করে চলে। রানা প্রতাপ নাটকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ উঠে এলেও, পরবর্তী নাটক মেবারপতন এবং অনেক কবিতায় মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা ঐক্যের বার্তা পাওয়া যায়। তার দেশপ্রেমের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক চেতনা ও সাংস্কৃতিক বোধের সংমিশ্রণ, যা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করে।

 

সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২১৯২২)

ছন্দ ও অলঙ্কারে পারদর্শী কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার রচনায় দেশপ্রেমকে অসাম্প্রদায়িক এবং মানবিক আবেগে উপস্থাপন করেছেন। তার কবিতায় যেমন রয়েছে প্রকৃতি বন্দনা, তেমনি রয়েছে জাতিধর্মনির্বিশেষে একটি উদার স্বদেশচেতনা। তিনি দেশকে ভালোবেসেছেন একটি বৃহত্তর সত্তা হিসেবে, যেখানে সব শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মানুষের অবস্থান নিশ্চিত।

 

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬): বিদ্রোহী দেশপ্রেমের কণ্ঠ

বিশ শতকে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের ভাবনায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি দেশপ্রেমকে কেবল রাজনীতিকদের ভাষণে সীমাবদ্ধ না রেখে সরাসরি শোষিত, বঞ্চিত ও মেহনতি মানুষের হৃদয়স্পর্শী অনুভূতিরূপে উপস্থাপন করেন। নজরুলের দেশপ্রেম ছিল সাম্প্রদায়িকতা গোঁড়ামিমুক্ত, যেখানে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকল মানুষকেই তিনি স্বদেশের সন্তান বলে কল্পনা করেছেন।

তার কবিতায় যেমন রয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র প্রতিবাদ

তোরা সব জালিমরে, জালিমরে, জালিম…”
তেমনি দেশি শোষক ও ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধেও রয়েছে ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহ। নজরুলের দেশপ্রেম কেবল দেশের মাটি, নদী, গাছ-পালা বা ঐতিহ্যকে ভালোবাসা নয়—তা মূলত সাম্য, ন্যায় মুক্তির প্রতি ভালোবাসা। তাই বলা যায়, তার দেশপ্রেম সর্বহারা সাধারণ মানুষের প্রতি মমতার এক গভীর ভাষ্য

 

বাংলা নাটকে দেশপ্রেমের প্রকাশ

বাংলা নাট্যসাহিত্য স্বদেশচেতনার এক গভীর অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর নাটকে যেমন জাতিগত অহংবোধ, তেমনি শাসক-শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সুর পরিলক্ষিত হয়।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাটকে দেশপ্রেম আরও বেশি বাস্তব, গতিশীল ও জটিল রূপ ধারণ করে। মুনীর চৌধুরী, মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ নাট্যকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, দারিদ্র্য, শোষণ ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের নাটকে বহুমাত্রিক দেশপ্রেমের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। নাটক হয়ে ওঠে তখন শুধু বিনোদন নয়—বরং জাতিসত্তার আত্মবিশ্লেষণ।

 

বাংলা কথাসাহিত্যে স্বদেশপ্রেম

বাংলা উপন্যাস গল্পসাহিত্যেও দেশপ্রেম একটি প্রভাবশালী অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে উঠেছে। এই ধারায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি তার উপন্যাসে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে জড়িত করেছেন দেশের প্রতি ভালোবাসা দায়বদ্ধতা

এছাড়াও বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যান্য বিশিষ্ট লেখকদের মধ্যে—

এই সব লেখকরা তাদের উপন্যাস ও গল্পের মাধ্যমে স্বদেশের প্রতি প্রেম, আত্মত্যাগ, সমবেদনা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে শিল্পরূপে গড়ে তুলেছেন।

এছাড়া আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন গণআন্দোলনে আমাদের কবি ও সাহিত্যিকরা তাদের রচনায় স্বদেশপ্রেমকে উচ্চকিত করে তুলেছেন।

 

উপসংহার:

সাহিত্য মানুষের আত্মার অভিব্যক্তি—যেখানে সে তার চিন্তা, অনুভব ও চেতনার কথা নিখুঁতভাবে ব্যক্ত করতে পারে। আর দেশপ্রেম সেই অনুভূতির এক অন্যতম স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক প্রকাশ, যা মানুষের জন্মগত আবেগের অংশ। মানুষ যখন তার মাটি, মানুষ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি মমতা প্রকাশ করতে চায়, তখন সাহিত্যই হয়ে ওঠে সেই ভাবপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।

বাংলা সাহিত্য যুগে যুগে সেই স্বদেশপ্রীতির ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ হয়েছে। কখনও বিদ্রোহে, কখনও ভালোবাসায়, কখনও ব্যঙ্গ বা দ্রোহে, কখনও বা শান্ত-নির্লিপ্ত সৌন্দর্যবোধে বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমের নান্দনিক ও বাস্তবধর্মী প্রকাশ ঘটেছে। এই সাহিত্যে উঠে এসেছে কৃষকের কান্না, বিপ্লবীর আহ্বান, মাটির গন্ধ, নদীর কলতান এবং বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা—সবই দেশপ্রেমের বিচিত্র ব্যঞ্জনায় মুখরিত।

বাংলা সাহিত্য শুধু বিনোদন নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় চেতনার দর্পণ, স্বাধীনতা সংগ্রামের সহচর, এবং স্বজাত্যবোধের জাগরণে প্রেরণার উৎস। সাহিত্যিকদের কলমে ধরা পড়েছে ইতিহাস, সমাজ ও সময়ের সঙ্গে দেশের আত্মার নিবিড় সংলাপ। আর এই সংলাপই বাংলা জাতিসত্তাকে বারবার আত্মপ্রত্যয়ে জাগ্রত করেছে।

অতএব, বলা যায়—সাহিত্য ও স্বদেশপ্রেম একে অপরের পরিপূরক। বাংলা সাহিত্যের ধারা দেশপ্রেমের আবেগকে শুধু ধারণ করেনি, বরং তা নিখুঁত শিল্পরূপে উপস্থাপন করে নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও চেতনায় দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালোবাসা গেঁথে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

Exit mobile version