আজকে আমরা বাংলা সন্ধি সম্পর্কে আলোচনা করবো। যা বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি এর অন্তর্গত।
Table of Contents
বাংলা সন্ধি
মানুষ কথা বলার সময় কথার গতি বৃদ্ধি পায়। দ্রুত কথা বলার সময় কখনো কখনো দুটো শব্দের কাছাকাছি থাকা দুটো ধ্বনির উচ্চারণ একত্রিত হয়ে যায়। ব্যাকরণে একে সন্ধি বলা হয়। যেমন: “আমি বিদ্যা আলয়ে যাব।” বাক্যটি বলার সময় ‘আমি বিদ্যালয়ে যাব’ হয়ে যায়। এখানে ‘বিদ্যা’-এর ‘আ’-ধ্বনি এবং ‘আলয়’-এর ‘আ’—ধ্বনি মিলে গেছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লিখেছেন : দুটি বর্ণ অত্যন্ত নিকটবর্তী হলে উচ্চারণের সুবিধার জন্য উভয়ের মিলন হয়ে এক বর্ণ বা একের রূপান্তর বা একের লোপ বা উভয়ের রূপান্তর হলে— এরূপ মিলনকে সন্ধি বলে।
এই সংজ্ঞার আলোকে বলা চলে : পাশাপাশি অবস্থিত দুটো ধ্বনির মিলনের ফলে যদি এক ধ্বনি সৃষ্টি হয়, তবে তাকে সন্ধি বলে।
সন্ধি শব্দের অর্থ মিলন। দুটো ধ্বনির সন্ধিতে প্রথম শব্দের শেষ ধ্বনি এবং পরের শব্দের প্রথম ধ্বনির মিলন ঘটে। সন্ধির ফলে নতুন নতুন শব্দের সৃষ্টি হয়। কথা বলার সময় শব্দের উচ্চারণ সহজ হয়। ভাষা সংক্ষিপ্ত হয় এবং শুনতে ভালো লাগে ৷
সন্ধিতে ধ্বনির চার ধরনের মিলন হয় :
১. উভয় ধ্বনি মিলে একটি ধ্বনি হয়।
২. একটি ধ্বনি বদলে যায়।
৩. একটি ধ্বনি লোপ পায় ।
৪. উভয় ধ্বনির বদলে নতুন ধ্বনির সৃষ্টি হয়।
বাংলা সন্ধি দু প্রকার : ১. স্বরসন্ধি, ২. ব্যঞ্জনসন্ধি।

১. স্বরসন্ধি :
স্বরধ্বনির সঙ্গে স্বরধ্বনির মিলনে যে সন্ধি হয়, তাকে স্বরসন্ধি বলে। যেমন :
সোনা + আলি = সোনালি
রুপা + আলি = রুপালি
মিথ্যা + উক = মিথ্যুক
কুড়ি + এক = কুড়িক
নদী + এর = নদীর
মা + এর = মায়ের
ব্যঞ্জনসন্ধি :
স্বরধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে ব্যঞ্জনধ্বনি মিলিত হয়ে যে সন্ধি হয়, তাকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে। যেমন :
কাঁচা + কলা = কাঁচকলা
নাতি + বৌ = নাতবৌ
ছোট + দা = ছোড়দা
উৎ + চারণ = উচ্চারণ
আর + না = আন্না
চার + টি = চাট্টি
বাংলা ভাষায় অনেক সংস্কৃত শব্দ কোনো রকম পরিবর্তন ছাড়া ব্যবহৃত হয়। এগুলোকে তৎসম শব্দ বলে । এসব তৎসম শব্দের সন্ধি সংস্কৃতের নিয়মেই হয়। তাই সংস্কৃতের নিয়ম মেনে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তৎসম শব্দের সন্ধি ৩ প্রকার। যথা : ক. স্বরসন্ধি, খ. ব্যঞ্জনসন্ধি ও ৩. বিসর্গসন্ধি
ক. স্বরসন্ধি : সূত্র ও উদাহরণ
১. অ, আ ধ্বনির সন্ধি
অ + অ = আ ( া )
নব + অন্ন = নবান্ন
পরম + অণু = পরমাণু
অ + আ = আ ( া )
জল + আশয় = জলাশয়
পাঠ + আগার = পাঠাগার
আ + অ = আ ( া )
কথা + অমৃত = কথামৃত
আশা + অতীত = আশাতীত
আ + আ = আ ( া )
বিদ্যা + আলয় – বিদ্যালয়
মহা + আশয় – মহাশয় –
২. ই, ঈ ধ্বনির সন্ধি
ই + ই = ঈ (ী)
অতি + ইত = অতীত
রবি + ইন্দ্র = রবীন্দ্র
ই + ঈ = ঈ (ী)
পরি + ঈক্ষা = পরীক্ষা
অধি + ঈশ্বর = অধীশ্বর
ঈ + ই = ঈ (ী)
শচী + ইন্দ্ৰ = শচীন্দ্র
মহী + ইন্দ্ৰ মহীন্দ্ৰ
ঈ + ঈ = ঈ (ী)
শ্রী + ঈশ = শ্ৰীশ
পৃথিবী + ঈশ্বর = পৃথিবীশ্বর
৩. উ, ঊ ধ্বনির সন্ধি
উ + উ = ঊ (ূ)
কটু + উক্তি = কটূক্তি
মরু + উদ্যান = মরূদ্যান
উ + উ = ঊ (ূ)
লঘু + ঊর্মি = লঘূর্মি
বহু + ঊর্ধ্ব = বহুর্ধ্ব
ঊ + উ = ঊ (ূ)
বধূ + উৎসব = বধূত্সব
বধূ + উক্তি = বধূক্তি
ঊ + ঊ = ঊ (ূ)
ভূ + ঊর্ধ্ব = ভূর্ধ্ব
২. অ/আ, ই/ঈ ধ্বনির সন্ধি
অ/আ + ই/ঈ = এ (6)
স্ব + ইচ্ছা = স্বেচ্ছা
যথা + ইষ্ট = যথেষ্ট
অপ + ঈক্ষা = অপেক্ষা
মহা + ঈশ্বর = মহেশ্বর
৩. অ/আ, উ/ঊ ধ্বনির সন্ধি
অ/আ + উ/ঊ = ও (ো)
সূর্য + উদয় = সূর্যোদয়
চল + ঊর্মি = চলোর্মি
কথা + উপকথন – কথোপকথন
মহা + ঊর্মি = মহোমি
৪. অ/আ, ঋ ধ্বনির সন্ধি
অ/আ + ঋ = অর (*)
অ/আ + ঋত = আর
দেব + ঋষি = দেবর্ষি
শীত + ঋত = শীতার্ত
৫. অ/আ, এ/ ঐ ধ্বনির সন্ধি
অ/আ + এ/ঐ = ঐ (2)
জন + এক = জনৈক
মত + ঐক্য = মতৈক্য
রাজা + ঋষি = রাজর্ষি
ক্ষুধা + ঋত = ক্ষুধার্ত
তথা + এর = তথৈব
মহা + ঐশ্বৰ্য = মহৈশ্বর্য
৬. অ/আ, ও/ঔ ধ্বনির সন্ধি
অ/আ + ও/ ঔ = ঔ (ো)
জল + ওকা = জলৌকা
চিত্ত + ঔদার্য = চিত্তৌদার্য
মহা + ওষধি = মহৌষধি
মহা + ঔষধ – মহৌষধ
৬. অ/আ, ও/ ঔ ধ্বনির সন্ধি
অ/আ + ও/ ঔ = ঔ (ো)
জল + ওকা = জলৌকা
মহা + ওষধি = মহৌষধি
চিত্ত + ঔদার্য = চিত্তৌদা
মহা + ঔষধ = মহৌষধ
৭. ই/ঈ-এর পর ভিন্ন ধ্বনির সন্ধি
ই/ঈ + অ/আ = য (371)
অতি + অন্ত = অত্যন্ত
নদী + অম্বু = নদ্যম্বু
ইতি + আদি – ইত্যাদি
মসী + আধার = মস্যাধার
ই/ঈ + উ/ঊ = য (1)
অতি + উক্তি = অত্যুক্তি
প্রতি + ঊষ = প্রত্যূষ
ই/ঈ + এ = য (63)
প্রতি + এক = প্রত্যেক
৮. উ/ঊ-এর পর ভিন্ন ধ্বনির সন্ধি
উ/ঊ + অ/আ = ব/বা
সু + অল্প = স্বল্প
উ/ঊ + ই/ঈ = বি/বী
অনু + ইত = অন্বিত
উ/ঊ + এ = বে
অনু + এষণ =অন্বেষণ
সু + আগত = স্বাগত
তনু + ঈ = তন্বী
১. এ/ঐ-এর পর ভিন্ন ধ্বনির সন্ধি
এ/ঐ + অ/আ = অয়/ আয়
নে + অন = নয়ন
নৈ + অক = নায়ক
১০.ও/ঔ-এর পর ভিন্ন ধ্বনির সন্ধি
ও/ঔ + অ/আ – অব/আব
পো + অন = পবন
গো + আদি – গবাদি
লো + অন = লবণ
পৌ + অক = পাবক
ও/ঔ + ই = অবি/আবি
পো + ইত্ৰ – পবিত্র
নৌ + ইক – নাবিক
ও/ঔ + উ = আবু
ভৌ + উক = ভাবুক
ও/ঔ + এ = অবে
গো + এষণা – গবেষণা
খ. ব্যঞ্জনসন্ধি : সূত্র ও উদাহরণ
১. স্বরধ্বনি + ব্যঞ্জনধ্বনির সন্ধি
অ + ছ = চ্ছ
প্র + ছদ = প্রচ্ছদ
আ + ছ =চ্ছ
কথা + ছলে – কথাচ্ছলে
ই + ছ = চ্ছ
পরি + ছদ = পরিচ্ছদ
উ + ছ = চ্ছ
তরু + ছায়া = তরুচ্ছায়া
২. ব্যঞ্জনধ্বনি + স্বরধ্বনির সন্ধি
ক + অ = গ
দিক্ + অন্ত = দিগন্ত
ট + আ = ড> ড়
ষট্ + আনন – ষড়ানন
ত + অ = দ
তৎ + অন্ত = তদন্ত
প + অ = ব
সুপ্ + অন্ত = সুবন্ত
৩. ব্যঞ্জনধ্বনি + ব্যঞ্জনধ্বনির সন্ধি
ত + চ/ছ = চ্চ/চ্ছ
উৎ + চারণ = উচ্চারণ
উৎ + ছেদ – উচ্ছেদ
দ + চ/ছ = চ্চ/চ্ছ
বিপদ্ + চয় = বিপক্ষয়
বিপদ্ + ছায়া = বিপচ্ছায়া
ত + জ/ঝ = জ্ঞ/ধ্ব
যাবৎ + জীবন = যাবজ্জীবন
কুৎ + ঝটিকা = কুঞ্ঝটিকা
দ + জ = জ্জ
বিপদ্ + জনক = ‘ বিপজ্জনক
ত+ ড = ড
উৎ + ডীন = উড্ডীন
ত + ল = ল্ল
উৎ + লিখিত – উল্লিখিত
ত+শ = চ্
চলৎ + শক্তি = চলচ্ছক্তি
ত + হ = দ্ধ
তৎ + হিত = তদ্ধিত
দ + হ = দ্ধ
পদ্ + হতি = পদ্ধতি
ক্+দ = গ্+দ
বাক্ + দান – বাগ্দান
ক্ + ব = গ + ব
দিক্ + বিজয় – দিগ্বিজয়
ট্ + য = ড্ ড্ + য
ষট্ + যন্ত্র – ষড়যন্ত্র =
ত্ + গ = দ্ + গ
উৎ + গিরণ = উদ্গিরণ
ত + ঘ = দ + ঘ
উৎ + ঘাটন = উদঘাটন
ত্ + ব = দ্ +ব
উৎ + কখন = উদ্বন্ধন
ত্ + ভ = দৃ + ভ
উৎ + ভব = উদ্ভব
ত্ + র = দ্ + র
তৎ + রূপ = তদ্রুপ
ক্ + ন = ঙ + ন
দিক্ + নির্ণয় = দিনিৰ্ণয়
ত্ + ম = ন + ম
তৎ + মধ্যে = তন্মধ্যে
ত্ + ন = ন্ন
উৎ + নতি = উন্নতি
জগৎ + নাথ = জগন্নাথ
ত্ + ম = ন্ম
তৎ + ময় = তন্ময়
মৃৎ + ময় = মৃন্ময়
ম্ + ক = ঙ/ং + ক
শম্ + কা = শঙ্কা
সম্ + কীৰ্ণ – সংকীর্ণ
ম্ + খ = ং + খ
সম্ + খ্যা = সংখ্যা
ম্ + গ = +গ
সম্ + গীত = সংগীত
ম্ + ঘ = + ঘ
সম্ + ঘাত = সংঘাত
ম্ + চ = ঞ্চ
সম্ + চয় = সঞ্চয়
ম্ + ত = ন্ত
সম্ + তাপ = সন্তাপ
মৃ + দ = দ
সম্ + দর্শন – সন্দর্শন
ম্ + ধ = ন্ধ
সম্ + ধান = সন্ধান
ম্ + ন = ন্ন
কিম্ + নর = কিন্নর
ম্ + য = ং + য
সম্ + যম = সংযম
ম্ + র = ং + র
সম্ + রক্ষণ = সংরক্ষণ
মৃ + শ = ং + শ
সম্ + শয় = সংশয়
ম্ + হ = হ
সম্ + হার = সংহার
আরও দেখুনঃ