বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলা ভাষার জন্মকথা নিয়ে আজকের আলোচনা। মানুষের মুখে কেমন করে ভাষা এল তা এক অপার রহস্য। কারণ বাঙালির মুখে বাংলা ভাষা যেদিন জন্মেছিল, সে- দিনই তা কেউ লিখে রাখে নি। মানুষের বুক থেকে মানুষের মুখে এসে ধ্বনিত হয়ে আদি বাংলা ভাষা মিশে গেছে। আকাশে-বাতাসে। ‘হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা রূপান্তরিত হয়ে বলীয় অঞ্চলে জন্ম নিয়েছিল এক মধুর-কোমল-বিদ্রোহী প্রাকৃত। তার নাম বাংলা। ওই ভাষাকে কখনো বলা হয়েছে ‘প্রাকৃত’, কখনো বলা হয়েছে। ‘গৌড়ীয় ভাষা’। কখনো বলা হয়েছে ‘বাঙ্গলা’ বা ‘বাঙ্গালা’। এখন বলি ‘বাংলা’।’

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px White বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলা ভাষার জন্মকথা

কোনো সমাজের চালু ভাষাই চিরকাল একরকম থাকে না। পালটে যায় কথা বলার কৌশল, বদলে যায় লেখার পদ্ধতি। এ জন্য ভাষাকে বলা হয়েছে প্রবাহিত নদীর মতো। নদী যেমন প্রবাহিত না থাকলে মরে যায়, নষ্ট হয়ে যায়; ভাষাও চলমান না থাকলে এক সময় হারিয়ে যায়। পৃথিবীর বহু ভাষা হারিয়ে গেছে। আবার কিছু ভাষা টিকে আছে শুধু পুঁথির পাতায়, অতীতের সাক্ষ্য হিসেবে। সে সব ভাষায় কেউ কথা বলে না, এদের বলে মৃত ভাষা। ভাষা চলতে থাকে তার নিজের নিয়মে, সময়ের চাহিদা অনুসারে। ভাষার উপর কোনো জোর-জুলুম চলে না।

এ পৃথিবীতে আসার পর থেকেই মানুষ কথা বলে ভাষার সৃষ্টি করেছে। আদি মানবের যে-ভাষা ছিল তা মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে কালক্রমে বহু ভাষার রূপ পরিগ্রহ করেছে। পৃথিবীর অধিকাংশে সুগঠিত ভাষারই আদি উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে।

 

বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

জেনে অবাক হবার কথা যে, বিশ্বের যাবতীয় ভাষার উৎপত্তি হয়েছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি মূল ভাষাগোষ্ঠী থেকে। তাদের মধ্যে একটি হল ইন্দো-ইউরোপীয়’ বা ‘আদি আর্য ভাষাগোষ্ঠী’। এই ভাষাগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে অনেকগুলো ভাষার। সেগুলোই মূলত বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রচলিত ভাষা।

পণ্ডিতগণ বিশ্বের প্রচলিত এবং গুস্ত ভাষাগুলোর ইতিহাস বিচার করে তাদের বেশ কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। প্রতিটি শ্রেণিতে অনেকগুলো ভাষা এদের বলে ভাষা বংশ বা ভাষাগোষ্ঠী। এমনই একটি ভাষা-গোষ্ঠীর নাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠী। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মধ্য এশিয়ায় এ ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল বলে পণ্ডিতদের ধারণা। যা হোক, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ আবার প্রধান আটটি শাখায় বিভক্ত।

এরা হল গ্রিক, ইতালি, কেশাটিক, জার্মানিত, আর্য (ইন্দো-ইরানীয়), বাটোরাধিক, আর্মেনীয় এবং আলবানীয়। এর মধ্যে প্রথম চারটি পশ্চিমাংশের তার (মুলত ইউরোপীয়) যার নাম ‘কেতন’ (Centum) এবং পরের চারটি পূর্বাংশের ভাগ মূেলত এশীয়া যার নাম ‘সতম’ (Satem)) ‘শত’ বা ‘একশত’ সংখ্যাটির উচ্চারণই এ নাম দুটোর উৎস। এদের মধ্যে জার্মানিক শাখার বিবর্তনে ইংরেজি ভাষার জন্ম। আর আর্য শাখার দুটি প্রধান ভাগ হল ইরানীয় ও ভারতীয় আর্য (যার থেকে সংস্কৃত ভাষা এসেছে) ।

বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলত না। বাংলা ভাষার পূর্বেও এদেশে ভাষা ছিল, তবে তা বাংলা ছিল না। এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও বিবর্তনধারা। আমরা জেনেছি ভাষার ধর্মই পালটে যাওয়া। এ ভূখণ্ডের ভাষাও অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের বাংলা ভাষা হয়েছে। খুবই মাজার সে সব ইতিহাস ।

খ্রিস্টপূর্ব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়ায় একদল লোক বাস করত। তারা প্রথম যে ভাষা ব্যবহার করেছিল তার নাম ‘ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষা। পরবর্তীকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের পক্ষে একস্থানে বসবাস করা আর সম্ভব হয় নি, তখন তারা ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শাখাগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পাড়ায় বিভিন্ন শাখার ভাষার মধ্যে ভাষাগত পরিবর্তন দেখা দেয়।

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর একদল ভারতে প্রবেশ করে। তাদের ভাষা ‘আর্য’ (noble) ভাষারূপে পরিচিত ছিল। তারা পেছনে আর একটি দল রেখে আসেন, যারা ইরান ও মধ্য-এশিয়ায় বসবাস শুরু করেন। ইরানীয় ও ভারতীয় আর্য একত্রে ইন্দো-ইরানীয় ভাষা নামে পরিচিত। ইন্দো-ইরানীয় ভাষার প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায় ঋক বেদে (১২০০-১১০০ খ্রিস্টপূর্বে রচিত)। এ সময় থেকেই ভাষা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

আর্যগণ মুখে মুখে রচনা করেছিলেন বহু গল্প, তাদের কথিত দেবতাদের উদ্দেশে বহু প্রশংসা স্মৃতি। বংশানুক্রমে তাঁরা মুখস্ত রাখতেন এসব। এগুলোকে বলে “শ্রুতি”। এ সমস্ত প্রতি সাহিত্যের প্রধান প্রস্থিত রূপ ঋক্ বেদ, যাকে তারা খুবই পবিত্র মনে করতেন। পণ্ডিতদের অনুমান, এ ঋক্ বেদ বা পরবর্তীকালের। ‘সাম’, ‘যজুঃ’ প্রভৃতি বেদ খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ অব্দের রচনা, যদিও পরে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে এসব গ্রন্থের। বেদ যে ভাষায় লেখা হয়েছিল তার নাম বৈদিক ভাষা। আর্যভাষাও বলা হয় তাকে।

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকেই আর্যরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ভারতবর্ষে আসতে শুরু করে। সঙ্গে ছিল। তাদের শক্তিশালী বৈদিক ভাষা ও দেবগীতিমূলক সাহিত্য। ধীরে ধীরে তাঁরা ভারতবর্ষের বহুস্থানে ছড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় অনার্য অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি আত্মসাৎ করে তারা একদিন আর্যভাষার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেন। কালক্রমে ভারতে বসবাসকারী আর্যদের ভাষা জলবায়ুগত প্রভাবে, অনার্য ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রণের ফলে এক ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করল। প্রয়োজন হল বৈদিক ভাষার সৎকার।

মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকেই চেষ্টা শুরু হয়ে গেল। ভাষাশাসনের। সর্বজনগ্রাহ্য একটা রূপ তৈরি হতে থাকল। এরপর পাণিনি নামে একজন ব্যাকরণবিদ (তিনি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ব্যাকরণবিদ) খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে তাঁর অষ্টাধ্যায়ী’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে এলোমেলো ভাষাগুচ্ছকে সংস্কার করে সর্বভারতীয় একটা সুস্থির রূপ দান করলেন। সেই থেকে এ ভাষার নাম হল সংস্কৃত ভাষা । ‘সংস্কৃত’ কথাটার মানে যার সংস্কার করা হয়েছে, যাকে শুদ্ধ করা হয়েছে। সংস্কারজাত নতুন ভাষাই হল সংস্কৃত ভাষা।

কিন্তু এ ভাষা তথাকথিত বিদায় ও অভিজাত শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল। কিন্তু লোকের মুখের ভাষাকে তো আর শাসন করা যায় নি। সাধারণের বোধগম্য ভাষা উপেক্ষা করে কার সাধ্য। তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন রূপে অগ্রসর হতে লাগল। এসকল ভাষাকে বলা হয় আদিম প্রাকৃত ভাষা বা মধ্যভারতীয় আর্য ভাষা। ‘প্রাকৃত’ বা ‘প্রাকৃত ভাষা’ কথাটির তাৎপর্য হল প্রকৃতির অর্থাৎ জনগণের কথা ও বোধ্য ভাষা। পালিভাষা, যে ভাষায় বৌদ্ধদের বহু ধর্মীয় পুস্তক লিখিত, এ সময়েরই একটি পর্যায়ে উদ্ভূত।

পরবর্তীকালে এই ‘প্রাকৃত’ ভাষাই ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রভাবে, কথা ভাষার উচ্চারণের বিভিন্নতা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করল। এই “প্রাকৃত ভাষাই আঞ্চলিক বিভিন্নতা নিয়ে বিভিন্ন নামে চিহ্নিত হল। যেমন, ‘মাগধি প্রাকৃত’, ‘মাহারাদি প্রাকৃতা ‘শৌরসেনি প্রাকৃত’, ‘পৈশাচি প্রাকৃত’ ইত্যাদি। মাগধী প্রাকৃতের অপভ্রংশ বো অবহট্ঠ অর্থাৎ যা খুব বিকৃত হয়ে গেছে) থেকেই কালক্রমে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উৎপত্তি লাভ করে বাংলা ভাষা।

 

oe বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

 

উনিশ শতকে বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে কারোরই কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বিভিন্ন সম্পর্কিত ভাষার সঙ্গে বাংলার সম্পর্কের সূত্রও উদ্ঘাটিত হতে শুরু করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে একজন বিদেশি পণ্ডিত জর্জ প্রিয়ার্সন তার একটি প্রবন্ধে প্রথম বলেন, ‘মাগধী প্রাকৃত” নামক একটি ভারতীয়, উপভাষার পূর্বাঞ্চলীয় বিশেষ এক রূপ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। তাঁর এই কথার পর আমাদের দেশের পণ্ডিতগণ নড়েচড়ে বসলেন। শুরু হয়ে গেল ব্যাপক অনুসন্ধান।

বিশ শতকের প্রথম দশকে বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে। কাঠামোবিষয়ক বিতর্ক বাংলা ভাষার উদ্ভব বিষয়ক ধারণার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে সংস্কৃত পন্থীরা সংস্কৃত উৎসে বিশ্বাসী থাকে, কিন্তু বাংলা পন্থীরা বিশ্বাসী হয় প্রাকৃতের বিবর্তনে। পুরাতন পণ্ডিতদের ধারণা ছিল সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেল তাঁদের অনুমান ঠিক নয়।

বাংলা ভাষার উৎপত্তি অন্যভাবে। নতুন অনুসন্ধানে জানা গেল বাংলা ভাষার জন্ম আজ থেকে হাজার বছর আগে, খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতাব্দীতে। সংস্কৃত ভাষার পূর্বে যে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা এ বঙ্গীয় ভূখণ্ডে চালু ছিল তার কথা রূপসমূহ মানুষের মুখে মুখে বহু বছরের গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষার জন্ম।

বিশ শতকের নবম বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। একজন অমর হয়ে গেছেন আদি বাংলা ভাষা আবিষ্কার করে। তিনি হলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি সেই ভাগ্যবান যার চোখ প্রথম দেখেছিল প্রথম যুগের বাংলা ভাষার মুখ। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারে সন্ধান পান তিনটি পুথির আর ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিষণ্ণত বাঁকুড়া- বিষ্ণুপুরের এক গোয়ালঘরে সন্ধান পান একটি পুঁথির।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কার একত্রে প্রকাশিত হয় ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ  গান ও দোহা’ (১৯১৬- ১৩২৩) নামে। এর একটির নাম ‘চর্যাশ্চর্য বিনিশ্চয়’ যার মূল নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষ”। পরবর্তীতে এটাই ‘চর্যাপদ’ নামে প্রচলিত হয়। আর বসন্তরঞ্জনের আবিষ্কার প্রকাশিত হয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ (১৯১৬) ১৩২৩) নামে বৰ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে।

 

Capture11 বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

 

Capture12 বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

 

 

এ-দুটি গ্রন্থ প্রকাশের পর সূচিত হয় বাংলা ভাষার ইতিহাস সন্ধানের যুগ — বিজয়চন্দ্র মজুমদার (১৯২০), সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২৬), সুকুমার সেন (১৯৩২), মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৬৬) প্রমুখের অনুসন্ধান ও গবেষণা। ওই গ্রন্থ দুটির রচনাকাল নির্ণয় ও ভাষার বৈশিষ্ট্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে রচিত হয় বিপুল পরিমাণ প্রবাশ এবং বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ধারণা যচ্ছ হয়ে ওঠে অনেকখানি।

এ উদ্যোগের শ্রেষ্ঠ ফল সুনীতিকুমার  চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত ‘দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৯২৬)। তাকেই পণা করতে হয় বাংলা ভাষার প্রধান ঐতিহাসিকরূপে। বস্তুবিষয় আলোচনা করে প্রশ্নের বিরাশি পাতায় সুনীতিকুমার উপনীত হন এ সিদ্ধান্তে। ইন্দো-আর্যভাষা, মধ্যভারতীয় আর্য ভাষা স্তরের প্রথম পর্যারো, বাংলায় আগমনের এক হাজার বছরের মধ্যে (খ্রি.পূ. 800- খ্রি. ১০০) রূপান্তরিত হয় বাংলা ভাষায়। তিনি মাগধি অপভ্রংশকে মেনে নেন বাংলার উৎস-ভাষা হিসেবে এবং এ গোত্রে বিন্যস্ত করেন অসমিয়া, শুড়িয়া, মাগধি, মৈথিলি, ভোজপুরিয়াকে। তিনি বাংলা ভাষার গঠনকাল হিসেবে নির্দেশ করেন ৭০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ, আদি বাংলা যুগ হিসেবে নির্দেশ করেন। ১৫০-১২০০ অব্দকে, মধ্য বাংলা যুগ হিসেবে নির্দেশ করেন ১২০০-১৮০০ এবং এর পরের সময় আধুনিক যুগ।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

সুনীতিকুমারের পরেই বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে ধার মত মূল্য পেয়ে থাকে তিনি হলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৬৩)। তিনি মনে করেন ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে, অর্থাৎ সপ্তম শতকে, গৌড়ি প্রাকৃত থেকে জন্ম নিয়েছিল আধুনিকতম প্রাকৃত বাংলা ভাষার।

তাহলে দেখা গেল বাংলা ভাষার উৎপত্তি সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে হয় নি। তবে বংশানুক্রমে মানুষে মানুষে যে আত্মীয়তা থাকে, বাংলা ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত বা অন্যান্য ভারতীয় ভাষা যথা- হিন্দি, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, সিদ্ধি প্রভৃতির সে রকম সম্পর্ক। বাংলা ভাষা যেহেতু একটি সঙ্গীর প্রবাহ, তাই দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে এর জন্যসময় বলা অসম্ভব। এ ব্যাপারে বিভিন্ন পণ্ডিত গবেষক শুধু অনুমানই করেছেন, নিশ্চিত হতে পারেন নি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন দশ শতকে ১০০ থেকে ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে, মাগধি অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন খ্রিস্টীয় সাত শতকে, ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে, গৌড়ি অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। প্রথম থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়ের বাংলা ভাষাকে প্রধানত তিন যুগে ভাগ করা হয়। যেমন:

১। প্রাচীন যুগ

৬৫০ (মতান্তরে ১৫০) থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত।

২। মধ্যযুগ

১২০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত।

৩। আধুনিক যুগ

১৮০০ থেকে বর্তমান পর্যন্ত।

 

এর মধ্যে ১২০১ থেকে ১৩৫০ সাল পর্যন্ত কালকে সন্ধিযুগ বা অন্যকার যুগ ধরা হয়। তবে বর্তমান গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে এ যুগ অন্ধকার যুগ নয়।

 

প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে বাংলা ভাষার কালক্রম ও নিদর্শন•

প্রাচীন বাংলা

১০ম থেকে ১৩৫০ শতক।

নিদর্শন : চর্যাপদ বা বৌদ্ধগান ও দোহা।

মধ্যযুগ

১৩৫০ থেকে ১৮ শতক

নিদর্শন : শ্রীকৃষ্ণকীর্তন— বড়ুচণ্ডীদাস, ১৪ শতক, শ্ৰীকৃষ্ণবিজয় — মালাধর বসু,

১৫ শতক: রামায়ণ— কৃত্তিবাস, ১৫ শতক, মনসাবিজয়— বিপ্রদাস পিপিলাই, ১৫

আদি-মধ্যযুগের বাংলা

১৩৫০ থেকে ১৫ শতক।

নিদর্শন :  শতক, চণ্ডীমঙ্গল— মানিক দত্ত, ১৫ শতক, ইউসুফ জোলেখা— শাহ মুহম্মদ সগীর, আনুমানিক ১৫ শতক, পদ্মাপুরাণ (মনসামঙ্গল) বিজয়গুপ্ত, ১৫ শতক। নিদর্শন : চণ্ডীমঙ্গল— মুকন্দরাম চক্রবর্তী, ১৬ শতক; লাইলী মজনু দৌলত উজির বাহরাম খান, ১৬ শতক, পদ্মাবতী- আলাওল, ১৭ শতক; সতীময়না ও

অন্ত্য মধ্যযুগের বাংলা

১৬ শতক থেকে ১৮ শতক

লোরচন্দ্রাণী— দৌলত কাজী, ১৭ শতক, মহাভারত— কাশীরাম দাস, ১৭ শতক

অনুদামান ভারতচন্দ্র, ১৮ শতক।

আধুনিক যুগের বাংলা

১৯ শতক থেকে বর্তমান।

 

Capture13 বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

কবি কাহ্নপাদের ছবি।  চর্যাপদের কবিদের মধ্যে তাঁর নামডাকই বেশি ছিল।

 

Capture14 বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

কবি ভুসুকুপাদের ছবি।  তিনি তাঁর নিজের কবিতায় জানিয়েছেন তিনি বাঙালি।

 

পন্ডিতগণ বাংলাভাষার যুগ বিভাজন করেছেন ভাষার বৈশিষ্ট্য অনুসারে। চর্যাপদ যে ভাষায় লেখা সে আদিযুগের বাংলা আজ আমরা পড়ে বুঝতে পারি না। সে এক আলো-আধারি জড়ানো বাংলা। শাস্ত্রী মহাশয় নিজেই একে বলেছেন সান্ধ্যভাষা। সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ বা গানের এ সংকলনে যাঁদের কবিতা বা গান রয়েছে তাঁদের নামগুলো একটু অদ্ভূত এবং পণ্ডিতগণ মনে করেন অনেক নামই ছদ্মনাম : কাহ্নপা, লুইপা, কুক্কুরীপা, বিরুআপা, গুড্ডরীপা, ভুসুকুপা, সরহপা, শবরপা প্রভৃতি। এঁদের সিদ্ধাচার্যও বলা হয়। ‘চর্যা’ শব্দের অর্থ আচরণ। চর্যাপদের গানে বা কবিতায় মূলত রহস্যময় বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনতত্ত্ব রূপকের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। দু-এক জায়গায় তৎকালীন সমাজের কিছু ছবি, বাঙালির চিরায়ত দুঃখ-দারিদ্র্যের ছবিও পাওয়া যায়। যেমন ঢেন্টনপাদ লিখেছেন-

‘টালত ঘর মোর নাহি পড়িবেষী।

হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী ॥

বেঙ্গ সংসার বড়হিল যায়।

দুহিল দুধু কি বেন্টে সামায়’

 

—অর্থাৎ, পাহাড়ের টিলায় আমার ঘর, কোনো প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই, কিন্তু নিত্যই অতিথি আসে। দিন দিন ব্যাঙের সংসার বেড়েই চলেছে। কী দুঃখ, দোয়ানো দুধও পুনরায় বাঁটের মধ্যে চলে যায়।

সাহিত্যগুণেও চর্যাপদগুলো অনন্য সৃষ্টি। রূপক এবং চিত্রকল্পের সাহায্যে চর্যাপদ কর্তারা এমন কিছু ছবি নির্মাণ করেছেন, যার সাহিত্যমূল্য- সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। শবরপাদের একটি চর্যায়

আমরা এমন একটি অপূর্ব ছবি লক্ষ করি—

‘উঞ্চা উষ্ণা পাবত তহি বসই শবরী বালী

মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরহিন সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী ॥’

—অর্থাৎ, উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে শবর বালিকার বাস। সে ময়ূরের পুচ্ছ পরিধান করে, গলায় দিয়েছে গুঞ্জার মালা।

এমন আরও নানা ছবি চর্যাপদে পাওয়া যায়। যা হোক, খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যে এ চর্যাগীতিগুলো রচিত হয়েছিল বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন। হাজার বছরের বাঙালির সৃষ্টিশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত বৌদ্ধ চর্যাপদ। এগুলো আমাদের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার।

আদিযুগের তুলনায় মধ্যযুগের বিস্তৃতি অনেকটা বেশি। ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তবে ১২০০ থেকে ১৩৫০, আনুমানিক এই দেড় শ বছরের বাংলা ভাষার কোনো নিদর্শন পাওয়া না গেলেও ত্রয়োদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দের ইংরেজ শাসন স্থায়ীকরণ পর্যন্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এ যুগ অনেকভাবে অর্থবহ। ইতিহাসের পর্বে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে বিদেশি শাসনের অধীনে থেকেছে প্রথমে তুরকি, তারপরে আফগানসহ আফ্রো-এশীয়। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি এবং মুঘল। এ সমস্ত শাসনের প্রভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে প্রচুর ফারসি, আরবি, ভুরকিসহ বিভিন্ন শব্দ এবং বাগবিধি। বাংলা ভাষা হয় সমৃদ্ধ। বাংলা সাহিত্যেরও বিকাশ ঘটে সরাসরি রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায়। স্বাধীন সুলতানদের অনেকেই এ ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন।

মধ্যযুগের আদি নিদর্শন চতুর্দশ শতাব্দের শেষ দিকে রচিত বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। রাধা ও কৃষ্ণের লৌকিক প্রণয়-কাহিনীমূলক বিভিন্ন ছন্দ ও রাগ-রাগিনীযুক্ত এটি একটি গীতিনাট্য । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত লোকসাহিত্য এবং কথকতারই লেখা রূপ। এর ভাষা থেকে বোঝা যায় এর আগে মুখে মুখে বাংলা ভাষা শব্দে সমৃদ্ধি ও বিকাশে স্বাচ্ছন্দা লাভ করেছে।

১২০৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীধর দাশ কর্তৃক সংকলিত সংস্কৃত ভাষায় ‘সদুক্তি কর্ণামৃত’ নামক গ্রন্থে বাংলা ভাষার প্রশংসাসূচক একটি শ্লোক রয়েছে। বাঙালি এক কবির রচনা সেটি। শ্লোকটি এই—

‘ঘন রসময়ী গভীরা বঙ্কিম সুভগোপঞ্জীবিতা কবিডি ।

অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বাঙ্গালবাণী চ ॥’

 

সরল বাংলায় এর ভাবার্থ- বাংলা ঘনরসময়ী, গভীর এবং মনোহর। কবিগণ এর সুধা উপভোগ করেন। গঙ্গায় স্নান করলে যেমন পুণ্য লাভ হয়, বাংলা ভাষায় অবগাহন (চর্চা) করলেও সেরূপ পুণ্য লাভ হয়।

মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলি, মক্কাল কাব্য, অনুবাদ কাবা, আরবি-ফারসি-বাংলা শব্দের মিশ্র রূপে লেখা রোমান্টিক প্রণয়-উপাখ্যান, সুলতান নবাবদের প্রশংসাসূচক দরবারি সাহিত্য, পাঁচালি প্রভৃতি বিভিন্ন শাখায় বাংলা কাব্য সমৃদ্ধ হয়। বিশেষ করে শ্রীচৈতন্য দেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবের ফলে এবং তাঁকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন প্রকরণে বাংলা ভাষার বিশেষ উৎকর্ষ ঘটে। মধ্যযুগে আরবি-ফারসি শব্দের কাব্যিক প্রয়োগে বাংলা ভাষা বিশেষ বৈচিত্র্যও লাভ করে। এ সময়ে আরও একটা ঘটনা হল বৈষ্ণব পদাবলির ভাষা। বাংলার হয়ে ওঠা পর্বের অবহট্ঠ ও বাংলার আত্মীয় মিথিলা (মৈথিল) ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছিল এ স্বতন্ত্র ও কৃত্রিম কাব্য ভাষা যার নাম ব্রজবুলি।

এ যুগের লিখিত সাহিত্যের বাংলা ভাষার প্রথম নমুনা দেখা যাক বৈষ্ণব পদাবলি থেকেই :

‘সখি হমারি দুখক (দুঃখের নাহি ওর (সীমা)

এ ভরা বাদর মাহ (মাস) ভাদর

শূন্য মন্দির মোর।’

 

রচনাটি ওই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতির। দ্বিতীয় নমুনাটি মধ্যযুগের শেষ গুরুত্বপূর্ণ কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় এর শ্রেষ্ঠ রচনা ‘অন্নদামকাল’ কাব্য থেকে, কবি তাঁর রচনার ভাষা সম্পর্কে বলেছেন :

“না রবে প্রসাদগুণ না হবে রসাল

অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।

প্রাচীন পণ্ডিতগণ গিয়াছেন কয়ে

যে হৌক সে হৌক ভাষা কাবারস লয়ে ।”

 

মধ্যযুগের শেষ পর্বে ভাষার নমুনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি বাংলা ভাষা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ আমরা অনুমান করতে পারি বাংলা ভাষা আধুনিক হয়ে ওঠার প্রায় চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গেছে এ সময়ে।

বাংলা ভাষার আধুনিক যুগের লক্ষণ ফুটে ওঠে উনিশ শতকের প্রথমেই, বাংলা গদ্যের ব্যবহারে। প্রাচীন কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত আমাদের ভাষার যে সব নিদর্শন পেয়েছি তা প্রায় সবই কাব্য। প্রায়ই বলছি এ কারণে যে ষোড়শ শতক থেকে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত কিছু দলিল, চিঠি-পত্রে, বৈষ্ণব শাস্ত্রীয় রচনা ‘কড়চা’ প্রভৃতিতে বাংলা গদ্যের নমুনা পাওয়া যায়। আমরা কথা বলি গদ্যেই। এবং বাংলা ভাষার আধুনিকতা গদ্য রূপকে কেন্দ্র করেই। তাই বাংলা ভাষার ইতিহাস আলোচনায় বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের রূপটি খুব সংক্ষেপে দেখে নেয়া যাক।

 

বাংলা ভাষার জন্মকথা | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment