বাংলা ভাষারীতির বিবর্তন

বাংলা ভাষারীতির বিবর্তন নিয়ে আজকের আলোচনা – বিষয়ে আজকের আলোচনা। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিষয়ের “বাংলা ভাষা” বিভাগের একটি পাঠ।

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px White বাংলা ভাষারীতির বিবর্তন

বাংলা ভাষারীতির বিবর্তন

বাংলা ভাষারীতির ইতিহাস জানতে হলে বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকা দরকার। বাংলা সাহিত্যের আদি ও মধ্যযুগের সাহিত্য রচিত হতো কবিতায়। বাঙালিরা গদ্যে কথা বললেও সাহিত্যের জন্যে দীর্ঘদিন কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিল।

বাংলা গদ্যের উদ্ভব মধ্য ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে পর্তুগিজ ও ইংরেজ খ্রিস্টান মিশনারির হাতে। তবে আগে বাংলা গদ্য ছিল না এমন কথা বলা যায় না। দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহৃত মুখের ভাষা ছিল গদ্যাশ্রয়ী। তাছাড়া চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজে বাংলা গদ্য ব্যবহৃত হত। যেমন :

[ক] “এথা আমার কুশল তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্ছা করি অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত রহে।

[খ] “আমরা সপরিবারে অন্নারণ উপস্থিত ক্রেমে নগদ মূল্য তোমার স্থানে এপার রূপাইয়া পাইয়া মইচ্ছা পূৰ্ব্বক আত বিক্রি হইলাম তোমার পুত্র পৌত্র আদি ক্রেমে আমার পুত্র পৌত্র আদি রুেমে গোলামি করিব এহি করারে আস্ত বিক্রয় পত্র দিলাম।

লক্ষণীয় যে, এসব দলিল-দস্তাবেজ, চিঠিপত্রের গদ্য ছিল অনেকাংশে সাধুরীতির।

সতেরো শতক থেকে বাংলা ভাষা বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতির সংস্পর্শে আসে। খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও ইংরেজ রাজকর্মচারীদের এদেশীয় ভাষা শেখানোর তাগিদে বাংলা গদ্যে গ্রন্থ রচনা করেন পর্তুগিজ ও ইংরেজ খ্রিস্টান মিশনারি মানোএল দা আসসুম্পসাঁও, দোম আন্তোনিও, উইলিয়াম কেরি প্রমুখ কতিপয় ব্যক্তি। ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের লিসবন শহরে মুদ্রিত হয় বাংলা গদ্য: রোমান বর্ণমালায় তিনটি বাংলা বই। এর প্রথমটি ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’, লেখক ধর্মান্তরিত বাঙালি খ্রিস্টান দোম আন্তোনিও। অন্য দুটি পর্তুগিজ পাদরি মানোএল দা আসা- এর ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ এবং ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেনগল্লা ই পর্তুগিজ।

বাংলা ভাষারীতির বিবর্তন | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

আস্সুম্পসাঁও রচিত বাংলা গদ্যের নমুনা:

“সেই শহরে অনেক বেপারী বেপার করিত এক দিন একটা বেপারী জিনিষ কিনিয়া আপনের দেশে যাইতে চাহিত আর বেপারীর ঠায় কহিত এহি দেশে অনেক ডাকাইত আছে, এ কারণে আমারে বিদাএ দিও আমি রাইত্রে থাকিতেজাইব।’

 

আন্তোনিওর ‘রামায়ন কাহিনীর’ গদ্যের নমুনা:

“রামের এক স্ত্রী, তাহার নাম সীতা, আর দুই পুত্রো, লব আর কুশ। তাহান ভাই লকোন। রাজা অযোধ্যা বাপের সত্যো পালিতে বোনবাসী হইয়া ছিলেন। তাহাতে তাহান স্ত্রীরে রাবোনে ধরিয়া লিয়াছিলেন ।’

 

উইলিয়াম কেরি রচিত বাংলা গদ্যের নমুনা:

(ক) পরে আর সাতটা গাভী উঠিল নদী হইতে বড় কুচ্ছিত ও কৃষ্ণা পরে নদীতীরে দণ্ডাইল আর সকল গাভীর কাছে, অতঃপর কুচ্ছিত কৃষা খাইয়া ফেলাইল সেই সাতটা সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট গাভীরদিগকে।’

(খ) ‘সে দিনে য়েশু ঘর হইতে যাইয়া সমুদ্রের তিরে। এবং তিনি হিত উপদেশ কহিলেন অনেক বিষয়তাহাদিগের বলিয়া…।’

১৮০১ সালে প্রকাশিত হয় রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’, এবং এ সঙ্গে সত্যিকার অর্থে শুরু হল বাংলাগদ্যের জয়যাত্রা।

বাংলা গদ্যের ইতিহাস মূলত ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হলেও ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (Fort William College) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা গদ্যরীতি’র ধারাবাহিক প্রয়োগ ও প্রচলন শুরু হয়। পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনে উইলিয়াম কেরি ও তাঁর সহকর্মী বাঙালি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা গ্রন্থ রচনা করেন বাংলা গদ্যে। ফলে ভাষার যেটুকু লৌকিক বা কথারূপ ছিল তা বর্ণিত হয়ে সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগবাহুলা ভাষাকে গুরুভার ও কৃত্রিম করে ফেলে। গদ্যের এই আড়ষ্টতা সত্ত্বেও সাধু ভাষারীতির আদর্শ বা standard অনেক গঠিত হয়। কারণ সাধুজনের মধ্যে ব্যবহৃত সংস্কৃত ভাষার ওপর নির্ভর করে লিখিত বাংলা গদ্য ভাষারীতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়।

 

একটি উদাহরণ লক্ষ করা যাক– 

‘দণ্ডকারণ্যে প্রাচীন নদীতীরে বহু কালাবধি এক তপনী তপস্যা করেন বিবিধ কৃষ্ণসাধ্য তপঃ করিয়াও তা হন না।’

উপরের উদাহরণে শুধু সংস্কৃত শব্দরাধানাই না, সম্মি-সমাসবার দীর্ঘ, পদবিন্যাস রীতির অনুসরণ, সেই সঙ্গে বাক্যান্বয়ের ত্রুটি, ছেনবিধির অভাব বাংলা গদ্যের standard বা আদর্শ গড়তে ব্যর্থ হয়েছিল। পরে রামমোহন রায়ের বেদান্ত প্রমাদি বাংলা গদ্যের মান্যরূপ গড়তে না পারলেও দিক নির্দেশ করেছিল। যেমন :

‘সন্নাস করিবেক অতএব সন্ত্রাস করণের বিধি ইহার দ্বারা পায়া জাইতেছে তাহার উত্তর এই যে এ বিধি অপূর্ব বিধিনহে কেবা অলস বারির জন্যে এমত কখন আছে।’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে ছেদবিধিযুক্ত সার্থক বাক্যানুয়ী গুণে ভূষিত করে মানা বা আদর্শ গদ্যে উন্নত করেন। বিদ্যাসাগর এই কাচা ভাষার চেহারায় শ্রী ফুটিয়ে তুললেন। আমার মনে হয় তখন থেকে বাংলা গদ্য ভাষাররূপের আবির্ভাব হল।

তাই, বাংলা গদ্যের লিখিত রূপ ও রীতির ইতিহাস অতি অল্প সময়ের। এ অতি অসময়ের মধ্যেই বাংলা গদ্য নাটিকউপন্যাস, ছোটগল, প্রবন্ধ প্রভৃতি বিষয়-বৈচিত্র্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

হাজার বছরের বাংলা কাব্যের ধারায় যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি গুণ সমৃদ্ধ হয়েছে গত একশো বছরের বাংলা গদ্য-রীতির ধারা। এখানে লক্ষনীয় বিষয়, বাংলা গদ্যের বিকাশের প্রথম দিকে গদ্যের একটা বিশেষ রূপ সাহিত্যে ব্যবহূত হয়েছে। তার নাম সাধু রীতি। এখনকার মতো তখনও বাঙালিরা মুখের কথা (কথা-রীতি) একই ভাবে বলেছে, কিন্তু সাহিত্যের ভাষা ছিল আলাদা। অর্থাৎ, সাহিত্যের ভাষার জন্যে কৃত্রিম সাধু রীতি তৈরি করে সাহিত্যে প্রয়োগ করা হয়েছে। তখন লেখকগণের ধারণা ছিল সাহিত্যের ভাষা দৈনন্দিন মুখের ভাষা থেকে পৃথক হবে এবং তা হবে ভাষার মার্জিত রূপ। ফলে বাংলা ভাষার হয়ে যায় দুটি রূপ একটি সাহিত্যের জন্যে এবং অপরটি মুখের কথার জন্যে।

মুখের ভাষা আর সাহিত্যের ভাষার এই পার্থক্য থাকার জন্যে সাহিত্যের ভাষাকে কৃত্রিম বলে বিবেচনা করা হয়। সাহিত্যের ভাষা থেকে এই কৃত্রিমতা দূর করে মুখের ভাষার কাছাকাছি এনে ভাষাকে বাস্তবভিত্তিক করার জন্যে সাহিত্যে মুখের ভাষা বা কথা রীতির ব্যবহার শুরু হয় এবং বর্তমান কালে এই কথ্য রীতিই সাহিত্যে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছেন,

‘বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির প্রয়োজনে উদ্ভূত হয়েছিল দু’টি মান ভাষারীতি সাধু ও চলিত। দুটিই সাধন করেছে, উপকার। তবে এ-দুটি সৃষ্টি করেছে দীর্ঘকালব্যাপী দ্বিভাষিক পরিস্থিতি। সাধুরীতিটি যেহেতু জীবনের সমস্ত দায়িত্ব পালনে সমর্থ নয়, তাই এটির বিনাশের বীজ ছিল এর অভ্যন্তরেই। সমস্ত দায়িত্ব পালনদক্ষ চলতি রীতির রয়েছে টিকে থাকার শক্তি। এখন সাধুরীতি অবলুপ্তির প্রান্তে এসে উপনীত, গুতে হয়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষার, দ্বিরীতিক পরিস্থিতি। এটা শোকাবহ মনে হ’তে পারে প্রথাগতদের কাছে, কিন্তু এর বিদয় এত অবধারিত যে বিশ শতকেই একে আশ্রয় নিতে হবে স্মৃতিশিলাপট খচিত ‘ঐতিহাসিক কবরস্থানে।’

তবে বাংলা ভাষা থেকে সাধু ভাষা একেবারে বিদায় নেবে, এমনটি বলা যায় না। কেননা, চলিত ভাষার রূপ-বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার জনো সাধু ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখাও অবধারিত; যতদিন না চলিত ভাষাকে বাংলা ভাষার অন্য কোনো ভাষারীতির সঙ্গে তুলনা করা যাচ্ছে। সুতরাং, আলো এবং অন্ধকারের মতো চলিত ও সাধু ভাষার কোনোটিকেই বাদ, দেয়া যাচ্ছে না। যদিও বাংলা ভাষায় সাধু ভাষা একেবারেই অচল হয়ে পড়েছে, তবু অচল অবস্থায়ই শুধু চলিত ভাষার জন্যে সাধু ভাষাকে বেঁচে থাকতে হবে। তাছাড়া সাধু ভাষায় রচিত লৈখিক সাহিত্যের এক বিরাট ভাণ্ডার পেয়েছি আমরা যার ব্যবহার করাতে হলে আমাদের সাধু ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। প্রসঙ্গত জ্যোতিভূষণ চাকী তাঁর “বাংলা ভাষার ব্যাকরণ গ্রন্থে বলেছেন—

‘সাধু ও চলিত ভাষা যার যার ক্ষেত্রে অটল হয়ে আছে। যে-কোনও একটিকে বর্জন করা হবে আমাদের শক্তির নির্বাসন।”

 

বাংলা ভাষারীতির বিবর্তন | বাংলা ভাষা | ভাষা ও শিক্ষা

 

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment