বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার , ভূমিকা : বিশ্বের প্রত্যেক জাতির নিজস্ব একটা ভাষা আছে, যা তার মাতৃভাষা । আমাদের মাতৃভাষা বাংলা । মাতৃভাষার ভাবধারার ভেতর দিয়েই মানুষের মানসিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। মাতৃভাষার সুললিত মধুর বাণী বিনিময়ের ভেতর দিয়েই মানুষ মনের ভাব প্রকাশে তৃপ্তি পায়। উন্নত দেশগুলো মাতৃভাষাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়, মাতৃভাষার মাধ্যমেই তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যসহ সবকিছুর চর্চা চর্যা হয় বলেই তারা উন্নত ।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা | ভাষা ও সাহিত্য | বাংলা রচনা সম্ভার
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা
মাতৃভাষা ব্যতিরেকে জ্ঞান চর্চা অনেকটা দায়ে পড়ে শেখার ব্যাপার । তাই সহজে কিছু আয়ত্তে আসে না, তা দিয়ে সমৃদ্ধি ও গৌরব অর্জিতও হয় না। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, ‘আমরা যে পরিমাণ শিক্ষা পাই সেই পরিমাণে বিদ্যা পাই না। ইংরেজি ভাষার অবগুণ্ঠিত বিদ্যা আমাদের মনের সহবর্তিনী হতে পারে। আপন ভাষাকে অনুশীলনে, সৃষ্টিতে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর বড় বড় জাতি জ্ঞানে গৌরবে ভাস্বর হতে পেরেছে। মাতৃভাষা ভিন্ন বড় হওয়া যায় না, মাইকেল মধুসূদন তার জ্বলন্ত প্রমাণ ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পরই বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয় । শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। ইংরেজ শাসনামলে পাক-ভারত উপমহাদেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও প্রসার ঘটলেও আমাদের দেশের ওপর বিজাতীয় ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করাটা এ দেশের মানুষের পক্ষে কঠিন ও প্রায় অসম্ভব ছিল।
তদুপরি এ দেশের মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সাফল্য অর্জন করুক এটাও ইংরেজরা চাইত না। যে নগণ্য সংখ্যক ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করত তাদেরকে মূলত ইংরেজদের প্রয়োজনেই ব্যবহার করা হতো। সুতরাং নানা কারণেই ইংরেজ আমলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় বাংলা ভাষার কোনো সুযোগ ছিল না এবং বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোনো পরিবেশও গড়ে ওঠেনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন বা তার পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থাবলি রচিত হচ্ছে এবং আগ্রহী জনগণ ও শিক্ষার্থীরা তা পাঠ করে বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞানার্জন করছে; তার প্রয়োগেও তৎপর হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সূচনা : বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয়নি এ কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। বহুকাল পূর্ব থেকে স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হয়েছে এবং তার সুফলও পাওয়া গেছে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ভাষা গদ্য নির্ভর। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে গদ্যের চর্চা শুরু হয় এবং তখন থেকেই বাংলা ভাষায় গদ্যে বিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। তার সমৃদ্ধ রচনায় এর সুস্পষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়।
পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা বা বিজ্ঞান চর্চার ধারা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই- খুদা, ড. আবদুল্লাহ-আল মুতী প্রমুখসহ আরো অনেকেই বাংলা ভাষায় জ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ, প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপন করেছেন।
তাদের এসব রচনা ও উপস্থাপন থেকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে থাকে। বিশেষ করে বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা প্রচলিত হওয়ায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ ও মৌলিক রচনার প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচিত হচ্ছে। বাংলা একাডেমী ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও বর্তমান সময়ে অনেক নতুন নতুন লেখক ও প্রকাশক বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা ও বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত প্রকাশ করছেন। বিজ্ঞান বিষয়ক সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে যাতে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা ব্যাপকভাবে প্রসারিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার উপযোগিতা : বাংলা ভাষা অতি অল্প সময়ের সৃষ্ট কোনো ভাষা নয় । এর উৎপত্তি, বিকাশ ও ঐতিহ্য হাজার বছরের। এটি একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে স্বীকৃত এবং পৃথিবীর একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক এ ভাষায় কথা বলে; শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা, এর উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব বলে বিবেচিত হলেও উপযুক্ত যত্ন ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এতদিন তা ফলপ্রসূ হয়ে ওঠেনি। বিজ্ঞানমনস্ক লোক ও উদ্যোগের অভাবও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
বাংলা ভাষায় বিদেশী ভাব ও শব্দ সম্ভার আত্মীকরণের যথেষ্ট উপযোগিতা রয়েছে। তাছাড়া বাংলা ভাষা বিভিন্ন ধরনের বিদেশী শব্দ সমন্বয়ে গঠিত একটি সমৃদ্ধ ভাষা। সুতরাং বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অতীত ও বর্তমান বিশ্বে যে বিজ্ঞান চর্চা হয়েছে বা হচ্ছে তা প্রধানত ইংরেজি ভাষায় এবং চীন, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের নিজ নিজ মাতৃভাষায় । এসব দেশের বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস ও সুফল সম্পর্কে আমরা জানতে পারি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে। কেননা এ দেশে ইংরেজি ছিল শিক্ষার মাধ্যম। রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের বাহনও ছিল ইংরেজি।
ফলে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই এ দেশের বিজ্ঞানীরা বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করেছেন। তাদের আহরিত জ্ঞান ও গবেষণার ফসল তারা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই দেশবাসীকে উপহার দিয়েছেন। বাংলা মাতৃভাষা হলেও তারা বাংলা ভাষায় তাদের জ্ঞান ও গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেননি। ঐ সময় বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র সুপ্রসারিত হতো। বাংলা ভাষাও যে বিজ্ঞান চর্চার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত তার প্রমাণ পাওয়া যেত। কিন্তু ইংরেজির আধিপত্য ও বাংলার চেয়ে ইংরেজি প্রীতির কারণেই তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এটা সত্যিই পরবর্তী প্রজনের জন্য ছিল দুর্ভাগ্যের বিষয়।
সুতরাং বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অপরিহার্যতা উপেক্ষা করা যায় না। ইংরেজি শিখলেই যে বিজ্ঞান চর্চার সার্বিক উন্নয়ন ও অফুরন্ত উৎস উন্মোচিত হবে এ কথা বলা যায় না। কেননা বিশ্বের এমন অনেক দেশে বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন ও নব নব আবিষ্কার হচ্ছে যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয়। ঐসব দেশে বিজ্ঞান চর্চায় তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তারা সাফল্যও অর্জন করছে। সুতরাং আগ্রহী, উদ্যোগী ও আন্তরিক হলে আমাদের বাংলা ভাষায়ও বিজ্ঞান চর্চার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এবং ইতোমধ্যে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এসব নিদর্শন থেকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার উপযোগিতাও প্রমাণিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার অন্তরায় ও তার সমাধান : বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কিছু সমস্যা রয়েছে। বলে অনেকের ধারণা। তারা পরিভাষাগত উপযুক্ত শব্দের অভাবের কথা বলেছেন। ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা হওয়ার কারণে বিজ্ঞান বিষয়ক শব্দাবলী ইংরেজিতেই রূপায়িত হয়েছে। বাংলা ভাষায় তার অনুরূপ শব্দ বা যথার্থ অর্থবোধক শব্দ না পাওয়ার কারণে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে অনেকের কাছে বিরাট সমস্যা। বলে মনে হয়। কিন্তু যদি যথোপযুক্ত পারিভাষিক শব্দ চয়ন করা যায় তাহলে কোনো সমস্যা হয় না।
পরিভাষা তৈরি করা খুব সহজ না হলেও প্রয়োজনের তাগিদে তা তৈরি করা অসম্ভব নয়। এ বিষয়ে বিজ্ঞানমনস্ক ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ যত্নবান ও আন্তরিক হলে বিজ্ঞান বিষয়ক পরিভাষা তৈরি করা যায়। এতদিন প্রয়োজন ছিল না তাই পরিভাষা তৈরি হয়নি। কিন্তু এখন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই পরিভাষাও তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশের স্বার্থে ও বিজ্ঞান চর্চার অগ্রগতির স্বার্থে পরিভাষা সৃষ্টি ও তাদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং এতে যথেষ্ট অগ্রগতিও হয়েছে। পারিভাষিক শব্দ চয়ন বা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। যেমন— শব্দটা যথার্থ কিনা, তা উপযুক্ত ‘অর্থবোধক’ কিনা এবং কতটুকু দুর্বোধ্য বা শ্রুতিকটু। তবে সুশ্রাব্য, অর্থবোধক ও উপযোগী প্রতিশব্দ গ্রহণে কোনো সমস্যা থাকে না।
যেসব ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না সেক্ষেত্রে মূল ইংরেজি শব্দটি রেখে দেয়া যায়। যেহেতু বাংলা ভাষায় ইংরেজিসহ অনেক বিদেশী শব্দ বহুকাল পূর্ব থেকেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে এবং তা বাংলা ভাষার সাথে মিশে গেছে, সময়ের প্রয়োজনে আরো পারিভাষিক শব্দ গৃহীত হচ্ছে, সুতরাং বিজ্ঞান চর্চার স্বার্থে বাংলা ভাষায় আরো কিছু ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটলে এতে ভাষাগত দিক থেকে কোনো জটিলতা সৃষ্টি করবে না । বরং অনুপ্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত রাখা উচিত। এতে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে ।

ভাষা প্রীতি ও অধিক মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার একটি বড় সমস্যা। কেননা বাংলাদেশের অনেক বিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদগণ মাতৃভাষা বাংলা হলেও ইংরেজি ভাষার প্রতি অনুরক্ত। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, গবেষণার ফলাফল কিংবা বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য ইংরেজি ভাষায় উপস্থাপন ও প্রচার করেন। যদি তারা তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল ও যে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বাংলা ভাষায় উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করতেন তাহলে বিজ্ঞান চর্চার সমস্যা বহুকাল আগে থেকেই দূর হয়ে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন হতো।
এক শ্রেণীর শিক্ষার্থী রয়েছে যারা ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণকে অধিক মর্যাদাশীল বলে মনে করেন। তদুপরি তারা অধিকতর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য বিদেশ গমন পছন্দ করেন এবং বিদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করলে দেশে ফিরে আসতে চান না। সুতরাং বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান তাদের ভিতরেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র সীমিতই থেকে যায়। এসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী হলে এবং তাদের শিক্ষালব্ধ জ্ঞান এ বাংলা ভাষায় জনসমক্ষে উপস্থাপন করলে বিজ্ঞান চর্চার সমস্যা থাকত না; বরং প্রভূত অগ্রগতি ঘটত ।
প্রকাশনা সমস্যাও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে একটি সমস্যা ও বাধা। বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান সম্বলিত গ্রন্থ প্রণয়ন ও তা প্রকাশের পরিমাণও নগণ্য। লেখকের স্বল্পতাও রয়েছে। তদুপরি প্রকাশকরাও এসব পুস্তক প্রকাশে অন্যগ্রহী। কারণ মুনাফা কম এবং পাঠকের সংখ্যাও কম। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সাধারণ গণমাধ্যমে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রচারণাও সীমিত। বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান ও তথ্য প্রচার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এসব বিভিন্ন কারণে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র সুপ্রসারিত নয়।
বাংলা একাডেমীর পদক্ষেপ: পরিভাষাজনিত সমস্যা বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার বড় একটা অন্তরায় ছিল বটে, কিন্তু বাংলা একাডেমী বিজ্ঞানের নানা শাখায় পরিভাষা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। তবে যেগুলো পারা যায়নি তা ইংরেজিতে চালানোতে দোষ কি? বহু বিদেশী শব্দ বাংলায় অবলীলাক্রমে চলছে। তেমনি বিজ্ঞানের অনেক শব্দই হুবহু বাংলায় এলে তাতে ক্ষতি নেই, বরং বাংলা ভাষা আরো সমৃদ্ধ হয়, এর ধারণ ক্ষমতা বাড়ে ।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজনীয়তা : মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা অধিক সহজ ও ফলপ্রসূ। তাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা অত্যাবশ্যক। শুধু বৃত্তিমূলক, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনই বিজ্ঞান শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নয় বরং বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষ যদি বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠে তবে দেশ ও জাতির জন্য তা কল্যাণ বয়ে আনবে। বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে নব চেতনার সূচনা হবে। জাতীয় জীবনে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। কেননা বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষকে জীবনের নানা দিক থেকে সচেতন করে তোলে।
যেহেতু মাতৃভাষা সকলের পক্ষে বোঝা ও উপলব্ধি করা সহজ, তদুপরি সকলের পক্ষে ইংরেজি ভাষা বোঝা ও উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সে কারণে দেশের অধিক মানুষের বিজ্ঞান চর্চার স্বার্থে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষকে নানা রকম অনাচার ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত রাখে। বিজ্ঞান শিক্ষা মানুষের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পরিবেশ ও শিক্ষা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন করে তোলে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে। এতে সামাজিক কল্যাণ বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দৈনন্দিন বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ। অথচ দৈনন্দিন বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষ সচেতন হলে ও জ্ঞান লাভ করলে পরিবার ও সমাজজীবনের নানারকম ছোটখাটো সমস্যা নিজেরাই
সমাধান করতে পারে । বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি এবং এ সম্পর্কে অর্থাৎ দৈনন্দিন বিজ্ঞান সম্পর্কে অধিক সংখ্যক পুস্তক প্রণীত হলে অধিক সুফল পাওয়া যাবে।
এভাবে মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠলে উন্নত বিশ্বের সাথে সংযোগ রক্ষা করে বিজ্ঞানের সুফল উপভোগে সক্ষম হবে। এতে জাতির অনগ্রসরতা কাটবে এবং জাতির পক্ষে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিকাজে বিজ্ঞান উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিত। কৃষি বিষয়ক বিজ্ঞান সম্পর্কে বাংলা ভাষায় অধিক হারে পুস্তিকা, নির্দেশিকা প্রচার ও তার ব্যবহার করা গেলে কৃষকরা বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদে অভ্যস্ত হবে এবং কৃষির উন্নয়ন ঘটবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছে এবং এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে ।
দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রাথমিক পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাংলা মাধ্যম স্বীকৃতি পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় সব কাজকর্মে বাংলা ব্যবহার হচ্ছে। বাংলা ভাষা ব্যবহারের এ শুভ উদ্যোগের সাথে সমন্বয় রেখে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। জাতিকে বিজ্ঞানের ব্যবহৃত ও এর অবদান থেকে উপকৃত হতে হলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের ইংরেজি না জানা অল্পশিক্ষিত ও অর্থশক্ষিত মানুষের জন্য পৃথিবীর উন্নত বিজ্ঞান ও গবেষণার ফলাফল বাংলা ভাষায় পরিবেশন করতে হবে। বিজ্ঞানের বিষয়সমূহ বাংলা ভাষায় পরিবেশন করা হলে আমাদের দেশের জনগণ বিজ্ঞানের আশীর্বাদ লাভ করতে সক্ষম হবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বিজ্ঞান যেভাবে প্রভাবিত করছে তাতে এর কল্যাণকর সেবা লাভ করার জন্যই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা একান্ত অপরিহার্য।
উপসংহার: বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষা কেবল সম্ভব নয়, উচিতও। তবে উচ্চতর পর্যায়ে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য যনি ইংরেজি শিখতে হয় তবে সহযোগী ভাষা হিসেবে ইংরেজি বা অন্য ভাষা শেখায় অনীহার মনোভাব দেখানো সঙ্গত নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হলে তাতে বিজ্ঞানমনষ্কতা যেমন বাড়বে তেমনি বিজ্ঞান শিক্ষায় স্বয়ম্ভরতা অর্জনেও আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
আরও দেখুন: