বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে আজকের আলোচনা। বানান ও বর্ণ উভয়কেই সুস্থিত সুশৃঙ্খল সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রথম প্রয়াস লক্ষ করা যায় আঠারো শতকের আটের দশকে। হ্যালহেডের (১৭৭৮) ব্যাকরণে বাংলা উদাহরণ ছাপার জন্যে উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকার যে-দিন ছাঁচে ঢালেন বাংলা বর্ণমালা, সেদিন শুরু হয় বাংলা বর্ণমালার আধুনিক রূপের যুগ। এই রূপ এরপর নানাভাবে সংস্কৃত হয়েছে—— দেখা গিয়েছে বিচিত্র মনো যুক্তাক্ষর ও লাইনো-বিশ্লিষ্টাক্ষর, কিন্তু বাংলা বর্ণের রূপ ও বিন্যাসের প্রকৃতিতে কোনো বিশাল পরিবর্তন সাধন করা হয় নি।
বাংলা বানান সংস্কার
বাংলা ভাষার মানরূপ বিধিবদ্ধকারীদের কাছে বর্ণের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে বানানকে; বানানের এলাকাটিকে তাঁরা নিজেদের অধীনে রেখে বর্ণের রূপ এ গঠনের এলাকাটি ছেড়ে দেন বর্ণঢালাইকারীদের ওপর। ১৭৭৮ থেকে বাংলা ভাষাবিদেরা অনেকটা নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা করে আসছেন বাংলা বানান ও তার সংস্কার সম্পর্কে। এর ফলে দু-শো ত্রিশ বছরে অর্জিত হয়েছে বাংলা মান বানান, যার কয়েকটি এলাকা এখনো অস্থিত-অস্থির।
উল্লেখযোগ্য যে, মান ভাষার মান বানান থাকা দরকার, কিন্তু ওই বানান যে বিজ্ঞানসম্মত হবেই, তার কোনো কথা নেই। পৃথিবীর কোনো ভাষায়ই বিজ্ঞানসম্মত বানান নেই; আর চরম অর্থে ‘শুদ্ধ’ বলেও কোনো বানান নেই— যে বানান গৃহীত, তাই শুদ্ধ; আর যা গৃহীত নয়, যতই যুক্তিসংগত হোক না কেন, তা অশুদ্ধ। হ্যালহেডের ব্যাকরণের (১৭৭৮) আগে বাংলা বানান ছিল উচ্চারণ-অনুসারী; কিন্তু হ্যালহেড থেকেই শুরু হয় সংস্কৃতনিষ্ঠ ব্যুৎপত্তিনির্ভর বানান।
উনিশ শতকে ব্যুৎপত্তিনির্ভর করে বাংলা বানানের একরকম মান প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সংস্কৃতপন্থীদের কাছে ছিল আদরণীয়, কিন্তু বাংলাপন্থীরা — যেহেতু ব্যুৎপত্তিনির্ভর বানান ও তার উচ্চারণে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধান- ওই বানানকে স্বীকার করে নিতে পারেননি। জনসনের অভিধানের ব্যুৎপত্তিনির্ভর বানান যেমন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল, ঠিক তেমন উত্তেজনাই এ বানান সৃষ্টি করে প্রকৃত বাংলাপাশীদের মধ্যে। ব্যুৎপত্তিনির্ভর বানান বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা লিখি সংস্কৃত কিন্তু উচ্চারণ করি বাংলা বানানই যেন বাংলা ভাষাকে দান করে রাখছে সংস্কৃতের। রবীন্দ্রনাথ (১৯৩৮) মনে করতেন যে ‘বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে নিলেই দেখা যাবে বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয়।”
উনিশ শতকের সূচনায় যখন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক পর্ব শুরু হল, বাংলা সাহিত্যিক গদ্যের উন্যেষ হল, তখন মোটামুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন অনুযায়ী বাংলা বানান নির্ধারিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় বহু তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ গৃহীত হলেও অর্ধ-তৎসম, অনুভব, দেশি, বিদেশি শব্দের পরিমাণ কম নয় এ ছাড়া রয়েছে – অতৎসম শব্দ, প্রতায়, বিভক্তি, উপসর্গ ইত্যাদি সহযোগে গঠিত, নানারকমের মিশ্র শব্দ। তার ফলে বানান নির্ধারিত হলেও বাংলা বানানের সমতাবিধান সম্ভবপর হয় নি।

তাছাড়া, বাংলা ভাষা ক্রমাগত সাধু রীতির নির্মোক ত্যাগ করে চলিত রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে। তার ওপর, অন্য অনেক ভাষার মতো বাংলারও লেখারূপ সম্পূর্ণ ধ্বনিভিত্তিক নয়। তাই বাংলা বানানের অসুবিধাগুলো চলতেই থাকে। এই অসুবিধা ও অসান্তি দূর করার জন্য প্রথমে বিশ শতকের বিশের দশকে বিশ্বভারতী এবং পরে ত্রিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ অধিকাংশ পণ্ডিত ও লেখক সমর্থন করেন। এখন পর্যন্ত এই নিয়মই আদর্শ নিয়মরূপে মোটামুটি অনুসৃত হচ্ছে।
“তবু বাংলা বানানের সম্পূর্ণ সমতা বা অভিন্নতা যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা নয়। বরং কালে কালে বানানের বিশৃঙ্খলতা বেড়ে যাচ্ছে। কতকগুলো শব্দের ক্ষেত্রে দেখা যায় নানাজনে নানারকম বানান লিখছেন। এটি গৌরবের কথা নয়। বানানের এইসব বিভিন্নতা ও বিশৃঙ্খলতার কী কী কারণ থাকতে পারে এখানে সে আলোচনা নিয়োজন। তবে অনেক চলিষ্ণু ও বর্ধিষ্ণু ভাষাতেই দীর্ঘকাল জুড়ে ধীরে ধীরে বানানের কিছু কিছু পরিবর্তন হতে দেখা যায়।
তখন এক সময়ে বানানের নিয়ম নতুন করে বেঁধে দেওয়ার বা সূত্রবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। এ যাবৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নির্দেশিত নিয়ম আমরা অনুসরণ করে চলেছি। কিন্তু আধুনিক কালের দাবি অনুযায়ী, নানা বানানের যে-সব বিশৃঙ্খলতা ও বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে বানানের নিয়মগুলোকে আর একবার সূত্রবদ্ধ করার প্রয়াসে:- ১৯৪৭-এর পর বাংলাদেশ সরকার, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কোনো কোনো ব্যক্তি বাংলা বানান ও লিপির সংকারের চেষ্টা করেন।
এরই পথ ধরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ১৯৮৮ সালে কর্মশালা করে ও বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে বাংলা বানানের নিয়মের একটি খসড়া প্রস্তুত করেন এবং তা চূড়ান্তভাবে এই কর্মশিবিরে গৃহীত হয়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকসমূহে বর্তমানে এই বানান রীতিই অনুসৃত হচ্ছে। বাংলা একাডেমি ১৯৯২ সালের এপ্রিলে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম নির্ধারণের জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ১৯৯৪ সালে তা চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।
একাডেমির এ প্রমিত বানানরীতি কোনো নতুন বিষয় নয়। বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রণীত বানানরীতি, বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক গৃহীত বানানরীতি সবই বিশেষভাবে বিবেচিত হয়। বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতিকে এসবের সুন্দর সমন্বয় বলা যেতে পারে।
বাংলা বর্ণমালা লেখার সঠিক নিয়ম, কৌশল, পদ্ধতি:
আরও দেখুন: