বাংলা উচ্চারণের নিয়ম | স্বরধ্বনির উচ্চারণ | ভাষা ও শিক্ষা

বাংলা উচ্চারণের নিয়ম – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিভাগের “স্বরধ্বনির উচ্চারণ” বিষয়ের একটি পাঠ। ভাষা মানুষের সামাজিক জীবনের ভাবপ্রকাশের একমাত্র বাহন। তার মৌলিক গঠন—উপাদান হচ্ছে অর্থবোধক ধ্বনি। ধ্বনি একটি বাচনিক প্রক্রিয়া-যা শ্রবণীয়। মানুষের মুখে তা উচ্চারিত হয় এবং অপরের কানে তা অর্থবহ হয়ে প্রবেশ করে। ভাষার এই অর্থবহতা বা বোধগম্যতার ক্ষেত্রে উচ্চারণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলা উচ্চারণের নিয়ম | স্বরধ্বনির উচ্চারণ | ভাষা ও শিক্ষা

উচ্চারণের শুদ্ধতা রক্ষিত না হলে ভাষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। শুদ্ধ উচ্চারণ একদিকে যেমন ঠিকভাবে মনোভাব প্রকাশে সহায়ক, তেমনি শব্দের অর্থবিভ্রান্তি ও বিকৃতি ঘটার সম্ভাবনা থেকেও মুক্ত রাখে। তাই বিশুদ্ধ উচ্চারণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিশেষ করে আধুনিক কালে সংবাদ ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, সংগীত, আবৃত্তি, নাট্যকলা ইত্যাদি উপস্থাপনা শিল্পে (performing art) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় হচ্ছে। এর ফলে ভাষার উচ্চারণের দিকটি ক্রমেই অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। বর্তমানে গণমাধ্যম শিক্ষা ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত প্রমিত বাংলা ভাষা বা মান্য বাংলার উচ্চারণকেই প্রমিত উচ্চারণ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

স্বরধ্বনির উচ্চারণ

“অ’ ধ্বনির উচ্চারণ শব্দে অবস্থানভেদে অ দু রকমে লিখিত হয় : (১) স্বাধীনভাবে ব্যবহৃত অ। যেমন— অমর, অনেক (২) শব্দের মধ্যে অন্য বর্ণের সঙ্গে বিলীনভাবে ব্যবহৃত অ। যেমন— কর, বল। এখানে ক এবং র আর ব এবং ল বর্ণের সঙ্গে অ বিলীন হয়ে আছে। (ক্ + অ + র্ + অ; ব্ + অ + ল্ + অ)। শব্দের অ ধ্বনির দু রকম উচ্চারণ পাওয়া যায় : (১) বিবৃত বা স্বাভাবিক উচ্চারণ। যেমন— অমল, , অনেক, কত। (২) সংবৃত বা ও-ধ্বনির মতো উচ্চারণ। যথা— অভ্যাস, অমনি, মন। এ উচ্চারণগুলোতে অ-এর উচ্চারণ অনেকটা ও-এর মত (ওভ্যাস্, ওনি, মোন্ ১. অ-ধ্বনির বিবৃত বা স্বাভাবিক উচ্চারণ ক. শব্দের আদিতে : (১) শব্দের আদিতে না-বোধক অ যেমন— অটল, অচল । (২) অ কিংবা আ—যুক্ত ধ্বনির পূর্ববর্তী অ-ধ্বনি বিবৃত হয়।

বাংলা উচ্চারণের নিয়ম | স্বরধ্বনির উচ্চারণ | ভাষা ও শিক্ষা

যেমন— অমানিশা, অনাচার, সদা, কথা । খ. শব্দের মধ্যে ও অন্তে : (১) পূর্ব স্বরের সঙ্গে মিল রেখে স্বরসঙ্গতির কারণে বিবৃত অ। যেমন— কলম বৈধতা, যত, শ্রেয়। (২) ঋ–ধ্বনি, এ-ধ্বনি, ঐ-ধ্বনি এবং ঔ-ধ্বনির পরবর্তী অ প্রায়ই বিবৃত হয়। যেমন— তৃণ, দেব, ধৈর্য, নোলক, মৌন ইত্যাদি। (৩) অনেকসময় ই-ধ্বনির পরের অ বিবৃত হয়। যেমন— গঠিত, মিত, জনিত ইত্যাদি। অ-ধ্বনির সংবৃত উচ্চারণ অ-ধ্বনির বিবৃত উচ্চারণে চোয়াল বেশি ফাঁক হয়, ঠোঁট তত বাঁকা বা গোল হয় না। কিন্তু সংবৃত উচ্চারণে চোয়ালের ফাঁক কম ও ঠোঁট গোলাকৃতি হয়ে ও-এর মত উচ্চারিত হয়।

সংবৃত উচ্চারণকে বিকৃত বা অস্বাভাবিক উচ্চারণ বলা ঠিক নয়। সংবৃত উচ্চারণও স্বাভাবিক, অবিকৃত ও প্রকৃত উচ্চারণ । ক. শব্দের আদিতে : (১) পরবর্তী স্বর সংবৃত হলে শব্দের আদি অ সংবৃত হয়। যেমন— অতি (ওতি), করুণ (কোরুণ), করে (অসমাপিকা কোরে)। কিন্তু সমাপিকা ‘করে’ শব্দের ‘অ’ বিবৃত হয়; যেমন— ক্রয়, কলম, তমসা ইত্যাদি। (২) পরবর্তী ই, উ— ইত্যাদির প্রভাবে পূর্ববর্তী র-ফলাযুক্ত ‘অ’ সংবৃত হয়। যেমন— প্রতিভা (প্রোতিভা), প্রচুর (প্রোচুর্) ইত্যাদি। কিন্তু অ, আ ইত্যাদির প্রভাবে পূর্ব ‘অ’ বিবৃত হয়।

যেমন— প্রভাত, প্রত্যয়, প্রণাম ইত্যাদি। খ. শব্দের মধ্যে ও অন্তে : (১) তর, যুক্ত বিশেষণ পদের অন্ত্য স্বর ‘অ’ সংবৃত হয়; যেমন— তম তন প্রিয়তম (প্রিয়তমো), গুরুতর (গুরুতরো), পূর্বতন ইত্যাদি। (২) ই উ–এর পরবর্তী মধ্য ও অন্ত্য ‘অ’ সংবৃত। যেমন— প্রিয় (প্রিয়ো), যাবতীয় (যাবতীয়ো) ইত্যাদি। আ-ধ্বনির উচ্চারণ বাংলায় আ-ধ্বনি একটি বিবৃত স্বর। এর উচ্চারণ হ্রস্ব ও দীর্ঘ দু-ই হতে পারে। এর উচ্চারণ অনেকটা ইংরেজি ফাদার (father) ও কাম (calm) শব্দের আ (a)-এর মতো।

যেমন : আপন, বাড়ি, মা, দাতা ইত্যাদি। বাংলায় একাক্ষর (monosyllable) শব্দে আ-এর উচ্চারণ সাধারণত দীর্ঘ হয়। যেমন : চাল শব্দের আ-এর উচ্চারণ দীর্ঘ এবং ভালো শব্দের আ-এর উচ্চারণ হ্রস্ব আ-এর দীর্ঘ উচ্চারণের উদাহরণ : যা, চা, খা, ধান (ধান্), গান (গান্), পান (পান্), কাজ (কাজ), চাঁদ (চাঁদ), ফাঁদ আ- ইত্যাদি। (ফাঁদ) ই, ঈ-ধ্বনির উচ্চারণ বাংলায় সাধারণত হ্রস্ব ই-ধ্বনি এবং দীর্ঘ ঈ-ধ্বনির উচ্চারণে তেমন কোনো প্রভেদ লক্ষ করা যায় না। এক অক্ষরবিশিষ্ট শব্দের ই এবং ঈ দুটিরই উচ্চারণ দীর্ঘ হয়। যেমন : বিশ, তিন, দিন, দীন, শীত, কী ইত্যাদি আরবি ও ইংরেজি ভাষা থেকে গৃহীত শব্দে ই-এর হ্রস্বতা এবং ঈ-এর দীর্ঘতা রক্ষিত হয়।

উ, ঊ-ধ্বনির উচ্চারণ বাংলায় উ এবং ঊ ধ্বনির উচ্চারণে তেমন কোনো পার্থক্য লক্ষ করা যায় না। এক অক্ষরবিশিষ্ট শব্দ ও বহু অক্ষরবিশিষ্ট শব্দের বদ্ধাক্ষরে অথবা প্রান্তিক (শেষ) যুক্তাক্ষরে এ ধ্বনি দুটির উচ্চারণ সামান্য দীর্ঘ হয়। যেমন : হ্রস্ব উচ্চারণ : চুল, ভুল, মুক্ত ইত্যাদি। দীর্ঘ উচ্চারণ : তূলা, ধূলা, মূলা ইত্যাদি। ঋ-ধ্বনির উচ্চারণ বাংলায় স্বাধীনভাবে ঋ-এর উচ্চারণ সাধারণত ‘রি’ বা ‘রী’-এর মতো হয়। যেমন : ঋণ (রীন), ঋতু (রীতু)। ব্যঞ্জনধ্বনি ‘র’-এর সাথে ই-কার যুক্ত হয়ে এই সংযুক্ত ধ্বনিটি গঠিত হয়েছে।

ব্যঞ্জনের আশ্রয়ী এবং স্বর স্থানীয় বলে প্রাচীন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদগণ এই ‘র্’-এর জন্য একটি পৃথক বর্ণ ‘ঋ’ স্থির করে গেছেন। ব্যঞ্জনের সাথে কার হিসেবে ঋ যুক্ত হলে র-ফলা + ই-কার এর মতো মনে হয়। যেমন : পিতৃ (পিত্রি), মাতৃ (মাত্রি), কৃষ্টি (ক্রিষ্টি), (প্রিথিবী) ইত্যাদি। পৃথিবী ‘এ’ এবং অ্যা-ধ্বনির উচ্চারণ এ-ধ্বনির উচ্চারণ দুরকম : সংবৃত ও বিবৃত। যেমন— মেঘ (মেঘ— সংবৃত), খেলা (খ্যালা— বিবৃত)। ১। সংবৃত : (ক) পদের অন্তে ‘এ’ সংবৃত হয়। যেমন— পথে, ঘাটে, দোষে, গুণে, আসে ইত্যাদি। (খ) তৎসম শব্দের প্রথমে ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে এ-ধ্বনির উচ্চারণ সংবৃত হয়।

 

বাংলা উচ্চারণের নিয়ম | স্বরধ্বনির উচ্চারণ | ভাষা ও শিক্ষা

 

যেমন— দেশ, প্রেম, শেষ ইত্যাদি। (গ) একাক্ষর সর্বনাম পদের ‘এ’ সংবৃত হয়। যেমন— কে, সে, যে। (ঘ) ‘হ’ কিংবা আকারবিহীন যুক্তধ্বনি পরে থাকলে ‘এ; সংবৃত হয়। যেমন— দেহ, কেহ, কেষ্ট। (ঙ) ‘ই’ বা ‘উ’-কার পরে থাকলে ‘এ’ সংবৃত হয়। – যেমন— দেখি, রেণু, বেলুন । ২। বিবৃত (অ্যা) : ‘এ’ ধ্বনির বিবৃত উচ্চারণ ইংরেজি ক্যাট (cat) ও ব্যাট (bat)-এর ‘এ’ (a)-এর মত। যেমন— দেখ (দ্যাখ), একা (এ্যাকা) ইত্যাদি। এ-ধ্বনির এই বিবৃত উচ্চারণ কেবল শব্দের আদিতেই পাওয়া যায়, শব্দের মধ্যে ও অন্তে পাওয়া যায় না।

(ক) দু অক্ষর বিশিষ্ট সর্বনাম বা অবায় পদে যেমন- অব্যয় পদে, যেমন— এত এখন, হেন, কেন ইত্যাদি। কিন্তু ব্যতিক্রম : যেথা, সেথা, হেথা। (খ) অনুস্বার ও চন্দ্রবিন্দুযুক্ত ধ্বনির আগের এ ধানি বিবৃত। যেমন— খেড়া, চেংড়া, সেঁতসেঁতে, বেঁকা। (গ) ঘাঁটি বাংলা শব্দে, যেমন— মন – খেমটা, ঢেপসা, তেলাপোকা, তেনা, দেওর। (ঘ) এক, এগারো, তেরো— এ কটি সংখ্যাবাচক শব্দে, ‘এক’ যুক্ত শব্দেও ; যেমন— এক চোট, এক তলা, এক ঘরে ইত্যাদি।

(ঙ) ক্রিয়াপদের বর্তমান কালের অনুজ্ঞায়, তুচ্ছার্থে ও সাধারণ মধ্যম পুরুষের রূপে; যেমন- দেখ (দ্যাখ), দেখ (দ্যাখো), খেল্ (খ্যাল্), খেল (খ্যালো); ফেল্ (ফ্যাল্), ফেল (ফ্যালো) ইত্যাদি। ‘আ’ ধ্বনির ‘অ্যা’ উচ্চারণ কয়েকটি ক্ষেত্রে আ-ধ্বনির উচ্চারণ অ্যা হয়। শব্দের শুরুতে যুক্ত ব্যঞ্জন জ্ঞ-এর আ-কার থাকলে : জ্ঞান (গ্যান / গ্যান্), জ্ঞানী (গ্যানি / গ্যানি), জ্ঞাপন (গ্যাপন)। শব্দের শেষে জ্ঞা থাকলে আ-ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণ বজায় থাকে : প্রতিজ্ঞা (প্রোতিগ্‌গা), অনুজ্ঞা, * প্রজ্ঞা ইত্যাদি। ২. য-ফলা যুক্তব্যঞ্জনের সঙ্গে আ-কার বা আ-ধ্বনির উচ্চারণ প্রায় ক্ষেত্রেই অ্যা হয় : খ্যাতি, ধ্যান, ব্যাকরণ।

ঐ-ধ্বনির উচ্চারণ ঐ কোনো মৌলিক স্বরধ্বনি নয়। এটি দুটি স্বরধ্বনির মিলিত রূপ। স্বরধ্বনি দুটি হচ্ছে ও+ই=ঐ। এ কারণে এটি ক যৌগিক স্বরধ্বনি পর্যায়ে পড়ে। বাংলায় ঐ-এর উচ্চারণ ‘ওই’। ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য এর যে য স্বরচিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাকে ৈ(ঐ— কার) বলে। ঐ-কার আশ্রয়ী-ব্যঞ্জনের বাম দিকে বসে।

 

বাংলা উচ্চারণের নিয়ম | স্বরধ্বনির উচ্চারণ | ভাষা ও শিক্ষা

 

যেমন : ক+ঐ=কৈ, চ+ঐ=চৈ। . বাংলায় ঐ ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণ হ্রস্ব। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আবেগ প্রকাশ কিংবা মনোযোগ আকর্ষণের বেলায় ‘ঐ’ ধ্বনির উচ্চারণ দীর্ঘ হতে পারে। যেমন : আরে ঐ-তো ওরা যাচ্ছে ! ও-ধ্বনির উচ্চারণ বাংলা এক অক্ষরবিশিষ্ট শব্দে ও-কারের উচ্চারণ দীর্ঘ হয়। যেমন : জোর, দোর, ভোর, ঘোর, রোজ, রোগ, বোন, গো ইত্যাদি।

অন্য ক্ষেত্রে সাধারণত হ্রস্ব হয়। যেমন : সোনা, বোনা, লোনা, বোঁটা, গোটা, পুরো, কারো, ছাড়ো ইত্যাদি। ঔ-ধ্বনির উচ্চারণ ধ্বনিটিও কোনো মৌলিক বা শুদ্ধ স্বরধ্বনি নয়। ও এবং উ স্বরধ্বনি দুটি যুক্ত হয়ে ‘ঔ’ ধ্বনিটি গঠিত হয়েছে। এটি একটি যৌগিক স্বরধ্বনি। ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত হলে এর যে প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাকে ৗে (ঔ-কার) বলে। ঔ-কার আশ্রয়ী ব্যঞ্জনের দুপাশে বসে। যেমন : ন+ঔ=নৌ, চ+ঔ=চৌ-ইত্যাদি বাংলায় ঔ-এর উচ্চারণ অনুসরণে লেখা কবিতায় ‘ঔ’ ধ্বনি কখনো কখনো দীর্ঘ হয়। যেমন : হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ- জৈন-পারসিক।

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কবিতা পাঠ, আবৃত্তি চর্চা, সহজ শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ :

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment