বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা – বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা গবেষক সৌরভ সিকদারের মতে, বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম ৪টি ভাষা পরিবারের প্রায় ৩০টি ভাষা রয়েছে।
Table of Contents
বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা
চাকমা ভাষা (Chakma Language)
বাংলাদেশে যেসব আদিবাসী জাতিসত্ত্বার মানুষ বাস করেন তাদের মধ্যে জনসংখ্যার বিবেচনায় চাকমা জনগোষ্ঠী অন্যতম। বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান জেলায় প্রধানত এদের বাস। চাকমা জাতির ভাষা চাকমা ভাষা নামে পরিচিত। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য। বাংলাদেশের বাইরে ভারত এবং মায়ানমারে এ ভাষার প্রচলন আছে। এ ভাষার লিপি বা বর্ণমালার নাম বর্মি-মনখেমের। বাংলাদেশের প্রায় আড়াই লক্ষ সহ সব মিলিয়ে পৃথিবীতে এ ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ।
সাঁওতালি ভাষা (Santali Language)
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় প্রধানত সাঁওতাল জাতির মানুষদের বাস। এছাড়া, আরও কিছু জেলায় বাস করেন সাঁওতালরা। বাংলাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষ। বাংলাদেশ ছাড়া ভারত এবং নেপালের সাঁওতালরাও ব্যবহার করেন সাঁওতালি ভাষা।
এথনোলগের তথ্যমতে, দুনিয়ায় এ ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ আর বেশির ভাগের বাস ভারতে। এটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের সদস্য। বাংলাদেশে এ ভাষা প্রধানত রোমান হরফে লেখা হয়, বাংলা বর্ণমালার ব্যবহারও আছে সামান্য মাত্রায়। ভারতে বাংলা, দেবনাগরি, ওড়িয়া এবং ল্যাটিন বর্ণমালায় লেখা হয় এ ভাষা।
মারমা ভাষা (Marma Language)
বাংলাদেশের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার জেলায় বাস করেন মারমা জনগোষ্ঠী। মারমা ভাষা মগ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ ছাড়া মায়ানমার এবং ভারতে বাস করেন মারমা জাতির মানুষ। বাংলাদেশে এ ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ আর পৃথিবীতে প্রায় ১১ লক্ষ। এটি চীনা- তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্য। আরাকান বা মনখেম বর্ণমালা দিয়ে এ ভাষা লেখা হয়।
ত্রিপুরা বা ককবোরক ভাষা (Tripura or Kok Borok Language)
ত্রিপুরা জাতির মানুষের ভাষা ত্রিপুরা বা ককবোরক নামে পরিচিত। টিপরা এবং ত্রিপুরা মূলত একই গোষ্ঠী। বাংলাদেশে এ গোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এটি চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্য। বাংলা বা রোমান হরফে লেখা হয় এ ভাষা। এ ভাষার আছে ৩৬টি উপভাষা।
গারো বা মান্দি ভাষা (Garo or Mandi Language)
বাংলাদেশ এবং ভারতে বাস করেন গারো জাতির মানুষ। বাংলাদেশে এদের বাস মূলত গারো পাহাড় এবং সংলগ্ন জেলাগুলোতে। ভারতে মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, কুচবিহার প্রভৃতি এলাকায় বাস করেন গারো জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে এ ভাষার মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬৮ হাজার আর ভারতে প্রায় আট লাখ। এটি চীনা- তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্য। বাংলা বা রোমান লিপি দিয়ে লেখা হয় এ ভাষা।
ওঁরাও বা কুঁড়ুখ ভাষা (Oraoan or Kurukh Language)
বাংলাদেশে ওঁরাও জাতির বাস মূলত উত্তরবঙ্গে। ভারতে এদের বাস ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিম বাংলা, উড়িষ্যা, আসাম রাজ্যে। বাংলাদেশে এ ভাষার জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার আর ভারতে প্রায় ২০ লাখ। এটি দ্রাবিড় ভাষা পরিবারের সদস্য। এ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। ভারতে দেবনাগরি লিপিতে এ ভাষা লেখা হয়। বাংলাদেশে ওঁরাও ভাষার অবস্থা বিপন্ন।
সাদরি ভাষা (Sadri Language)
বাংলাদেশের ওঁরাও, মাহালি, মাহাতো, সিং, রাজোয়ার, পাহান প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠী এ ভাষা ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের ওঁরাও জনগোষ্ঠীর মূল ভাষা ওঁরাও বা কুঁডুখ হলেও এখন তারা প্রধানত ব্যবহার করেন সাদরি ভাষা। বাংলাদেশে এ ভাষার জনসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। ভারতে ঝাড়খণ্ড, মধ্য প্রদেশ, উড়িষ্যা, বিহার এবং পশ্চিম বাংলায় এ ভাষার মানুষ বাস করেন। এটি ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের সদস্য। এ ভাষার বেশ কয়েকটি উপভাষা রয়েছে।
খাসিয়া ভাষা (Khasi Language)
বাংলাদেশে খাসিয়া জনগোষ্ঠীর বাস মূলত সিলেট জেলায়। বাংলাদেশে খাসিয়া ভাষার জনসংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। ভারতে মেঘালয়, জৈন্তিয়া পাহাড়, আসাম, মণিপুর, পশ্চিম বাংলায় বাস করেন খাসিয়ারা। ভারতে এ ভাষাভাষার লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে আট লাখ। এটি অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের সদস্য। এ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। এদেশে সীমিত আকারে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার হয়েছে। ভারতে ১৮৪২ সাল থেকে ল্যাটিন বর্ণমালা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ম্রো ভাষা (Mro Language)
বাংলাদেশে ম্রো আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস মূলত বান্দরবান জেলায়। ভারতে পশ্চিম বাংলা এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও আছে ম্রো জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশে ম্রো ভাষার লোকসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। ভারতে এক হাজার, মিয়ানমারে ২০ হাজার। এটি চীনা-তিব্বতি (কুকি-চীন) ভাষা পরিবারের সদস্য।
এ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। মেনলে ম্রো (১৯৮৪-৮৫) এ ভাষা লিখতে এক ধরনের বর্ণমালা তৈরি করেছেন যাতে ৩১ টি বর্ণ আছে। রোমান, বর্মি, শ্যাম, কম্বোডিয়া এবং চৈনিক বর্ণের সমন্বয়ে এ বর্ণগুলো তৈরি করা হয়েছে।

খুমি ভাষা (Khumi Language)
খুমি জনগোষ্ঠীর বাস বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে। বাংলাদেশের বান্দরবান এবং মিয়ানমারের আরাকান, চিন রাজ্য এবং পশ্চিম মিয়ানমারে এদের বাস। বাংলাদেশে এ ভাষার লোকসংখ্যা দেড় থেকে দুই হাজারের মধ্যে। আর পৃথিবীতে এ ভাষার মোট লোকসংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। এটি তিব্বত-বর্মি ভাষা পরিবারের সদস্য। নিজস্ব লিপি নেই, লিখতে রোমান হরফ ব্যবহৃত হয়।
মুণ্ডা ভাষা (Munda Language)
বাংলাদেশে মুণ্ডা জাতিগোষ্ঠী বা মুণ্ডাভাষীর সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার, ভারতে প্রায় ১৫ লাখ এবং নেপালে প্রায় সাত হাজার। এ ভাষা অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের মুণ্ডারি শাখার সদস্য। এ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। ভারতে বাংলা, দেবনাগরি, ল্যাটিন বর্ণমালা দিয়ে লেখা হয়।
কোচ ভাষা (Koch Language)
বাংলাদেশে বসবাসরত কোচ জনগোষ্ঠীর আবাস ছিল ভারতের কুচবিহারে। বর্তমানে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার এবং ভারতে ৩৬ হাজার। ধারণা করা হয়, কোচ ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের ভোট-বর্মি শাখার বোড়ো দলভুক্ত। এ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই।
পাত্র বা লালং’দের ভাষা
বাংলাদেশের সিলেটে প্রায় দুই হাজার পাত্র বা লালং জাতিসত্তার মানুষ বাস করেন। এদের ভাষা এদেশের অন্য আদিবাসীদের ভাষা থেকে ভিন্ন। এ ভাষা সম্পর্কে এখনও বেশি কিছু জানা যায়নি। এ ভাষার বর্ণমালা বা লিখিত কোন নিদর্শন নেই।
মৈতেয় বা মণিপুরি ভাষা (Meitei or Manipuri Language)
বাংলাদেশে মণিপুরি গোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় ২৪ হাজার। ভারতে আছেন প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার। মণিপুরিদের ভাষা দুই ভাগে বিভক্ত। মৈতেয় মণিপুরি এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। মৈতেয় মণিপুরি তিবেতো-বার্মা (Tibeto-Burman) ভাষা পরিবারভুক্ত অন্যদিকে বিষ্ণুপ্রিয়া হলো ইন্দো-আর্য ভাষা। ধারণা করা হয়, মৈতেয় লিপির উদ্ভব হয়েছে ব্রাহ্মী লিপি থেকে।
মিজো বা লুসাই ভাষা (Mizo or Lusai Language)
বাংলাদেশে লুসাই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মাত্র ৬০০ জন (প্রায়)। ভারতে প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার এবং মিয়ানমারে ১৩ হাজার। মিজো বা লুসাই ভাষা, চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্য।
পাংখোয়া ভাষা (Pangkhua Language)
বাংলাদেশে পাংখোয়া গোষ্ঠীর জনসংখ্যা মাত্র আড়াই হাজার। ভারতে আছেন প্রায় ২৫০ জন। এ ভাষা চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের কুকি-চীন-নাগা শাখার সদস্য। এ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই।
চাক ভাষা (Chak Language)
চাকদের বাস বাংলাদেশের বান্দরবান এবং মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। বাংলাদেশে এ ভাষার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার এবং মিয়ানমারে ২০ হাজার। এটি চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারের সদস্য।
রাখাইন ভাষা (Rakhine Language)
বাংলাদেশে রাখাইন ভাষার জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার এবং মিয়ানমারে প্রায় সাড়ে সাত লাখ। গবেষক সৌরভ সিকদারের মতে, এটি মূলত মারমা ভাষার উপভাষা। এ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে। বর্ণমালায় স্বরবর্ণ বা ছারা ১২টি ব্যঞ্জনবর্ণ বা বোঃ ৩৩টি।
ঠার/থেক বা ঠেট ভাষা
এটি এদেশের বেদে সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা। বাংলাদেশে এ ভাষার জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এটি চীনা-তিব্বতি ভাষা পরিবারভুক্ত। এ ভাষার মৌখিক সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ। এ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই।
তঞ্চঙ্গা ভাষা (Tangchangya Language)
বাংলাদেশে তঞ্চঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাস মূলত রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায়। বাংলাদেশে এ ভাষার জনসংখ্যা প্রায় ২২ হাজার। এটি ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের সদস্য। এ ভাষার সঙ্গে চাকমা ভাষার প্রায় ৯০ শতাংশ সাদৃশ্য রয়েছে।
এ ভাষাগুলোর বাইরে আরও যেসব আদিবাসী ভাষা বাংলাদেশে প্রচলিত আছে তার মধ্যে রয়েছে-হাজং ভাষা, পাহাড়িয়া ভাষা, মাহালি ভাষা, রাজবংশি ভাষা, বম ভাষা প্রভৃতি।
[তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা, সৌরভ সিকদার]
আরও পড়ুনঃ