আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য বর্ণনা করে একটি ভাষণ এর নমুনা তৈরি করে দেব আজ। শিক্ষার্থীরা নিজেরা নমুনাটি দেখে ধারণা নিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করবেন। এরপর নিজের মতো করে নিজের ভাষণটি তৈরি করবেন। আমাদের ভিডিও ক্লাস থেকেও সহায়তা নিতে পারেন। ভাষণ।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য বর্ণনা করে একটি ভাষণ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত এ মহতী অনুষ্ঠানের শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি, সম্মানিত প্রধান অতিথি, মঞ্চে উপবিষ্ট সম্মানিত আলোচকবৃন্দ এবং উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আপনারা আমার সালাম ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।…আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে আমার বক্তব্য উপস্থাপনের আগে প্রথমেই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের, যাঁরা মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পিচঢালা পথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে উৎসর্গ করেছিলেন নিজেদের জীবনকে। সুধী, আপনারা জানেন, আমাদের জাতীয় জীবনে মহান শহীদ দিবস এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
এ দিবস একদিকে যেমন গভীর শোকের অন্যদিকে তেমনি বিশাল গৌরবের। এর সঙ্গে বাঙালির বেদনার গৌরবের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে জীবন দিয়েছিল রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার প্রমুখ মহান দেশব্রতী। সেদিন তাঁদের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে প্রথম বিকশিত হয়েছিল জাতীয় অস্তিত্বের কোরক। সেদিন স্বাধিকারের যে চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়েছিল সেই সংগ্রামী চেতনাই বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক আন্দোলন এই দু’ধারাকে একসূত্রে গ্রথিত করে মুক্তি সংগ্রামের মোহনায় এনে দিয়েছে। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে সুধীবৃন্দ, একুশে ফেব্রুয়ারি এতদিন ছিল বাঙালির ‘শহীদ দিবস’।
আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)-র সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশের সমর্থন নিয়ে সর্বসম্মতভাবে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয়, “১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্যে বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এই দিনের শহীদদের স্মৃতিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
প্রতি বছর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশ এবং ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হবে।” ইউনেস্কোর এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রায় ৫ হাজার ভাষা সম্মানিত হল এবং একবিংশ শতাব্দীর তথা ২০০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সারা বিশ্বব্যাপী প্রথম পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
বিশ্বের দেশে দেশে আজ আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবগাঁথা কীর্তিত হবে, উচ্চারিত হবে বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নাম। বাঙালি জাতি নিজের রক্ত দিয়ে সারা বিশ্বকে শিখিয়ে দিয়ে গেল ভাষাকে ভালোবাসার মন্ত্র। এটা আমাদের জন্য বড়ই আনন্দের, বড়ই গর্বের বিষয়। সুধী, বিংশ শতাব্দীর শেষলগ্নে একুশ শতকের প্রথমদিকে বাঙালির পক্ষে এটিই সবচেয়ে বড়ো সুসংবাদ। এরজন্য আমাদের আপ্লুত কৃতজ্ঞতা যাঁদের প্রথম প্রাপ্য, তাঁরা কেউ আর এ পৃথিবীতে নেই। সেই ১৯৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকার রাজপথের ধুলোয় নিজেদের রক্ত মিশিয়ে দিয়ে, বিদেশি ক্যালেন্ডারের তিনশ ছেষট্টিটি (ওই বছর একটি দিন বেশিই ছিল) দিনের মাঝখান থেকে তাঁরা রক্তিম শালুক ফুলের মতো একটি দিনকে ছিড়ে এনে আমাদের হাতে তুলে দিলেন।
একটি অমর অম্লান চিরবিভাময় দিন, একুশে ফেব্রুয়ারি। তখনকার কয়েক কোটি বাংলাভাষীর পক্ষে আর সম্ভব হল না ওই দিনটিকে অন্য কোনো দিনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা। ওই দিনটির সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তকে প্রতিদিনের প্রাকৃতিক ঘটনা বলে ভুলে থাকা। একইসঙ্গে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে আরও স্মরণ করছি একুশের এই অনন্য বিশ্বস্বীকৃতি অর্জনের নেপথ্যে মাতৃভাষা-প্রেমিক যেসব মহহৃদয়-বাঙালি অবদান রেখেছেন, তাঁদের। কৃতজ্ঞতা জানাই ‘লাভার্স অব দ্য মাদার্স ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব’ (মাতৃভাষাপ্রেমী সংগঠন)-এর দুই প্রবাসী বাঙালি সংগঠক সালাম ও রফিককে এবং সেই সঙ্গে ইউনেস্কোসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে।

সুধীবৃন্দ, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে ব্যাপকভাবে পরিচিতি দান করেছে এই ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। এই দিনটির মাধ্যমেই বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনে আজ নতুন তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। আর এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহু ভাষা-ভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের বর্তমান স্রোতধারায় নতুন তাৎপর্যের দাবি রাখে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য হল- সকল মাতৃভাষাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া, যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা, দুর্বল বলে কোনো ভাষার ওপর প্রভুত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করা, ছোট-বড় সকল ভাষার প্রতি সমান মর্যাদা প্রদর্শন। এ দিবসে প্রত্যেক ভাষার মানুষ নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালোবাসবে তেমনি অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। এভাবে একুশকে ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালোবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ। কোনো জাতিই নিজের দেশ, ভাষা, সংস্কৃতির মূল্যায়ন না করে বড় হতে পারে না। মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা ছাড়া মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি যে, আমরা এখনো আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার প্রতি যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে পারছি না। সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলনের বিষয়টি এখনো ব্যাপকভাবে কার্যকর হয় নি আমাদের উচিত শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে না দেওয়া। আমরা যদি বাস্তব অর্থেই বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে যথাযথ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারি তবে আমাদের ভাষাপ্রেম একটি সার্থক রূপ পরিগ্রহ করবে। নতুবা তা অন্তঃসারশূন্য হয়ে উঠবে যা আমরা কেউ চাই না। তাই নতুন প্রজন্মকে নিজের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলতে হবে।
মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য লুকিয়ে আছে দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে, দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবাসা, তার জীবনাচারকে ভালোবাসা আর তার জন্যে গর্ববোধ করা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হোক জগতের সকল অনৈক্য, সংঘাত ও অশান্তির বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ হাতিয়ার। হোক সমুদ্রপথের ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অন্ধকার রাতের আশার প্রদীপ, দিক নির্দেশক আলোক বর্তিকা। পরিশেষে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আজকের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আমাকে কিছু বলার সুযোগ করে দিয়েছেন এবং এতক্ষণ যারা অসীম ধৈর্য নিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন- আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
গুরুকুলের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভিডিও নমুনা ভাষণ ১:
গুরুকুলের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ভিডিও নমুনা ভাষণ ২:
আরও দেখুন: