বচনভেদ লক্ষণীয় – আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “ভাষা ও শিক্ষা” বিভাগের “বচন” বিষয়ের একটি পাঠ। বাংলা ভাষায় বচন দুই প্রকার। যথা : ১. একবচন ও ২. বহুবচন । একবচন : যে শব্দ দ্বারা কোনো ব্যক্তি, প্রাণী বা বস্তুর মাত্র একটি সংখ্যা বোঝায় তাকে একবচন বলে। যেমন : বইটি, পাখিটি ইত্যাদি। বহুবচন : যে শব্দ দ্বারা কোন ব্যক্তি, প্রাণী, বা বস্তুর একের অধিক সংখ্যা বোঝায় তাকে বহুবচন বলে। যেমন : বইগুলো, পাখিগুলো ইত্যাদি।
বচনভেদ লক্ষণীয় | বচন | ভাষা ও শিক্ষা
যা গণনা করা যায় না তার বহুবচনও হয় না। যেমন : পানিরা, দুধেরা ইত্যাদি হবে না, কারণ এগুলো দ্বারা এখানে পরিমাপ বোঝায়— সংখ্যা নয় ৷ বচনভেদ কেবল বিশেষ্য ও সর্বনাম শব্দের বচনভেদ হয় । একবচনের রূপ একবচন প্রকাশের জন্য পৃথক কোনো বিভক্তি নেই, শব্দের মূল রূপটিকে একবচন বোঝায়। সাধারণত এক (‘এক’, ‘একটা’, ‘একটি’, ‘একখানা’) শব্দযোগে একবচন নির্দেশ করা হয়। যেমন : একজন লোক, এক ছাত্র, একটা বই, একটি পাখি, একখানা কলম ইত্যাদি। ‘টি’, ‘টা’, ‘খানা’, ‘খানি’ ইত্যাদি নির্দেশক প্রত্যয় ‘এক’–এর সঙ্গে যোগ করে, অথবা ‘এক’ শব্দটিকে ব্যবহার না করেও বিশেষ্যের সঙ্গে টা, টি, খানা, খানি, গাছা, গাছি ইত্যাদি নির্দেশক প্রত্যয় যোগে একবচন গঠন করা যায়। যেমন : একটি ছেলে অথবা ছেলেটি। একখানা শাড়ি অথবা শাড়িটি।
তার গলায় ছিল একখানি হার। গরুটা পাওয়া যাচ্ছে না ইত্যাদি। একবচনের বিভক্তিযোগে একবচন নির্দেশিত হয়। যেমন— লোককে। বহুবচনের রূপ রা, এরা, গুলো, দিগকে (দের) ইত্যাদি বহুত্ববাচক বিভক্তি বিশেষ্যে যুক্ত হয়ে বহুবচন প্রকাশ করে। যেমন : ছেলেরা, লোকেরা, আমাদিগকে, রহিমদের, গাছগুলো, বইগুলো ইত্যাদি। একবচনে ও বহুবচনে বিশেষণের রূপ একই রকম হয়ে থাকে। যেমন— ভাল ছেলে, ভাল ছেলেরা। শুধু বিশেষণের দ্বিত্ব সাধন করে কখনো- কখনো তার দ্বারা বহুবচনের কাজ করা হয়, সেক্ষেত্রে বিশেষ্যের সঙ্গে বহুবচন-প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয় না। যেমন : একবচন— পাকা কথা, বহুবচন— পাকা পাকা কথা।
২. অনেক, সব ইত্যাদি বহুত্ববাচক শব্দযোগে বহুবচন প্রকাশ করা যায়। যেমন : সব বই কিনেছ?, সব ছেলে, অনেক মেয়েই আজ আসে নি ইত্যাদি।
8| -বিদেশি বহুবচনবাচক প্রত্যয়যোগেও বহুত্ব বোঝানো হয়। যেমন : হা : আমলা + হা =আমলাহা (আমলারা) [লেখ্য বাংলায় প্রয়োগ দুর্লভ ] আৎ : কাগজ + আত = কাগজাত (কাগজপত্র) [লেখ্য বাংলায় প্রয়োগ দুর্লভ ] আন : সাহেব + আন = সাহেবান; বুজুর্গ + আন = বুজুর্গান
৫| পদের দ্বিরুক্তি দ্বারা বহুবচন গঠন। যেমন : বাগানটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে। জিজ্ঞাসিব জনে জনে। সর্বনামের দ্বিরুক্তি দিয়ে বহুবচন : যারা যারা; কে কে ইত্যাদি। ক্রিয়াপদের দ্বিরুক্তিতে বহুবচন : খেটে খেটে, বলে বলে ইত্যাদি। অব্যয়ের দ্বিরুক্তিতে বহুবচন : যখন যখন। সহচর অনুচর শব্দযোগে বহুবচন : বন্ধু-বান্ধব বিশেষ্যের দ্বিত্ব : লোকে লোকে লোকারণ্য, দ্বারে দ্বারে ঘুরে। বিশেষণের দ্বিত্ব : ছোট ছোট মাছ, বড় বড় আম ইত্যাদি।
ভুল : সব ছেলেগুলোকে ডাক । শুদ্ধ : সব ছেলেকে ডাক । শুদ্ধ : সব টাকাই তো তোমাকে দিলাম । ভুল : সব টাকাগুলোই তো তোমাকে দিলাম । ভুল : ভাল ভাল ছেলেগুলোকে পুরস্কার দেয়া হবে। শুদ্ধ : ভাল ভাল ছেলেকে পুরস্কার দেয়া হবে।
৬ | সম্বন্ধপদ প্রয়োগে বহুবচন। যেমন : গুচ্ছের কলা না আনলেই পারতে!
লক্ষণীয়
১। রা— কেবল উন্নত প্রাণিবাচক শব্দের সঙ্গে ‘রা’। এরা বিভক্তির ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন : ছাত্রেরা, তারা, শিক্ষকেরা (শিক্ষকগণ)। যে ধরনের শব্দে ‘রা’ যুক্ত হয়, সে ধরনের শব্দের শেষে কোনো কোনো সময় ‘এরা’ ব্যবহৃত হয়। যেমন— মায়েরা, ঝিয়েরা ইত্যাদি। সময় সময় কবিতা বা অন্যান্য প্রয়োজনে অপ্রাণী ও ইতর প্রাণিবাচক শব্দেও রা, এরা যুক্ত হয়। যেমন— “পাখিরা আকাশে উড়ে দেখিয়া হিংসায়, পিপীলিকা বিধাতার কাছে পাখা চায়।’-রজনীকান্ত। শব্দের শেষে স্বর থাকলে ‘রা’ এবং ব্যঞ্জন থাকলে ‘এরা’ বসে।
২। গুলা, গুলো, ইতর প্রাণী ও অপ্রাণিবাচক শব্দের বহুবচনে ব্যবহৃত হয়। যেমন— অতগুলো আম এনেছ কেন? আমগুলো তো টক। টাকাগুলোই বৃথা গেল ।
৩। পাল ও যূথ শব্দ দুটো কেবল জন্তুর বহুবচনেই ব্যবহৃত হয়। যেমন— ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে’। প্রাচীনকালে হস্তিযূথ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত।
8। বিশেষ্য শব্দের একবচনের ব্যবহারেও অনেকসময় বহুবচন বোঝানো হয়। যেমন- পোকার (বহুবচন) আক্রমণে ফসল নষ্ট হয়, বাজারে লোক (বহুবচন) জমেছে ইত্যাদি।
৫ । একবচনাত্মক বিশেষ্যের আগে অজস্র, অনেক, বিস্তর, বহু, নানা, ঢের ইত্যাদি বহুত্ববোধক শব্দ বিশেষ হিসেবে প্রয়োগ করেও বহুবচন বোঝানো হয়। যেমন- অজস্র ভুল। অনেক লোক। বিস্তর টাকা। নানা কথা। ঢের খরচ। অঢেল টাকাপয়সা ইত্যাদি।

৬। একই সঙ্গে দুবার বহুবচনবাচক প্রত্যয় বা শব্দ ব্যবহৃত হয় না। যেমন : শুদ্ধ : মানুষ / মানুষেরা / সব মানুষই মরণশীল। ভুল : সব মানুষেরাই মরণশীল। দ্রষ্টব্য : ওপরে বর্ণিত বহুবচনবোধক প্রত্যয় ও সমষ্টিবোধক শব্দের অধিকাংশই তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত এবং সে কারণে অধিকাংশই সাধুরীতি ও সংস্কৃত শব্দে প্রযোজ্য। খাঁটি বাংলা শব্দের বহুবচনে এবং চলিতরীতিতে রা, এরা, গুলো, গুলা, দের- এসব প্রত্যয় এবং অনেক, বহু, সব— এসব শব্দের ব্যবহারই বহুল প্রচলিত।
আরও দেখুন: