আজকের আলোচনার বিষয়ঃ বঙ্গভূমির প্রতি । যা সাহিত্য কণিকার অন্তর্গত। এটি মাইকেল মধুসুদন দত্ত রচিত কবিতা।মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত কয়েকটি গীতি কবিতার একটি ‘বঙ্গভূমির প্রতি’। এ কবিতায় স্বদেশের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ও একাগ্রতা তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
Table of Contents
বঙ্গভূমির প্রতি । মাইকেল মধুসুদন দত্ত
রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।
সাধিতে মনের সাধ
ঘটে যদি পরমাদ,
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে দৈবের বশে, জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে, নাহি খেদ তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে,
অমর কে কোথা কবে,
চিরস্থির কবে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
কিন্তু যদি রাখ মনে, নাহি, মা, ডরি শমনে;
মক্ষিকাও গলে না গো পড়িলে অমৃত-হ্রদে।
সেই ধন্য নরকূলে,
লোকে যারে নাহি ভুলে,
মনের মন্দিরে সদা সেৰে সৰ্বজন;
কিন্তু কোন গুণ আছে,
যাচিব যে তব কাছে,
হেন অমরতা আমি, কহ, গো, শ্যামা জন্মদে।
তবে যদি দয়া কর,
ভুল দোষ, গুণ ধর
অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে!
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে,
মানসে, মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস কী বসন্ত, কী শরদে!
শব্দার্থ ও টীকা
মিনতি – বিনীত প্রার্থনা ।
পরমাদ – প্রমাদ; ভুল-ভ্রান্তি।
কোকনদ – লাল পদ্ম।
নীর – পানি; জল ।
শমন – মৃত্যুর দেবতা ।
মক্ষিকা- মাছি।
শ্যামা জন্মদে – শ্যামল জন্মভূমি অর্থে ।
বর – আশীর্বাদ।
মানস – মন।
তামরস – পদ্ম।
শরদে – শরৎ কাল বোঝাতে ।
পাঠের উদ্দেশ্য
এই কবিতা পাঠের মাধ্যমে স্বদেশের প্রতি শিক্ষার্থীর মনে শ্রদ্ধা ও বিনয়ভাব জেগে উঠবে। বিদেশের ঐশ্বর্য ও জৌলুস সত্ত্বেও নিজ দেশের প্রতি মনের গভীরে আগ্রহবোধ সৃষ্টি হবে।
পাঠ-পরিচিতি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত কয়েকটি গীতি কবিতার একটি ‘বঙ্গভূমির প্রতি’। এ কবিতায় স্বদেশের প্রতি কবির শ্রদ্ধা ও একাগ্রতা তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে। দেশকে কবি মা হিসেবে কল্পনা করে নিজেকে ভেবেছেন তার সন্তান। প্রবাসী মধুসূদন ভেবেছেন—মা যেমন সন্তানের কোনো দোষ মনে রাখেন না, দেশমাতৃকাও তাঁর সব দোষ ক্ষমা করে দেবেন। অবশ্য তিনি বিনয়ের সঙ্গে এও বলেছেন যে, তাঁর এমন কোনো মহৎ গুণ নেই, যে-কারণে তিনি স্মরণীয় হতে পারেন। বিনয়ী কবি তাই দেশমাতৃকার কাছে এই বলে প্রণতি জানাচ্ছেন, তিনি যেন দেশমাতৃকার স্মৃতিতে পদ্মফুলের মতো ফুটে থাকেন ।
কবি-পরিচিতি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রথা বিরোধী লেখক। তিনি মহাকাব্য, গীতিকাব্য, সনেট, পত্রকাব্য, নাটক, প্রহসন ইত্যাদি রচনা করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। শৈশব থেকে তাঁর মনে কবি হওয়ার তীব্র বাসনা ছিল। তিনি মনে করেছিলেন, বিলেত না গেলে কবি হওয়া যাবে না। বিলেতে গেলে সুবিধা হবে—এ আশায় তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে তাঁর নামের আগে ‘মাইকেল’ শব্দটি যুক্ত হয়। পরে তিনি সত্য উপলব্ধি করতে পারেন এবং বাংলায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও তিনি হিব্রু, ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান, তামিল, তেলেগু ইত্যাদি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ রচনা করেন।
তাঁর রচিত প্রহসন : ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’, ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’; নাটক : ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’; পত্রকাব্য : ‘বীরাঙ্গনা’ ইত্যাদি। ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ নামে একটি সনেট-সংকলনও তিনি রচনা করেন । তিনি ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে যশোরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ।
কৰ্ম-অনুশীলন
ক. ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ শীর্ষক কবিতাটি নিয়ে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন কর (শ্রেণির সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে। শুদ্ধ উচ্চারণ, উচ্চারণে স্পষ্টতা, শ্রবণযোগ্যতা, বোধগম্যতা, আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ইত্যাদি বিবেচনায় রাখতে হবে।)
নমুনা প্রশ্ন
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. ‘মক্ষিকা’র সমার্থক শব্দ কোনটি?
ক. মৌমাছি
খ. মাছি
গ. বোলতা
ঘ. ফড়িং
২. নরকূলে ধন্য কে?
ক. ক্ষমতাবান ব্যক্তি
খ. দীর্ঘজীবী মানুষ
গ. যিনি কীর্তিমান
ঘ. মন্দিরের সেবক
নিচের কবিতাংশ পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
ক. ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম— যেন এই দেশেতে মরি।
খ. বাংলার হাওয়া বাংলার জল
হৃদয় আমার করে সুশীতল।
৩. কবিতাংশে ‘বঙ্গভূমির প্রতি’- কবিতার কোন চরণটির ভাব প্রকাশ পেয়েছে?
ক. অমর করিয়া বর, দেহ দাসে, সুবরদে!
খ. রেখো মা দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে।
গ. চিরস্থির করে নীর, হায় রে, জীবন-নদে?
ঘ. তবে যদি দয়া কর, ভুল দোষ, গুণ ধর
৪. ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতাটির মতো দ্বিতীয় (খ) কবিতাংশেও প্রকাশ পেয়েছে
i. স্বদেশের প্রতি অনুরাগ
ii. স্বদেশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ
iii. প্রশান্তি
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
১. আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়— হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
২. মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। এই সূর্য করে এই পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই !
ক. বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মহাকাব্যের নাম কী?
খ. কবি বর প্রার্থনা করেন কেন? ব্যাখ্যা কর ।
গ. উদ্দীপকের প্রথম কবিতাংশের আলোকে ‘ফুটি যেন স্মৃতি-জলে’ চরণটির ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. “দ্বিতীয় কবিতাংশ ও ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতার মূল সুর একই”- তুমি কি একমত? যুক্তিসহ উত্তর দাও।
আরও দেখুনঃ