বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা । Bangabandhu o Bangladesh Rocona

আজ আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর অবিস্মরণীয় নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করবো। বঙ্গবন্ধু, যাঁকে সংক্ষেপে শেখ মুজিব অথবা simply ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে পরিচিত, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের নেতা নন, বরং গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন প্রতিভাবান নেতা হিসেবে সমাদৃত।

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের অধিকার ও স্বাধিকারের জন্য সংগ্রাম শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্রতা ও স্বাধীনতার জন্য অবিচলিত নেতৃত্ব প্রদান করেন। তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য অর্জিত হয় এবং তিনি বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম শুধু রাজনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং তিনি সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধেরও প্রতীক। তাঁর আদর্শ, ত্যাগ এবং দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করে। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বাংলাদেশ এবং তার জনগণের হৃদয়ে অমলিন এক ইতিহাস হয়ে থাকবে।

 

Table of Contents

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা [ Bangabandhu o Bangladesh Rocona ]

ভূমিকাঃ

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। তিনি একটি পরাধীন, অধিকারহীন, নিষ্পেষিত বাঙ্গালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাধীনতার তৃষ্ণা সৃষ্টি করেছেন। সেই জাতিকে সুসংগঠিত করে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন। এরপর স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদেরকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ক্ষণে উপস্থিত করেছেন। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণার পরে যখন গোপ্তার হন, তখনও তিনি বাংলার মানস-পটে ছিলেন স্বাধীনতার বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে। “আমার নেতা, তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব” এই শ্লোগানের সাথে বাঙ্গালি যুদ্ধ করে শত্রুদের বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। তার এই অবদানের জন্য আমরা তাকে আমাদের জাতির পিতা হিসেবে সম্মান করি।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি :

ও বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পিছনে তার অবদান ও ত্যাগ ভুলবার নয়। আমদের উচিত তার জীবনী সম্পর্কে গভীর ভাবে জানা । আজ আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে রচনা আকারে আলোকপাত করবো।

জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৬ মার্চ পূর্বে ফরিদপুর ও বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং; মাতার নাম সায়েরা খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে; তিনি ছিলেন তৃতীয় ।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবন:

১৯২৭ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বয়স ৭ বছর তখন তিনি স্থানীয় গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯২৯ সালে ৯ বছর বয়সে তাকে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি করানো হয়। পরে তিনি মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে যখন তিনি বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হন, তখন তার প্রায় ৪ বছর পড়াশোনা ছিল।

তারপর ১৯৩৬ সালে তিনি আবার মিশনারি স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে তিনি ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তির সুযোগ পান এবং বেকার হোস্টেলে থাকতে শুরু করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন।

১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সমর্থন ও নেতৃত্বের মধ্যে প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এবং আইন অধ্যয়নরত অবস্থায় তাকে তার ছাত্রজীবনের ইতি টানতে হয়।

রাজনীতি-পূর্ব জীবন:

বিশ্ব রাজনীতির অবিসংবাদিত নেতা এবং বাংলা ও বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতি শুরুর আগে থেকেই গ্রামের দরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে নিজের মধ্যে এক ধরনের তারণা অনুভব করতেন। তার মাথায় ছিল এই দরিদ্র মানুষের জন্য কিছূ একটা করতে হবে।

ছোট বেলা থেকেই ক্ষুধার্তদের মুখে নিজের খাবার তুলে দেওয়ার ঘটনা দু-একটি নয়; বরং অনেক। তাছাড়া শীত এলেই অনেক অসহায় শীতার্ত মানুষকে নিজের চাদর দান করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেন। অন্যায় যতই শক্তিশালীই হোক না কেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিশোধ নিতে কখনো দ্বিধা করতেন না।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ও বিশেষ অবদানঃ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ছাত্রাবস্থা থেকেই। আর তার রাজনৈতিক জীবনে বিশেষ অবদান রয়েছে।

ভাষা আন্দোলন:

প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আইনসভায় ঘোষণা করেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করবে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে এই ঘোষণার প্রতিবাদ করেন। ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম হলে ভাষা বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

১১ মার্চ হরতাল চলাকালে সচিবালয়ের সামনে থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আবার ঘোষণা করেন, ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।

এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিবস হিসেবে পালন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আহ্বান জানান। এর দাবিতে ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু কারাগারে অনশন শুরু করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে ছাত্র-জনতা ঢাকার রাজপথে মিছিল করলে পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়। এতে সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত, সফিউরসহ বহু মানুষ শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কারাগারে বসে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং ১৩ দিন অনশন চালিয়ে যান। তিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান।

ছয় দফা আন্দোলন:

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন, যা ছিল কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা। বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত এই দাবি পরবর্তীকালে বাঙালির “প্রাণের দাবি” ও “বাঁচা মরার দাবি” হিসেবে পরিচিতি পায়।

আগরতলা মামলার আসামী:

১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মোট ৩৫ জন সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে মামলা করে। এরপর ১৯ জুন কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা মামলার বিচার শুরু হয়।

গণঅভ্যুত্থান:

৬ দফাসহ ১১টি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে পরিষদ দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে।

একপর্যায়ে এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত এক সংবর্ধনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

বাংলাদেশের নামকরণ:

১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন বাংলাদেশ।

নির্বাচনী বিজয়:

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গ জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসন ভিত্তিক আসনের মধ্যে ১৬০টিতে জয়লাভ করে।

তাছাড়া, সংরক্ষিত ৬টি মহিলা আসন সহ আওয়ামী লীগের মোট আসন সংখ্যা ১৬৭টি। আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসন ভিত্তিক আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করেছে। এছাড়া ১০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগের মোট আসন সংখ্যা ২৯৮টি।

BanglaGOLN.com Logo 252x68 px White বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ রচনা । Bangabandhu o Bangladesh Rocona

 

পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা, বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তা:

নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্জনের পরেও বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে সরকার গঠন করা হয়নি। পাকিস্তান পিপলস‌ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করতে থাকে। এর পরিবর্তে তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য দুইজন প্রধানমন্ত্রীর আজব প্রস্তাব করেন। সেই সাথে ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয় দফা প্রত্যাখ্যান করেন। “এক ইউনিট কাঠামো” নিয়ে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এরূপ অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা মার্চ রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। জ্বলে ওঠে বাঙ্গালী।

এই সময় বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন রকম হুমকি, ধমক, ইত্যাদি চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা দেখিয়ে স্থির থাকেন এবং এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানি ক্ষমতাসীনরা চূড়ান্ত বিপদে পড়ে। এই ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সরকারি দপ্তর বঙ্গবন্ধুর আদেশে চলতে থাকে। বাংলাদেশ অংশে পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

ঢাকায় আলোচনা:

৩রা মার্চ রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানসহ দুই প্রদেশের দুই নেতা দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই আলোচনায় কোনো সন্তোষজনক ফলাফল না আসায় শেখ মুজিবুর রহমান দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা গৃহযুদ্ধ আসন্ন দেখে।

এসময় ভুট্টো তার বিশ্বস্ত সঙ্গী মুবাশির হাসানকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠান। এরপর ভুট্টোর ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সময়ে ভূট্ট্রো কৌশলে একটি গুজব প্রচার করেন। সেই গুজবে বলা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ও ভুট্টো রাষ্ট্রপতি করে সম্মিলিত সরকার গঠনে দুজনেই সম্মত হয়েছেন। এই খবর প্রকাশিত হবার পরে ৫ই মার্চ বঙ্গবন্ধু তা অস্বীকার করে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন। ভূট্ট্রো এতদিন সেনাবাহিনী ও সামরিক শাসক কে বুঝিয়ে এসেছিলেন তার এসব ফর্মুলা কাজ করবে। কিন্তু এই খবর শোনার পরে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য ভুট্টো রহমানের উপর চাপ বৃদ্ধি শুরু করে সেনাবাহিনী। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখেন এবং ৭ মার্চ ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ :

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে তিনি ২৫ মার্চের অধিবেশনের পূর্বেই বাস্তবায়নের জন্য আরও চার দফা দাবি পেশ করেন:

অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে;
অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে;
গণহত্যার তদন্ত করতে হবে;
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

এই ভাষণে তিনি বাংলার “ঘরে ঘরে দুর্গ” গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি ভাষণের মধ্যে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ক্ষণের ইঙ্গিত দেন। তিনি জানতেন, কোন আক্রমণ বা আইনত প্রক্রিয়া ছাড়া সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তার আন্দোলনকে পাকিস্তান সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন [ Secessionist Movement ] হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে। এরপর সেনাবাহিনী দিয়ে দমন করলেও আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

তাই বঙ্গবন্ধু কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে কি কি করতে হবে তা ভাষণের মধ্যে বলে দেন। তিনি এও বলে দেন যে, স্বাধীনতার ঘোষণা নাও দিতে পারেন, তাহলে স্বাধীনতার জন্য কি কি করতে হবে, তারও নির্দেশনা দেন। সবাইকে ফিরে গিয়ে স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিতে এবং শত্রুর মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এই ভাষণটিই মূলত বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে।

মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক:

এমতাবস্থায় ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন। কিন্তু একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অভিযান চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ১০ থেকে ১৩ তারিখ পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স পূর্ব পাকিস্তানে “সরকারি যাত্রী” বহনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের সমস্ত আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে। এই “সরকারি যাত্রী”রা ছিলেন মূলত সাদা পোশাকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

এসময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে অধিষ্ঠানের জন্য জেনারেল টিক্কা খানকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বিচারপতি সিদ্দিকসহ পূর্ব পাকিস্তানের কোনও বিচারপতি তার শপথ পাঠ করাতে রাজি হননি। পাকিস্তান নৌবাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই জাহাজ এমভি সোয়াত চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। কিন্তু বন্দরের বাঙালি কর্মী ও নাবিকেরা জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করে। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের এক দল বাঙালি সৈন্য বিদ্রোহ শুরু করে এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে। অনেক আশা সত্ত্বেও মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হয়নি।

সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের মতে, শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের প্রধান চার নেতা পরিকল্পনা করেছিলেন যে, ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পরপরই সংসদে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে বৈধ আইনগত প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত করবেন। কিন্তু খন্দকার মোশতাক আহমেদ তা গোপনে ভুট্টোকে জানিয়ে দেন, যার কারণে ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তর না করে অপারেশন সার্চলাইটের গোপন পরিকল্পনা করতে থাকেন। ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সশস্ত্র অপারেশনের গোপন সংকেত প্রদান করে সন্ধ্যায় গোপনে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন।

অপারেশন সার্চলাইট ও স্বাধীনতার ঘোষণা :

বাঙালি জাতীয়তাবাদী স্বাধিকার আন্দোলনকে অবদমিত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যা শুরু করে, যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। সেই রাতে শুরু হওয়া গণহত্যার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে প্রচারিত এক বেতার ভাষণে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘোষণাটি নিন্মরুপ:

বাংলায় স্বাধীনতার ঘোষণা:

“ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি, যে যেখানে আছ, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো। পাকিস্তানী বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।”
— শেখ মুজিবুর রহমান
২৬ মার্চ, ১৯৭১

ইংরেজিতে স্বাধীনতার ঘোষণা:

“This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”

— Sheikh Mujibur Rahman
26 March, 1971

বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের আগেই বেতার ভাষণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ছড়িয়ে দিতে আদেশ দেন। ঘোষণাটি তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তানি সেনাদের বর্ণনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ঘোষনাটি রেডিওর মাধ্যমে শুনতে পাবার পরই তারা বঙ্গবন্ধুকে আটক করার নির্দেশ দেয়। ২৯ মার্চ পাকিস্তান রেডিওর মাধ্যমে জানা যায় পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ২৬ মার্চ রাত আনুমানিক দেড়টায় গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধ ও বন্দিজীবন:

লাহোর থেকে ৮০ মাইল দূরে পাকিস্তানের উষ্ণতম শহর লায়ালপুরের (বর্তমান ফয়সালাবাদ) কারাগারে শেখ মুজিবকে কড়া নিরাপত্তায় আটকে রাখা হয়। তাকে নিঃসঙ্গ সেলে (সলিটারি কনফাইন্টমেন্ট) রাখা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর সরকার, বাংলাদেশের প্রথম সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ:

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (বর্তমানে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সরকারের রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দিন আহমেদ হন প্রধানমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বড় রকমের বিদ্রোহ সংঘটিত করে। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর মধ্যকার সংঘটিত যুদ্ধটিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত।

কারামুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তন:

পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়বরণ করার ফলশ্রুতিতে ২০শে ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতাচ্যুত হয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতা হস্তান্তরকালেও ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তা আন্তর্যাতিক চাপে সম্ভব ছিলোনা। কারণ ইতমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধি সারা বিশ্বে সফর করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার পক্ষে এক শক্ত জনমত গঠন করেছিলেণ। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জানুয়ারি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

সেদিন রাত ২টায় অর্থাৎ ৮ই জানুয়ারির প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি কার্গো বিমান লন্ডনের উদ্দেশ্যে রাওয়ালপিন্ডি ছাড়ে। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি লন্ডন থেকে নয়াদিল্লিতে ফিরে আসেন এবং ভারতীয় রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের পর জনসমক্ষে ভাষন দেন। এরপর তিনি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে এসে তিনি সেদিন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সামনে বক্তৃতা দেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও বাংলাদেশের সরকার পরিচালনা :

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ মুজিবুর রহমান অল্পদিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান আইনসভার জন্য নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি তারিখে নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংসদ গঠন করেন। ১২ই জানুয়ারি সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিকট হস্তান্তর করেন।

বঙ্গবন্ধুর মহাপ্রয়াণ:

১৫ আগস্ট জাতীয় শোকের দিন। বাংলার আকাশ-বাতাস আর প্রকৃতিও অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। কেননা পঁচাত্তরের এই দিনে আগস্ট আর শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়।

উপসংহার:

বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত। সেই সংক্ষিপ্ত জীবনটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের জন্য, বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য। স্ত্রী, সন্তান, সংসার ত্যাগ করে সংক্ষিপ্ত জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন করার কারণে পাকিস্তানি অপশক্তি ও আন্তর্জাতিক কর্তৃত্ববাদীদের চিরশত্রুতে পরিণত হন তিনি। এছাড়া জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতি ও তার বিশ্বে নেতৃত্বে ভূমিকার কারণে তিনি ওই শত্রুদের আরও অস্থির করে তোলেন। সেই অপশক্তি ও তার দেশি দোসরদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হয়। তার স্বল্প দিনের দেশ পুনর্নির্মাণ আজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি থাকলে আজ বাংলাদেশ আরও উন্নত একটি দেশ হতো। এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন তার নাম জড়িয়ে থাকবে বাংলাদেশের সাথে ওতপ্রোত ভাবে।

 

আরও পড়ুন:

Leave a Comment