ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতা – শামসুর রাহমান

‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ কবিতাটি বাংলাদেশের সাহিত্য ও ইতিহাসে এক অনন্য স্বাক্ষর। এটি শুধু একটি কবিতা নয়, বরং একটি যুগচেতনার দলিল, যেখানে দেশপ্রেম, গণজাগরণ এবং সংগ্রামী চেতনার অগ্নিশিখা একাকার হয়ে উঠেছে। কবিতাটি রচিত হয়েছে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান– সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, যখন পূর্ব পাকিস্তানে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল জনতা রাজপথে নেমে আসে, স্বাধীনতার বীজতলা হয়ে ওঠে জমিন।

এই কবিতায় দেশমাতৃকার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের দীপ্তি ভাষার প্রতিটি ছত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। কবি এই কবিতায় তুলে ধরেছেন জনগণের দুর্বার জাগরণ, রক্তে রঞ্জিত রাজপথ, পতাকার সম্ভ্রম রক্ষা এবং তরুণদের বলিষ্ঠ পদচারণার মধ্য দিয়ে একটি ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের চেতনা।

গদ্যছন্দে রচিত এই কবিতায় রয়েছে প্রবাহমান, প্রত্যয়ী ও তীব্র ভাষার শিল্পিত প্রকাশ, যা বাংলা কবিতায় সংগ্রামী সাহিত্যের ধারাকে আরও শক্তিশালী করেছে। এটি কেবল সাহিত্যিক সৃষ্টিই নয়, বরং ইতিহাসের একটি সংবেদনশীল ভাষ্য, যা আজও পাঠকের হৃদয় ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে তোলে। ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’ তাই বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেমিক কবিতার ধারায় এক উজ্জ্বল সংযোজন।

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতা – শামসুর রাহমান

আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা
শহিদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রং।
এ-রঙের বিপরীত আছে অন্য রং,
যে-রং লাগে না ভালো চোখে, যে-রং সন্ত্রাস আনে
প্রাত্যহিকতায় আমাদের মনে সকাল-সন্ধ্যায়-
এখন সে রঙে ছেয়ে গেছে পথ-ঘাট, সারা দেশ
ঘাতকের অশুভ আস্তানা।
আমি আর আমার মতোই বহু লোক
রাত্রি- দিন ভূলুণ্ঠিত ঘাতকের আস্তানায়, কেউ মরা, আধমরা কেউ,
কেউ বা ভীষণ জেদি, দারুণ বিপ্লবে ফেটে পড়া।
চতুর্দিকে মানবিক বাগান, কমলবন হচ্ছে তছনছ।
বুঝি তাই উনিশশো উনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের চোখে আজ আলোচিত ঢাকা,
সালামের মুখে আজ তরুণ শ্যামল পূর্ববাংলা।
দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই জনসাধারণ
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে
হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায়। সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ,
শিহরিত ক্ষণে ক্ষণে আনন্দের রৌদ্রে আর দুঃখের ছায়ায়।

 

 

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার মূলভাবঃ

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতার মূলভাবঃ কবি শামসুর রাহমানের ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সংগ্রামী চেতনা, দেশপ্রেম ও গণজাগরণের জন্য উদ্বুদ্ধ করার মতো একটি কবিতা । ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন, শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান রূপ নেয় ।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এদেশের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে । ঢাকার রাজপথে জনগণের ঢল নামে । এ কাতারে সামিল হয় গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ, কলকারখানার শ্রমিক, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ ।

কবি এ কবিতায় পরম মমতায়, শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সকল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামী চেতনাকে শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন। এই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান, মতিউর, ড. শামসুজ্জোহা প্রমুখের মৃত্যুকে ভাষা-শহিদ সালাম ও বরকতের প্রতীকে তাৎপর্যময় করে তুলেছেন ।

 

ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ কবিতা আবৃত্তিঃ

 

 

Leave a Comment