প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে – নারীর চিত্রায়ণ : পাশ্চাত্যের মহাকাব্য হোমারের ইলিয়াড ও ভার্জিলের ঈনিড-এর কেন্দ্রীয় দুই নারী চরিত্র হেলেন ও ডিডো। গ্রীক ও লাতিন মহাকাব্যের এই দুই রমণী সাহিত্যে বিশেষভাবে আলোচিত। তবে হেলেনই বোধকরি অধিক আলোচিত। হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি ছাড়াও সেরা তিন গ্রীক নাট্যকার ইস্কিলাস, সফোক্লিস ও ইউরিপিডিসের একাধিক নাটকে হেলেন উপস্থিত। হেলেনের চরিত্র চিত্রণে এঁরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছেন।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ - Helen of Troy by Evelyn De Morgan, 1898, London
Helen of Troy by Evelyn De Morgan, 1898, London

কঠোর নীতিবাদী ইস্কিলাসই সম্ভবত হেলেনের সমালোচনায় সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন। হেলেন নামের উৎপত্তির পেছনে তিনি ‘নরক’ (Hell)-এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন। তাঁর Agamemnon নাটকে হেলেনের ক্ষমাহীন পাপের উল্লেখ রয়েছে। হেলেন চিত্রিত হয়েছেন অশুভের প্রতীক হিসেবে। তাঁর ভুবনমোহিনী রূপকেও ইস্কিলাস অগ্রাহ্য করেছেন অনেকটা হোমারের মতই। হেলেনের প্রতি সফোক্লিসের মনোভাব বরং কিছুটা নমনীয়। তবে ইউরিপিডিসের নাটকেই হেলেন অধিক প্রাণবন্ত। হেলেনের সৌন্দর্যের প্রতি আদৌ উদাসীন ছিলেন না তিনি। হেলেনকে তিনি চিত্রিত করেছেন সৌন্দর্য-সর্বস্ব হাল্কা হৃদয়ের সাধারণ এক রমণী রূপে।

আমাদের আরও প্রতিবেদন পড়ুন:

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ

তবে হোমারের ইলিয়াডে হেলেন চিত্রিত হয়েছেন প্রেমিকার চরিত্রে। হেলেন জননী ছিলেন এক কন্যার, কিন্তু হোমার তাঁকে জননী বা স্ত্রীর পরিচয়ে উপস্থাপিত করেননি, যেমনটি করেছেন এ্যান্ড্রোমাকিকে। ঈনিড-এও ডিডোর উপস্থিতি প্রেমের পটভূমিতে। ভার্জিলের বর্ণনায় সম্রাজ্ঞী ডিডোর চেয়ে প্রেমিকা ডিডোই অধিক জীবন্ত। ইলিয়াড-এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে; নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। হেলেনকে উপলক্ষ করেই এই নারকীয় কাণ্ড ঘটেছে ট্রয় নগরীতে।

গ্রীক উপকথা অনুসারে, দেবী আফ্রোদিতি প্যারিসকে বর দিয়েছিলেন বিশ্বের সেরা সুন্দরীর প্রেমের। আর এই বর লাভের জন্য প্যারিস আফ্রোদিতিকে ঘোষণা করেছিলেন দেবীদের মধ্যে সেরা সুন্দরী বলে। হেলেন ছিলেন সে সময়ে বিশ্বের সেরা সুন্দরী। অবশ্য কী ভাবে তিনি সেরা সুন্দরী বিবেচিত হয়েছিলেন তার বিশদ বিবরণ নেই গ্রীক উপকথায়। আজকের পাঠকের কাছে তা এক কৌতূহলী জিজ্ঞাসা।

প্যারিসকে এই বর দান কালে হেলেন ছিলেন বিবাহিতা। বিবাহিতা রমণীর সঙ্গে অবৈধ প্রেম, আর স্বর্গীয় দেবীরই ইঙ্গিতে — নৈতিক বিচারে গর্হিত মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবে গ্রীক সমাজে এ ধরনের ঘটনা বিরল ছিল না। এ ব্যাপারে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা উদার ছিল বলেই মনে হয়। উপকথা অনুযায়ী বিবাহের পূর্বেই হেলেনকে থিসিউস অপহরণ করেছিলেন। ক্যাস্টর ও পলুকা ভ্রাতৃদ্বয় পরে হেলেনকে উদ্ধার করেন।

গ্রীক উপকথা অনুযায়ী মর্ত্যের মানুষের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করা ছিল স্বর্গীয় দেব-দেবীর খেয়াল খুশীর ব্যাপার। আচরণে দেবতাকুল মানুষের চেয়ে কোনক্রমেই শ্রেয়তর ছিলেন না। কলহ, দ্বন্দ্ব ও জৈবিক আচরণে তাঁরা মানুষকেও ছাড়িয়ে গেছেন। মানুষ মরণশীল আর তাঁরা মৃত্যুর নাগালের বাইরে – এই অনুধাবন তাঁদের আরো বেশী স্বেচ্ছাচারী করে তুলেছিল। হোমার তাঁর ইলিয়াড-এ দেবতাদের প্রতি বিদ্রূপাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করেছেন সে কারণে। অবশ্য প্লেটো সেজন্য হোমারের সমালোচনা করেছেন। তবে এ্যারিস্টটল হোমারকে দেখেছেন। ভিন্ন নিরিখে। তাঁর কাব্যতত্ত্বে এ্যারিস্টটল হোমারের প্রশংসাই করেছেন অধিক।

The death of Dido by the German painter, Heinrich Friedrich Füger
The death of Dido by the German painter, Heinrich Friedrich Füger

হেলেন আফ্রোদিতির স্বেচ্ছাচারিতার নির্মম শিকার। দেবীর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে অবশ্য হেলেনের প্রতিবাদী কণ্ঠ স্বোচ্চার হয়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুক্তি কোনদিনই পাননি হেলেন। হতাশা ও মানসিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়েছেন তিনি। আত্মগ্লানি, অনুশোচনা ও অসহায়তায় পীড়িত হেলেন মৃত্যু কামনা করেছেন বার বার। কিন্তু আত্মহত্যার পথ বেছে নেননি তিনি, যেমনটি নিয়েছেন ডিডো। এখানেই দু’জনের সবচেয়ে বড় পার্থক্য। হেলেন যেখানে বিবেক-পীড়িত, ডিডো সেখানে একেবারেই আবেগপ্রবণ। কার্থেজ নগরীর সার্থক শাসনকর্ত্রী হলেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ নিজের আবেগকে শাসন করতে ডিডো ব্যর্থ হয়েছেন পুরোপুরি। এখানেই ডিডো চরিত্রের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।

ইলিয়াড-এ হেলেনের উপস্থিতি মাত্র কয়েকটি ‘পুস্তকে’। কিন্তু সমগ্র মহাকাব্যেই তাঁর নীরব উপস্থিতি অনুভূত হয়। তাঁর সামগ্রিক উপস্থিতি ইলিয়াড এর ‘ঐক্য’কে করেছে সুদৃঢ়। সৌন্দর্য ও দুর্ভাগ্য হেলেন চরিত্রের দু’টি দিক। হেলেনের জীবনে তাঁর অপরূপ সৌন্দর্য এসেছে অভিশাপ হয়ে। ভুবনমোহিনী এই রূপের কারণেই দেবীর স্বেচ্ছাচারিতার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত তিনি। এই রাজ-নন্দিনীর জীবনে কোন মুক্তি নেই, নেই কোন স্বস্তি। ট্রয় যুদ্ধের বিজয়ী তাঁকে লাভ করবেন পুরস্কার হিসেবে, কিন্তু হেলেনের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটবে না এতে।

আমাদের আরও প্রতিবেদন পড়ুন:

প্যারিস বা মেনেলিউস যিনিই তাঁকে লাভ করুন না কেন, হেলেনের অভিশপ্ত জীবনে তা কোন স্বস্তি আনবে না। তাঁর সৌন্দর্যে বিমোহিত পুরুষ জৈবিক প্রয়োজনেই তাঁকে কামনা করবে, তাঁর যন্ত্রণাদগ্ধ মনের খবর তাদের কাছে নিতান্তই নিষ্প্রয়োজন। এই নিষ্ঠুর উপলব্ধি হেলেনের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে হেলেন যেন আত্মভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত। তীব্র ক্ষোভ, অনুশোচনা আর আত্ম গ্লানিতে তাঁর উচ্চারণে মৃত্যু কামনা প্রকাশ পেয়েছে বার বার।

“এখানে আসার আগে মৃত্যুকে বেছে নেয়াই উচিত ছিল আমার” (তৃতীয় পুস্তক)। “প্রথমেই যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম” (চতুর্বিংশতি পুস্তক)। “আমার জন্মলগ্নে প্রচণ্ড এক ঝড় যদি আমাকে উড়িয়ে নিত এক পর্বত চূড়ায় বা কোন গর্জনশীল সমুদ্রে — আর এত কিছু ঘটার আগেই যদি নেকড়ের দল আমাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলত” (ষষ্ঠ পুস্তক)। মৃত্যুকে হেলেন আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন, স্বাগত জানিয়েছেন বার বার, কিন্তু সে সাধ পূর্ণ হয়নি তাঁর। নিজের প্রয়োজনেই দেবী তাঁকে মরতে দেননি।

হেলেনের সৌন্দর্যের কোন স্তুতি নেই ইলিয়াডে। বরং একে উপস্থাপিত করা হয়েছে অশুভের প্রতীক হিসেবে। হেলেনের সৌন্দর্য দর্শনে বৃদ্ধ ট্রোজানরা হয়েছেন স্তম্ভিত ও ভীত-সন্তস্ত। হেলেনকে তাঁদের কাছে মনে হয়েছে ধ্বংস ও মৃত্যুর অশুভ প্রতীক হিসেবে। হেলেনের উপস্থিতি অনিষ্টকর। অবিলম্বে তাঁরা হেলেনের কবল থেকে মুক্তি পেতে চান। বৃদ্ধ এই ট্রোজানদের প্রতিক্রিয়া ও উচ্চারণের মাধ্যমে হোমার হেলেনের সৌন্দর্যের ধ্বংসাত্মক দিকের কথাই হোমারের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘অ-রোমান্টিক’ বলা হয়েছে সঙ্গতভাবেই।

Andromache Mourning Hector by Jacques-Louis David, 1783
Andromache Mourning Hector by Jacques-Louis David, 1783

ইলিয়াড-এর তৃতীয় পুস্তকে আমরা প্রথম বারের মত হেলেনকে দেখি। নগরীর বাইরে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পটভূমিতে হেলেন গভীর মনোযোগে সূচীকর্মে মগ্ন। নীলাভ রক্তিম বর্ণের জালের ওপর গ্রীক ও ট্রোজানদের মধ্যে সংঘটিত কয়েকটি যুদ্ধের চিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলছেন দক্ষ শিল্পীর মত। ঘটনাটিকে তাৎপর্যপূর্ণ মনে করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে জালের উপমা ব্যবহার গ্রীক সাহিত্যে বিশেষতঃ ইস্কিলাসের নাটকে আমরা দেখতে পাই।

নীলাভ রক্তিম বর্ণ যেন সেই ধ্বংসের ভয়াবহতারই বহিঃপ্রকাশ। হেলেন চরিত্রের দুঃসহ যন্ত্রণা প্রকাশ পেয়েছে যুদ্ধের চিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে। এই চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে হেলেন যেন তাঁর দুর্ভাগ্যের নীল নকশার প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করেছেন সজ্ঞানে। ইলিয়াড-এর শেষ দিকে আমরা এ্যান্ড্রোম্যাকিকেও অনুরূপ নীলাভ রক্তিম বর্ণের জালের ওপর সূচীকর্মে মগ্ন দেখি হেক্টরের মৃত্যু সংবাদ আসার পূর্ব মুহূর্তে।

হেলেন চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ না করে বরং পরিস্থিতির ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা করা। তাঁর একাধিক মৃত্যু কামনায় তাঁর মুক্তি কামনাই প্রকাশ পেয়েছে বার বার। দেবী আফ্রোদিতির মুখোমুখী হয়েছেন হেলেন উদ্ধতভাবে। মুহূর্তের জন্য ভুলে গেছেন যে তিনি অসহায়া এক রমণী, স্বেচ্ছাচারী ও পরাক্রমশালী এক দেবীর সঙ্গে কথা বলছেন। ভুলে গেছেন যে তিনি তাঁরই ক্রীড়নক।

মেনেলিউস প্যারিসকে পরাস্ত করে এখন তাঁর ভ্রান্ত স্ত্রীকে গৃহে ফিরিয়ে নিতে এসেছে, আর তুমি বুঝি ষড়যন্ত্র আটছ দূরান্তের ফ্রাইজিয়া বা মনোহর মেয়োনিয়ার কোন শহরে বসবাসকারী তোমার পছন্দনীয় কাউকে দেবার জন্য আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে। তাই তুমি প্রথমেই আমাকে ভুলিয়ে প্যারিসের কাছে নিতে এসেছ। না, তুমি চলে যাও। উপবেশন কর তার সঙ্গে। ভুলে যাও যে তুমি একজন দেবী। অলিম্পাসে আর পদার্পণ কর না। বরং প্যারিসের প্রণয়ে অতিমাত্রায় লিপ্ত হও। হয়ত একদিন তার স্ত্রী কিম্বা দাসী হতে পারবে।

আমাদের আরও প্রতিবেদন পড়ুন:

হেলেনের এই উচ্চারণে আফ্রোদিতির বিরুদ্ধে তাঁর যে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে তা হেলেন চরিত্রকে কিছুটা প্রতীকী করে তুলেছে। স্বর্গীয় দেবতাদের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে হেলেন যেন মানুষের বিদ্রোহী প্রতিবাদী কণ্ঠ। আত্মসচেতনতা হেলেন চরিত্রের আর একটি দিক। হেলেন আত্মসচেতন ছিলেন বড্ড বেশী। তাই নিজের সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছেন, “আমি সত্যিই এক নির্লজ্জ কুমনা ঘৃণ্য প্রাণী” (ষষ্ঠ পুস্তক)। হেলেনের এই আত্মসমালোচনায় জীবনের প্রতি তাঁর অন্তহীন তিক্ততারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

ইলিয়াড-এর সমাপ্তি লগ্নে কিছুক্ষণের জন্য আমরা হেলেনকে দেখি। হেক্টরের শবদেহসহ রাজা প্রায়াম সদ্য প্রত্যাগত। শবদেহের ওপর করুণ বিলাপে ভেঙে পড়েছেন হেকাবে ও এ্যান্ড্রোমাকি। শোকাবিভূত ট্রোজানরাও উপস্থিত। বিলাপ মুখর এই পরিবেশে হেলেনের উপস্থিতি হেক্টরের মৃত্যুতে হেলেন গভীরভাবে শোকাহত। পরস্পরকে ‘ভগ্নি-ভাতা’ সম্বোধন করলেও তাদের সম্পর্ক ছিল স্নেহময় ও আন্তরিক। হেলেন ট্রয়ে অবস্থানকালে একমাত্র হেক্টরই তাঁর প্রতি কোন কটু বাক্য উচ্চারণ করেননি।

অপর কেউ হেলেনে দোষারোপ করলে তিনি তার প্রতিবাদ করেছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মধ্যযুগীয় রাজাদের মত তিনি হেলেনের রক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। আর হেক্টর তা করেছেন অগাধ ভগ্নি স্নেহে। হেক্টরের সঙ্গে হেলেনের প্রণয়জনিত কোন সম্পর্ক কল্পনাতীত। হেক্টরের এই রক্ষকের ভূমিকা সম্পর্কে হেলেনও ছিলেন পুরোপুরি সচেতন। তাই হেক্টরের মৃত্যুর পর নিজের অসহায়তা হেলেন আরো বেশী উপলব্ধি করেছেন। হেলেনের বিলাপ মুখর উচ্চারণঃ আপনার ও আমার দুর্ভাগা সত্তার জন্য আমি এই দুঃখের অশ্রু বর্ষণ করছি।”

ইলিয়াড-এর সমাপ্তিতে হেলেনের এই অসহায়তার ছবিই পাঠকের চেতনায় উদ্ভাসিত থাকে। এখানেও হেলেন চরিত্র প্রতীকী এই কারণে যে, তিনি মানুষের অসহায়তারই প্রতিচ্ছবি। হোমার বিভিন্ন প্রসঙ্গে মানুষের অসহায়তার কথা বলেছেন তাঁর মহাকাব্যে। মানুষকে তুলনা করেছেন গাছের পাতার সঙ্গে, সামান্য বাতাসেই যা ভূলুণ্ঠিত হয়। অন্যত্র দেবরাজ জিউসের উচ্চারণে বলেছেন, পৃথিবীর বুকে যত প্রকার প্রাণীর বাস, মানুষই তাদের মধ্যে সবচেয়ে অসহায় ও দুর্ভাগা।

অসহায়তা ও দুর্ভাগ্যই বয়ে এনেছে মানুষের জীবনে অশেষ দুঃখ। এ প্রসঙ্গে এ্যাকিলিসের অনুধাবন, মৃত্যুহীন দেবতারা মানুষের জীবনে সংযোজন করেছেন অশেষ দুঃখ। হোমারের এই মহাকাব্য অসহায় মানুষের দুর্ভাগ্য ও দুঃখের এক করুণ চিত্র। আর হেলেন হচ্ছেন তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্র। তবে লক্ষণীয়, ইলিয়াড-এর সমাপ্তি নৈরাশ্যে নয়। ইলিয়াড-এ যুদ্ধ আছে, আছে যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি রক্তপাত ও মৃত্যু। কিন্তু সে যুগের মানুষ বীরত্বের আদর্শে বিশ্বাসী।

যুদ্ধকে তাঁরা মনে করেন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসেবে। যুদ্ধ জীবনের একটি প্রয়োজনীয় দিক। আর তা ছাড়া ইলিয়াড-এ যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে তা এক নৈতিক কারণে। পরস্ত্রী হেলেনকে অপহরণ করে প্যারিস যতটুকু পাপ করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশী পাপ করেছেন অন্য কারণে। মেনেলিউসের গৃহে আতিথ্য গ্রহণের পর গৃহকর্তার অনুপস্থিতির সুযোগে গৃহকর্ত্রীকে অপহরণ করে প্যারিস বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় দেন; অবমাননা করেন গ্রীকদের অতি পবিত্র সেই অতিথি-গৃহকর্তার সম্পর্কের, যা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব স্বয়ং দেবরাজ জিউসের।

আরও পড়ুন:

রাজা প্রায়াম পুত্রের এই অপকর্ম সমর্থন না করলেও। হেলেনকে প্রতার্পণের গ্রীক দাবী প্রত্যাখ্যান করেন এই অজুহাতে যে, অতীতে গ্রীকদের হাতে আটক তাঁর ভগ্নি হেসিওনিকে প্রতার্পণ করা হয়নি। এ ভাবেই প্যারিসের ক্ষমাহীন পাপের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন প্রায়াম, সংঘটিত হয় ট্রয় নগরীর ধ্বংসযজ্ঞ। অবশ্য সে ধ্বংসযজ্ঞের বিশদ বিবরণ হোমার দেননি সঙ্গত কারণেই।

নিষ্ঠুরতম প্রতারণামূলক সে ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ শুনলে স্বভাবতই শ্রোতৃমণ্ডলী ট্রোজানদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতেন, যদিও নৈতিক কারণে তাঁরা গ্রীকদের সমর্থক ছিলেন। উল্লেখ্য, ইলিয়াড মূলত মৌখিক (oral) মহাকাব্য। সমবেত শ্রোতার উদ্দেশ্যে হোমার চারণকবির মত তাঁর কাহিনী বর্ণনা করেছেন। লোক মুখে প্রচলিত হোমারের সে কাহিনী পরবর্তীকালে লিপিবদ্ধ হয়েছে।}

অবশ্য ট্রয় নগরীর ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ রয়েছে ভার্জিলের ঈনিড-এ। প্রত্যক্ষদর্শীর সে বিবরণ দিতে গিয়ে নায়ক ঈনিয়াস (যিনি জাতিতে ট্রোজান এবং স্বর্গীয় নির্দেশে ট্রয় নগরীর পতনের পর উদ্ধার প্রাপ্ত কতিপয় ট্রোজানদের সঙ্গে নিয়ে একটি নতুন বাসভূমি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিবেদিত) হেলেন সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য দিয়েছেন। একটি বিশাল আকৃতির কাঠের ঘোড়ার মধ্যে সৈন্য লুকিয়ে রেখে তা সুকৌশলে ট্রয় নগরীতে পাঠিয়ে গ্রীকরা গভীর রাতে অতর্কিতে ট্রয় নগরী আক্রমণ করেন।

ভীত-সন্ত্রস্ত হেলেন তখন মন্দিরের বেদীর আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। ভয় করছিলেন তিনি গ্রীক ও ট্রোজান উভয়কেই। তাঁর প্রতি ট্রোজানদের বিদ্বেষ ও গ্রীকদের প্রতিহিংসা-পরায়ণতা সম্পর্কে তিনি পূর্ণ সচেতন। সচেতন তিনি মেনেলিউসের ক্রোধ সম্পর্কেও। শত্রু তিনি আজ সকলের। আক্রান্ত হতে পারেন যে কোন দিক থেকেই। হেলেনের ঐ সঙ্কট মুহূর্তে ঈনিয়াস তাঁর মুখোমুখি হন।

হেলেনকে অসহ্য মনে হয় তাঁর কাছে। ট্রোজানদের জীবনে ধ্বংস ডেকে এনে তখন বিজয়িনীর বেশে ফিরে যাবেন হেলেন, অলঙ্কৃত করবেন রাণীর সিংহাসন, আর যুদ্ধ বন্দী সকল সম্ভ্রান্ত ট্রোজান নর-নারী শৃঙ্খলিত হবে তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ দাসত্বে! নারী হত্যায় কোন গৌরব নেই জেনেও স্বজন হত্যার প্রতিশোধকল্পে হেলেনকে হত্যা করতে মনস্থ করেন ঈনিয়াস। কিন্তু সুকৌশলে আফ্রোদিতি (ঈনিডের ভেনাস) তাঁকে নিবৃত্ত করেন।

এ ভাবেই জীবন রক্ষা পেয়েছে হেলেনের, যে জীবনকে তিনি ঘৃণা করেছেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। হোমারের হেলেন ও টলস্টয়ের এ্যানা চরিত্রের যথেষ্ট মিল লক্ষণীয়। উভয় রমণীই গৃহত্যাগ করেছেন নিষ্ঠুর আফ্রোদিতির প্ররোচনায়। জীবনে মুক্তি ও অনাবিল শান্তি কাম্য ছিল উভয়েরই, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন দু’জনেই, অনুশোচনা ও আত্ম গ্লানিতে জর্জরিত হয়েছেন উভয়েই। হেলেনের খৃষ্টপূর্ব পৃথিবী থেকে এ্যানার খৃষ্টীয় পৃথিবীর দূরত্ব অবশ্য অনেক। তবুও এ্যানাকে দেখি হেলেনের পৃথিবীতে বিচরণ করতে। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে এ্যানা খৃষ্টান ধর্মকে উপেক্ষা করে যেন হেলেনের খৃষ্ট পূর্ব পৃথিবীতেই ফিরে গেছেন।

হোমার প্রসঙ্গে টলস্টয়ের নাম এসে যায় আরো একটি কারণে। টলস্টয় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন হোমারের প্রশংসা করেছেন হোমারের মাত্রাজ্ঞান ও শৈল্পিক কাব্য সৃষ্টির। হোমারের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে টলস্টয় শেক্সপীয়রের সঙ্গেও তুলনা করেছেন তাঁকে। এ প্রসঙ্গে টলস্টয় শেক্সপীয়র সম্পর্কে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা যে কোন সংবেদনশীল পাঠককে আহত করবে। চরিত্রের প্রতি উদাসীনতা, নৈতিকজ্ঞানের অভাব এবং অতিরঞ্জন দোষ – শেক্সপীয়রের বিরুদ্ধে এগুলোই টলস্টয়ের বড় অভিযোগ।

হেলেন চরিত্রের সঙ্গে ব্রাইসিস চরিত্রের যথেষ্ট মিল রয়েছে ইলিয়াড-এ। হেলেনের মত তিনিও ছিলেন এক যুদ্ধের পুরস্কার। যুদ্ধবন্দী ব্রাইসিসকে সৈন্যগণ অর্পণ করেছিল এ্যাকিলিসের হাতে। এই অর্পণের মধ্যে নিহিত ছিল তাদের আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু রাজাধিরাজ ও সেনাধ্যক্ষ এ্যাগামেম্নন যখন তাঁকে দাবী করেন তখন তা এ্যাকিলিসের কাছে তাঁর সম্ভ্রমের ওপর প্রচণ্ড আঘাত বলেই মনে হয়। বীর শ্রেষ্ঠ এ্যাকিলিস সেনাধ্যক্ষের এই আচরণে ভীষণ অপমানিত বোধ করেন। আত্মসচেতন স্বার্থপর বীরের যে পৃথিবী হোমার ইলিয়াড-এ সৃষ্টি করছেন সেখানে সম্ভ্রমবোধ ও সুনামের স্থান সর্বোচ্চে।

তাই ব্রাইসিসের কারণে এ্যাকিলিস সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে কলহে লিপ্ত হন, এমনকি তাঁকে হত্যা করতেও উদ্যত হন। হেলেনের মতই এখানে ব্রাইসিস কলহের উপলক্ষ। আর এই বিবাদ পরবর্তী ঘটনাবলীকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। এমনকি ট্রোজান যুদ্ধ চলতে থাকে অধিক সময় ধরে। ট্রয়ে অবস্থান কালে হেক্টর যেমন হেলেনকে সমর্থন ও সাহায্য করেছেন সকল সময়ে, এ্যাকিলিসের তাঁবুতে অবস্থান কালে পেট্রক্লসও ব্রাইসিসকে অনুরূপভাবে সান্ত্বনা দিয়েছেন, তাঁকে করেছেন আশ্বস্ত কথা দিয়েছেন স্বদেশে ফিরে গেলে তিনি ব্রাইসিসকে এ্যাকিলিসের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করাবেন।

তাঁদের মধ্যে হেক্টর-হেলেনের মতই একটি স্নেহের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। তাই পেট্রক্লসের মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহের ওপর ব্রাইসিস বিলাপে ভেঙে পড়েন, যেমন বিলাপে ভেঙে পড়েছিলেন হেলেন হেক্টরের মরদেহের ওপর। হেক্টর-পত্নী এ্যান্ড্রোমাকি ইলিয়াড-এর অপর একটি উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র। কিন্তু এ্যান্ড্রোম্যাকি ও হেলেনের অবস্থান ভিন্ন দুই বৃত্তে। এ্যান্ড্রোম্যাকি যেখানে প্রতীক দাম্পত্য প্রেমের, হেলেন প্রতীক অবৈধ প্রেমের। তাঁরা নিজেরাও বোধ করি তাঁদের এই বৈসাদৃশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। আর তাই একই প্রাসাদে বাস করলেও সমগ্র ইলিয়াড-এ শুধুমাত্র একবারই তাঁরা মুখোমুখি হয়েছেন।

ঈনিড রচনায় ভার্জিল অনেক ক্ষেত্রেই হোমারকে অনুসরণ করেছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু ডিডোর সৌন্দর্য বর্ণনায় তিনি ছিলেন পুরোপুরি হোমারের প্রভাব মুক্ত। হেলেনের সৌন্দর্য বর্ণনায় হোমার যেখানে একেবারেই নির্লিপ্ত, ডিডোর বর্ণনায় ভার্জিল সেখানে অননুকরণীয় ভাবে জীবন্ত। প্রথম ‘পুস্তকেই ডিডোর রাজকীয় উপস্থিতি। এখানে ভার্জিল ডিডোকে তুলনা করেছেন দেবী ডায়নার সঙ্গে। ইউরেটাস নদীর তীরে অথবা সিনথাসের পাদদেশে শত শত পাহাড়ী দেবীর সাহচর্যে ডায়না যে ভাবে নর্তকীদের নৃত্য অনাবিল আনন্দে অবলোকন করতেন, সম্রাজ্ঞী ডিডোও তেমনি সহচরী সমভিব্যহারে আনন্দিত চিত্তে ভবিষ্যৎ-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বাসনা নিয়ে এগিয়ে এলেন।

আমাদের আরও প্রতিবেদন পড়ুন:

তবে ডিডোর উপস্থিতির পূর্বেই তাঁর উল্লেখ রয়েছে ঈনিড-এর শুরুতেই। দেবী ভেনাস পুত্র ঈনিয়াসকে বলেছেন ডিডোর দুর্ভাগ্যের কথা। দেবরাজ জুপিটার দ্রুত মার্কারীকে ডিডোর কাছে পাঠিয়েছেন কার্থেজে ঈনিয়াসকে সাদর আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। কারণ তাই ছিল নিয়তির বিধান। ডিডোর জীবনেও হেলেনের মত প্রেম এসেছে — এসেছে অশেষ দুর্ভোগ। প্রেমের এই ভয়াবহ পরিণতির চিত্র অঙ্কনে হোমার ও ভার্জিল উভয়েই সেই গ্রীক ধারণায় প্রভাবিত হয়েছিলেন যাতে বলা হয়েছে প্রেম ধ্বংসাত্মক। ইংরেজ কবি সুইনবার্নও গ্রীক রীতিতে তাঁর লেখা আটালান্টা ইন ক্যালিডন নাটকে মিলিয়েগারের সঙ্গে আটালান্টার প্রেমের পরিণতি দেখিয়েছেন। মিলিয়েগারের জীবননাশের মধ্য দিয়ে।

ডিডোর জীবনে প্রেম এসেছে দুইবার। প্রথমবার কুমারী জীবনে তিনি বিত্তবান সাইকেয়াসের প্রণয়াসক্ত হন। সে প্রণয় পর্যবসিত হয় পরিণয়ে। কিন্তু অচিরেই দুর্যোগ নেমে আসে ডিডোর জীবনে। ডিডোর ভ্রাতা পিগমিলিয়ন সম্পদের লোভে সাইকেয়াসকে হত্যা করেন, গোপন রাখেন তাঁর এই অপকর্ম। কিন্তু একদিন স্বপ্নে ডিডোর সামনে এসে দাঁড়ান সাইকেয়াসের অতৃপ্ত আত্মা। বর্ণনা করেন তাঁকে হত্যার করুণ কাহিনী, যেমনটি আমরা দেখি শেক্সপীয়রের হ্যামলেট নাটকে। তবে পার্থক্য এই যে, রাজা হ্যামলেট নিজ হত্যার প্রতিশোধ নিতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই পুত্র হ্যামলেটের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

তবে তা স্বপ্নে নয়, বাস্তবে। স্বপ্নে আত্মার আবির্ভাবের বর্ণনা আছে হোমারের ইলিয়াড-এ। নিহত বন্ধু পেট্রক্লস স্বপ্নে এ্যাকিলিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। মরদেহের অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আত্মা মৃতের জগতে (Hades) প্রবেশাধিকার পায় না; বরং ভোগ করে অশেষ যন্ত্রণা। এই গ্রীক বিশ্বাসের পটভূমিতে পেট্রক্লসের আত্মার স্বপ্নে আবির্ভাব। এ্যাকিলিসকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন অবিলম্বে অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। হেক্টরসহ অপর বারোজন সম্ভ্রান্ত ট্রোজানকে হত্যার পরই এ্যাকিলিস সে অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তাই ছিল এই বিলম্ব।

কিন্তু সাইকেয়াসের আত্মার উপস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। প্রতিশোধ গ্রহণের কথা সাইকেয়াস বলেননি, বলেননি অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্নের কথাও, বরং বলেছেন ডিডোকে দ্রুত অন্যত্র পালিয়ে যেতে। আর সে পলায়ন কার্যকর করার জন্য ডিডোকে সন্ধান দিয়েছেন ভূগর্ভস্থ গোপন এক সম্পদ ভাণ্ডারের। কাহিনীর প্রয়োজনেই ডিডোর এই পলায়নের আবশ্যকতা ছিল। কার্থেজে পালিয়ে যান ডিডো, সেখানে ঈনিয়াসের সান্নিধ্যে তাঁর জীবনে আসে দ্বিতীয় প্রেম। এই প্রেম স্বর্গীয় দেবতাদের আশীর্বাদপুষ্ট ও চক্রান্তের ফল হলেও ডিডো অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই প্রণয়ে লিপ্ত হন।

ভেনাসের নির্দেশে কিউপিড ডিডোর অন্তরে সর্বগ্রাসী বহ্নি জ্বালিয়ে দেন। কিন্তু তার আগেই ঈনিয়াসের প্রথম দর্শনেই তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন ডিডো। ভার্জিল সে দৃশ্যের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন ঈনিড-এ। ডায়নার মত সহচরী বেষ্টিত ডিডো যখন মন্দিরে প্রবেশ করেন, ঈনিয়াস তখন মন্দির গাত্রে খোদাই করা ট্রোজান যুদ্ধের ছবি দেখছিলেন গভীর মনোযোগে। সঙ্গে সহচর এ্যাকাসে। স্বর্গীয় কুয়াশার আচ্ছাদনে তাঁরা নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিলেন অপরের দৃষ্টি থেকে।

সহসা উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন ঈনিয়াস। সমুদ্রঝড়ে হারিয়ে যাওয়া তাঁর অনুচরবর্গ, যাদের তিনি মৃত বলেই এতদিন ভেবেছেন, তারা একে একে ডিডোর সামনে এসে দাঁড়ালো। তাদের দলনেতা হিসেবে উচ্চারণ করল ঈনিয়াসের নাম, ব্যক্ত করল নিজেদের পরিচয়, অব্যক্ত রইল না দুর্যোগময় সমুদ্র যাত্রার কাহিনীও। পরিশেষে প্রার্থনা করল কিছু সাহায্য সুবিধা। ডিডো সাগ্রহে শুনলেন তাদের কথা, মঞ্জুর করলেন তাদের প্রার্থনা।

ঈনিয়াস সম্পর্কে তাঁর উচ্ছ্বসিত উচ্চারণে ঈনিয়াস নিজেই মুগ্ধ হলেন। কুয়াশার আচ্ছাদন ছিন্ন করে তিনি আবির্ভূত হলেন সকলের সামনে। সহসা ঈনিয়াসের আবির্ভাবে ডিডো বিস্ময়াবিভূত হলেন। স্মরণে এল তাঁর নিজের দুর্ভাগ্যের কথা। একটা সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন ঈনিয়াসের সঙ্গে তাঁর নিজের। সাদর আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের সকলকে তাঁর গৃহে আতিথ্য গ্রহণের জন্য। ঈনিয়াসকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “আপনার মত আমাকেও নিয়তি পর্যুদস্ত করেছে। অনেক দুঃখ কষ্টের পর আমি এই দেশে এসে আশ্রয় পেয়েছি। দুর্ভাগ্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়, দুর্ভাগ্যের শিকার অপরকে হায্য করতে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে।”

ডিডো তাঁদের রাজ প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশে মেষ বলির ব্যবস্থা করা হল। আয়োজিত হ’ল প্ৰীতি ভোজ। ইতিমধ্যে ভেনাসের চক্রান্তে ডিডোর দুর্ভাগ্যের নীল নকশা প্রস্তুত হয়েছে। ঈনিয়াস পুত্র এ্যাসকানিয়াসের ছদ্মবেশে কিউপিড ডিডোর জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হলেন। ডিডোকে উপহার প্রদানের ছলে তাঁর হৃদয়ে জ্বালিয়ে দেন জীবন্ত প্রেমের আগুন। ডিডোর হৃদয়ে সুপ্ত সাইকেয়াসের সকল স্মৃতি হল অপসারিত।

ভোজ শেষে ডিডো ঈনিয়াসকে ক্রমাগত প্রশ্ন করলেন রাজা প্রায়াম ও হেক্টর সম্পর্কে। বাদ পড়ল না এ্যাকিলিস ও ডিওমিডিসের কথাও। সবশেষে ডিডো ঈনিয়াসকে অনুরোধ করলেন ট্রয় যুদ্ধের সকল ঘটনাসহ তাঁর দীর্ঘ সাত বছরের সমুদ্র যাত্রার কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করতে। ঈনিড-এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় ‘পুস্তকে’ ঈনিয়াস তা বর্ণনা করেছেন।

ঈনিড-এর চতুর্থ ‘পুস্তকে’র নামকরণ করা হয়েছে “ডিডোর ট্র্যাজেডী।” এটা ডিডোর দ্বিতীয় প্রেমের ট্র্যাজেডী। প্রণয়-কাতর ডিডোকে এখানে দেখি অশান্ত ও অস্থির চিত্তে। ভগ্নী এ্যানাকে তিনি খুলে বলছেন তাঁর মনের কথা। অকপটে স্বীকার করছেন যে সাইকেয়াসের মৃত্যুর পর পুনরায় বিবাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা না করলে ঈনিয়াসকে তিনি নির্দ্বিধায় পতিত্বে বরণ করতেন।

এতদিন তিনি ভেবেছিলেন সাইকেয়াসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের সকল অনুভূতিরও মৃত্যু ঘটেছে তাঁর জীবনে। কিন্তু এখনও তিনি আবার অনুভব করছেন প্রেমের দুর্বার আকর্ষণ। উভয় সঙ্কটে পড়েছেন ডিডো। প্রতিজ্ঞা রক্ষায় অপারগ, আবার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গে অনীহা — এই দুই অনুভব তাঁকে অনুক্ষণ জর্জরিত করেছে। এই দ্বন্দ্ব ডিডো চরিত্রকে অধিকতর মানবিক করে তুলেছে। সম্ভ্রম-চিন্তায় বিচলিত ডিডো অবশেষে কামনা করেছেন ধরা দ্বিধা হোক আর তিনি তার ক্রোড়ে বিলীন হয়ে যান অথবা দেবরাজ এক বজ্রাঘাতে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করুন।

আমাদের আরও প্রতিবেদন পড়ুন:

এ্যানা ডিডোকে উৎসাহিত করেছেন প্রেমে — যেমন হিপোলিটাসের সঙ্গে প্রেমে ফেইড্রাকে উৎসাহিত করেছিলেন তাঁর নার্স। উভয় রমণীই জানতেন তাদের এই প্রণয় অবৈধ। তবুও তাঁরা নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি প্রেমের সর্বনাশী বন্ধন থেকে। এখানেই তাঁদের জীবনের পরাজয়। এ্যানার উৎসাহ ও সমর্থনে ডিডো সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে ঈনিয়াসের প্রেমে আত্মনিয়োগ করলেন। প্রেমানলে দগ্ধীভূত ডিডোর বর্ণনা প্রসঙ্গে ভার্জিল যে উপমা ব্যবহার করেছেন তা জীবন্ত। ডিডোর অবস্থা হয়েছে সেই চঞ্চলা হরিণীর মত যে তার রক্ষীর অগোচরে কোন মেষ পালকের তীরে ভূলুণ্ঠিত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

অন্তরে দগ্ধীভূত হলেও উচ্চারণে তা প্রকাশ করতে পারছেন না ডিডো। দিবাবসানে তিনি আবার ভোজের আয়োজন করছেন, নিতান্ত অকারণেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন ট্রয় নগরীর কাহিনী শুনতে। ভোজ শেষে সকলের প্রস্থানের পর ডিডো জর্জরিত হন একাকিত্বের নৈঃশব্দ্যে। ঈনিয়াসের পরিত্যক্ত আসনে তিনি উপবেশন করেন কিছুটা মানসিক তৃপ্তি লাভের জন্য। ঈনিয়াস দৃষ্টির আড়াল হলেও ডিডোর মনে হয়, তিনি তাঁকে স্পষ্ট দেখছেন, শুনছেন তাঁর কথা।

পিতার সঙ্গে চেহারার সাদৃশ্যের কারণে তিনি এ্যাসকানিয়াসকে কাছে টেনে নেন গভীর স্নেহে। এমনিভাবেই দিন কাটে ডিডোর। রাজকার্যে আর মন নেই তাঁর। নগরীর নির্মাণাধীন স্তম্ভের কাজের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। সৈন্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণেও এসেছে শৈথিল্য। তাঁর এই কর্তব্যে অবহেলার কারণে ডিডো পাপ করলেন আর একটি।

স্বর্গীয় চক্রান্তে এবার ডিডোর প্রেম দৈহিক মিলনের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করল। একত্রে শিকারে গেলেন ঈনিয়াস ও ডিডো। স্বর্গীয় ইঙ্গিতে শুরু হল প্রবল ঝড় বৃষ্টি। অনুগামীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একই পর্বত গুহায় আশ্রয় নিলেন তাঁরা। পূর্ণতা পেল তাঁদের প্রেম, কিন্তু ভার্জিলের মন্তব্য: এ ভাবেই বপিত হল যন্ত্রণা ও মৃত্যুর বীজ, এর পর থেকে সম্ভ্রমের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ না করে ঈনিয়াসের সঙ্গে খোলাখুলি ভাবে প্রণয়ে লিপ্ত হন ডিডো।

বিবাহের ছদ্মাবরণে তাঁর পাপ ঢাকতে সচেষ্ট হন। এদিকে দেবরাজের নির্দেশে অবিলম্বে যাত্রার আয়োজন করলেন ঈনিয়াস। ডিডোর কাছে তা গোপন রইল না। ক্রোধান্বিত ডিডো ছুটে এলেন ঈনিয়াসের কাছে। সম্বোধন করলেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে। এই ‘পুস্তকে’ ডিডোর আচরণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিডো পুরোপুরিই আবেগ-তাড়িত। তাঁর প্রণয়ের নিরিখে তিনি সব কিছু প্রত্যক্ষ করেছেন।

জিজ্ঞাসা করেছেনঃ “বিশ্বাসঘাতক, তুমি কি সত্যিই ভেবেছিলে তোমার অপকর্মকে ঢেকে রেখে কিছু না বলেই আমার দেশ থেকে পালিয়ে যাবে? কিছুই তোমাকে আটকাতে পারলো না – আমাদের প্রেম – আমাদের এক সময়ের বাগদত্তা দুটি হাত অথবা নিষ্ঠুর মৃত্যু যা তোমার ডিডোর জন্য অপেক্ষা করছে? .. আমার কাছ থেকেই কি তুমি পালিয়ে যেতে চাও?” অশ্রুসিক্ত নয়নে ডিডো ঈনিয়াসকে অনুরোধ করেন তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে। একে একে ব্যক্ত করেন তাঁর দুর্ভাগ্যের কাহিনী। ঈনিয়াসকে ভালবেসে তিনি আজ সকলের ঘৃণার পাত্রী, সকলের শত্রু।

যে সম্ভ্রমের জন্য তিনি অমর হতে পারতেন তা তিনি বিসর্জন দিয়েছেন ঈনিয়াসের কারণে। প্রচণ্ড দুঃখ ও ক্ষোভে পতির বদলে অতিথি সম্বোধন করেছেন ঈনিয়াসকে। আবেগের আতিশয্যে ঈনিয়াসকে বলেছেন: “তুমি চলে যাবার আগে যদি তোমার এক পুত্রের মা হতে পারতাম – ছোট্ট এক ঈনিয়াস আমার সারা ঘরে খেলে বেড়াত তার সাথে তোমার চেহারার সাদৃশ্যের জন্যও হয়ত তোমাকে আমি ফিরে পেতাম আর তাহলে নিজেকে এতটা পরিত্যক্ত মনে হত না।”

প্রত্যুত্তরে ঈনিয়াস ডিডোকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন তাঁর নিজের অসহায়তা; অনুরোধ করেছেন পরিস্থিতি অনুধাবন করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন ডিডো। প্রচণ্ড ক্রোধে জ্বলন্ত চোখে আবার সম্বোধন করেছেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে, ব্যঙ্গ করেছেন তাঁর নিষ্ঠুরতার। অন্যত্র দেখি ডিডো নিজেকে প্রশ্ন করেছেনঃ “আমার কান্নায় সে কি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছে? ফিরে তাকিয়েছে একবারও? তার মন কি এতটুকুও গলেছে? অথবা প্রিয়তমার স্মরণে এক ফোঁটা অশ্রু বর্ষণ করেছে? … জাহাজ বিধ্বস্ত এক নিঃস্বকে আমি স্বাগত জানিয়েছিলাম, প্রাসাদে তাকে আশ্রয় দিয়েছিলাম নিতান্ত বোকার মতই।”

এই আত্মজিজ্ঞাসার পর সহসা প্রতিহিংসায় মেতে ওঠেন ডিডো। তিনি এখন ঈনিয়াসকে ঘৃণা করেন। ঈনিয়াসের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ তাঁর ঘৃণার চূড়ান্ত রূপ। লরেন্স তাঁর উপন্যাসে প্রেম ও ঘৃণার যে সহাবস্থান দেখিয়েছেন এ যেন অনেকটা তেমনই। “স্বর্গে যদি ন্যায় ও সত্য বলে কিছু থাকে তা হলে শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। তখন ডিডোর নাম বার বার উচ্চারণ করবে তুমি। তখন আমি তোমার কাছে থাকব — কুচকুচে কাল পীচের অগ্নিশিখা নিয়ে তোমার সামনে আবির্ভূত হব। আর যখন আমার জীবন প্রদীপ নিভে যাবে, তুমি যেখানেই যাওনা কেন, আমার প্রেতাত্মা সেখানে থাকবে।

শাস্তি তোমার হবেই, হে দূরাচার। মৃত্যুপুরীতে সে খবর আমার কাছে পৌঁছাবে।” আবেগের আতিশয্যে ডিডো তাঁর কথা শেষ করার আগেই অচৈতন্য হয়ে পড়লেন পরিচারিকাবৃন্দ তাঁকে নিয়ে গেলেন অন্দরে।

ডিডো চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক তাঁর অহঙ্কার। আবেগপ্রবণ ছিলেন তিনি, আরো ছিলেন অহঙ্কারী। এ অহঙ্কার সম্রাজ্ঞীর অহঙ্কার। কার্থেজ নগরীর সম্রাজ্ঞী যখন সামান্য এক ট্রোজানের দ্বারা পরিত্যক্ত, স্বভাবতই তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রচণ্ড। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সকল অহঙ্কার পরাভূত হয় আবেগের কাছে। নগরীর সুরক্ষিত দুর্গশীর্ষ থেকে ডিডো যখন ঈনিয়াসের যাত্রার আয়োজন দেখলেন, দুচোখ অশ্রুসিক্ত হল তাঁর। এ্যানার শরণাপন্ন হলেন তিনি।

অন্ততঃ অনুকূল বাতাসের অপেক্ষায় তাঁর যাত্রা কিছুটা বিলম্ব করতে পারেন ঈনিয়াস। এ্যানা ডিডোর অনুনয় বার্তা পৌঁছে দিলেন ঈনিয়াসকে। কিন্তু ঈনিয়াস তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। এখন মৃত্যুই ডিডোর একমাত্র কাম্য। মন্দিরের বেদীতে অর্ঘ্য নিবেদনের সময় ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য দেখলেন ডিডো। পবিত্র পানীয়ের রং সহসা পরিবর্তিত হল কাল রংয়ে। আর মাদক পানীয় রূপান্তরিত হল রক্তে। গভীর রাত্রিতে ডিডোর মনে হল তিনি যেন তাঁর নিহত স্বামীর ডাক শুনছেন।

নিঃসঙ্গ এক পেঁচা যেন তাঁরই মৃত্যুর করুণ আর্তনাদে বিলাপ করছে। দুঃস্বপ্ন দেখলেন, ক্ষিপ্ত ঈনিয়াস তাঁকে অনুসরণ করছেন। শঙ্কায় তিনি মৃতপ্রায়। মানসিক অপ্রকৃতস্থিতে ডিডো দেখলেন প্রতিহিংসার দেবী তাঁকে খুঁজে ফিরছেন। অস্থির চিত্তে তিনি একবার ট্রোজানদের কাছে আত্মসমর্পণের কথা ভাবলেন। হাজার প্রশ্নের মিছিল এখন ডিডোর চৈতন্যে। ওদের কাছে ফিরে গেলে ট্রোজানরা কি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করবে? মানসিক যন্ত্রণার এক পর্যায়ে সহসা ডিডো উপলব্ধি করেন তাঁর অপ্রকৃতস্থতা। সজোরে আর্তনাদ করে ওঠেনঃ “এ্যানা, আমি পাগল হয়ে গেছি।”

পরদিন প্রত্যূষে ডিডো দেখলেন, পোতাশ্রয় শূন্য। ক্রোধ ও প্রতিহিংসায় গর্জে উঠলেন তিনি। কার্থেজবাসীকে আদেশ করলেন ঈনিয়াসের পশ্চাৎধাবন করতে। ডিডোর প্রতিহিংসাপরায়ণতা চরমে পৌঁছে যখন তিনি ঈনিয়াসকে তাঁর সকল সঙ্গীসহ নির্মমভাবে হত্যা করতে চান। এ্যাসকানিয়াসকে হত্যা করে পরিবেশন করতে চান ঈনিয়াসের খাবার হিসেবে। ডিডোর শেষ অভিশাপ ছিল অনেকটা দৈববাণীর মত। ডিডোর অভিশাপ ছিল ঈনিয়াস তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে শক্তিশালী এক শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন। পরবর্তীকালে ল্যাটিনাসে পৌঁছে শক্তিধর টারনাসের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল ঈনিয়াসের।

ডিডোর আত্মহত্যার যে বর্ণনা দিয়েছেন ভার্জিল তা যুগপৎভাবে ভীতি ও করুণার সঞ্চার করে। ডিডোর দু’চোখ রক্তিম ও ঘূর্ণায়মান। ঈনিয়াসের দেয়া খঞ্জর উন্মুক্ত করলেন তিনি। ট্রোজানদের উপহার দেয়া পোশাক পরিচ্ছদের দিকে তাকালেন কিছুক্ষণ। অতঃপর দৃষ্টি ফেরালেন বহু স্মৃতি-বিজড়িত শয্যার দিকে। আছড়ে পড়লেন শয্যার ওপর। উচ্চারণ করলেন তাঁর মৃত্যু কামনা। স্মরণে এল তাঁর জীবনের কীর্তিমালা। দেয়াল ঘেরা এক নগরী প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।

স্বামীকে হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছেন, শাস্তি দিয়েছেন শত্রুভাবাপন্ন ভাইকে, শুধুমাত্র ট্রোজানদের উপস্থিতি না ঘটলেই মহাসুখী হতেন তিনি। মৃত্যুর জন্য কোন দুঃখ নেই তাঁর। দুঃখ শুধু এ জন্য যে, মৃত্যুর কোন প্রতিশোধ নেয়া হবে না। তবে যেন কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজেছেন ঈনিয়াসকে এই অভিশাপ দিয়ে যে, তাঁর মৃত্যু হৃদয়হীন সেই ট্রোজানের কাছে অশুভের বার্তা বয়ে নিয়ে যাবে। এর পরই তিনি তীক্ষ্ণ খঞ্জরের ওপর পতিত হলেন। সহচরীরা তাঁকে এসে দেখলেন রক্তাপুত, ছুটে এলেন এ্যানা। গভীর ক্রন্দনে জড়িয়ে ধরলেন ডিডোকে।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ক্লাসিকাল মহাকাব্যে নারীর চিত্রায়ণ

ডিডো তাঁর চোখ খুলতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রতিবারই তিনি বিছানায় পড়ে গেলেন। অতঃপর এক ঝলক সূর্যের আলোর প্রত্যাশায় ঘূর্ণায়মান চোখ ফেরালেন সুদূর আকাশের দিকে। ডিডোর বুক চিরে বেরিয়ে এল গভীর দীর্ঘশ্বাস। এই ‘পুস্তকে’র শেষাংশে মন্তব্য রয়েছেঃ ডিডোর জীবনে এই বিপর্যয় এসেছে আকস্মিক আবেগের কারণে। এতে নিয়তির কোন হাত ছিল না। ডিডোর এই অবদমিত আবেগ স্বভাবতঃই শেকস্পীয়রের ক্লিওপেট্রা চরিত্রকে স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রথম প্রেমিক জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর ডিডোর মতই ক্লিওপেট্রা দ্বিতীয় বার প্রণয়ে লিপ্ত হন মার্ক এ্যান্টনীর সঙ্গে।

উভয় রমণী যতটা পরিচালিত হয়েছেন আবেগ দ্বারা, বুদ্ধি-বিবেক দ্বারা আদৌ ততটা নয়। আর ডিডোর মতই ক্লিওপেট্রাও সম্রাজ্ঞী অপেক্ষা প্রেমিকা রূপেই অধিক প্রাণবন্ত। উভয় রমণীই পরিশেষে আত্মহত্যা করেন। তবে পার্থক্য এই, ডিডো যেখানে ঈনিয়াসের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণে আত্মহত্যা করেন, ক্লিওপেট্রা সেখানে আত্মহত্যা করেন এ্যান্টনীর প্রেমে।

ডিডোর এই আবেগজনিত দুর্ভাগ্য ফেইড্রার সঙ্গেও তুলনীয়। হিপোলিটাস কর্তৃক পরিত্যক্ত ফেইড্রাও ডিডোর মত নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর সম্ভ্রম বিনষ্ট হয়েছে। তিনি বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। ফেইড্রার মধ্যেও কিছুটা প্রতিহিংসাপরায়ণতা লক্ষণীয়। মৃত্যুর পূর্বে এই মর্মে তিনি এক পত্র লিখে যান যে, হিপোলিটাস তাঁর সম্ভ্রম বিনষ্ট করেছেন। তবে নিজেই তাঁকে শাস্তি দিতে উদ্যত হননি যেমনটি হয়েছেন ডিডো।

শেকস্পীয়রের ক্লিওপেট্রাও স্তম্ভিত ও শিহরিত হন, যখন সিজারের প্রস্তাব আসে মার্ক এ্যান্টনীকে হত্যা করার। তাঁদের প্রণয়েও অভিমান ছিল, ছিল ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ। কিন্তু দুর্নিবার ক্রোধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতায় ডিডো সকলকে ছাড়িয়ে গেছেন। লাতিন সাহিত্যে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী নারী চরিত্র। আর এই চরিত্রের স্রষ্টা ছিলেন অতি বড় এক শিল্পী। নারী-হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে তিনি যে ভাবে ডিডো চরিত্রে উপস্থাপিত করেছেন তা আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকের কৌতূহলেরই বিষয়।

হোমারের অপর মহাকাব্য অডিসি ও প্রাচ্যের বাল্মীকির রামায়ণ-এ উপস্থাপিত হয়েছে পেনেলোপি ও সীতা নামের সতী ও পতিভক্ত দুই রমণী। ভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই দুই নারী স্বামীর কারণে যন্ত্রণাদায়ক ভাগ্য পরীক্ষার সংগ্রামে একাত্ম হয়ে যান। অডিসি-তে অডিসিউসের স্ত্রী পেনেলোপি তাঁর প্রিয়তম স্বামীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বীরোচিত সংগ্রাম করেছেন। রামায়ণেও রামের স্ত্রী। সীতা প্রিয়তম স্বামী রামের সঙ্গে মিলিত হবার আকাঙ্ক্ষায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হন। হেলেনের মত সৌন্দর্য ও দুর্ভাগ্য পেনেলোপি ও সীতার জীবনে দুর্যোগ বয়ে আনে।

হোমার হেলেনের মত পেনেলোপিরও সরাসরি কোন সৌন্দর্য বর্ণনা করেননি, তবে অডিসি-র দ্বিতীয় ‘পুস্তকে’ বলা হয়েছে, অতীত কালের সকল গ্রীক সুন্দরীদের মধ্যে এমন একজনও নেই, এমনকি টাইরো বা আল্‌ল্কমেনিও না, যাদের পেনেলোপির মত বুদ্ধিদীপ্ততা ও হাস্যরত রয়েছে। দেবী আফ্রোদিতি যেমন হেলেনের শুভার্থী, একইভাবে দেবী এ্যাথিনী পেনেলোপির শুভার্থী।

অডিসি-র অষ্টাদশ ‘পুস্তকে’ দেখি, স্বামীর যুদ্ধযাত্রার কারণে অসংখ্য পাণিপ্রার্থীর উপস্থিতিতে পেনেলোপি যখন বিচলিত ও উদ্বিগ্ন, দেবী এ্যাথিনী তাঁকে উৎসাহিত করছেন পাণিপ্রার্থীদের মুখোমুখী হতে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাদের কাবু করে স্বামী ও পুত্রের কাছে নিজেকে মহিমান্বিত করতে। পেনেলোপির অশ্রুসিক্ত বিবর্ণ চেহারা পরিবর্তনের জন্য যখন তাঁকে কিছু প্রসাধন ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হল, তিনি গভীর দুঃখের সঙ্গে বলেন, স্বামীর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সৌন্দর্যও হারিয়ে গেছে। দেবী এ্যাথিনী তখন তাঁকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দেন পেনেলোপির ভুবন মোহিনী রূপ ফিরে আসে তাঁর অবয়বে।

সৌন্দর্যের প্রতি হোমারের নেতিবাচক মনোভাবের বিপরীতে বাল্মীকির মনোভাব একান্তই ইতিবাচক ও রোমান্টিক। লাতিন মহাকাব্য ঈনিড-এ ভার্জিল যেমন ডিডোর সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন অলঙ্কারিক ভাষায়, একইভাবে বাল্মীকিও সীতার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন গভীর আবেগে ও প্রশংসায়। রাম সীতাকে ব্যালকনিতে দেখেন সখিদের সঙ্গে খেলতে। বিমুগ্ধ চোখে সীতাকে দেখেন রাম, অলঙ্কার ও ফুলে শোভিত সীতাকে রামের কাছে মনে হয় যেন বিদ্যুতের এক চমক।

সীতার অশ্রু সজল নয়ন বিচলিত করে তাঁর সখিদের। সীতা অকপটে বলেনঃ “সে আমার হৃদয় জয় করেছে আর আমার সব লজ্জা হারিয়ে গেছে। আমার হৃদয় ফাঁদে ফেলে সব স্বস্তি নিয়ে গেছে। সে কেন আর এক মুহূর্ত বেশী অপেক্ষা করল না, যাতে তাকে আর এক পলক বেশী দেখে আমার বিক্ষুব্ধ মন শান্ত হত।” প্রথম দর্শনেই সীতা রামের প্রেমে পড়েন ও আবেগ তাড়িত হয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবেন। সীতার এই আচরণ রামায়ণ মহাকাব্যে একটি রোমান্টিক সুর যোগ করেছে।

রামায়ণ-এ সীতার বিবাহ-পূর্ব ও বিবাহ-উত্তর উভয় সমস্যা উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু অডিসি-তে পেনেলোপির বিবাহ-উত্তর সমস্যাই শুধু উপস্থাপিত হয়েছে। উভয় রমণীর ক্ষেত্রে তাদের বিবাহ-উত্তর বিপর্যয় পরস্পরকে একই সমান্তরালে নিয়ে গেছে। দু’জনেই বিচ্ছিন্ন তাঁদের প্রিয়তম স্বামীর সান্নিধ্য থেকে। অডিসিউস ট্রয়ের যুদ্ধে যোগ দিতে প্রবাস গেছেন। ঘরে রেখে গেছেন তাঁর স্ত্রী ও নবজাত পুত্রকে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে উৎসাহী পাণি প্রার্থীদের সামাল দিতে সমস্যায় পড়েছেন পেনেলোপি।

এটা তাঁর নিজের সৃষ্ট কোন সমস্যা নয়, কিন্তু সীতার সমস্যার জন্য দায়ী তিনি নিজেই। লঙ্কার রাজা রাবণ সীতার সৌদর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে হরণ করতে এক দৈত্যকে হরিণীর রূপে পাঠিয়েছেন। মনোমুগ্ধকর হরিণী দেখে সীতার মধ্যে ঈভ-সুলভ কৌতূহল জেগে ওঠে এবং ঐ হরিণ ধরার জন্য তিনি রামকে প্ররোচিত করেন। হরিণীর পিছু নিয়ে রাম এক ভিন দেশে চলে যান এবং হরিণীরূপী দানবকে আক্রমণ করেন। এদিকে রামের কণ্ঠস্বরের অনুকরণে দানব সাহায্যের আবেদন জানায়।

বিচলিত সীতা রামের সাহায্যের জন্য তাঁর নিরাপত্তায় নিয়োজিত লক্ষ্মণকে পাঠিয়ে দেন। অরক্ষিত সীতার সামনে এক সাধুর বেশে উপস্থিত হয় প্রতারক রাবণ এবং সুকৌশলে সীতাকে অপহরণ করে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সীতা সাহায্যের জন্য বৃথা চিৎকার করেন। দানবদের প্রহরায় সীতাকে বন্দী করে রাখা হয়। পেনেলোপির তুলনায় সীতার পরিস্থিতি অনেক বেশী ভয়ঙ্কর, কারণ শত্রুদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল তাঁর জীবন।

কিন্তু পেনেলোপির অবস্থান ছিল তাঁর স্বামীগৃহে, বিশ্বস্ত প্রহরায়। যদিও সীতার প্রতিপক্ষ শুধু একজন রাবণ, কিন্তু সে পেনেলোপির পাণি-প্রার্থীদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী ও ভয়ঙ্কর। গ্রীক সংস্কৃতি ও শিক্ষায় আলোকিত পেনেলোপির প্রতিপক্ষরা আচরণে ছিল অনেক সংযত ও মার্জিত। সহজেই পেনেলোপি তাদের প্রতারিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ল্যারটেসের জন্য সোয়েটার বোনা শেষ হলেই তিনি তাঁর পাণি-প্রার্থীদের মধ্য থেকে স্বামী বেছে নেবেন। কিন্তু দিনের বেলায় তিনি যেটুকু বুনতেন, রাতের আঁধারে তা খুলে ফেলতেন, যাতে তাঁর বোনা কাজ কখনও শেষ না হয়।

সীতার ঘটনায় প্রতিংিসার ব্যাপারটি প্রধান হয়ে ধরা পড়ে। কিন্তু পেনেলোপির ঘটনায় রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাই প্রধান। তবে মহাকাব্যের শেষ ভাগে পেনেলোপি ও সীতার অবস্থান বিপরীত মেরুতে। রাবণের ধ্বংসের পর প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে মহামিলনের স্বপ্নে বিভোর সীতা, কিন্তু পেনেলোপি পাণি প্রার্থীদের পরাজিত করার পর প্রিয়তম স্বামীর সত্যিকার পরিচয় নিয়ে সন্দিহান। পুত্র টেলেমেকাস অডিসিউসের পক্ষে মত দিলেও সতী পেনেলোপি স্বামীর স্বপক্ষে আরো প্রমাণের অপেক্ষায় থাকেন।

অবশেষে অডিসিউস বিছানা সংক্রান্ত গোপন তথ্য দানের পরই পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে পেনেলোপি অডিসিউসকে আলিঙ্গন করেন। সীতার পক্ষে স্বামীর সান্নিধ্য লাভ অতটা সহজ ছিল না। হিন্দু ধর্ম মতে সতীত্ব প্রমাণের জন্য সীতাকে অগ্নিগোলক অতিক্রম করতে হয় এবং জ্বলন্ত অগ্নিগোলক নিরাপদে অতিক্রম করে সীতা প্রিয়তম স্বামীর সান্নিধ্য লাভ করেন। প্রাচ্যের এই রমণীর সাহস ও ত্যাগ পাশ্চাত্যের পেনেলোপির তুলনায় অনেক বেশী হৃদয়গ্রাহী ও প্রশংসনীয়।

আরও পড়ুন:

সহায়ক-গ্রন্থ:

হেলেন পি. ফলি : “Reverse Similies and Sex Roles in the Odyssey. M Harold Bloom সম্পাদিত The Odyssey গ্রন্থে পুনর্মুদ্রিত, নিউ ইয়র্ক : Chelsea, ১৯৮৮।

হোমার: The Iliad, লন্ডন Penguin, ১৯৮৮।

——: The Odyssey, লন্ডন: Penguin, ১৯৮৮। আর. কে. নারায়ণ: Ramayana, নিউ ইয়র্ক : Viking, Penguin, ১৯৭২। এলেন এম. স্নগ্রাস: Greek Classics, নতুন দিল্লী : Kalyani, ১৯৮২।

ভার্জিল: The Aeneid, লন্ডন: Penguin, ১৯৮৫।

Leave a Comment