Site icon Bangla Gurukul [ বাংলা গুরুকুল ] GOLN

উৎপত্তিস্থলের বিবেচনায় পৃথিবীতে জীবিত ভাষাগুলোর বিস্তার | ভাষাকোষ | শানজিদ অর্ণব

উৎপত্তিস্থলের বিবেচনায় পৃথিবীতে জীবিত ভাষাগুলোর বিস্তার – গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের মধ্যভাগে মিশর সফরে যান। মেফিসের মন্দিরে হেরোডোটাসকে একটি কাহিনী শুনিয়েছিলেন পুরোহিতরা। কাহিনীটি ছিল মিশরের একজন ফারাও সামেটিকাসকে নিয়ে। সামেটিকাসের শাসনের আগে মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন যে, তারাই দুনিয়ার প্রাচীনতম জাতি। কিন্তু সামেটিকাস নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন এ বিষয়ে। তাই তিনি মানুষের প্রথম ভাষা কোনটি, সেটা নির্ণয় করার পদক্ষেপ নেন।

তিনি একই ধরনের দুটি শিশুকে তুলে দেন এক মেষপালকের হাতে। মেষপালকের ওপর কঠোর নির্দেশ ছিল সে যেন শিশু দুটির সামনে কোন শব্দ উচ্চারণ না করে। মেষপালক শুধু নির্জন স্থানে শিশুদুটিকে রেখে এসে নিয়মিতভাবে তাদের খাবার ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌছে দিত। ফারাও এর ধারণা ছিল, শিশু দুটি প্রথম যে ভাষার শব্দ উচ্চারণ করবে সেটি হবে পৃথিবীর প্রথম ভাষা। আর সে ভাষার জাতি হবে পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি।

মেষপালক একদিন শুনলেন একটি শিশু ‘Bekos’ বলে চিৎকার করছে। ফ্রাইজিয়ান ভাষায় রুটিকে বলা হয় ‘Bekos’। খবরটি দ্রুত পৌছায় ফারাও এর কানে। এ থেকে তিনি উপসংহার টানেন ফ্রাইজিয়ান মানব জাতির প্রথম ভাষা। অবশ্য হেরোডোটাসের অর্ধ শতাব্দী আগে মাইলেটাসের হেকাটিয়াসও মিশরে গিয়ে এ কাহিনী শুনেছিলেন।

প্রথম ভাষা যেটাই হোক না কেন পৃথিবীর সবথেকে বড় ভাষা সমীক্ষক এথনোলগের তথ্যমতে, পৃথিবীতে এখন জীবিত ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯টি। ইস্টার্ন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর ল্যাংগুয়েজ ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি’ এর গবেষণায় এ পর্যন্ত সনাক্ত করা গেছে ৫৭৩টি বিলুপ্ত ভাষা।

 

 

যদিও এসব তথ্য নিয়ে কেউই পূর্ণতা দাবি করেন না কারণ ভাষার অতল মহাসাগরের তল এখনও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। হয়তো সম্ভব হবেও না কারণ ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছে অনেক নিদর্শন। নতুন খোঁজ পাওয়া একটি ভাষার শেষ জীবিত মানুষটির কাছ থেকে সে ভাষা সম্পর্কে জানার আগেই মারা গেছেন তিনি, এমন ঘটনাও ঘটেছে।

গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায়, আগামী একশ বছরে প্রায় ৩ হাজার ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সামার ইনস্টিটিউট অব লিংগুয়িসটিকস’ এর সমীক্ষা থেকে জানা যায়, দুনিয়ায় এখন ৫১টি ভাষা আছে যার সর্বশেষ মাত্র একজন ব্যক্তি জীবিত আছেন। একশ জনের কম জানেন এমন ভাষা আছে প্রায় ৫০০। এক হাজার জন বলতে পারেন এমন ভাষার সংখ্যা ১৫০০।

ভিন্ন একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর ৫টি অঞ্চল থেকে ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে। অঞ্চলগুলো হলো: সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চল, অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাংশ, দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যাঞ্চল, ওকলাহোমা এবং দ্য ইউ.এস. প্যাসিফিক নর্থ ইস্ট। গত ৫০০ বছরে হারিয়ে গেছে পৃথিবীর অর্ধেক ভাষা। তবে যে কোন সময়ের তুলনায় ভাষা বিলুপ্তির হার এখন দ্রুত।

পেনসিলভানিয়া সোয়ার্থমোর কলেজের ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক অধ্যাপক ডেভিড হ্যারিসন এর মতে, “যখন একটি ভাষা হারিয়ে যায় তখন বহু শতাব্দী জুড়ে প্রাণী, বৃক্ষ, গণিত এবং সময় নিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের জ্ঞান, চিন্তা হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।” হ্যারিসনের মতে, দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক অজানা তথ্য, আবিষ্কার লুকিয়ে আছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলোর মধ্যে।

তাই তিনি মনে করেন, ভাষাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে আমরা বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা জ্ঞান আর আবিষ্কারকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি। হ্যারিসন লাতিন আমেরিকার আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে সরেজমিন গবেষণায় দেখেছেন, সেখানকার অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী ঔষধি গাছ এবং প্রাণী সম্পর্কে তাদের জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে রেখেছে গোপন ভাষায়। এ গোপন ভাষায় তারা বাইরের মানুষের সাথে কথা বলেনা।

লিভিং টাংস ইনস্টিটিউট ফর এনডেনজারড ল্যাংগুয়েজ এর গবেষক গ্রেগরি অ্যান্ডারসন বলেন, “ভাষা তখনই বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে যখন একটি গোষ্ঠী বা জাতি সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের নিজস্ব ভাষা তাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে”। মেক্সিকোর ইতিহাসবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং আজটেক ভাষা-সংস্কৃতির গবেষক মিগুয়েল লিয়ন-পোরটিল্লা তার ‘হোয়েন আ ল্যাংগুয়েজ ডাইজ’ বা ‘যখন ভাষার মৃত্যু হয়’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন-

“…যখন ভাষার মৃত্যু হয়,

স্বর্গীয় যা কিছু-

সূর্য, চাঁদ, তারা

মানুষের যা কিছু

চিন্তা, অনুভব, ভাবনারা

সব হারিয়ে যায়

আর প্রতিফলিত হয় না ভাষার আয়নায়…”

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বর্তমান পৃথিবীতে জীবিত ভাষাগুলোর ৬ শতাংশ ভাষায় কথা বলেন বিশ্বের ৯৪ শতাংশ মানুষ তার বাকি ৯৪ শতাংশ ভাষায় কথা বলেন মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ। মানুষের এই অমূল্য সম্পদকে নিয়ে তাই বাড়ছে উদ্বেগ। উদ্বেগ বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে ভাষা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা। হিব্রু ও আইনুসহ কয়েকটি ভাষার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। ভাষাকোষ বইটিতে A থেকে Z বর্ণানুক্রমে পৃথিবীর অনেকগুলো ভাষার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে, জীবিত ভাষাগুলোর ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

একইসাথে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিলুপ্ত ভাষার বর্ণনাও আছে। মূল এই বর্ণনামূলক অংশটি ছাড়াও বিলুপ্ত ভাষা, ভাষা পরিবার, এখনও অর্থ উদ্ধার করা যায়নি এমন ভাষা, বিখ্যাত কিছু ভাষা/লিপির অর্থ-উদ্ধারের কাহিনী, বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা প্রভৃতি সম্পর্কে বর্ণনা ও তথ্য রয়েছে বইটিতে।

ভাষাগুলোর বর্ণনায় তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে প্রধানত এথনোলগ এবং ওমনিগ্লট নামক দু’টি ভাষা বিষয়ক এনসাইক্লোপিডিয়াকে। এছাড়া অন্য অংশগুলো লিখতে বিশিষ্ট ভাষাবিদ এবং গবেষকদের বইয়ের সহায়তা নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অংশগুলোর শেষে তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। আমার সব কাজেই অসীম ধৈর্য্য নিয়ে যে মানুষটি সবসময় পাশে থাকেন তিনি অনন্যা মেহেরীন। তাকে ছাড়া এ বইয়ের কাজ শেষ করা হয়তো সম্ভব হতো না।

উৎপত্তিস্থলের বিবেচনায় পৃথিবীতে জীবিত ভাষাগুলোর বিস্তার

 

 

পৃথিবীকে পাঁচটি ভৌগোলিক অঞ্চল ধরে এ বিন্যাস নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু জীবিত অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট ভাষার ন্যূনতম একজন বক্তা আছেন এমন ভাষাগুলোকেই এখানে স্থান দেয়া হয়েছে। যেসব ভাষা একাধিক দেশ বা অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় তাদের মধ্যে প্রধান দেশটির অবস্থানকে বিবেচনা করা হয়েছে। শতাংশ বলতে পৃথিবীর মোট জীবিত ভাষার কত শতাংশ তা বোঝানো হয়েছে।

অঞ্চল ভাষার সংখ্যা (জীবিত) শতাংশ
আফ্রিকা ২১১০ ৩০.৫
আমেরিকা ৯৯৩ ১৪.৪
এশিয়া ২৩২২ ৩৩.৬
ইউরোপ ২৩৪ ৩.৪
প্যাসিফিক (প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল)
১২৫০ ১৮.১
মোট ৬৯০৯ ১০০

আরও পড়ুনঃ

Exit mobile version